somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অরণ্যানী

০৭ ই জুন, ২০১৩ বিকাল ৫:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আজ খুব ভোরবেলা টুনু মারা গেছে ।

আমি খবরটা পেলাম বিকেলে । ভার্সিটিতে ক্লাস নিয়ে বাসায় ফিরবো । সুবিধে-মতো বাস রিকশা কিছুই পাচ্ছি না । হাঁটতে হাঁটতে খালেকের চায়ের দোকানের কাছে চলে এসে ভাবলাম এক কাপ চা খেয়ে যাই । খালেকের দোকানটা আমি সবসময় এড়িয়ে চলি । মাঝে-মধ্যেই টুনুদের আড্ডা বসে এখানে । হঠাৎ দেখা হয়ে গেলে টুনুও লজ্জা পায়, আমিও অস্বস্তিবোধ করি । আজ ঢুকেই চারপাশে তাকিয়ে নিলাম । না, টুনু নেই । তবে টুনুকে নিয়েই কিছু লোক কানাকানি করছে । টুনুর মৃত্যুসংবাদ নিয়ে । আমি প্রথমটাতে বিশ্বাস করিনি । হয়তো করতামও না । চা শেষ করে বিল দিতে গেছি, খালেক মিয়া একটা সিগারেট বাড়িয়ে দিলো । আমি ‘লাগবে না’ বলেও কি মনে করে আবার সিগারেট হাতে নিলাম । খালেক মিয়া লাইটার দিয়ে উৎসুক ভঙ্গীতে ফিসফিস করে বলল, ‘ভাইজান, টুনু ভাইরে গুলি দিয়া দিছে । ক্রসফায়ার ।’

আমি সিগারেট ধরিয়ে বললাম, ‘এর আগেও এই ধরনের গুজব কয়েকবার শুনেছি । গতবারের মত এবারও হয়তো ফলস্‌ ।’
‘টুনু ভাইয়ের বাড়ির উঠানে লাশ রাখা আছে । তার মা নাকি পাগল হয়ে গেছে । কিছুতেই লাশ দাফন করতে দিতেছে না । লাশের কাছে কাউকে যেতেও দিতেছে না । নিজের গলায় ছুরি ধরে রাখছে । ক্রসফায়ারের খবর তো টিভিতেও দেখাইছে । আপনে কিছুই শোনেন নাই ?’

আমার হাত কাঁপতে লাগলো । সিগারেটটা বড় বেশি তেতো লাগছে । আমি সিগারেট ফেলে দিলাম । চলে আসছি এমন সময় শুনলাম এক ছোকড়া কর্কশ গলায় বলছে, ‘অপরাধ করলে শাস্তি তো পেতেই হবে কি বলো খালেক মিয়া ? দশ-বিশটা খুন করা সহজ বিষয় না ।’
খালেক খ্যাঁক-খ্যাঁক করে হেসে উঠে বলল, ‘তাতো ঠিকই ।’

এই খালেকের জন্য টুনু কম কিছু করেছে ? সেইতো চার বছর আগে খালেকের দোকান আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেলো । খালেক বাক্স-প্যাঁটরা গুছিয়েছে সদর-ঘাট যাওয়ার জন্য । সংসার নিয়ে শরীয়তপুর গ্রামের বাড়িতে চলে যাবে । দোকানটাই ছিল তার রুজি-রুটির কারখানা । সেই দোকানই যখন নেই, সে ঢাকায় কিভাবে থাকবে ? টুনু কোথা থেকে এই খবর পেয়ে খালেকের বাড়ির সামনে এসে হাজির । নিঃশব্দে খালেকের আট বছরের ছেলের হাতে নোটের বান্ডিল ধরিয়ে দিয়ে চলে এলো । সেই খালেক অপরাধীর শাস্তিতে হাসবে এটা ভাবতেই শিরদাড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে যায় ।

সামনের একটা রাস্তা পার হয়েই টুনুদের বাসা । আমার কি আজ টুনুদের বাড়িতে যাওয়া উচিত না ? গিয়ে কি বলব ? শোক-সন্তপ্ত কোনো বাড়িতে যাওয়াটা খুব সহজ বিষয় নয় । তাছাড়া আমার ও বাড়িতে ঢোকার ব্যাপারটা কি টুনুর বাসার কেউ সহজভাবে মেনে নিতে পারবে ? হয়তো পারবেন । হয়তো না !

