২০০৩ সাল বোধহয়... সদ্য আঠারোয় পা দিয়েছি। পলিটেকনিক জীবনের ঠিক মাঝামাঝিতে এসে দেখি... কায়দা করে সিগারেট টানতে শিখে গেছি ততদিনে। একটা সাইকেলে চেপে শহর পরিক্রমায় বের হই নিয়মিত, ফাঁকে ফাঁকে ক্লাসে গিয়ে উপস্থিতির হারটা টেনেটুনে ঠিক রাখি। বাসায় যতক্ষন থাকি গিটার বাজাই, গান শুনি... তারপরও উদ্বৃত্ত সময় যদি কিছু থাকে, পড়াশোনা করার চেষ্টা করি। পরিবারের কাছে সর্বকনিষ্ঠ সদস্য, মায়ের কাছে তখনও 'কোলের ছেলে' হিসেবে গন্য বলে আদরের পাশাপাশি বাড়ির সকলের ঝারি খেয়েই দিনপাত করি। তবে সেইসঙ্গে অনুভবও করি... ক্রমেই বয়সটা বাড়ছে ঢের!
সমবয়সী, পরিচিত বান্ধবের অভাব না হলেও 'বন্ধু'র সংখ্যা ছিলো সত্যিই সীমিত। চিরকালই... 'পরিচিত' আর 'বন্ধু'দের মধ্যে পার্থক্য সচেতনে নির্ণয় করে এসেছি। অল্প কয়েকজন কাছের মানুষ... তন্মধ্যে একজন... হাসান ভাই!
মাঝারি লম্বা চুল, ইব্রাহীম খাঁ-তে অনার্স অধ্যয়নরত হাসান ভাই গিটার বাজানোর ফাঁকে ফাঁকে প্রচুর পাগলামিও করতেন। সেসব পাগলামি যথারীতি 'এ্যাপরিশিয়েট' করতাম হাসিমুখে যেহেতু... তাই অব্যক্ত ইতিহাস হয়েই থাকুক তা। নচেৎ এই মুক্ত আন্তর্জালে কোনভাবে এই লেখা তার চোখে পড়লে কে জানে কি হয়? তবে কিনা... আজকের নরওয়েবাসী এই হাসান ভাই-ই একদিন বললেন, "গিটার কিনবি? আমার গিভসনটা বিক্রি করে একটা সিগনেচার কিনবো।"
নগদ এক হাজার আর বাকি আটশো... আঠারোশো টাকায় একটা গিভসন গিটারের মালিকানা পেলাম। বলে রাখা ভালো, গিটার শেখার প্রাথমিক ভাবনা ছিলো যদিও সুরের প্রতি ভালোবাসা। কিন্তু মনের কোণে লুকিয়ে ছিলো নিজেকে জাহির করার একটা অনুচিত উদ্দেশ্য। প্রথম প্রথম একটু ভাব নিতাম বৈকি! হাসান ভাই-ই ক্রমেই সে উদ্দেশ্যে বাগড়া দিতে লাগলেন। আমি বুঝতে শিখলাম, এটা আমার জন্য... শুধুই আমার জন্য। বলাটা কি বাহুল্য নয় যে গিটার শেখানোর দায়িত্বটাও নিয়ে নিলেন তিনিই?
বছরখানেক পর... নানাবিধ পাগলামির আরেকটি উদাহরন দেয়ার অভিপ্রায়েই বোধহয়... হাসান ভাই এক বিকেলে হাত থেকে সিগারেট কেড়ে নিয়ে জোরেশোরে একটা টানের পর ঘোরালো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বোমাটা ফাটালেন... "সন্তরণ নামটা কেমন?"
'ভালোই তো... কেন? আপনের পোলার নাম রাখবেন এইটা?' সন্দিহান গলায় বলি।
তীর্যক চাহনি তার চোখে... আমার মতো গাধা অন্যকোথাও কখনও দেখেছেন কিনা ভাবতে ভাবতেই বললেন... "আমরা দুজনে একটা ব্যান্ড দাঁড় করাবো! সন্তরণ- আমাদের ব্যান্ডের নাম!"
