মোটর সাইকেলে ওঠা আমার মা একদম পছন্দ করে না। কখনো মোটর সাইকেল চালাবো একথা শুনে মা আৎকে ওঠে। মা যদি জানতো আমি এই অজো পাড়াগায়ে যার দুপাশে বিশাল খাদ, সেই রাস্তায় ঝুকি নিয়ে মোটর সাইকেলে চড়েছি তবে মায়ের প্রেসার হয়তো অনেক বেড়ে যাবে। আর যদি কোন এক্সিডেন্ট করে বাড়ী ফিরি তা হলে তো কোন কথাই নেই। ভাবতে ভাবতেই একটা বিশাল বাস প্রচন্ড শব্দে পাশ দিয়ে গেলো। মোটর সাইকেল চালক কোনমতে ঠিক রইল। প্রায় খাদে পড়ে যাচ্ছিলাম। বুঝতে পারছিনা, মা কি কঠিন দোয়া টোয়া চালাচ্ছে নাকি? যাক, মোটর সাইকেলের রাস্তা শেষ। চিন্তা নেই। মা, আমি আসছি। ভালোভাবেই ফিরছি অপোয় থাকো।
আমি আসার সময় মা কে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছিল। মায়ের চেহারায় দেখে তার মনের কথা বুঝতে পারছিলাম, এতো দূর যাচ্ছিস ভালোভাবে যেতে পারবিতো? এসব প্রশ্নে সব সময় আমার গা ছাড়া ভাব। আরে, আমার কাছে কোন সমস্যাই সমস্যা না।
আমি জানি, মা এতে আশ্বস্ত হতে পারেনী। আমি সব সময়ই এমন কথা বলি।
আমি যেখানে যাচ্ছি সেখানে পৌছাতে পৌছাতে মা পাঁচবার ফোন করে ফেলেছে, কিরে তুই কই?
মা আমি পদ্মার মাঝখানে
মানে?
মানে, কঠিন ঢেউয়ের উপর আছি মা। ফেরী দুলছে। মাকে আরো ভয় দেখাই।
মায়ের কথা আটকে আটকে যাচ্ছে। মায়ের টেনশন বাড়ছে দেখে আমার আরো ভীষন মজা লাগে। আবার কিছুক্ষণ পর মায়ের ফোন, কিরে তুই কই?
দুই.
আমি মোটর সাইকেল থেকে নামলাম। আমার সাথে আরেকজন আছে। জয়, আমার ভাই। বন্ধু। আরো অনেক কিছু।
ভাই, তাড়াতাড়ি আসেন লঞ্চ ছাইরা দিল, জয় উচ্চ স্বরে বলে।
আমি তাকালাম। লঞ্চ, ঘাট ছেড়ে গেছে। মনটাই খারাপ হয়ে গেল। আবার কখন আসবে। দুই আড়াই ঘন্টা লাগে পদ্মা পেরুতে। আমি আর জয় অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছি ছেড়ে যাওয়া লঞ্চের দিকে। কি করবো?
জয় আস্তে বলে, ভাই স্পীডবোটে যাবেন?
আমি আৎকে উঠি, না উল্টে যাবে।
জয় দমে যায়। কিছুণ পরেই বলি, জয় চলো যাই। আল্লাহ ভরসা।
পাশে স্পীডবোটওয়ালা দু’জন যাত্রী নিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিল। আমার আগ্রহ বুঝতে পারে। ব্যাপক উচ্ছাস নিয়ে বলে, ভাই ওঠেন ছাইড়া দেই।
তিন.
ভয়, শঙ্কা, অনিচ্ছা নিয়ে স্পীডবোটে বসলাম। আমি আর জয় একদিকে। অন্যদিকে এক দম্পতি। পাশে স্পীডবোটের দুই চালক। স্পীডবোট ধীরে ধীরে চলতে শুরু করে।
ভাইজান, কতণ লাগবে? স্পীডবোটওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করলাম।
দশ, বারো মিনিট, অন্যমন্যস্ক উত্তর।
সমস্যা হবে নাকি?
