somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প: শুভ জন্মদিন (প্রথম অংশ)

১৩ ই মে, ২০০৮ রাত ১১:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বিকালের দুই লিটার লালচে আলো দুটি বোতলে ভরা, সেখান থেকে একটু একটু নিয়ে গ্লাসে ঢালি, পান করি আর একটু একটু করে সন্ধ্যা হতে থাকে। আমাদের শিরার ভেতর লালচে হলুদ আলো ছড়িয়ে পড়ে... মস্তিষ্কে আটকে যায় আনেকখানি আভা.. আমরা ঘুমের ভেতর ক্রমশ: জেগে উঠতে থাকি। গ্লাসগুলো কেবল শূণ্য হতে জানে। শূণ্য শূণ্য শূণ্য- যে অনুভুতিটার নাম আর দিতে পারি নাই তার মতো। বারবার গ্লাসগুলোর শূণ্যতা ভরে দেবার ব্যর্থ চেষ্টায় আলো ঢালি আর বিকাল ক্রমশঃ সন্ধ্যার দিকে ঝুঁকে পড়ে। আলো শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমরা ছাদেই বসে থাকি। শেষ হয়ে গেলে নেমে আসি শহরের সংকীর্ণ আর পুরানো রাস্তাগুলোতে। সোডিয়াম-এর ইলু্শন ঢেকে রেখেছে অনেকটা শহর, এ আলোর জাদুকরী ক্ষমতার সাথে আমরা পরিচিত, লাল গোলাপকে কালো বানিয়ে দিতে পারে সে! আরো এক নিপুণ জাদুকর যেনো ভর করেছে শহরের ওপর, অপরিচিত। রাস্তাগুলো যেনো নদীর মতো তরল, তবু দাঁড়িযে থাকা যায়; রাস্তার পাশে কাকের চোখ খুলে পড়ে আছে নাকি মার্বেল?

টিটি কলেজের বিশাল বটগাছর দু’পাশে পরাজয়ের বেদনা নিয়ে নতজানু দেয়াল। তার সামনে গভীর গভীর ড্রেন.. ছোট বেলায় দেখেছি ঘোঁত ঘোঁত করে সুইপার কলোনির শুয়োরগুলো ছুটছে। ড্রেনের পাশে আমরা তিনজন একসাথে চেইন খুলি.. অনেকটা আলো জল হয়ে গেছে.. অন্ধকারে মিশিয়ে দেই। আবার হাঁটি আমরা, শহরের শতাব্দীপ্রাচীন আত্মা ছায়ার ছদ্মবেশ নিয়ে আমাদের সাথে সাথে হাঁটে, ফিসফিস করে।
এই যে দেখছো রাস্তার পাশের প্রাচীন বাড়ি- লোহার কুঠি, এর একচিলতে অন্ধকারের বাতাস জানে তোমার প্রখম চুম্বনের শব্দ, দ্বিধান্বিত কিশোর হাতের কাঁপন আর লালাসিক্ত স্বাদ। আর কান পাতো কান পাতো.. শুনতে পাও নদীর নি:শ্বাস? আর একটু এগোলেই ব্রক্ষ্মপুত্র পূণ্যজল আর তার পার ধরে পার্ক। মান্দার গাছটির কথা মনে পড়ে যার ছায়ায় আড়ালে লুকানো তোমার কৈশোরের অসংখ্য দিনলিপির পাতা? ... ... ...
আমি জানি এই কণ্ঠস্বর আর থামবে না। আরো তীব্র আরো বাচাল হয়ে উঠবে কেবল। আমি আর এগুবো না। আমি এগুতে পারবো না। কেননা সামনে গেলেই মান্দার গাছটির ছায়া আমাকে ডাকবে, জড়িয়ে ধরতে চাইবে উষ্ণ মমতায়। নদীর নি:শ্বাস বয়ে আনবে সেই অতি পরিচিত ঘ্রাণ। প্রতি পদক্ষেপে আমার মুখোমুখি হতে হবে স্মৃতির, যার একাধিক মুখমন্ডল আর সব মুখই আমার চেনা।

