somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প: একজন পোষক

০৯ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ রাত ৯:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আমার একটু ব্যক্তিগত অন্ধকার ছিলো। একটু'র বদলে 'কিছুটা অন্ধকার'ও বলা যায়। অন্ধকার মাপার কোনো যন্ত্র নেই। থাকলে সঠিক পরিমাণটা বলতে পারতাম। তবে একেবারে কমও না। পুরনো দিনের সেগুন কাঠের ভারী আলমিরার পেছনের অন্ধকার তো দেখেছেন। অতটুকু তো হবেই।

ওঁ অনেকদিন আমার সাথে ছিলো। অন্ধকারটাকে আমি ওঁ বলে ডাকতাম। সারাদিন একটা জিনিসকে তো আর অন্ধকার অন্ধকার বলে ডাকা যায় না, শুনতেও খারাপ লাগে। তাছাড়া ব্যাপারটা অস্বস্তিকর। বিড়াল পুষলে কেউ তাকে নিশ্চয়ই বিড়াল বিড়াল বলে ডাকে না। অবশ্য ওঁকে আমি ঠিক পুষতাম বলা যায় না। অন্ধকারতো আর কুকুর-বিড়ালের মতো না যে দুধ-মাছ দিয়ে পুষতে হবে। তবে একজন বিশ্বস্ত সঙ্গীর মতো ওঁ আমার সাথে থাকতো।

এটা ঠিক- অন্ধকারের প্রাণ থাকে না। তাকে নিয়ম করে দু'বেলা খেতে দিতে হয় না। তবে তার মানে সে যে প্রাণহীন- সেটাও না। একে বরং অর্ধজীবন্ত কিছু একটা বলা যায়। ওঁকে ডাকতে ডাকতে মুখে ফেনা উঠে গেলেও সে আপনার ডাকে সাড়া দেবে না। কিন্তু আপনি ঠিকই বুঝতে পারবেন যে সে জেগে আছে এবং সব শুনতে পাচ্ছে।

ব্যক্তিগত অন্ধকার অনেকটা পুরনো আমলের স্যুটকেসের মতো। সেখানে আমাদের অতীতের গোপনতম কথাগুলো থাকে। যা অন্ধকারের মালিক ছাড়া আর কেউ জানে না- এক জীবনের দূরতম অন্ধকার। কুড়ি বছর পাশাপাশি এক বিছানা ভাগাভাগি করেও সঙ্গীর সেই অন্ধকারের নাগাল পাওয়া যায় না। সেখানে আর কারো প্রবেশাধিকার নেই।

আধুনিক জগতের সাথে খাপ খাইয়ে চলতে গেলে ইদানিং এটা বেশ কাজে দেয়। নিজের কুৎসিত দিকটা গোপন রাখার জন্য ব্যক্তিগত অন্ধকারের ভেতর নানা কিছু ব্যাপার থাকে। কারো কাছে নিজেকে ভালো মানুষ সাজাতে যাচ্ছেন, আপনার দরকার একটা 'শো-অফ' ফেসপ্যাক। যদিও এটা আজকাল খুব ভালো কাজে দিচ্ছে না। সবাই কিভাবে যেন ধরে ফেলছে। এক্ষেত্রে আপনি 'আমিই সাধু' ফেসওয়াশ ব্যবহার করতে পারেন। কে কী ভাবলো তাতে কী যায় আসে। আপনি জানেন- আপনি ভালো। তবে এর সাথে যদি একটা 'ভদ্রতা'র ঘড়ি পড়ে নেন তবে সময়ে সময়ে বেশ সহজ হবে কাজটা। এরকম আরো অনেক কিছু থাকে অন্ধকারটার ভেতর। একটা উপটান আছে। সেটা মাখলে সহজেই অন্যদের কাছে সুখী সাজা যায়।