আরে না এইটা হাওয়ার উপর দিয়া চলে। সমস্যা নাই।
কথা শুনে ভালো লাগলেও নিশ্চিত হতে পারিনা। এটা ব্যবসায়ীক কথা। স্পীডবোট দ্রুত চলছে। মনে হচ্ছে ঢেউ ক্রমশ বাড়ছে। শুধু মনেই হচ্ছেনা, আসলেই বাড়ছে। স্পীডবোটে একের পর এক ঢেউ বাড়ি খাচ্ছে। প্রায় অর্ধেক ভিজে গেছি আমি। কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে। ওপারে গন্তব্য খোঁজার চেষ্টা করি। কিছুই দেখা যায়না। পেছনে তাকাই। বেশী দুরে আসিনি। মাত্র দুমিনিট হয়েছে। স্পীডবোট আরো দ্রুত চলে। ঢেউ আরো বেশী আছড়ে পড়ে। বোট আর আমি প্রায় পুরোটাই ভিজে যাই।
চার.
তিন মিনিট পার হয়েছে মাত্র। পদ্মার মাঝখানেও বোধহয় আসিনি। ভয়াবহ ঢেউ এসে বাড়ি খাচ্ছে বোটে। আমি জয়ের দিকে তাকাই। জয় আমার দিকে। মাঝে মাঝে পাশে দম্পতিদের দিকেও তাকাই। তারা দুজন শক্ত করে ধরে আছে বোট। স্ত্রীর চেহারায় দুঃশ্চিন্তার ছাপ দেখে স্বামী তার দুঃশ্চিন্তা আড়াল করতে চাইছে। লাভ হচ্ছে না। আমি জয়ের দিকে তাকাই। এতো পানির মাঝখানে বসেও জয়ের মুখ শুকিয়ে গেছে। বিবর্ণ হয়ে গেছে চেহারা। নানা সময়ে অনেক সাহসের অভিনয় করা জয়ের আসল চেহারা দেখা যাচ্ছে। ধীরে ধীরে আমরা পদ্মার মাঝখানের দিকে যাচ্ছি। ঘড়ি দেখলাম। চার মিনিট হয়েছে। বারো মিনিট হতে আরো আট মিনিট বাকি। আমার ভেতর শুকিয়ে যাচ্ছে ভয়ে। ঢেউয়ের পর ঢেউ আসছে। বাঁচার আশা প্রায় শূন্যের কোটায়। জয়ের দিকে তাকাই। হায়, কোথাকার কোন জয়। যার মৃত্যু হয়তো লেখা আজ আমার সাথে। কি অদ্ভুত নিয়তি।
আকাশের দিকে তাকিয়ে সৃষ্টিকর্তাকে খোঁজার চেষ্টা করি। তোমাকে বোঝা আসলেই দায়!
পাচ.
পদ্মার ঠিক মাঝখানে আমরা। ছয় মিনিট পার হয়েছে। প্রচন্ড শব্দ আর ঢেউয়ের আকার দেখে ভয়ে নীল হয়ে যাই। বাঁচার কোন আশাই এখন আমার মধ্যে নেই। ঢেউয়ের পর ঢেউ আসছে। কোন ঢেউয়ে আমাদের মৃত্যু লেখা আছে কে জানে? আমরা অপো করি। ভাবি, হয়তো আর বিশ ত্রিশ মিনিটের মধ্যে হয়তো এই পৃথিবীর সব হিসাব নিকাশ শেষ হয়ে যাবে। এই কুল ছাড়া পদ্মার পাড়ে সর্বোচ্চ দশ পনের মিনিট হয়তো বেঁচে থাকার ব্যার্থ চেষ্টা করা যাবে। তারপর...?
