somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একজন নব্য অমলকান্তির গল্প

২১ শে জুলাই, ২০১০ দুপুর ১২:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর অমলকান্তির কথা মনে আছে? যে অমলকান্তি ক্ষান্ত বর্ষণ কাকডাকা বিকেলের সেই লাজুক রোদ্দুর হতে চেয়েছিল। তার বন্ধুরা কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ বা উকিল হয়েছিল। কিন্তু অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি। আজ, আমার দেখা এক অমলকান্তির কথা বলব। খুব বেশি কিছু না, তিনি শুধু ভালো মানুষ আর উচ্চশিক্ষিত হতে চেয়েছেন। কবিতার ছাপাখানার অমলকান্তির বলয় থেকে বেরোনো বাস্তবের অমলকান্তির চাওয়ার সঙ্গে প্রাপ্তির অমিল ঘটবে কি না তা ভবিষ্যত্ই জানে।
আজকের অমলকান্তির নাম এমরান হোসেন। তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় বহু দূরের এক দ্বীপ হাতিয়ার গণ-উন্নয়ন গ্রন্থাগারে। দেখি গভীর মনোযোগে খবরের কাগজে চোখ বোলাচ্ছেন। বেশ কথা জমল। কথার প্রসঙ্গ—দেশ, জাতিসত্তা, সংস্কৃতি, একটি অজপাড়া দ্বীপের অবহেলিত মানুষের দুঃখগাথা। হাতিয়ার দরিদ্র কিন্তু মেধাবীদের জন্য কিছু করার তাড়না তাঁর ভেতর। এলাকার সংস্কৃতির উন্নয়ন ঘটানোর জন্য কিছু একটা করতে হবে। কিন্তু কী করবেন তিনি একা? কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া আইলায় দুর্গতদের জন্য আরও ত্রাণ কিংবা সাহায্য কীভাবে ব্যবস্থা করা যায়। প্রয়োজনে তাদের ঘর তুলে দিতে নিজের কাঁধে বাঁশ-কাঠ তুলে নিতেও রাজি ছিলেন এমরান। কিন্তু সাধ আর সাধ্যের মধ্যে যে বিশাল ফারাক তাও জানা ছিল তাঁর। তাই সম্ভব হলো না অনেক কিছু। প্রসঙ্গ পাল্টে এমরানের নিজের কথা জানতে চাই। ভীষণ অবাক হতে হলো তাঁর গল্প শুনে।
এ বছর উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছেন এমরান। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের অপেক্ষা। বাবার একটা ছোট্ট চায়ের দোকান ছিল। একসময় এমরানের নিত্যসঙ্গী ছিল চা, চিনি, চা পাতা, চামচ—এসব। বাবার সঙ্গে দোকানে চা বিক্রি করতেন। চায়ের টুংটাং আওয়াজ শুনতে শুনতে আকার আর বয়সের সঙ্গে বাড়তে থাকে তাঁর স্বপ্ন। কেবল নিজের চেষ্টায়, মায়ের সম্মতি আর বাবার অনুরাগে এমরান প্রাথমিক, মাধ্যমিক পাড়ি দিয়ে কলেজটাও পাড়ি দিলেন।
কোনো এক মফস্বলের চায়ের দোকান থেকে কত আয়ই বা হতো? এমরান স্কুলজীবন থেকে তাই বেছে নিলেন টিউশন। প্রতিদিনই রাত করে ফিরতে হতো বাড়িতে। অন্যের বাচ্চাদের পড়িয়ে তবেই তো নিজের পড়া। যা আয় হতো তা দিয়ে নিজের ভরণপোষণ, পড়ালেখার খরচ চালাত। সেই সামান্য আয়ের কিছু অংশ পরিবারেও দিতে হতো তাকে। একসময় বেশ জমিজমা ছিল। কিন্তু মেঘনা নদী অন্য অনেকের মতো তাদেরও সর্বস্বান্ত করে দিয়ে গেছে। এখন আর কিছুই নেই। থাকার জায়গাটুকুও না। এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের দেওয়া সামান্য এক টুকরা জায়গায় এমরানদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। তাও নদীর অন্য পারে। কিছুদিনের মধ্যেই এমরানদের হাতিয়া ছাড়তে হবে। তারপর কী হবে? কথায় কথায় এমরানের চোখের কোণে জল চিকচিক করে। সবে উচ্চমাধ্যমিক পাস করলেন। ভর্তি হতে হবে শহরের কোনো ভালো প্রতিষ্ঠানে। তাঁর যে অনেক কিছু করতে হবে, বড় হতে হবে। এমরানের ইচ্ছে, ঢাকা অথবা চট্টগ্রামের কোথাও ভর্তি হওয়ার। কিন্তু এমরান হতাশ। কেননা তাঁর এমন কেউ নেই যে তাঁকে সাময়িক আশ্রয় দেবে, সাহায্যের হাত বাড়াবে। কী করবেন তাহলে তিনি? আক্ষেপের সুরে এমরান জানান, ‘একজন সামান্য চায়ের দোকানদারের ছেলের কে-ই বা থাকবে? এলাকায় থাকতে কিছু ছাত্র পড়াতাম, যা-ই পেতাম তাতেই নিজের কোনোমতে চলত। এখন বাইরে গেলে কেমনে চলমু, কই যামু।’ বলতে বলতে ভেঙে পড়েন এমরান।
তাঁর সঙ্গে যেখানে বসে এসব কথা হচ্ছিল সেই গণ-উন্নয়ন গ্রন্থাগারের সমন্বয়কারী মো. নুর উদ্দিন বললেন, ‘এমরান প্রতিদিন বাড়ি থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার সাইকেলে চেপে কলেজ করত, গ্রন্থাগারে আসত। পড়ালেখার প্রতি ওর আগ্রহ বেশ অবাক করার মতো। কিন্তু দারিদ্র্য তার সামনে প্রধান বাধা এখন।’ এমরানের সহজ স্বীকারোক্তি, বই কিনতে পারতেন না বলেই গ্রন্থাগারে প্রতিদিন পড়ে থাকতেন। কিন্তু এখন তাঁর কী হবে? অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সামনে পথ চলতে হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় দ্রুত এগিয়ে আসছে। কিন্তু এখনো স্থির হতে পারেননি অর্থ আর আবাসন-সংকট কীভাবে মোকাবিলা করবেন।
যে যুবক অন্য অনেকের জন্য কিছু করতে চান কিংবা করে বেড়ান তাঁর নিজের বেলায়ই তিনি ব্যর্থ! প্রশ্ন করি নিজেকে, কে ব্যর্থ, এমরান ব্যর্থ নাকি আমরা? সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘প্রিয়তমাসু’র শেষ কটা লাইন মনে পড়ল, ‘আমি যেন সেই বাতিওয়ালা, সে সন্ধ্যায় রাজপথে-পথে বাতি জ্বালিয়ে ফেরে/অথচ নিজের ঘরে নেই বাতি জ্বালার সামর্থ্য/নিজের ঘরেই জমে থাকে দুঃসহ অন্ধকার’। এমরানেরও তা-ই হলো। একসময় প্রতিদিন টিউশন করে বাড়ি ফিরতেন। অন্যের সন্তানের কাছে আলো বিলাতেন। আর এখন নিজেই আলোহীন হয়ে আছেন, আলোকিত হওয়ার অপেক্ষায়। তিনি জানেন না আদৌ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ হবে কি না, নাকি এখানেই থমকে যাবে পড়ালেখার পথ। এখন শুধু নীরব অপেক্ষা।
৭টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