ওঁ-এর কথায় ফিরে আসি। দিনের বেলা ওঁ আমার বিছানার নিচে খাটের অন্ধকারের সাথে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকতো। আমি বাইরে যাওয়ার সময় প্যান্টের পকেট কিংবা শার্টের ভেতরের অন্ধকারের সাথে করে নিয়ে যেতাম তাকে। সারাদিন ওঁ আমার সাথেই থাকতো। রাতে বাড়ি ফিরে তাকে বাইরে ছেড়ে দিতাম। ওঁ তখন মাঠে পৃথিবীর বাকীসব কালো অন্ধকারদের সাথে খেলতে যেতো। আর ভোররাতের দিকে অন্যসব অন্ধকাররা যখন চুপিচুপি বিদায় নিতো কিংবা আলমিরার পেছনে, বাথরুমে, রান্নাঘরের বৈয়ামের ভেতরে লুকিয়ে পড়তো, ওঁ তখন ভোরের আবছা ভেজা বারান্দা দিয়ে এসে সোজা আমার বিছানার নিচে নিজের জায়গা খুঁজে নিতো।

সব স্বাভাবিকভাবেই চলছিলো। সেদিনের আগ পর্যন্ত, যেদিন সকালে ঘুম থেকে জেগে আবিষ্কার করলাম- খাটের নিচটা ফাঁকা। ওঁ নেই। শুধু বিছানার অন্ধকারটা সেখানে মৃত মানুষের নাক ডাকানোর মতো করে ঘুমুচ্ছে। তাহলে কি ভোররাতে ওঁ ফেরেনি? কী সর্বনাশ। এমন তো কখনো হয় না। দ্রুত বারান্দায় গিয়ে দেখে এলাম একবার। নেই। অবশ্য থাকবে বলেও আশা করিনি আমি। দিনের আলো সবখানে। টবগুলোর ছায়াতে উঁকি দিলাম। যদিও ওখানে অতবড় অন্ধকারটার জায়গা হবে না জানি। মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেলো। এদিকে অফিসে যাওয়ার সময় হয়ে যাচ্ছে।

অন্য কেউ বা কিছু হলে তার বিপদে পড়ার একটা আশঙ্কা মাথায় আসতো। কিন্তু অন্ধকার বলেই হয়ত ওঁর ব্যাপারে তেমন কিছু হলো না। ঐ শালা নিজে একটা অন্ধকার; ওর আবার কিসের বিপদ হবে। সে তো নিজেই অন্যের বিপদের কারণ হয় সবসময়।

ঘুম থেকে উঠেই আমাকে এদিক-সেদিক করতে দেখে কণিকা বোধহয় খেয়াল করলো ব্যাপারটা। এমনিতে মেয়েটা বেশ পাগলাটে। তবে আমাকে সত্যিই বেশ যত্ন করে।
'কিছু খুঁজছো?'
আমার উত্তর দিতে ইচ্ছে করলো না। মুখের ভেতরটা কেমন তেতো লাগছে। অফিসে আজকে বসের সাথে একটা জরুরি মিটিং আছে। তেলটা ঠিকমত মাখতে না পারলে বিপদ। এমনিতেই আজকাল সবাই যেভাবে তৈলাক্ত মুখে বসের আশেপাশে ঘুর ঘুর করে, জায়গা পাওয়াই কঠিন। অথচ আজকের এই তেলোটে ভাবের ওপর সামনের অনেক কিছু নির্ভর করছে। হয়ত এই ধাক্কায় থেমে থাকা প্রমোশনটাও হয়ে যেতে পারতো। কিন্তু ওঁ ব্যাটা যে এভাবে ফাঁসিয়ে দিতে পারে কখনো এমন দুশ্চিন্তাও করিনি।

একবার ভাবলাম কণিকাকে জিজ্ঞেস করি, ওর বেলায় কখনো এমন হয়েছে কী না? যদি হয়, তাহলে সামাল দিয়েছে কিভাবে। কিন্তু পরক্ষণেই মাথা থেকে বাদ করে দিলাম চিন্তাটা। ওর অন্ধকার ও কোথায় রাখে কে জানে। তাছাড়া এসব কথা এভাবে সরাসরি জিজ্ঞেসও করা যায় না। কৌশলে জানতে চাইতে হয়। কিন্তু সেটাও করতে পারছি না। পেঁচিয়ে কথা বলার ঐ বডি স্প্রেটাও ওঁর পেটের ভেতর। বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে এলো। ভালো বিপদে পড়া গেলো দেখা যায়। এখনই এই অবস্থা- সারাদিন চলবে কিভাবে।