মায়ের কথা মনে হচ্ছে। আমি অযথাই মায়ের পা ধরে সালাম করতাম প্রতিদিন তিন চারবার। আমি মরে গেলে মা কেমন করবে কে জানে? ছোট বোনটা কি করবে? যে আমাকে প্রতিদিন দেখতে না পারার অভিনয় করে। আর বাবা? যে অপার স্বাধীনতায় ছেড়েছে ছেলেকে। নিজে অবিরাম ব্যস্ত ছেলের স্বপ্ন পূরণে। কে জানে কি করবে? আমার লাশ যখন নেয়া হবে আমাদের বাসার সামনে বিশাল লনে, তখন কি আমার প্রতিবেশীরা অথবা আমাকে দেখে নুয়ে যাওয়া দারোয়ানগুলো কাঁদবে? চেনা শব্দে ভাইব্রেশনসহ মোবাইল বেজে উঠল। মিসড কল। আমি সম্বিত ফিরে পেলাম। অপরিচিত নম্বার। যে মিসডকল দিল তার কথাও ভাবনায় আসে। সেকি জানে আমি এখন কোথায় কিভাবে আছি? মোবাইলে কার সাথে যেন শেষ কথা বলেছি, ভেবে মনটা খারাপ হয়ে যায়। সে মেয়েটা কি জানে তার সাথে ওটাই হয়তো ছিল শেষ কথা। আচ্ছা, আমার মৃত্যুর খবরে তার কি অবস্থা হবে? সে কি কাঁদবে, ভাবতেও বুকটা খালি খলি লাগে। মেয়েটাকে আরেকবার দেখতে ইচ্ছে করছে। কখনোই কারো হাতে হাত রাখিনী আমি। তার হাতটা ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে হয়। চোখের সামনে ভেসে ওঠে তার হাসি মাখা মুখ। আমার ভেতরে ঠান্ডা করা হাসি। যে হাসি আমি বছরের পর বছর ধরে দেখতে পারবো বিরতিহীনভাবে। কিন্তু সে হাসি হয়তো আর দেখা হবে না। প্রচন্ড গর্জনে ফুঁসছে পদ্মা। আমি সম্বিত ফিরে পাই। স্পীডবোট চলছে দ্রুত। আমরা বসে আছি পাড়ে ফেরার অপোয়।
ছয়.
ঢেউ এবার লাগামহীনভাবে আছড়ে পড়ছে। আমি তাকাই দুই চালকের দিকে। যারা এতোণ নির্লিপ্ত ছিল। এবার তাদের চেহারায় ভয়ের ছাপ। আমার ভয় আরো বেড়ে যায়। বেড়ে যায় ঢেউও। জীবন ও মৃত্যুর ঠিক মাঝখানটায় আমি। আমার বুকটা শূন্য হয়ে আসছে। জীবনে বহুবার মরে যেতে চেয়েছি। এই প্রথমবার খুব বাঁচতে ইচ্ছে হচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে দেখা দৃশ্যগুলো ভেসে আসছে চোখের সামনে। মা, বাবা, বোন, সেই মেয়েটা, আমার বন্ধুরা, আমার ঘর, আমার টেবিল, আমার শহর, আমার আড্ডা দেয়ার জায়গাটা। ঢেউ আরো উন্মাত্তাল হয়, আরো ভয়াবহ হয়। আমার বাঁচতে ইচ্ছে করছে। আমি মরতে চাইনা। স্পীডবোটওয়ালা বলেছে, বারো মিনিটে পৌঁছাবো। আমি ঘড়ির দিকে তাকাই। সময় যায়না। মনে হচ্ছে যুগের পর যুগ ধরে স্পীডবোটে বসে আছি আমি। বিশাল বিশাল ঢেউ আসছে। আমি বেঁচে থাকার চরম আকুতি নিয়ে তাকিয়ে আছি পানির দিকে। ঘড়ির দিকে। সময়ের দিকে। মাত্র সাত মিনিট। বারো মিনিট হতে এখনো পাঁচ মিনিট বাকী। আমি বাঁচতে চাই। আমি ফিরে যেতে চাই সেই মেয়েটার কাছে। তার হাতে হাত রাখবো। আমি ফিরতে চাই আমার মায়ের কাছে। তার পা ছুঁয়ে অযথাই সালাম করবো। হঠাৎ ভাইব্রেশন সহ মোবাইল আবার বেজে ওঠে। ওপাশ বেশ দুঃশ্চিন্তা ভরা কন্ঠে মা, কিরে তুই কই?
আমি জবাব দিতে পারছিনা। আমার কন্ঠ শুকিয়ে গেছে। মায়ের কন্ঠ শুনে আমার চোখে পানি চলে আসে। ঘোলা হয়ে আসে চোখ। আমি ঘোলা চোখে তাকিয়ে আছি আরেকটি ভয়ংকর ঢেউয়ের দিকে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