গাঢ় লাল রঙের মরচে ধরা একটা গেট । গেটের লাগোয়া পিলারে পাথরে খোদাই করে লেখা ‘অরণ্যানী’ । এ বাড়ির নাম আগে ছিল ‘তহুরা মঞ্জিল’ । টুনুর দাদীর নামে নাম । টুনুর বড় বোন অনু বলতো, ‘এ নামটা বড্ড বাজে । মায়ের নামে বাড়ির নাম হতে হবে এমন কোন কথা আছে ?’

একবার খালুজানের কানে কথাটা গেল । শুনে খালুজানের সেকি রাগ ! খালা বললেন, ‘বাদ দাও না । কথার কথা বলেছে । এতোটুকু মেয়ের কথা ধরতে আছে ?’
‘এতোটুকু মেয়ে, হ্যাঁ ? এতোটুকু মেয়ে ? বছর পেরোতে না পেরোতে যার বিয়ে হবে, সে এমন কথা কেন বলবে ?’
‘আহা, বলে ফেলেছে বলেই যে নাম পরিবর্তন করে ফেলতে হবে তা তো না । তুমি ঠান্ডা হও তো !’

অনুর বাবা, আমার খালুজান বরাবরই এমন বদমেজাজী । চোখেমুখে সবসময় এক ধরনের কাঠিন্য । তুচ্ছ কথাবার্তায়ও তিনি ক্ষেপে গিয়ে ছেলেমেয়েদের গায়ে হাত তুলতেন । ত্রিশ বছর পুলিশের চাকরি করাই হয়তো এর কারন । অনুরা তিন ভাই-বোনই তাদের বদমেজাজী বাবাকে প্রচন্ড ভয় পেতো । অনু যদিও মুখে বলতো, ‘আমি কাউকেই ভয় করি না’ তবুও আমার মনে হয় সেও খালুজানকে বেশ ভালোই ভয় পেতো । অনু পড়াশোনায় ততটা ভালো ছিল না । সেই অনু যখন ইন্টার-মিডিয়েট পরীক্ষায় সবাইকে অবাক করে দিয়ে হিউমিনিটিজ বিভাগ থেকে স্টার মার্কস তুলে নিল তখন খালুজান তাকে ডেকে বললেন, ‘মা, তোর জন্য আজ আমার বুকটা দশ হাত বড় হয়ে গেছে । বল্‌ তুই কি চাস ? আজ তুই আমার কাছে যা চাইবি – তাই পেয়ে যাবি ।’
অনু মুখ কালো করে বলল, ‘এ বাড়ির নামটা আমার ভালো লাগে না ।’
খালুজান খানিকক্ষন চুপচাপ বসে থেকে হো-হো করে হেসে উঠলেন । তারপর বললেন, ‘ঠিক আছে । আমার এক মায়ের নাম বদলে বাড়ির নাম অন্য মায়ের নামে রাখবো । অনু মঞ্জিল । ঠিক আছে রে মা ?’
অনু ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল, ‘আমি চাই এ বাড়ির নাম হোক- অরণ্যানী ।’
‘অরণ্যানী কেন ?’
‘অরণ্যানী খুব সুন্দর একটা শব্দ বাবা । তাছাড়া একটা বাড়ি জীবন্ত হয়ে ওঠে যখন তার মধ্যে নিজস্বতা থাকে । বাড়ির নিজস্বতা হচ্ছে তার নাম । অন্য কারো নামের সাথে ‘মঞ্জিল’ যুক্ত করে সেই নাম রাখতে হবে কেন ? খুব সুন্দর অনন্য একটা শব্দে রাখাটা কি ভালো না ? অপরিচিত কেউ এসে যখন বাড়ির সামনে দাঁড়াবে তখন মনে মনে ভাববে, ‘বাহ ! কি চমৎকার একটা নাম !’ বাবা, আমার ইচ্ছাটা কি তুমি রাখবে ?’

