[আল্লামা আমীন সফদরের সাথে লা-মাযহাবীদের এক ঐতিহাসিক ঘটনা
একবার ডা. জাকির নায়েকের ভক্ত দশ-বার জন জেনারেল শিক্ষিত পাকিস্তানের বিখ্যাত আলেম আল্লামা আমীন সফদরের নিকট এসে বললেন: হযরত আমরা সবাই বহুত বড় মসিবত ও টেনশনে ভুগছি, আপনার নিকট তা পেশ করতে চাই।
আল্লামা আমীন সফদর বললেন : আল্লাহ আপনাদের সহায় হোন। আপনারা কিসের টেনশনে ভুগছেন? তারা বললো : হযরত মাযহাব চারটি হলো কেন? চার মাযহাব নিয়েই আমরা বড় পেরেশান।
হযরত বললেন: ভাই কোথায় দেখছেন চার মাযহাব? আমিতো যেদিকে তাকাই মাযহাব শুধু একটাই দেখতে পাই। (হানাফী মাযহাব)
তারা বললো: আমাদের এদেশে একাধিক মাযহাব না থাকলেও বিভিন্ন দেশে তো আছে।
হযরত বললেন: তাহলে তো টেনশন তাদেরই থাকার কথা, যাদের দেশে মাযহাব চারটি রয়েছে। বলুন-আপনাদের কিসের টেনশন?
তারা বললো : আচ্ছা! হযরত বলুনতো, আসলে মাযহাব চারটি হলো কেন? আল্লাহ, রাসূল তো এক।
হযরত বললেন: ভাই, মাযহাবতো আমরা বানাইনি; বরং ইসলামের শুরুলগ্ন থেকেই একাধিক মাযহাব চলে আসছে। এতে কারো কোনো সমস্যা তো হয়নি। তবে আপনাদের মতো আধুনিক চিন্তাধারার অধিকারী যারা, তারা নিজেরা গবেষণার ভিত্তিতে এব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন হয়তো?
তারা বললো : জী, হ্যাঁ। আমরা এ সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি যে, কোনো মাযহাবই মানা যাবে না। মাযহাব সবগুলো ছেড়ে দিতে হবে। কারণ মাযহাবই সব ঝগড়ার মূল।
হযরত বললেন: না, না, ভাই জলদি করবেন না; একটু থামুন। এক কাজ করুন, মাযহাব ছাড়ার পূর্বে প্রথমে কুরআনকে ছেড়ে দিন। কারণ কুরআন সাত ক্বিরাতে পড়া হয়। ক্বিরাতের ইমাম সাতজন ও কুরআন তিলাওয়াতের ক্ষেত্রে পরস্পর মতভিন্নতাও রয়েছে। মাযহাব চারটি হওয়ার কারণে যদি মাযহাব ছাড়তে হয়, কুরআনের ক্বিরাত তো সাতটি তাই এটা আগেই ছেড়ে দিন। তখন কাজটি যেমন বড়, আপনাদের নামটিও হবে বড়। অতপর একই কারণে আপনারা ছয়টি হাদীসের কিতাবও ছেড়ে দিতে হবে। কারণ হাদীসের কিতাবও ছয়টি। পরস্পর হাদীসের মাঝে বিরোধও রয়েছে। মাযহাবতো শুধু চারটি। কুরআনের ক্বারীর সংখ্যা সাতজন। হাদীসের কিতাবের সংখ্যা ছয়টি। তাই প্রথমে সাত, ছয়কে ছেড়ে দিন। তারপর মাযহাবকে ছাড়বেন, আর কি। এতক্ষণে তারা জবাব পেয়ে খামুশ হয়ে গেলো।
তাদের মধ্যে একজন জেন্টলম্যান এগিয়ে এসে হযরতকে জিজ্ঞাসা করলেন: তাহলে বলুন, মাযহাব চারটিই কি হক? না-কি একটি হক অন্যগুলো বাতিল?
