প্রিয় মাশরাফি ভাই,
কেমন আছেন? আগামীকাল গেইলদের সাথে বিগ ম্যাচ। আমরা দেশের ১৬ কোটি মানুষ অধীর হয়ে অপেক্ষা করছি। আপনি ম্যাচের প্রথম বল করলেন। ডুইন স্মিথ ব্যাকফুটে খেলতে গিয়ে লাইন মিস করলেন। বোল্ড! আপনার সেই আঙ্গুল উঁচিয়ে আস্ফালন। গর্জে উঠলো পুরো মাঠ। গত কয়েকদিন ধরে এই স্বপ্ন-দৃশ্য কল্পনা করেই দিন কেটে যাচ্ছে। কিন্তু একটু আগে টেলিভিশনের খবরে জানতে পারলাম, আপনি ভালো বোধ করছেন না। আপনার পেটের সাইডে সেই ব্যাথাটা নাকি আবার বেড়েছে। ফুসফুসে পানি জমেছে সেটা আগেই জানতাম। শুনেই মনটা প্রচন্ড খারাপ হয়ে গেলো। টিভি অফ করে দিলাম। আগামীকাল আদৌ কি আপনি খেলতে পারবেন?
জানি না, ঠিক এই মুহূর্তে আপনি মনে মনে কি ভাবছেন। যেখানে হয়তো আগামী ম্যাচে কিভাবে বল করবেন সেটা ভাবতেন, সেখানে ভাবছেন আদৌ খেলতেই পারবেন কিনা।
সেই ২০০০ সাল থেকে আপনার খেলার সাথে পরিচয়। সবাই হয়তো আপনার ২০০১ সালে জিম্বাবুয়ের সাথে টেস্ট সিরিজ দিয়ে আপনাকে চিনেছে। আমি চিনেছি ২০০০ এর শেষের দিকেই। কোন এক আন্ডার-১৯ ম্যাচে (সম্ভবত ভারতের সাথে) আপনি ১৪ বলে অপরাজিত ৬০ রান করেছিলেন। পরের দিন প্রথম আলো পত্রিকায় আপনার ছবি এসেছিল। ব্যাট উঁচিয়ে অভিবাদনের জবাব দিচ্ছিলেন। সেদিনই জানলাম, আপনি ফাস্ট বোলিং করেন। বলে প্রচন্ড স্পিড। কৌতুহল জাগলো। আমাদের দেশে ফাস্ট বোলার! ঠিক তার পরের বছরই আপনার অভিষেক হলো জিম্বাবুয়ের সঙ্গে। অভিষেকেই কি দারুণ বোলিং করলেন! আপনাকে নিয়ে আমরা স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম। দেশের মানুষ আপনার নাম দিল "নড়াইল এক্সপ্রেস।"
সে বছরই নিউজিল্যান্ড সফরে গিয়েই ইনজুরিতে পড়লেন। সেই যে শুরু হলো। ইনজুরি আপনাকে ছাড়লো না। আজ এই ১৩ বছর পরে এসেও ইনজুরির সাথে আপনাকে লড়াই করতে হচ্ছে। কি অসম্ভব প্রাণশক্তি নিয়েই না একেকবার ফিরে এসেছেন আপনি! আমরাও নতুন করে স্বপ্ন দেখতে চেয়েছি আপনাকে ঘিরে। কিন্তু নিষ্ঠুর ভাগ্যটাও যে আপনার সাথে একেবারেই নেই।
পেপারে আপনার একেকটা সাক্ষাৎকার পড়ি। আপনার একেকটা কলাম পড়ি। চোখের পানি ধরে রাখতে পারি না। প্রতি ম্যাচে খেলতে নামার আগে আপনাকে ব্যাথানাশক ইনজেকশন নিতে হয়। হাঁটুতে জমে থাকা তরল বিশাল ইনজেকশন দিয়ে টেনে বের করতে হয়। যন্ত্রনায় আপনি কাতরাতে থাকেন। হাঁটুর লিগামেন্ট ছিঁড়ে গেছে। অ্যাজমার সমস্যায় ভুগছেন। ফুসফুসে পানি জমেছে। সাইড স্ট্রেইনের ব্যাথা এখনো কমে নি। সেই সাথে আফগানিস্তানের সাথে ডাইভ দিয়ে রান বাঁচাতে পরে গিয়ে পাওয়া বুকের ব্যাথা তো আছেই। পেপারে এগুলো পড়ি। টিভিতে দেখি। শুনি। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পরতে থাকে। আপনার সেই কথাটা মনে পরে যায়, "দেশের জন্য খেলবো না, এটা আমি ভাবতেই পারি না।। দেশের জন্য খেলার নেশা ছাড়তে পারি না যে!"
আমরা হয়তো বিশ্ব ক্রিকেটে খুব একটা বড় শক্তি এখনো হয়ে উঠতে পারিনি। শক্তির দিক দিয়ে হয়তো আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে। কিন্তু আমরা বড় সৌভাগ্যবান এক জাতি। বাংলাদেশ দলটা বড় বেশি সৌভাগ্যবান। আমরা আপনার মত একজন খেলোয়াড় পেয়েছি। হয়তো ইনজুরি আপনার অনেক কিছুই কেড়ে নিয়েছে। কেড়ে নিয়েছে অজস্র সময়, অনন্ত সম্ভাবনা। ঠিকভাবে খেলে যেতে পারলে এতদিনে হয়তো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আপনার ৪০০/৫০০ উইকেট হয়ে যেত। কিন্তু কেড়ে নিতে পারে নি আপনার মাঠে নেমে শতভাগ ঢেলে দেওয়ার আকুতি।
কিন্তু আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, আপনার এখন সময় এসেছে নিজেকে নিয়ে নতুন করে ভাবার। নীরব-নির্জন কোন ঘরে বসে একাকী কিছুটা সময় নিজেকে দেওয়ার। জীবনে খেলাটাই কি সব? আপনার পরিবার আছে। মমতাময়ী স্ত্রী আছে। আছে ফুটফুটে সন্তান। আপনি এভাবে ইনজুরির সাথে ক্রমাগত যুদ্ধ করতে করতে আপনার শরীরটাকে কতটুকু নাজুক করে ফেলেছেন, সেটা হয়তো আপনি নিজেই জানেন না। এখনই যদি আপনার এত রকম সমস্যা হয়, কতটা ভয়ংকর ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে আপনার জন্য, সেটা কি কখনো ভেবে দেখেছেন? এভাবে ইনজুরিতে পরতে থাকলে কোন এক সময় আপনাকে পঙ্গুত্বও বরণ করতে হতে পারে। আরো নানান সমস্যা তো আছেই। তখন কি হবে আপনার পরিবারের, একটুও কি ভেবেছেন?