খালুজান তার মেয়ের কথায় মুগ্ধ হয়ে গেলেন । এই মেয়ে এতো সুন্দর করে কথা বলা শিখেছে কোথায় ? তিনি অনুর পিঠে হাত রেখে বললেন, ‘মা রে, কিছু কিছু মানুষ আছে যারা পৃথিবীতে আসেই গোমড়া মুখ করে বসে থাকার জন্য । তাদের প্রকাশ ক্ষমতা থাকে কম । কোন কিছুই মন খুলে বোঝাতে পারে না । এজন্যেই হয়তো তুই জানিস না যে আমি তোকে কতখানি ভালবাসি । আচ্ছা যা ! আজ থেকে এই বাড়ির নাম অরণ্যানী ।’

খালুজান সত্যিই অনুকে প্রচন্ড ভালবাসতেন । তাই অনু যেদিন কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিল, সেদিন তার বড় রকমের স্ট্রোক হয় । ‘আর কোনদিন বাড়ি ফিরবো না, আমাকে মাফ করে দিও’ জাতীয় একটা ছোট্ট চিরকুট পাওয়া যায় অনুর টেবিলে । অনুর বড় বোন শিমুল আপা খবর পেয়ে তার স্বামী আর ছেলে-মেয়েদের নিয়ে ঐদিন-ই নারায়নগঞ্জ থেকে চলে আসেন । শেষপর্যন্ত অবশ্যি টুনু আর আমিই অনুকে রেল-স্টেশন থেকে ধরে নিয়ে আসি । আসলে আমি না, টুনুই খুঁজে আনে । আমি সাথে ছিলাম মাত্র । তার এক মাসের মাথায় অনুর বিয়ে হয়ে যায় কোন এক আর্কিটেক্ট ছেলের সঙ্গে । ছেলের বাবা সুপ্রীম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত জাস্টিস । বেশ বড় ঘরে বিয়ে হয়েছে অনুর । বিয়েতে একজন মন্ত্রী আর কয়েকজন প্রতিমন্ত্রীও এসেছিলেন । বিয়ের পরপর অনু তার স্বামীর সঙ্গে চলে যায় চিটাগাং । শুনেছি অনুর ডল-পুতুলের মতন সুন্দর একটা মেয়ে আছে ।

আমি লোহার গেট খুলে ঢুকতে গিয়ে বড় রকমের নস্টালজিয়ায় ডুবে গেলাম । প্রায় আট বছর পর পুরোনো ধাঁচের এই ‘অরণ্যানী’তে ঢুকলাম । আট বছরে সবকিছু অনেকখানি বদলে যাবার কথা । তা হয় নি । গেটের পাশেই বিশাল বড় পুরোনো সেই বড়ই গাছ । আগের মতই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে । বাড়ির রঙ’টা বদলেছে বোধহয় । এখন আগের চেয়ে আরও বেশি সুন্দর লাগছে দালানটা ।

ভেবেছিলাম অনেক লোক গিজগিজ করবে । দেখা গেলো তেমন কিছু নয় । উঠোনে চেয়ার পেতে ছ’সাত জন লোক বসে আছে । যেখানটাতে চেয়ার পাতা তার ঠিক পেছনেই কুয়োতলা ছিল । কুয়োতলার পাশে দুটো ঝাঁকড়া জাম গাছ । একবার এদের একটার গায়ে বিশাল মোটা-মোটা কালো রঙের সব বিছা বাসা বেঁধেছিল । ভয়াবহ অবস্থা । ধীরে ধীরে পুরো জাম গাছের ডাল-পালা সব কালো হয়ে গিয়েছিল । তাতে কিলবিল করছে সহস্র লোমশ বিছা । খালুজানের কথায় আমি আর টুনু কাজে লেগে পড়লাম । দুজন মিলে এক টিন কেরোসিন কিনে এনে গাছে কেরোসিন ঢেলে দিলাম । তারপর একটা লাঠির মাথায় কাপড় বেঁধে তাতে আগুন জ্বেলে মশাল বানানো হল । রাত্রিবেলা সেই মশাল দিয়ে গাছের গায়ে লাগানো হল আগুন । দাউ-দাউ করে আগুন জ্বলছে । আর বিছুটি পুড়ে যাওয়ার পট-পট শব্দ হচ্ছে । টুনু এক হাত থেকে আরেক হাতে মশাল অদল-বদল করে মহানন্দে গাছটাকে ঘিরে এলোপাথারি নাচছে । অনু দূরে দাঁড়িয়ে মাথায় তুলে দেয়া উড়নায় মুখ চেপে ভীত চোখে তাকিয়ে থেকে একসময় বলল, ‘টুনু সরে আয় । এতো কাছে যাচ্ছিস কেন গাধা ? ওগুলো পুড়ে আশেপাশে ছিটছে তো !’ । টুনুর চোখে তখন খুনী উল্লাস । সে বিছা পুড়িয়ে মজা পেয়ে গেছে । কিছুতেই তাকে সরানো যাচ্ছে না ।