হযরত বললেন: হ্যাঁ, চারও মাযহাব হক। যে কোনো এক মাযহাব মেনে চললেই আল্লাহকে পাওয়া যাবে।
তারা বললো : তাহলে আপনি একটি মাযহাব ছাড়া অবশিষ্ট মাযহাবগুলো মেনে চলেন না কেন? সবগুলো হক হলেতো সবই মানার কথা।
হযরত উত্তরে বললেন: মাযহাব চারটি হওয়ায় আপনাদের এত দুঃখ কেন? বলুনতো, নবী রাসূলগণের সংখ্যা প্রায় ১লক্ষ চব্বিশ হাজার। আপনাদের আকীদামত সকলেই হক কি-না?
তারা বললো : হ্যাঁ, সব নবী রাসূলগণই তো হক। এ ব্যাপারে কোন দ্বিমত নেই,অবশ্যই হক।
হযরত বললেন: তাহলে আপনাদের করণীয় হলো, সব নবীকে মেনে শুক্রবারে জুমা আদায় করবেন মসজিদে গিয়ে। শনিবারে ইহুদিদের ইবাদাতখানায়। আর রবিবারে যাবেন খৃস্টানদের গীর্জায়। কারণ মূসা আ. ও ঈসা আ. তো হক। আসলে আপনারা এ রকম করেন কী?
তারা বললো : না, এরকম তো করি না। আমরা মুসলমান শুধু শুক্রবারে মসজিদে যাই জুমার নামাজ আদায় করতে। ইয়াহুদী, খ্রিষ্টানদের গির্জায় যাই না।
হযরত বললেন: তাহলে আপনারাই জবাব দিন, সব নবীকে হক মানা সত্ত্বেও শুধু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অনুকরণ করেন কেন? এ ব্যাপারে আপনাদের যেমন জবাব, সে ব্যাপারে আমাদেরও তেমন জবাব।
তারা বললো : নবী রাসূলের ক্ষেত্রেও তা রহিত হওয়া এবং না হওয়ার ব্যাপারটি আছে। অর্থাৎ অতীত নবীদের শরীয়ত রহিত, তাই অনুকরণ করা যায় না।
হযরত বললেন: যদি নবীদের ক্ষেত্রে শরীয়ত রহিত হওয়ার বিষয় থাকে মাযহাবের ক্ষেত্রে راجح مرجوح প্রাধান্যতা ও অপ্রাধন্যতার বিষয়ও জড়িত আছে। অর্থাৎ হানাফী মাযহাবের সিদ্ধান্তবলি অন্য সব মাযহাবের তুলনায় অগ্রগণ্য বলেই আমরা হানাফী। আবার শাফেয়ীদের নিকট শাফেয়ী মাযহাবের সিদ্ধান্তবলির প্রাধান্যতা বেশি, তাই তারা শাফেয়ী। আমাদের দৃষ্টিতে অন্য মাযহাবের সিদ্ধান্তগুলো অগ্রগণ্য নয়, বিধায় তার অনুকরণ আমরা করি না। অন্যান্য মাযহাবের লোকদের নিকট হানাফীদের সিদ্ধান্তবলি অগ্রগণ্য নয় বলে, তারা হানাফী মাযহাবকে অনুকরণ করে না। তবে আমরা সব মাযহাবকেই হক মনে করি এবং শ্রদ্ধা করি।
অতপর তারা বললো : মাযহাব যদি সবগুলোই হক হয়ে থাকে, তাহলে মাযহাবগুলোর পরস্পর জায়েয না জায়েয বা হালাল হারামের মতানৈক্য হলো কেন?
হযরত বললেন : যে কারণে সব নবী রাসূল হক হওয়া সত্ত্বেও তাদের শরীয়তের মধ্যে পরস্পর হালাল ও হারামের মতানৈক্য ছিলো, ঠিক একই কারণে চার মাযহাবের মধ্যে পরস্পর হালাল ও হারামের মতানৈক্য রয়েছে। আদম আ. এর শরীয়তে ভাই বোনের মধ্যে বিবাহ হালাল ছিলো, পরে তা হারাম সাব্যস্ত হলো। ইউসুফ আ. এর যামানায় সম্মানী সিজদা বৈধ ছিলো, আমাদের নবীর শরীয়তে তা অবৈধ বলে সাব্যস্ত হলো ইত্যাদি।
তারা বললো : বিভিন্ন নবী-রাসূলের সময়ের মধ্যে পার্থক্য ছিল, তাই হালাল হারামের ব্যাপারেও মতভেদ হয়েছে; কিন্তু মাযহাব?