হয়তো এসব আপনার মাথায়ই কখনো আসে নি। আপনি তো "পাগলা।" খেলার জন্য আপনি কতটাই না পাগল! এতকিছুর পরেও, এত বাঁধা-বিপত্তির পরেও। এভাবে বারবার আঘাত পেয়ে মাঠের বাইরে চলে গিয়ে ব্যাথায় কাতরাতে হয়তো আপনি অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। আমরা এখনো পারি নি। আমাদের আপনার জন্য কষ্ট হয়। মন খারাপ হয়। বুকের মধ্যে দলা পাকিয়ে কান্না আসে। আপনাকে হয়তো বলে বুঝাতে পারবো না। সব অনুভূতি প্রকাশ করা যায় না।
আমি ক্রিকেটের সাথে সংশ্লিষ্ট কেউ নই। শখ করে একসময় খেলতাম। এখনো সময় পেলে খেলি। আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে আপনাকে আমি কতগুলো পরামর্শ দিতে চাই। জানি না, আপনার কাছে আমার এই পরামর্শ কেমন লাগবে। তারপরও আমি বলছি।
আমার মনে হয়, আপনার টেস্ট-ওয়ানডে থেকে অবসর নিয়ে শুধুই টি-২০ খেলা উচিৎ। আমার মনে হয় আপনার শরীর ওয়ানডে ক্রিকেটের চাপও আর নিতে পারছে না। গত দুইটি বিপিএল এ আপনি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কোনরকম ইনজুরি ছাড়া খেলতে পেরেছেন। কাজেই এই ফরম্যাটই আপনার জন্য এখন সবচেয়ে উপযোগী। একমাত্র তাহলেই আমরা আপনাকে আরো বেশ কিছুদিন বাংলাদেশের হয়ে একটানা খেলতে দেখতে পারবো। আর ব্যাটিং এ একটু মনোযোগ দিন। অনেকদিন ধরেই আপনার সেই ব্যাটিং আমরা দেখতে পাচ্ছি না।
আর যদি এতকিছুর পরেও ইনজুরি আপনাকে না ছাড়ে, তাহলে আপনি অবসর নিয়ে নিন। আমার কথায় মন খারাপ করলেন? এই কথাটা লিখতে আমার হাত অনেকবার কেঁপে উঠেছে। তারপরও লিখতে হলো। অবসর নিয়ে কি করবেন, এটাই তো ভাবছেন? ভাবছেন মাঠে আর খেলতে পারবেন না। তাতে কি হয়েছে? দেশকে দিতে হলে কি শুধু মাঠে খেলেই দিতে হবে? মাঠের বাইরে কাজ করেও তো দেওয়া যায়। আপনি একটা কোচিং কোর্স করে ফেলুন। বাংলাদেশ দলে পেস বোলিং কোচ হিসেবে আমি আপনাকে দেখতে চাই। রুবেল, আল-আমিন, তাসকিনদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ কেবলমাত্র আপনিই দিতে পারবেন। আপনিই পারবেন তাদেরকে উজ্জ্বীবিত করে তাদের সেরাটা বের করে আনতে। এজন্য আমি ওয়াসিম আকরামকে নিয়ে আসার কোন দরকার দেখছি না। সেই সাথে ড্রেসিং রুমেও আপনার উপস্থিতি উজ্জ্বীবিত করবে গোটা দলকে। আপনার কোচিং এ আল-আমিন অথবা তাসকিন যখন বিপক্ষ দলের ব্যাটসম্যানের স্ট্যাম্প উপড়ে ফেলবেন, সেই উইকেট হয়তো তাদের নামের পাশে লেখা হবে। পরোক্ষে এগুলো হবে আপনারই।
আপনি সারা দেশে পেসার খুঁজে আনার কাজ শুরু করতে পারেন। পেসার হান্ট করতে পারেন। বোর্ডের সহযোগিতা নিয়ে সারা দেশ খুঁজে পেস বোলার বের করে আনতে পারেন। এ কাজটা আপনার চেয়ে ভালো কেউ পারবে বলে মনে হয় না। যদি আপনার হাত ধরে ২ জন পেসারকেও আমরা পাই, সেটা কি আপনারই প্রাপ্তি হবে না? দেশের জন্য ঝাঁপিয়ে পরা হবে না?
আপনি একজন ফাইটার। দক্ষ মেন্টর। আপনাকে বাংলাদেশ ক্রিকেটের বড় দরকার। সেটা পূরণের জন্য মাঠে খেলাটাই একমাত্র উপায় নয়। মাঠের বাইরেও আপনি হতে পারেন একজন চ্যাম্পিয়ন। এবং আমার বিশ্বাস, আপনি পারবেন।
আপনাকে পারতে হবেই।
ইতি,
আপনার একজন ভক্ত