কতই বা বয়েস তখন টুনুর ? ক্লাস এইটে পড়ে । বাচ্চা বাচ্চা মুখ । নতুন নতুন দাড়ি-গোঁফ গজানোতে সেই মুখ সবসময় খানিকটা বিব্রত । আমি যখন শহীদুল্লাহ হলের রুম ছেড়ে খালুজানের এই বাসায় এসে উঠি তখন সে কেবল সেভেন থেকে এইটে উঠেছে । টেনেটুনে পাশ । আমার আপন কোন খালা ছিল না । ইনারা ছিলেন দুঃসম্পর্কের লতানো-পেঁচানো আত্মীয় । ভার্সিটি থেকে পাশ করে তখনও চাকরি জোটাতে পারছিলাম না । পাশ করে বেড়িয়ে গেলেও পলিটিকাল ব্যবস্থায় হলে থাকা যায় । আমিও সেভাবে থাকি । হঠাৎ রাজনৈতিক পট-পরিবর্তন হওয়ায় বিনা নোটিশে হল ছাড়তে হয় । ঢাকায় অন্য কোন আত্মীয়-স্বজনও ছিল না । কাজেই ‘তহুরা মঞ্জিল’-এ শফিকুল ইসলাম নামে আরেকজন সদস্য বাড়তি যুক্ত হয় । খালুজান প্রথম দিন কোন রকম সংকোচ ছাড়া বেশ স্বচ্ছন্দেই বলেন, ‘বিছানা-বালিশ নিয়ে এসেই যখন পড়েছো তখন কি আর করা ? থাকো । তোমার রেজাল্ট কি ?’
‘বি.এ. ফার্স্ট ডিভিশন । এম.এ. তে সেকেন্ড ডিভিশন ।’
‘যেই রেজাল্ট দিয়ে চাকরি জোটানো যায় না তার কোন মূল্য নেই, বুঝেছো ?’
‘জ্বি ।’
‘তোমার সাবজেক্ট কি ছিল ?’
‘বোটানী ।’
‘আমার ত্রিশ বছর পুলিশের চাকরি জীবনে আমি যতগুলো ড্রাগ এফেক্টেড ছেলে-পেলে দেখেছি তাদের নাইন্টি পারসেন্ট হচ্ছে বোটানীর । তুমি আবার ড্রাগ-ফ্রাগ নাও নাকি ?’
‘জ্বি না ।’
‘শোনো আমি বিনা পয়সায় তোমাকে রাখবো-খাওয়াবো তা হবে না...’
‘আমি কিছুদিনের জন্য থাকবো । কোন মেস খুঁজে পেলেই এখান থেকে চলে যাবো ।’
‘কথার মাঝখানে কথা বলো কেন ? ভার্সিটির ছেলে-পেলে আর কিছু না পারলেও ফড়-ফড় করে কথা বলতে পারে । শোনো । তুমি দুই দিন থাকো বা তিন দিন, আমি তোমাকে ফ্রিতে খাওয়াতে পারবো না । ফ্রি দিলে লাই পেয়ে মাথায় চড়ে বসবে ।’ খালুজান একটু থেমে বললেন, ‘আমার ছেলে টুনুকে তো চেনো । এবার ক্লাস এইটে উঠেছে । আমি চাই সে সায়েন্স নিয়ে পড়ুক । তুমি সায়েন্সের স্টুডেন্ট । ভালো পড়াতে পারবে । অবশ্যি এই ছেলেকে পড়িয়ে লাভ নেই । এ মহা-গর্দভ । একে যদি ‘A’ বলতে বলো তাহলে সে বলবে ‘ক’ । যদি ‘B’ বলতে বলো তাহলে ‘খ’-ও শুনবে না, শুনবে কক্‌ । যার ওজন আছে, স্থান দখল করতে পারে তা ‘পদার্থ’ হলেও টুনু অপদার্থ । নিপাতনে সিদ্ধ অপদার্থ । এর বোন মেরিটোরিয়াস । এ বছর স্টার মার্কস নিয়ে ইন্টার পাশ করেছে জানো বোধহয় । তাকে বিজ্ঞানে পড়ানো উচিত ছিল । যাই হোক, এই গাধাকে মানুষ বানানোর চেষ্টা নিতে হবে । কি ? পারবা না ?’
‘জ্বি পারবো ।’
‘অতিরিক্ত কনফিডেন্ট ভালো না । কথার শেষে ইনশাল্লাহ-ও তো বললা না । লেখাপড়ার পাশাপাশি আদব-লেহাজও জানতে হয় । তুমি টুনুর ঘরেই থাকবা । এখন যাও । চোখের সামনে থেকে দূর হও । দেশ ভর্তি হয়ে যাচ্ছে বেকার দিয়ে । এতো বেকার দিয়ে হবেটা কি ?’