আমি আর এগুবো না। আমরা ঘুরে যাই। রিকশা ডাকি। শহরের আত্মা মৃদু হেসে নিশ্চুপ হয়ে যায়। সাইফ ...সাইফ... রিকশা থামা... আমার বমি আসছে। রাস্তায় ঢেউ, গাছের গায়ে ঢেউ, পুরোন দালানকোঠাজুড়ে ঢেউ। সমস্ত শহর কেঁপে কেঁপে ওঠে। সময় দুমড়ে মুচড়ে যায়। আমার শরীর, তার ভেতরের শরীর থেকে স্রোত ছুটে আসে। গাঙিনারপার মোড়ের কোলাহল আমার মাথার ভেতর সুই হয়ে বিঁধে যেতে থাকে। আমি এই যন্ত্রণা আর হাল্কা হতে পারার স্বস্তি নিয়ে পানি দিয়ে মুখ ধুই। দোকানের লোক পানি ঢালতে ঢালতে বলে, ভালো আছেন ভাই? বহুৎ দিন পর দ্যাখলাম আপনারে। তার দিকে তাকিয়ে আমি হাসি। আমি বুঝতে পারি আমি তাকে চিনি। আর কিছু আমার মনে পড়ে না।

আমরা তিনজোড়া এলোমেলো পদক্ষেপবাহী জুতা এক হোটেলের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠি। নয়ন কাকে যেন খুঁজতে থাকে, পেয়েও যায়। দুই ঘন্টার জন্য লাগবে, কত টাকা? খুঁজে বের করা লোকটি জানায় আজ রাতে কিছুতেই সম্ভব না। টাকা কোন বিষয় না। নয়ন আরো কিছুক্ষণ চেষ্টা করে। তারপর আসলেই সম্ভব না বুঝতে পেরে হাল ছেড়ে দেয়। আমরা নেমে আসি। শহরের ভদ্র জনগোষ্ঠী সাধারণত: যে গলিটি সযত্নে এড়িয়ে চলে তাতে নিঃসঙ্কোচে ঢুকে পড়ি। কেমন একটা চাপা কিন্তু ঝাঁঝালো গন্ধ টের পাই। পুরুষ আর নারীকণ্ঠের নানা মাত্রার স্বর- গুঞ্জন থেকে শুরু করে চিৎকার পর্যন্ত। কিছু শিশুর চিৎকার শোনা যায়। সরু গলির দুইপাশে একতলা দোতলা বাড়ি... নোনা ধরা দেয়াল.. মানুষ ঢুকছে আর বের হচ্ছে। আমরা এক বাসায় ঢুকি। মেয়েটার মাথায় ঘোমটা। আমাদের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর মৃদুস্বরে বলে, অ্যাডিক্ট পোলাপান লই না। যাইন গা। আমরা নিঃশব্দে বের হয়ে আসি। সাইফ শুধু একবার বলে, মালডা ভাল আসিল। একটা দোতালায় উঠি। বারান্দায় তিনটা মেয়ে আর একজন মহিলা দাঁড়ানো। মহিলা আমাদের বলে, দ্যাখেন কারে পসন্দ হয়? আমি শ্যামলা ক্ষীণ মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করি- নাম কি তোমার? মাথা নাড়তে নাড়তে সে বলে, মৌ। আমি জানি মৌ তার নাম না। কি আসে যায়, কি আসে যায় তাতে- শুধুই তো একটি নাম।