সাবধানে নাস্তা সারলাম। কণিকার সাথে খুব বেশি কথাবার্তায় গেলাম না। মুখ ফসকে কখন কী বলে ফেলি কে জানে। ইদানিং ও বেশ মোটা হয়ে যাচ্ছে, রাতের বেলা কাছে টানলে আগের মতো আর স্রোত পাই না, এসব কথা যদি মুখ ফসকে একবার বেরিয়ে যায়- কেলেঙ্কারি হবে। তাড়াতাড়ি বের হওয়ার আগে শেষ একবার শূন্য বিছানার নিচে উঁকি দিয়ে একজোড়া হতাশ কাঁধে রাস্তায় নেমে এলাম।

বাসে উঠেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো। প্রতিদিনকার মতোই গাদাগাদি ভীড়। মনে হচ্ছে বাসের ভেতরটা একটা ভ্রাম্যমাণ মাছবাজার- সবাই মাছ কিনতে এসে দাঁড়িয়ে আছে। অথবা হয়ত আমরাই মাছ। কিছু দামী মাছ আলাদা করা। আর কেউ কেউ কুঁচো চিংড়ির মতো ভাগ ভাগ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা চলেছি ব্যাপারীর কাছে বিক্রি হওয়ার জন্য। আমার স্টপেজটা মাঝামাঝি- তাই বসার সিট না পেয়ে আজকেও আমি চিংড়িদের দলে।

তবে তখনো সত্যিকারের দুর্ভোগ শুরু হয়নি। স্ট্যান্ড ধরে ভীড়ের মাঝে কোনো রকমে ব্যালেন্স ঠিক রাখছি, হঠাৎ খেয়াল করলাম পাশের ভদ্রলোক একটা মেয়ের শরীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছেন। সময়ে সময়ে সেদিকে আরো চেপে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। মাথায় টাক পড়ে যাওয়া মধ্যবয়স্ক লোক। মুখে একটা 'নির্লিপ্ত' প্রলেপ দেওয়া। দেখে মনে হয় জগতের কোথায় কি হচ্ছে সেই সম্পর্কে তার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। মেয়েটা বোধহয় একটা বেকায়দা পরিস্থিতিতে পড়ে গেছে। কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। আমার কিছুটা মন খারাপের মতো হলো। অন্ধকারটা সাথে থাকলে আমিও এভাবে মেয়েটার দিকে চেপে যেতে পারতাম। ফাটা কপাল। তবে এই মন খারাপ ভাবটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হওয়ার সুযোগ পেলো না।

'ভাই, একটু চেপে দাঁড়ান না। উনার হয়ত অসুবিধা হচ্ছে।'
সবাই যখন অবাক ভঙ্গিতে তাকালো আর লোকটা কঠিন মুখ করে আমার দিকে ফিরলো শুধুমাত্র তখনই আমি নিশ্চিত হলাম যে কথাগুলো আমার মুখ থেকেই বেরিয়েছে। বুঝলাম শুধু শুধুই অহেতুক একটা ঝামেলা বাঁধিয়ে ফেলেছি। আরো অনেকেই নিশ্চয়ই খেয়াল করেছে ব্যাপারটা, কিন্তু 'গা বাঁচানো' রেইনকোটটা পড়ে থাকায় কেউ কিছু বলেনি। মনে মনে ওঁ-এর চৌদ্দগোষ্ঠী তুলে গালিগালাজ করতে ইচ্ছা করলো আমার। কিন্তু সেই সুযোগ পাওয়া গেলো না। তার আগেই লোকটা কঠিন মুখ করে চিবিয়ে চিবিয়ে পাউরুটি খাওয়ার মতো করলো।
'আপনি কেরে ভাই? উনি কি আপনাকে কিছু বলছে? পন্ডিতি দেখান কেন?'