এই ছিলেন খালুজান । আমি এক সময় ধীরে ধীরে তহুরা মঞ্জিলের নিয়মিত এবং প্রয়োজনীয় সদস্য হয়ে উঠি । সকালের বাজার থেকে শুরু করে টিভি সারানোর মিস্ত্রি খোঁজা সবটাই আমার ডিপার্টমেন্ট । এর মধ্যেই চাকরির ব্যর্থ চেষ্টা চলতে থাকে । রাতে যখন টুনুকে পড়াতে বসিয়ে হাজারবার করানো পুরোনো অংক করতে দেই, তখন টুনু এমন ডাগর চোখে তাকিয়ে থাকে যেন প্রথমবার দেখছে । আমি তাঁকে রাগও করতে পারি না । বেশ মায়া লাগে ছেলেটার ওপর । পড়াশোনায় তার একেবারেই মন নেই । মেট্রিক পরীক্ষায় দু’দুবার ফেল করার পর সে পড়াশোনা ছেড়ে দেয় । খালুজান তার স্বভাবসিদ্ধ প্রলয় চিৎকারে বাড়ি মাথায় তোলেন । টুনু এমনভাবে বাড়িময় ঘুরতে থাকে যেন কিছুই হয় নি । এরপর থেকেই খালুজান টুনুকে সহ্য করতে পারতেন না । টুনুর নাম শুনলেই তিনি গাল দিয়ে ওঠেন । ঘর থেকে পর্যন্ত বের করে দিয়েছিলেন । সবার উপর কঠিন নির্দেশ ছিল তাকে ঘরে দেখতে পেলেই যেন খালুজানকে খবর দেয়া হয় । টুনু পালিয়ে পালিয়ে রাতে বাসায় ঢুকতো । খালা লুকিয়ে লুকিয়ে তাকে ভাত খাইয়ে দিতেন । গভীর রাতে আমার দরোজায় টোকা পড়তো । আমি বুঝতে পারতাম খালা টুনুকে নিয়ে এসেছেন ঘুমুবার জায়গা দিতে ।

তার পরের বছর এক বৃষ্টির রাতে কি জন্যে যেন আমি বিছানার তোষক সরাতে গিয়ে তোষকের নিচে একটা জিনিস খুঁজে পাই । অস্ত্র-শস্ত্রের ব্যাপারে মূর্খ হলেও এটুকু বুঝতে পারলাম এটা একটা রিভলবার । এ বিছানায় আমি আর টুনু ঘুমাই । তৃতীয় কারো এই জিনিস এখানে পালিয়ে রাখতে আসার কথা না । আমি ঘুমুবার সময় টুনুকে বললাম, ‘তোষকের তলায় ঐ জিনিসটা কি তোর ?’
টুনু একটু ইতস্তত করে বলল, ‘শফিক ভাই, ওটা একটা চাইনিজ রিভলবার ।’