হযরত বললেন : ওখানে যামানার বেশ-কম ছিল, এখানে এলাকা-স্থানের পার্থক্য রয়েছে। ওখানে শরীয়তের পার্থক্য ছিল, এখানে হাদীসের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে, তাই মতানৈক্য হয়েছে। তবে সকল মাযহাব আকীদার ব্যাপারে এক ও অভিন্ন। যেমন নবী রাসূলগণের মধ্যে বিধি-নিষেধের ব্যাপারে মতানৈক্য থাকলেও আকীদার বিষয়ে তারা সবাই ছিলেন এক ও অভিন্ন। আর মাযহাবের সকল ইমামই নবী রাসূলগণের উত্তরাধিকারী। তাদের মধ্যে যা নিয়ে ঐক্য ও যে ক্ষেত্রে মতানৈক্য, ইমামগণের নিকটও সেক্ষেত্রে ঐক্য অন্যক্ষেত্রে মতানৈক্য।
অতপর তারা আরেকটি প্রশ্নের অবতারণা করে বললো: মাযহাবই যদি মানতে হয় তাহলে মক্কী বা মাদানী মাযহাব মানবো। কারণ, কুরআন নাযিল হয়েছে মক্কা ও মদীনায়। কূফায়তো আসেনি, তাহলে মদীনার ইমাম ও মাযহাবকে অনুকরণ করাই যুক্তিযুক্ত। কুফার ইমাম (আবু হানীফা) কে মানব কেন?
জবাবে হযরত বললেন: কুরআনের সাত ক্বারীর মধ্যে মক্কা-মদীনার ক্বারীও তো ছিল। আপনারা ও আমরা সকলেই আছেম কূফীর ক্বিরাত অনুসরণ করি কেন? এই প্রশ্নের যেই জবাব ওই প্রশ্নের সেই জবাব।
লা-মাযহাবী ভাইয়েরা শেষ প্রশ্নটি করলেন: ইমাম আছেম তো কুরআনের পাঠ্যনীতি মনগড়াভাবে বানাননি; বরং সাহবারা যখন কূফায় আসেন তখন তারা মক্কা ও মদীনা থেকে কুরআনকে কূফায় নিয়ে এসে ছিলেন। তাই আছেম কূফীর ক্বিরাত অনুযায়ী আমরা সবাই কুরআন পড়ি।
হযরত বললেন: বলুুনতো, সাহাবায়ে কেরাম যখন মদীনা থেকে কুরআন নিয়ে কুফায় এসেছিলেন তখন নামাযকে মদীনায় ছেড়ে এসেছিলেন? না-কি নামাযও সাথে করে কূফায় নিয়ে এসেছিলেন?
তারা বললো : হ্যাঁ নামাযও তো কূফায় নিয়ে এসেছিলেন।
হযরত বললেন: মাশাআল্লাহ! আপনারা যখন কূফার ইমামের উপর কুরআনের ক্বিরাতের ব্যাপারে আস্থা রাখতে পারলেন, তাহলে নামাযের ব্যাপারে তাদের উপর আস্থা রাখতে অসুবিধা কোথায়? আলহামদুলিল্লাহ! আমরা উভয় ব্যাপারেই কূফার ইমামদের উপর আস্থাশীল। কুরআন পড়ি আছেম কূফীর অনুসরণে। আর নামায পড়ি আবূ হানীফা কূফীর অনুকরণে।
লা-মাযহাবী ডা. জাকির নায়েকের দোসরগণ এতক্ষণে খামুশ ও পরাজয়বরণ করতে বাধ্য হলেন। (আল্লাহ সকলকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমীন)
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই মার্চ, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:৫৪