তখন দু-একটা কর্ড ধরে ধরে গিটার বাজাই। যার কাছে প্রথম গিটার ধরতে শিখেছি, সেই হাসান ভাইয়ের সাথে আমি করবো ব্যান্ড! হাসবো না কাঁদবো? আবার ভাবছি, আজ কি রোদটা কড়া ছিলো... পাগলামীর এক্সট্রিম লেভেল কি নয় এটা? হাসান ভাই আশ্বস্ত করে বললেন, নিজেকে যতটা ছোট করে ভাবছি আসলে নাকি তা না! আমার মধ্যে নাকি 'ইয়ে' আছে একটা! গানটা আপাতত আমিই গাইবো প্র্যাকটিসের খাতিরে... শুরুটা হোক আগে, পরে অন্যান্য মেম্বারের ব্যাপারে ভাবা যাবে!
শুরু হলো জীবনের প্রথম ব্যান্ড অধ্যায়... সন্তরণ!
২.
প্রতিদিন বিকেলে হাসান ভাইয়ের বাসার ছাদে প্র্যাকটিস... সিগারেট, আদা-চা, আর ধমকাধমকি খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে একোস্টিক গিটার বাজাই। স্বপ্ন... একটা সিগনেচার আর গিভসন জাম্বোতে ভর করেই একদিন বিশাল কিছু একটা করে ফেলবো!
হাসান ভাই জ্ঞান দিতেন প্রচুর... বাহুল্য হবে বলা, সেসব কাজের ছিল বেশ! শুধুমাত্র মিউজিক নয়... সংস্কৃতির অন্যান্য ধারাতেও যেমন বিচরন ছিল... সেসব নিয়ে গল্প করতেও ভালোবাসতেন ভদ্রলোক। জীবনের অনেক 'এথিকস্' যে তার কাছ থেকে ভেতরে ধারন করতে শিখেছি, তা বলতে একটুও সংকোচ করিনা!
যাই হোক... ঠিক এমনই সময়ে আরোও অনেক কিছুর মতোই আর্টসেলের সাথেও আমার পরিচয় হয়েছিল হাসান ভাইয়েরই মাধ্যমে। একদিন প্র্যাকটিস শেষে বাড়ি ফিরছি, হাতে তিনটি সিডি ধরিয়ে দিলেন তিনি... পিংক ফ্লয়েডের 'দ্য ওয়াল', বেস্ট অব এয়ার সাপ্লাই আর আর্টসেলের 'অন্যসময়'!
বাসায় ফিরে মায়ের বকা খেয়ে পড়তে বসলাম। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে ভাবনায় পড়লাম... পিংক ফ্লয়েড? এয়ার সাপ্লাই নাকি আর্টসেল?? শেষ পর্যন্ত 'অন্যসময়' সিডিরমে চাপিয়ে দিলাম... এতোদিনের এল.আর.বি, নগর বাউল, ওয়্যারফেইজের সাথে যোগ হলো... 'অন্যসময়'-এর গল্প!
'....দাসত্বের দাস হয়ে ফিরছি
বিবাগী পথিকের বেশে
বারেবারে একই ঠিকানায়!'
তারপর অন্য ট্র্যাকগুলোর সাথে পথচলা, ইতিহাস, অবশ অনূভুতির দেয়াল, অলস সময়ের পাড়ে একটি ঘন্টা পেরুলে সম্বিত ফিরে পেলাম! এরকমও গান হয়? এসবই তো আমি লিখতে চেয়েছি... গাইতে চেয়েছি! নেশাগ্রস্তের মতো ঘুমাতে গেলাম!!
এরপর মহীনের ঘোড়াগুলি, দ্যা ডোরস, ইগলস্, অর্থহীন, গানজ এন রোজেজ, ড্রিম থিয়েটার, লিংকিন পার্ক, আয়রন মেইডেন, ফসিলস্... আমার প্লেলিস্ট সমৃদ্ধ হতে থাকলো হাসান ভাই কিংবা অন্য কোন বড়-ছোট ভাইদের সান্নিধ্যে, আর ধীরে ধীরে আমি একজন 'শ্রোতা' হয়ে উঠতে লাগলাম!
৩.