আমি পুরোপুরি অবাক হয়ে গেলাম । মুখে কথা আটকে গেলো । কি বলবো ভেবে পেলাম না । বাইরে ঝড়-বৃষ্টির শোঁ-শোঁ শব্দ । ইলেকট্রিসিটি চলে গেছে । হয়তো পুরো রাতে আর আসবে না । ঘরের ভেতরে ভ্যাপসা গরম । আমি বিছানার পাশের জানালার কয়েকটা পাট খুলে দিলাম । বৃষ্টির ছাটে বিছানা ভিজে যাচ্ছে । তবু ঠান্ডা পানিগুলো গায়ে আসায় বেশ ভালো লাগছে । অনেকক্ষন পর টুনু ক্ষীনস্বরে বলল, ‘শফিক ভাই, কাউকে কিছু বলার দরকার নাই । সবাই শুধু শুধু টেনশনে পড়ে যাবে ।’ আমি কোন উত্তর না দিয়ে পাশ ফিরে শুলাম । ঘুমের ঘোরে একসময় কি একটা মধুর স্বপ্নও দেখলাম । সেই স্বপ্নের মাঝে সব রকমের দুশ্চিন্তা হারিয়ে গেলো ।
ঐ সময় যদি খালুজানকে কিছু বলতাম তাহলে কি আজকের দিনটা বদলানো যেতো ?

আমি বেশ খানিকটা দ্বিধা-দন্দ্ব কাটিয়ে ঘরে ঢুকে পড়লাম । না, লাশ উঠোনে না । বাড়ির ভেতরে সামনের রুমে রাখা । সোফাটা খুব সম্ভবত সরিয়ে সেখানটাতেই লাশের খাটিয়া রাখা হয়েছে । খালা খাটিয়ার পাশে পা ছড়িয়ে বসে আছেন । তার চোখে-মুখে উদভ্রান্ত একটা ভাব । তাকে সত্যিকারের উন্মাদিনীর মত লাগছে । কর্পূরের গন্ধে সমস্ত ঘর ভরে গেছে । ভেতরের ঘর থেকে দ্রুত কোরআন তিলওয়াতের অস্পষ্ট একটা সুর ভেসে আসছে । যে সুর মৃতের পাশে দাঁড়িয়ে শুনলে ভয় ধরিয়ে দেয় । আমি কি করবো বুঝতে পারছি না । চলে যাবো ? লাশ দাফন হবে কখন ? কোন কবরস্থানে ?

আমি ঠিক করলাম উঠোনে গিয়ে খানিকক্ষন বসবো । ঘর থেকে বের হবার আগেই হঠাৎ অনু ঘরে ঢুকলো । তার পরনে কালো বোরকা । একটা উড়না স্কার্ফের মত মাথায় জড়িয়ে রেখেছে । প্রায় আট বছর পর অনুকে দেখলাম । অনু যেন আগের চেয়ে আরও সুন্দর হয়ে গেছে । সাজগোজ ছাড়াই তাকে অপ্সরার মত অনিন্দ্য সুন্দরী মনে হচ্ছে । অনু আমাকে দেখেই দ্রুত বলল, ‘শফিক ভাই, আপনি একা একা এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন ? ভেতরে আসুন ।’ আমাকে আর কিছু বলবার সুযোগ না দিয়েই সে ভিতরে ঢুকে গেলো । আমি দরোজার পর্দা সরিয়ে ভিতরে ঢুকলাম ।

ভেতরে শিমুল আপা, তার স্বামী এবং আরও কয়েকজন লোক চোখ-মুখ শক্ত করে ডাইনিং টেবিল ঘিরে বসে আছে । পাশের সিঙ্গেল খাটে বসে দাড়িওয়ালা এক লোক দ্রুত কোরআন তিলাওয়াত করে যাচ্ছেন । একজন লম্বা ফর্সা করে কোট-পরা এক ভদ্রলোক এক কোনায় বসে ছিলেন । অনু আমাকে ডেকে পরিচয় করিয়ে দিল, ‘শফিক ভাই, ইনি আমার হাসবেন্ড । আপনাদের বোধহয় পরিচয় নেই ।’ অনু ভদ্রলোকের পাশের খালি চেয়ারটি টেনে আমাকে বসতে ইশারা করল । আমি বসতেই সে ‘আসছি’ বলে তাড়াহুড়ো করে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে গেলো ।

