বিশ্ববিদ্যালয়ে সফটওয়্যার ইন্জিনিয়ারিং কোর্সটা নিতে হয়েছিল। প্রথম ক্লাস শুরু হওয়ার আগে প্রফেসর থেকে ই-মেইল পেলাম আগামীকাল বিকেলে কোর্সের সকল ছাত্র-ছাত্রীকে মাঠে জমা হতে হবে। একটু থতমত খেলাম। সফটওয়ার ইন্জিনিয়ারিং কোর্সের প্রথম ক্লাসের আগেই মাঠে কেন?
সময় মত উপস্থিত হলাম। শরতের নরোম বিকেল। সবুজ ঘাসের কার্পেটে বসে যে যার মত গল্প করছি। স্যার এলেন মনোবিদ্যা বিভাগের একজন প্রফেসর আর কিছু সিনিয়র স্টুডেন্টকে সাথে নিয়ে।
সফটওয়্যার ইন্জিনিয়ারিং কোর্সে মনোবিদ্যার টিচার কেন? মনোবিদরা আমাদের নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়লেন।
আমাদের দিয়ে রশি টানাটানি খেলালেন। বিশাল এক রশির মধ্যে অনেক গুলো বিতিকিচ্ছিরি গিট দিয়ে দিলেন, ছোট ছোট গ্রুপ করে দিলেন, দেখতে চাইলেন কোন গ্রুপ আগে জট ছড়াতে পারেন। আমরা যখন জট ছড়াতে ব্যস্ত তখন মনোবিদরা খেয়াল করছিলেন আমাদের মাঝে কে বেশী একটিভ। কে কথা বেশী বলছে। কে কথা বলছে কম কিনতু চিন্তা করে সমাধানটা ঠিকই বের করে দিচ্ছে ইত্যাদি।
এর পর দেয়া হলো ছোটখাটো গ্রুপ ম্যাথ করতে। এমনকি কে কি কালারের কাপড় পড়েছি, কোন স্টাইলের কাপড় পড়েছি সে গুলোর ভিত্তিতে গ্রুপ করে দৌড়াতে বলা হলো। নেতা বলেছেন জাতীয় খেলাও খেলতে হলো। ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। বলা হলো ক্লাস রুমে যেতে। আসলে উনারা দেখতে চেয়েছিলেন দিনের আলোতে আমাদের একটিভিটির পাশাপাশি রাতের আধাঁরে, ক্লাস রুমে আমরা কে কেমন।
প্রায় চার ঘন্টার টানা মজার সব অভিজ্ঞতা শেষে আমাদের গ্রুপগুলো ঘোষণা করা হলো।
এখানে বলে রাখা দরকার যে, সফটওয়ার ইন্জিনিয়ারিং কোর্সটা করতে হয় গ্রুপ ভিত্তিক। প্রতি গ্রুপে পাঁচ জন। আমরা এটা জানতাম বলে বাংলাদেশী ছেলে-মেয়েরা নিজেরা কয়েকটা গ্রুপ করে নিয়েছিলাম। কিন্তু এ প্রোগ্রাম শেষেতো আমাদের মাথায় বাড়ী। আমাদের বানানো গ্রুপের সদস্যরা কেউ আমাদের গ্রুপে নেই। মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল।
পরে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি প্রত্যেক গ্রুপ তাদের মেম্বারদের নিয়ে খুশি। আমাদের গ্রুপে ছিলাম আমি, একজন কানাডিয়ান, দুইজন চাইনিজ আরে একজন ইন্দোনেশিয়ান। কেউ ভালো প্রোগ্রামিং জানেতো, কেউ টেস্টিং এ ভালো। এ নিয়ে কারো আবার কোন অহং নেই। যে ইংলিশে খারাপ সেই মিনিটস লিখছে, যে ভালো সে পরে তা এডিট করে দিচ্ছে। যেন সবাই ভাই ভাই, একটি পরিবার। আমি অবাক হই মনোবিদদের নির্বাচনের যোগ্যতা দেখে। সব গ্রুপেই ভালো খারাপের মিশেল। গ্রেট কম্বিনেশন।
সবাই প্রোগ্রাম লিখছি, কেউ টেস্টিং করছি, কেউ প্রশাসনিক দিকটা দেখছি, দুইজন কোম্পানির প্রতিনিধির সাথে যোগাযোগ রাখছে, সপ্তাহে দু'বার মিটিং করছি, সকলের সময়ের সাথে মিলিয়ে, সকলের মতামত নিয়ে মিটিং হচ্ছে, মিটিং এ গঠনমূলক সমালোচনা হচ্ছে। মিটিং শেষে আবার অনলাইনে গ্রুপ মেম্বারদের ১ হতে পাঁচের মধ্যে রেটিং করতে হচ্ছে। এতে প্রফ বুঝতে পারছে কে একটিভ কে একটিভ না। কে পরমত সহিস্নু, কে রগচটা ইত্যাদি ইত্যাদি।
এই কোর্সটা করতে গিয়েই বুঝতে পেরেছি টিম ওয়ার্ক কাকে বলে। এখানে চাকুরী করতে হলে আপনাকে ভাল টিম ওয়ার্কার হতে হবে।
অবাক বিস্ময়ে ভাবি, আমরা মুসলমানরা আর বাংলাদেশীরাই বুঝি শুধু টিম ওয়ার্কে বড়ই দূর্বল। একা একা আমরা বিশ্বজয় করতে পারি। কিন্তু দু'জনে মিলে একটা মোমবাতিও জ্বালাতে পারিনা। মতের সেক্রিফাইস করা আমাদের পক্ষে অসম্ভব। কথায় আছে, দুই আলেম এক কম্বলের নিচে ঘুমাতে পারেনা। আমরা এক নেতা কিংবা এক নেত্রী নির্ভর। সংসদীয় ব্যব্স্থা হলেও সবার অংশগ্রহন নাই। একজনের কথাই চূড়ান্ত। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভিসিই হলেন একনায়ক। অন্যরা কেউ না। আমরা সাফল্যকে ভাগ করে নিতে পারিনা। নিজেই সফল হতে চাই। তাই কখনো সফল হতেও পারিনা।
আমাদের দেশে টিম ওয়ার্কারের চেয়ে স্বৈরাচার, স্বৈরতন্ত্র খুব বেশী পরিচিত। আমাদের ক্রিকেট টিমেরও একই দশা।
আমরা যেন সবাই রাজা। সবাই নেতা।
মনে মনে বলি "চির উন্নত মম শির"। কাউরে আমি থোরাই কেয়ার করি। কিন্তু এটা বুঝিনা যে, অপরকে কে শ্রদ্ধা করলে সেও আমাকে শ্রদ্ধা করবে। কেউ একজন বলেছিলেন, শ্রদ্ধা হলো সেভিংস একাউন্টের মত। টাকা জমা করলেই শুধু টাকা তোলা যায়। তেমনি শ্রদ্ধা পাওয়ার আগে শ্রদ্ধা অর্জন করতে হয়। অপরের যোগ্যতা, মেধার স্বীকৃতির মাধ্যমেই নিজের বড়ত্বের প্রমাণ মেলে। এপ্রিসিয়েশনের বড় অভাব আমাদের মাঝে। শুধু নিজেকে জাহির করা আর অপরকে বিনাশ করাতেই খুঁজে ফিরি আনন্দ। সহমত, সহাবস্থান এগুলো যেন শুধুই অভিধানেই আছে, বিদায় নিয়েছে আমাদের জীবন থেকে।
কবে যে আমরা সম্মিলিতভাবে কাজ করতে শিখবো? সকলে মিলে দেশ গড়তে শিখবো?