কী বলবো ভেবে পেলাম না। মনে মনে নিজের গালে ঠাস ঠাস চড় কষাতে ইচ্ছা হলো। উচিৎ শিক্ষা। আর কখনো অন্ধকার ছাড়া রাস্তায় নামবি হারামজাদা? এখন এই রাস্তার টেকো লোকের হাতে অপমান হতে হচ্ছে। কী দরকার ছিলো। একটা অপ্রস্তুত সকালে নিজের দুর্ভাগ্যের কথা ভেবে মাথা নিচু হয়ে আসছে, ঠিক তখনই মেয়েটার গলা শুনতে পেলাম। এতক্ষণে বোধহয় এটুকু সাহস জমিয়ে ফেলেছে।
'উনি তো ঠিকই বলেছেন। আপনি অনেকক্ষণ থেকেই অসভ্যের মতো করছেন।'

লোকটাও অবস্থা বুঝে আর কথা বাড়ালো না। একটু পর নেমে গেলো। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে গিয়ে দেখি আশেপাশের অনেকেই অন্যরকম চোখে তাকাচ্ছে। মেয়েটার চোখেও একটা নীরব কৃতজ্ঞতা। অন্যসময় হলে 'হিরো হিরো' ভাবটা নেয়ার সুযোগ ছাড়তাম না। কিন্তু এই ওঁ হারামজাদার জন্য সেটাও হলো না। আমার স্টপেজ আসলে স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই নেমে গেলাম বাস থেকে। তবে সত্যি বলতে কি আমার বেশ একটা ফুরফুরে অনুভূতি হলো।

অফিসে ঢুকেই বুঝলাম সবাই আজ বেশ সেজেগুজে এসেছে। কয়েকজন এত বেশি ভালো মানুষ সেজেছে যে রীতিমতো উৎকট গন্ধ বেরুচ্ছে। মনটা আবার ছোট হয়ে গেলো। আমাকে বোধহয় খারাপ মানুষের মতো লাগছে। মাথা গুঁজে নিজের ডেস্কে গিয়ে বসলাম। কাজ যতটা গুছিয়ে নেয়া যায়। লাঞ্চের পর মিটিং। আবার কোন অঘটন না হয়ে যায়। একবার ভাবলাম ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে যাই। কিন্তু বস তাতে আরো ক্ষেপে গেলে শেষে প্রমোশন তো পরের কথা, চাকরি নিয়েই টানাটানি পড়ে যাবে।

মিটিং-এর শুরুতেই বস আমাদের নতুন একটা আপকামিং প্রোজেক্ট নিয়ে ব্রিফ করলেন। তারপর সেটা নিয়ে কার কি মতামত জানতে চাইলেন। বোঝাই যাচ্ছে নিতান্তই একটা ফালতু প্রজেক্ট। শুধু শুধু টাকার শ্রাদ্ধ। কিন্তু সেটা বলতে যাওয়া মানেই নিজের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণার মতো ব্যাপার। বিশেষ করে তিনি যখন খুবই উত্তেজিত এটা নিয়ে। মনে মনে নিজেকে সাবধান করার চেষ্টা করলাম।
'খবরদার। ভুলেও উল্টাপাল্টা কিছু বলতে যেও না। এমনিতেই অন্ধকারটা নিয়ে বিপদে আছো। সেটা বাড়ানোর কোনো দরকার নেই।'