রাত্রির একটা অনবদ্য আকর্ষণ আছে। যারা টের পায়... রাত তাদের কাছে একটা বিশেষ মূহুর্ত, কি এক অদ্ভুত নেশাময় সময়... আমিও টের পেয়েছিলাম... অন্ধকার আমাকে ডাকতো তীব্র স্বরে! ভাবনাগুলোর যত ডালপালা আছে, তার গভীরে বিচরন করার জন্য এরচেয়ে ভালো সময় আমি এই জীবনে আর খুঁজে পাইনি! গভীর রাতে ঘরের বাইরে তালা লাগিয়ে বেরিয়ে যেতাম। হাঁটতাম পথে পথে, অন্ধকারের সাথে কথা বলতাম একা একাই।
একরাতে... ইউনিভার্সিটির ছুটিতে ভাইয়া এসেছেন বাসায়। আমি জানতাম, তবুও যথারীতি... নৈশচারী হতে বাইরে! কি করে যেন টের পেলেন ভদ্রলোক, বাসায় ফিরতে না ফিরতেই... মাথায় আমার আকাশ ভেঙে পরলো!! সেই ভাংচুরে... শহীদ হলো আমার প্রিয় 'গিভসন'!!
৪.
এই গিটার হারানোটা ছিলো আমার জীবনের মস্ত একটা টার্নিং পয়েন্ট। তখন আমি বাধ্য ছেলের মতো পড়াশোনা করি, আবৃত্তি সংসদের বৈঠকগুলোতে নিয়মিত হাজিরা দেই... নাট্যম নামে একটা নাট্যদলেও যুক্ত হলাম। আবৃত্তির অনুষ্ঠান, নাট্যোৎসব... সংস্কৃতি চর্চার কথিত শুদ্ধ পথে হাঁটাহাঁটি করি। একটা পথনাটক ছিলো শহীদ মিনারে... সমাজবিরোধী একটা চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম বড় যত্নে। মনে আছে মাস দেড়েক গালে ব্লেড ছোঁয়াইনি যাতে একটা রেকলেস লুক চলে আসে চেহারায়। পরিচিত কিংবা 'প্রিয়জন'এর ঠাট্টা কম শুনতে হয়নি তাতে। তবুও... নিজের 'চরিত্র'টাকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি। আসলে... আমি যখনই কোন কিছুতে স্বপ্রণোদিত হয়ে 'ইনভলবড' হয়েছি, তার পারফেকশনের দিকে খেয়াল রাখতে চেয়েছি! যাই হোক, পাশের বাসায় একজন নাট্যকর্মী থাকতেন। নাট্যোৎসবে তাদের দলের নাটকও ছিলো। তিনি সেই নাটক দেখে এসে গল্প করার পর বাসা থেকেও 'ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো'র জন্যে বিদ্রুপাত্মক মন্তব্যগুলো বন্ধ হয়ে গেল। আর দিনগুলো... কাটছিলো এভাবেই!
২০০৩ সালের শেষের দিকে... সেদিন... মনে পরে... কেন যেন মন ভালো ছিলো না। ভেবেছিলাম সন্ধেটা স্টেশনে গিয়ে প্লাটফর্মের একপাশে কোন একটা বেঞ্চে কাটিয়ে দেবো। সে পথে পা বাড়াতেই হাসান ভাইয়ের সাথে দেখা। তার আশি সিসির ভটভটির পেছনে চেপে পৌঁছে গেলাম প্রিয় নদীতীরে। সেই স্বভাবসুলভ সিগারেটের ঘোরালো ধোঁয়ার ওপাশ থেকে হাসান ভাই বললেন... একটা ড্রামস আছে, কেনার প্রয়োজন নেই। আমি যদি শিখতে চাই তবে শেখানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তিনি জানতে চাইলেন, আমি আগ্রহী কিনা?
দোটানায় পড়বো কিনা বলেন? আমার স্বপ্ন ছিলো বেইজিস্ট হবো! সেভাবেই গুছিয়ে নিয়েছিলাম নিজের ভাবনাগুলো। হাসান ভাই বললেন, "লেগে থাক... ক্রিকেটে বোলার আর ব্যাটসম্যান ছাড়াও অলরাউন্ডার বলে একটা ব্যাপারে আছে! সেসব মিউজিকেও হয়!"
আমি... রাজি হয়ে গেলাম!
(এখান থেকে কিছু চরিত্রের ছদ্মনাম ব্যবহার করবো! এতোদিন পরে 'স্পর্শকাতর' কোন বিষয়ে কাউকে অস্বস্তিতে ফেলার কোন সাধ আমার বিন্দুমাত্রও নেই!)
৫.