রাজাকার হিসাবেই গর্ববোধ করবেন মুক্তিযোদ্ধা আখতারুজ্জামান !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:১৮


একজন রাজাকার চিরকাল রাজাকার কিন্তু একবার মুক্তিযোদ্ধা আজীবন মুক্তিযোদ্ধা নয় - হুমায়ুন আজাদের ভবিষ্যৎ বাণী সত্যি হতে চলেছে। বিএনপি থেকে ৫ বার বহিস্কৃত নেতা মেজর আখতারুজ্জামান। আপাদমস্তক টাউট বাটপার একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশে কোন প্রজন্ম সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত? ১৯৭১ থেকে একটি সংক্ষিপ্ত ভাবনা

লিখেছেন মুনতাসির, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৮:৪৩

বাংলাদেশে দুর্নীতির প্রশ্নটি প্রায়ই ব্যক্তি বা দলের দিকে ছুড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু একটু গভীরে গেলে দেখা যায়, এটি অনেক বেশি প্রজন্মভিত্তিক রাজনৈতিক - অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত। ১৯৭১ এর পর... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাঁদগাজীর মত শিম্পাঞ্জিদের পোস্টে আটকে থাকবেন নাকি মাথাটা খাটাবেন?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৫৭


ধরুন ব্লগে ঢুকে আপনি দেখলেন, আপনার পোস্টে মন্তব্যকারীর নামের মধ্যে "জেন একাত্তর" ওরফে চাঁদগাজীর নাম দেখাচ্ছে। মুহূর্তেই আপনার দাঁত-মুখ শক্ত হয়ে গেল। তার মন্তব্য পড়ার আগেই আপনার মস্তিষ্ক সংকেত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টি দিল্লী থেকে।

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:১৫


((গত ১১ ডিসেম্বর ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টির ইতিবৃত্ত ১ শিরোনামে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। সেটা নাকি ব্লগ রুলসের ধারা ৩ঘ. violation হয়েছে। ধারা ৩ঘ. এ বলা আছে "যেকোন ধরণের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৩



৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

×