বসের ব্রিফ শেষ হতেই একে একে সবাই নিজেদের মতামত জানালো। মত বলতে তেলতেলে মুখে বসের প্রশংসা করা আর কি। উনি কতটা দূরদর্শী, এই প্রজেক্টটা আমাদের কোম্পানীকে কিভাবে এগিয়ে নেবে- এইসব হাবিজাবি। আমি তখন মনে মনে রিহার্সেল করছি আসলে ঠিক কি বললে এই বিপদ থেকে বাঁচা যায়।
'খুব ভালো একটা প্রজেক্ট এটা। ঠিকমতো এগুলে বেশ ভালো একটা ফলাফলই অপেক্ষা করছে কোম্পানীর জন্য...'
নাহ। 'ঠিকমতো এগুলে' কথাটায় সন্দেহ প্রকাশ পায়। আরো বেশি জোরালো কিছু দরকার।
'অসাধারণ একটা কাজ হবে, স্যার।' হ্যাঁ, এটা ঠিক আছে মোটামুটি। তবে শুরুতে 'আমার মনে হয়' লাগিয়ে নিলে আরো ভালো হবে।

'কি ব্যাপার, মনসুর? আর ইউ অলরাইট? কেমন যেন আনিজি ফিল করছো মনে হয়।'
'ইয়ে মানে... না স্যার। ঠিক আছি আমি।'
দেখো কী অবস্থা। মুখে কিছু মাখা হয়নি বলে ঠিকই ধরে ফেললো। অথচ অন্ধকারটা যখন ছিলো কতজনের সাথে হেসে হেসে কথা বলতে বলতে মনে মনে ধমকেছি- 'ব্যাটা আহম্মক। এবার থাম।' কেউ কিছু সন্দেহও করেনি।
'ওকে। এবার বলো। তোমার কী মনে হয় প্রজেক্টটা নিয়ে। এনি ফ্ল?'
'না স্যার... মানে...'

মনে মনে যা বলবো বলে ঠিক করে রেখেছিলাম, সেগুলোর খোঁজে মাথা হাতড়াতেই জমে গেলাম। নেই কথাগুলো। কোথাও নেই। যেন বেমালুম উধাও হয়ে গেছে। টেবিলের নিচে থাকা পা দু'টো দুর্বল আর মাথাটা একেবারে ফাঁকা লাগে। এদিকে বস শীতল দৃষ্টি বিছিয়ে অপেক্ষা করছেন। তার চোখে অহেতুক তাড়া। সেদিকে তাকিয়ে আমার মনে হয় যেন গুটি গুটি পায়ে অনন্ত সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মিটিং রুমের হিমশীতল পরিবেশে নিজের অস্পষ্ট গলার স্বর শুনতে পেলাম।

এভাবে কতক্ষণ কেটেছে জানি না। একসময় আবিষ্কার করলাম ঘরের ভেতর পিনপতন নীরবতা। কারো নিঃশ্বাসের শব্দও পাওয়া যাচ্ছে না। সহকর্মীদের পাথরের চোখ আমার দিকে অবাক হয়ে আছে। সবাই যেন নিঃশব্দে খুব ভয়ংকর কিছু একটার জন্য অপেক্ষা করছে। কোকাকোলার ঠাণ্ডা গ্লাসের গায়ে বিন্দু বিন্দু পানি জমার মতো। বস কঠিন মুখে মিটিং শেষ করে দিয়ে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলেন। কেউ আমার সাথে আর একটিও কথা বললো না। শুধু জারিফ সাহেব বললেন, এভাবে কথাগুলো বলতে গেলেন কেন ভাই? স্যার খুব ক্ষেপে গেছেন। সব সত্য কথা সবসময় বলতে হয় না।

দুরু দুরু বুকে ডেস্কে ফিরে এলাম। ভেবেছিলাম বস ডেকে পাঠাবে। কিংবা কাউকে দিয়ে হয়ত ইস্তফা পত্র ধরিয়ে দেবে। কিন্তু এখনো তেমন কিছু হলো না দেখে পাঁচটা বাজতেই কোনো রকমে তাড়াহুড়ো করে সব গুছিয়ে অফিস থেকে রীতিমত পালিয়ে এলাম।