কে বলবে এই ইন্দ্রানীর মত রূপসী মেয়েটিই চৈত্রের এক মায়াময় দুপুরে আমার কাছে বিশাল এক চিঠি লিখেছিল । চিঠি পেয়ে আমার মাথা এলোমেলো হয়ে গেল । অনু কেন আমাকে এই চিঠি লিখবে ? কোথাও কোন ভুল হয়ে যায় নি তো ? সম্বোধনে তো আমার নাম-ই লেখা । অনুর তখন অনার্স ফাইনাল ইয়ার চলছে । আমার ঢাকা ভার্সিটিতে লেকচারার হিসেবে একটা চাকরী পেয়ে যাবার একটা কথাবার্তা চলছিল । নিতান্তই নগন্য মাইনে, তবু চাকরি তো ! পাগলী অনু’ও এই বিষয়টি জানতো । জেনেশুনেই হয়তো আমার সাথে পালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল । সে রাতে কালবৈশাখীর মত প্রবল ঝড় হলো । রাতের ঘুম ফেরী করা হু-হু বাতাসও আমায় ঘুমুতে দিলো না । কেবলই ভাবতে লাগলাম অনু নামের মেয়েটির কথা । তার পাগলামির কথা । আমাদের ভবিষ্যতের কথা ।

পরদিন সকালে টুনুর ঘরে আমাকে একলা পেয়ে অনু ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলো । জলভরা চোখে আমার হাত ধরে ক্ষীনস্বরে বলল, আমার চিঠির উত্তর পাবো না ?
আমি অনেকক্ষন চুপ করে ছিলাম । কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না । অনু আমার হাত ছেড়ে দিলো । চলে যাবার জন্য সে দরজার ছিটকিনি খুলছে এমন সময় অজান্তেই আমার মুখ থেকে কেমন করে যেন বেড়িয়ে গেলোঃ
‘প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস
তোমার চোখে দেখেছিলেম আমার সর্বনাশ !’

তারপর ? তারপর আমার হাত ধরে অনু ঘর ছেড়ে বের হয়ে গেল । ঐদিনই নয় । তারও অনেকদিন পরে । হুট করে পালিয়ে গেছি বলাটা কি ঠিক হবে ? আমরা দুজন মিলে কিছুতেই মেলাতে পারছিলাম না খালা কিংবা খালুজানকে কি করে রাজি করাবো । কেউ কোন অবস্থাতেই আমাকে মেনে নেবেন না । তাই সহজ সমাধান । পালিয়ে যাওয়া । একবারের জন্যেও মনে হয় নি অনুর পরিবারের কি হবে ? আমি কি সত্যিই অনুর ভবিষ্যৎটা সাজিয়ে-গুছিয়ে দিতে পারবো ? একবারের জন্যেও মনে হয় নি আমার ।
দুজনে রেল-স্টেশনে বসে আছি । ট্রেন আসতে লেট করছে । ঠিক তখন কিছু উগ্র ধরনের ছেলেদের সঙ্গে নিয়ে টুনুকে আসতে দেখা গেলো । অনু আমার ডান হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলো । আমি তখন কি ভাবছিলাম আমার মনে নেই । শুধু এটুকু মনে আছে টুনুর চোখ সেদিন টকটকে লাল হয়ে ছিল । সেই যে ও জাম গাছে আগুন লাগিয়ে দিলো, কালো কীটগুলোর দিকে ওর যেইরকম খুনে একটা দৃষ্টি ছিল, ঠিক সেইরকমের তীব্র দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়েছিল ও । হয়তো বিশ্বাস করতে পারে নি আমি ওর বোন অনুকে নিয়ে সত্যিই এভাবে পালিয়ে এসেছি ।

টুনু আমার কাছে এসে খুব অস্পষ্ট স্বরে বিড়বিড় করে যে কথাগুলো বলেছিল তা হচ্ছেঃ
শফিক ভাই, আমার বাবা মারা যাচ্ছে । আমার বাবা মারা যাচ্ছে ।

খালুজান স্ট্রোক করেছিলেন । এবং সেদিন শেষ রাত্রির দিকে তিনি মারা গেলেন । টুনুকে আমি কখনও কাঁদতে দেখিনি । ঐদিন খুব কেঁদেছিল । খালুজানকে কবরে নামিয়ে সে অনেকদিনের জন্য শহর থেকে হারিয়ে গিয়েছিল । যখন ফিরে আসে তখন সে অন্য টুনু । সেই টুনুকে আমি একেবারেই চিনি না ।