সাইফ আর নয়ন বুঝতে পারে। তারা মহিলার সাথে রফা করে। তারপর 'শুধুই-একটি-নাম-মৌ' একটা ঘরের দরজা খুলে ডাকে, আসেন। কথা বলার সময় তার নাকের দু’পাশ সামান্য কুঁচকে যায় খেয়াল করি। সাইফ আর নয়ন বলে, যা আমরা বাইরে আছি। সমস্যা নাই। আমি ঘরে ঢুকি। মৌ দরজা লাগিয়ে দেয়। দুপাশের দেয়ালে ভূমিকা চাওলা আর কারিনা কাপুর-এর রঙীন পোস্টার চকচক করছে। মৌ বিছানায় শুয়ে পড়ে। আমি বিছানার একপাশে চুপচাপ বসে থাকি। মৌ সম্ভবত কিছুটা বিভ্রান্ত হযে পড়ে। কি করবে বুঝতে না পেরে বোধ হয় বলে ফেলে, টাইম নাই, টাইম নাই... শুরু করুইন। আমি হাসি, তোমাকে তো এক ঘন্টার জন্য নেওয়া হইসে। মৌ আর কিছু বলে না। আমি জিজ্ঞেস করি, তোমার মা বাপ নাই? এই কাম করো ক্যান?
যেই বেটির কাছ থেইকা ভাড়া লইলেন, হেয় আমার মা.. আর বাপ কেডা মায়েও কইবার পারবো না। মৌ হাসে। তার নাকের দু’পাশ সামান্য কুঁচকে যায়। আমার খুব অস্বস্তিবোধ হয়। আমি পকেট থেকে মোবাইল বের করে হাতে নেই। মেয়েটার সন্দেহ তৈরি হয়। আপনি কি কিসু করবাইন না? খালি আলাপ করবাইন? খালি আলাপ আমার ভালা লাগে না। টাইমডি নষ্ট।
তার সময় সচেতনতা মুগ্ধ হবার মতো। আমি মুগ্ধ হই এবং প্রাসঙ্গিক একটা প্রশ্ন করি, তুমি কি করনের সময় চিল্লাও?
এইতা চিল্লানি আর আমগো আহে না। তবে ২০ টাকা বেশি দিলে চিল্লামু।
আমি মোবাইল পকেটে ভরে উঠে দাঁড়াই। সামান্য হেসে বলি, থাক.. তোমার কিসু করতে হবে না। বের হয়ে আসি দরজা খুলে। মেয়েটা এক অজানা কারনে বের হওয়ার সময় চাপা কণ্ঠে বলে, জানোয়ার। তার নাক সামান্য কুঁচকে যায়।
বাইরে নয়ন আর সাইফ দাঁড়িয়ে সিগ্রেট টানছে। আমরা তিনজন নিঃশব্দে বের হযে আসি। রিকশায় উঠি। ওদেরকে রাস্তায় নেমে যেতে বলি।
তুই কই যাবি??তোর বাসায়? তোর বাসায় না ভাড়াটে ছিল? চল, আমার বাসায় থাকিস। সাইফ বলে।
ভাড়াটে গত মাসে বাসা ছেড়ে দিসে। সমস্যা নাই, যা তোরা।
আচ্ছা যা তাইলে। কালকে ঢাকায় যাওয়ার আগে দেখা কইরা যাইস।
আমি কিছু বলি না আর।

বাসার দরজা খুলে ঢুকতেই সেই গন্ধটা এসে নাকে লাগে যেটাতে পরিত্যক্ত পরিত্যক্ত একটা ব্যাপার প্রকট। অন্ধকার খালি বাসা। যেই রুমটায় আমি থাকতাম ৭ বছর আগে সেই রুমের দরজা খুলি। ভেতরে ঢুকি। সকালে এসে একটা ৮০ ওয়াটের বাল্ব লাগিয়ে গিয়েছিলাম, সেটা জ্বালাই। তারপর ঘরের কোনে রাখা ব্যাগটা থেকে কালো প্যাকেটটা বের করি। সময় প্রায় হয়ে এসেছে। আজকের দিন, আমার তেইশতম জন্মদিবস শেষ হতে আর মাত্র ১৫ মিনিট বাকি আছে। আজ আমার জন্মদিন, সকাল বেলা আমি প্রথমে তেইশটা সিগারেট কিনেছি।
........................................

(পুরাটাই দিতাম, কিন্তুক পুরাটা আসলে লেখা হয় নাই))
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০১১ সন্ধ্যা ৬:৫০
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৮




আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না। আমাদের দেশে মানুষ জন্ম নেয়ার সাথেই একটি গাছ লাগানো উচিৎ । আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানবতার কাজে বিশ্বাসে বড় ধাক্কা মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৭


মানুষ মানুষের জন্যে, যুগে যুগে মানুষ মাজুর হয়েছে, মানুষই পাশে দাঁড়িয়েছে। অনেকে কাজের ব্যস্ততায় এবং নিজের সময়ের সীমাবদ্ধতায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে না। তখন তারা সাহায্যের হাত বাড়ান আর্থিক ভাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমের খাট্টা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৪



তাতানো গরমে কাল দুপুরে কাচা আমের খাট্টা দেখে ব্যাপারটা স্বর্গীয় মনে হল । আহা কি স্বাদ তার । অন্যান্য জিনিসের মত কাচা আমের দাম বাড়াতে ভুল করেনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×