'কি হয়েছে তোমার? সকাল থেকেই দেখছি কেমন মনমরা।'
রাতে বিছানায় শুয়ে কণিকার কথায় ভীষণ বিরক্ত লাগে। কেমন ন্যাকা ন্যাকা কথা। এই মেয়েটা আগে থেকেই এমন। দিন দিন যেন আরো বাচ্চা হচ্ছে।
'কিছু না।'
'বলো না। নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে।'
মেয়েটা একটা বেহায়া। আমি যে বিরক্ত হচ্ছি সেটাও ধরতে পারছে না নাকি? কেমন আদুরে গলায় হ্যাবলামি করছে।
'আচ্ছা থাক, বলা লাগবে না।'
কণিকা কপট রাগের ভান করে কিছুটা সরে যায়। ঠিকমত রাগটাও করতে পারে না। ধরা পড়ে যায়। আমি এর সাথে বাস করছি কিভাবে। মাথামোটা বোকা মেয়ে।

ভেবেছিলাম আবার জিজ্ঞেস করলে একটা রামধমক দেবো। কিন্তু না, আর কোনো কথা ভেসে আসে না। বরং ঘরের মধ্যে একটা শীতল নৈঃশব্দ নেমে আসে যা আমাকে দুপুরের মিটিং-এর কথা মনে করিয়ে দেয়। কী ভয়ানক পরিস্থিতিটাই না ছিলো সেটা। কিন্তু যখন মনে পড়ে- ওটা অতীতেই রয়ে গেছে, এখানে আশেপাশে কোনো বস নেই, শুধু কণিকা রাগের ভান করে শুয়ে আছে পাশে, মনে কিছুটা স্বস্তি আসে। নাহ, মেয়েটা তো অন্যায় কিছু করেনি। আমার মন খারাপের কারণটা শুধু জানতে চেয়েছে। ভেবে একটা অপরাধবোধ মেশানো মায়ার মত হয়।

'আসলে কিভাবে বলবো বুঝতে পারছি না।'
'কি হয়েছে, বলো।' কণিকা সাথে সাথেই আবার কাছে ঘেঁষে আসে। মেয়েটা বেহায়া আছে। এই ঝামেলার মাঝেও আমার হাসি পায়।
'মানে... আমার অন্ধকারটা... কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। সকালে উঠে দেখি- যেখানে থাকার কথা সেখানে নাই।'
'কিসের অন্ধকার?'
কণিকা এমন একটা আহ্লাদী ভাব করে জিজ্ঞেস করছে যেন বুঝতেই পারছে না কিছু। আমার মেজাজটা আবার বিগড়ে যাবার উপক্রম হয়। কিন্তু ওর চুপচাপ চোখের দিকে তাকিয়ে থেমে যেতে হয়। অন্ধকার মেখে খুব সুন্দর করে মিথ্যে বলা যায়। ধরা পড়ার উপায় নেই। কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছে কনিকা মিথ্যে বলছে না। ও কি তাহলে আসলেই জানে না? কিন্তু তা কি করে হয়?

আমাকে চিন্তা করতে দেখে সে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। বেচারী যেন কিছুই বুঝতে পারছে না। সেই মুহূর্তে ওকে ভীষণ বোকা বোকা লাগে। তা দেখে আগেকার দিনের কথা মনে পড়ে যায় আমার। কণিকার এই বোকাটে দৃষ্টিটাই আমাকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করেছিলো। সেসব কতদিন আগের কথা। সুদূর অতীতের মতো লাগে। অনেকদিন পর সেইসব হারিয়ে যাওয়া পুরনো দিনের মত ভালো লাগে ওকে দেখে। কী সব দিন ছিলো সেসব। ইচ্ছে হলে হাসতাম, রাগ করতাম, ঝগড়া; এমনকি মারপিটও করেছি। তখন মুখে আলাদা প্রলেপ মেখে চলতে হতো না। হবে কিভাবে? অন্ধকারটা তো তখনো এতোটা পোষ মানেনি।