আমার পাশে বসা ভদ্রলোকটি দু’হাত ঘষতে ঘষতে বললেন, ‘আমি আসলে আপনাকে ঠিক চিনতে পারিনি । আপনি টুনুদের কিরকম আত্মীয় হন ?’
আমি কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বললাম, ‘আমি জানি না ।






অরণ্যানী থেকে যখন বাইরে বেড়িয়ে এসেছি তখন আকাশে রূপালী থালার মতন বিশাল বড় একটা চাঁদ উঠেছে । আজ নিশ্চয়ই পূর্নিমা । টুনু আর আমি একবার এক পূর্নিমা রাতে রিকশায় করে বানিজ্য মেলা থেকে ফিরছিলাম । পথে একটা দূর্ঘটনা ঘটতে দেখি । কমবয়স্ক একটা ছেলেকে ট্রাক চাপা দিয়ে চলে গেছে । তার গুঁড়ো হওয়া মাথা, থেতলানো শরীর আর বীভৎস কালো রক্ত দেখে আমি শিউরে উঠি । টুনু ধীরস্বরে বলেছিল, ‘সবাইকেই একদিন মরে যেতে হবে । সব মৃত্যুই তো ভয়ংকর, তাই না শফিক ভাই ?’

হাজার হাজার সোডিয়াম আলোর ভীড়ে গাঢ় নীল রঙের জোছনা গায়ে মেখে আমি হাঁটতেই থাকি । হাঁটতেই থাকি । হাঁটতেই থাকি । কানের কাছে কে যেন ঘোর লাগা কন্ঠে ফিসফিস করে বলেঃ

অন্য সব আলো আর অন্ধকার এখানে ফুরালো;
লাল নীল মাছ মেঘ- ম্লান নীল জ্যোৎস্নার আলো
এইখানে; এইখানে মৃণালিনী ঘোষালের শব
ভাসিতেছে চিরদিনঃ নীল লাল রূপালি নীরব !
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই অক্টোবর, ২০১৩ সকাল ৭:২৯
১৯টি মন্তব্য ১৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হামাসকে দিয়ে গাজায় ঠিক কী কী উপকার হয়েছে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ১৭ ই মে, ২০২৫ সকাল ৯:২৫



ইসরায়েলের বিমান হামলায় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় নিহত হয়েছেন ১১৫ জন ফিলিস্তিনি এবং আরও অন্তত ২১৬ জন আহত হয়েছেন।

২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্টারের কাচ্চি বিরিয়ানী

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৭ ই মে, ২০২৫ সকাল ১১:৩১



শেষ কবে স্টারের কাচ্চি খেয়েছিলাম আমার মনে নেই। আগে একটা সময় ছিল যখন কাচ্চির নাম নিলে যে নামগুলো সবার প্রথমে সামনে আসতো তার ভেতরে এই স্টারের নাম থাকতো। এখনকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

পিনিক চা

লিখেছেন রাজীব নুর, ১৭ ই মে, ২০২৫ দুপুর ২:২৯



একটা গান আছে- পিনিক পিনিক লাগে।
ফালতু গান। পচা গান। পিনিক নামে একটা বাংলা সিনেমাও হয়েছে। আসলে 'পিনিক' শব্দটির আভিধানিক কোনো অর্থ নেই। সাধারণত নেশাদ্রব্য সেবন করার ফলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

নটীদের আড্ডাখানা ছিল সংসদ!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৭ ই মে, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৪


বাজারে যত নটী আছে হাসিনা সবগুলোকে একছাদের নিচে দক্ষতার সংগে জমায়েত করতে পেরেছিল। সেই নটীদের ছিলনা কোন যোগ্যতা কিংবা না ছিল কোন রাজনৈতিক ব্যকগ্রাউন্ড; তারপরও নটীরা সংসদে যেতে পেরেছিল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছবি ব্লগঃ প্রকৃতি

লিখেছেন সামিয়া, ১৭ ই মে, ২০২৫ বিকাল ৪:৫১



কিছুক্ষণ আগে পাতায় পাতায় গড়িয়ে পড়েছে বৃষ্টির ধারা; তার চিহ্ন রয়েছে জমে থাকা পাতার ফোঁটাগুলায়, মাঝে মাঝে নিচে পড়ে গিয়ে ছোট্ট শব্দ তুলছে, বাতাসে ভেজা মাটির গন্ধ, আর দূর... ...বাকিটুকু পড়ুন

×