বিষয়টা হয়েছে কি... ছোট্ট একটা রিভল্যুশন! আমাদের সেই মফস্বলেও গোটাকয়েক ব্যান্ড যা ছিলো, তাদের সংগঠন ছিলো একটা (নামটা বলছি না... বামবা'র মতোই একটা কিছু আর কি!) তুষার ছিলো একজন অলরাউন্ডার মিউজিশিয়ান... মূলত গিটারিস্ট হলেও ড্রামস আর কিবোর্ডেও তার কিছু পারদর্শিতা ছিলো। সংগঠনের বিভিন্ন পক্ষপাতিত্ব আর অনিয়মে বিরক্ত হয়ে সে ভাবলো এদের সাথে আর না। হাসান ভাই আর জন নামে এক জুনিয়র ছেলেকে সাথে নিলেন... আমি কিছুটা ড্রামস জানতাম বলে ভীড়ে গেলাম এই দলে।
এই ব্যান্ডের কার্যক্রমে আমার ভূমিকা ছিলো নগন্য... ড্রামসের পেছনে বসে তুষারের ইশারায় খানিকটা পুতুলের মতো। তুষারের প্রতি একটা শ্রদ্ধা আর নিজের সীমিত পারদর্শিতা আমাকে স্বকীয় হতে বাঁধা দিতো বারবার। তবুও সেসব ইগো পাত্তা না দিয়ে নিজের কাজটুকু চেষ্টা করছিলাম যত্নে করতে!
এরই মাঝে তুষারের সাথে হাসান ভাইয়ের কোন একটা সমস্যা হলে তিনি ব্যান্ড ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। আরও চার-পাঁচজন ছেলে এসে ঢুকলো যার পূর্বোক্ত সেই সংগঠন পরিচালিত মিউজিক স্কুলের ছাত্র ছিলো... তিনজন গিটার বাজায়, একজন কিবোর্ড আর একজন ড্রামস। আপত্তি সত্ত্বেও ড্রামসের পেছনে ছোট্ট টুলটা নিয়মিত শেয়ার করতে শুরু করলাম তার সাথে! বলা হলো... আমরা একটা মিউজিক ফ্যামিলি... সবাই মিলেই 'একটা কিছু' করবো বলে প্রাকটিস চলতে লাগলো!
হঠাৎ একদিন তুষার সবাইকে ডেকে বললো... "যথেষ্ট হইছে, এইবার আমরা শো করমু!" আমরাও প্রস্তুতি নিতে লাগলাম!
শো করবো বললেই তো আর হয়না... প্র্যাকটিস, শো'র জন্য হল. অডিটোরিয়াম ভাড়া, সাউন্ড সিস্টেম, লাইটিংস্, স্পন্সরের জন্য ছুটোছুটি... বলাটা এখানেও বাহুল্য, সেই পাগলাটে হাসান ভাইকে ছাড়াই! অভিমানেই... আমার সাথেও তেমন যোগাযোগ রাখেন না তিনি!
সময় চলে এলো। শো'য়ের দুদিন আগে পটভূমিতে যোগ হলো বিতর্কিত কিছু চরিত্র! প্রশ্ন তুললেই তুষারের উত্তর যা এসেছিল, তা বলার ইচ্ছেটা হচ্ছে না!
চুপচাপ নিজের পার্ট'টুকু প্লে করে যাচ্ছিলাম।
শো হলো... আর তার সাথে তুষারের বক্তব্য কিংবা আমার ভাবনার সাথে কোনরকম মিল খুঁজে পেলাম না! প্রকৃতপক্ষে এই কনসার্ট'টি ছিলো তুষারের জন্য সংগঠনে প্রত্যাবর্তন শো! আমি ততদিনে এই ব্যান্ড সংগঠনটির আভ্যন্তরীন কলুষতা সম্পর্কে যথেষ্টই ওয়াকিবহাল! শো শেষ হওয়া পর্যন্ত কোন কথাই বলিনি... চুপচাপ বাজিয়ে গেছি! সবকিছু চুকেবুকে গেলে, পরদিন ব্যান্ডের মিটিং কল করলাম!
জীবনের প্রথম (আসলে কিন্তু দ্বিতীয়... আমি অন্তত দ্বিতীয় বলেই জানি) ব্যান্ডের প্রথম কনসার্টের পরদিন সকাল এগারো কি সাড়ে এগারটা... ব্যান্ড'টা ভেঙে গেলো! তুষার চলে গেল তার পুরনো সংগঠনে। আমি কয়েকজন নিয়ে আলাদা হয়ে গেলাম... আর ওইদিনই নতুন ব্যান্ড সেটআপ করলাম... ড্রিম হান্টারস!
(চলমান পোস্ট)