'বললে না কিসের অন্ধকার?'
কণিকা তার মোলায়েম দৃষ্টি মেলে বসে থাকে। ওর ভোর ভোর চোখের দিকে তাকিয়ে একটা অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করে আমার। বহু দিন পর এই মেয়েটাকে আমার ভালোবাসতে ইচ্ছে হয়। সত্যিকারের ভালোবাসা। যেখানে স্রোত-ফ্রোতের কোনো ব্যাপার নেই। শুধু বুকের একেবারে ভেতরের কুঠুরিতে একটানা মরে যাবার মতো অনুভূতি হবে। একটা ছায়া ছায়া দুপুরঘোরে আমার চোখ জড়িয়ে আসে।
'কিছু না। বাদ দাও। তোমাকে ভীষণ মায়া লাগছে।'
মেয়েটা লজ্জা পেলে একটা সবুজ টিয়াপাখির মতো হয়ে যায়।

কিছুক্ষণ পর ফোনটা যখন তার তীব্র আলো জ্বেলে বেজে উঠলো, কণিকা তখনো আমার বুকের উপর ক্লান্ত মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। মোবাইলের স্ক্রীনে বসের নাম্বার। সাথে সাথেই আমার একটু আগের শান্ত, নীরব আর সুখী রাতটা জানালার কাঁচের মতো ঝন ঝন শব্দে ভেঙ্গে পড়লো। প্রথমে সংকোচ ও পরে বিরক্তি চেপে ধরলো। দিনের ঝামেলাগুলোর কথা তো আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। আবার বুঝি ফিরে এলো। বস শালার ফ্রিজের ভেতর খাবার-দাবার কিছু নেই বোধহয়। তাই এই রাতের বেলা চাকরি খাওয়ার শখ জেগেছে।

'জ্বি স্যার'
'ঘুমাচ্ছিলে?' ফোনের ভেতর থেকে গম গম শব্দ উঠলো। যেন কোনো জলহস্তী পানিতে পড়ে গেছে।
'না স্যার। মাত্র শুয়েছিলাম...'
'মনসুর, আজকে যা করলে, তোমার কাছ থেকে আমি এটা আশা করিনি।'
'সরি স্যার। আসলে... আজকে হয়েছে কী...'
'গুড জব।'
প্রথমে ভাবলাম ভুল শুনেছি। কিন্তু তারপরেই যে কথাটা প্রথম মাথায় এলো, শালা মদ-টদ খেয়ে মাতাল হয়ে ফোন করেনি তো?
'বুঝলে মনসুর, আমি সারাদিন তোমার কথাগুলো নিয়ে ভাবলাম। তোমার কথাগুলো একেবারে ফেলে দেয়ার মতো না। ইউ হ্যাভ ভ্যালিড পয়েন্টস। এটা আসলেই অনেকটা ঝোঁকের বশে নেয়া প্রজেক্ট। তাছাড়া কোম্পানীর ...'

ফোনটা যখন নামিয়ে রাখলাম তখনো কানের ভেতর শয়ে শয়ে ঝিঁঝিঁ পোকা ডেকে যাচ্ছে। কণিকা ঘুম জড়ানো ভারী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো- কে ফোন করেছে এতো রাতে?
'বস'
'কোনো সমস্যা?'
'তেমন কিছু না। আমার প্রমোশন হয়েছে- এটা বলতে।' নির্জীব গলায় বলে চলি আমি।
'এতো রাতে প্রমোশন? তোমরা কি সবাইই পাগল? তবে আমাদের উচিৎ এটা সেলিব্রেট করা।'

যদিও কণিকার কণ্ঠে খুশির চেয়ে ঘুমের অংশটাই বেশি মনে হলো। এরপর আবার সব চুপচাপ। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ওকে ডাকলাম। কোনো উত্তর নেই। ঘুমিয়ে পড়েছে নিশ্চয়ই। কিন্তু আমার ঘুম চটে গেছে। এখন আর সহজে আসবে না। ধীরে ধীরে একটা টগবগে ভালো লাগা ফুটতে শুরু করেছে। বারান্দায় গিয়ে সিগারেট জ্বালালাম। কোথাও থেকে একটা একটা নির্মল আনন্দ এসে তার নরম ডানায় চেপে সারা ঘরময় উড়ে বেড়াচ্ছে যেন। নানা রকমের ভবঘুরে ভবিষ্যৎ চিন্তা মাথার মধ্যে দোলনা খেলতে শুরু করেছে। সেগুলো ভাবতে ভাবতেই মুখের কোণে নিজের অজান্তেই একটা মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠলো। জীবনটাকে সেই মুহূর্তে নিজের কাছে বেশ ভালো লাগে।

ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে সারাদিনের ব্যাপারগুলো মনে পড়ে যায় আমার। এসবের কি সত্যিই খুব প্রয়োজন? মুখে নানারকম রঙ মেখে সঙ সেজে থাকা? অহেতুক হুড়োহুড়ি, প্রতিযোগিতা, অভিনয়, অন্ধকার? এই যে অন্ধকারকে পুষে ভাবছি খুব জিতে যাচ্ছি- আসলেই কি তাই? অন্ধকারকে কি সত্যিই পোষ মানানো যায় কখনো? নাকি তা করতে গিয়ে নিজেই হয়ে উঠছি ক্রমশ ব্যবহৃত, জীর্ণ আর ঝাপসা একজন। আসলে আমরা কে কাকে পুষছি? সবচেয়ে ভয়ংকর উত্তরটাই কি তবে সবচেয়ে সত্য?

কোথায় যেন পড়েছিলাম- ইংরেজীতে 'মাইন্ড সাকারস' বলে এক ধরণের পরজীবী আছে যাদের আক্রমণে পোষকের নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি নষ্ট হয়ে যায়। পোষকের শরীর আশ্রয় করেই পরজীবী দখল করে নেয় তার মস্তিষ্ক। পোষক তখন পরজীবীর নির্দেশমতো চলে, চলতে বাধ্য হয় আসলে। আর ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় এক দুর্ভাগ্যপীড়িত অসহায় মৃত্যুর দিকে। শিউরে ওঠার মতো ভয়াবহ ব্যাপার। জলাতঙ্কতেও নাকি এটাই হয়।

'নাহ', শীতল বাতাসে মনে মনে দৃঢ়তার সাথে মাথা ঝাঁকাই।
'ঐ ব্যাটাকে ছাড়াই দিব্যি ভালো থাকা যায়। সহজ থাকা যায়। যা হওয়ার ভালোই হয়েছে। শুধু শুধু...'

ঠিক তখনি কোথাও একটা কুকুর ডেকে ওঠাতেই হোক কিংবা বারান্দা থেকে কিছুটা দূরে চোখ আটকে যাওয়াতেই হোক- থেমে যাই। একটা অস্পষ্ট নড়াচড়া। রাতের জমাট ধোঁয়াশায় কিছুই পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। তবু ল্যাম্পপোস্টের আবছা আলোয় সরু চোখে অপেক্ষা করতে করতে মনের ভেতর নিঃশব্দে এক হাঁটু জল জমে যাওয়ার মতো অনুভূতি হয়।

পৃথিবীর অখণ্ড আঁধারের শরীরে পা টিপে টিপে কেউ যেন ঠিক এদিকেই এগিয়ে আসছে। এক টুকরো পরিচিত আর পৃথক অন্ধকার।



সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ রাত ১০:৫২
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

সিকান্দার রাজার চেয়ে একজন পতিতাও ভালো।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৭

সিকান্দার রাজা কোকের বোতল সামনে থেকে সরিয়ে রাতারাতি হিরো বনে গেছেন! কিন্তু তাকে যারা হিরো বানিয়েছেন, তারা কেউ দেখছেন না তিনি কত বড় নেমকহারামি করেছেন। তারা নিজেদেরকে ধার্মিক বলে দাবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৫৬

...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ অন্তর্জাল।

ছোটবেলায় মুরব্বিদের মুখে শোনা গুরুত্বপূর্ণ অনেক ছড়া কবিতার মত নিচের এই লাইন দুইটাকে আজও অনেক প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×