পরেশ বাবু রিটায়ার করেছেন বেশ কয়েক বছর হয়েছে । ছেলে মেয়ের বিয়ে দিয়ে কর্তব্যমুক্ত হয়েছেন এর ও দুই বছর হল । এখন আর কাজ তেমন কিছুই নেই । সকালে স্বামী স্ত্রী মিলে একটু হাঁটাহাঁটি করেন , তারপর দুপুরটা ঘরেই থাকেন বিকালে লেইক পাড়ে গিয়ে একটু মুক্ত হাওয়া নেন তারপর কাছের নিধুর চায়ের দোকানে একটু হালকা আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যার পর বাড়ি চলে আসেন, বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজন ও তেমন নেই তাই কোথাও বেড়াতেও যান না । এই হল উনার প্রাত্যহিক রুটিন আজ অব্দি এর ব্যতিক্রম হয়নি । আজও তিনি রোজদিনের মতো নিধুর দোকানে আড্ডা দিতে এসেছেন আজ আড্ডার বিষয় লাশ চুরি । আজ পরেশ বাবুকে একটু অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে নিধু ব্যাপারটা লক্ষ্য করে খোঁচা দিয়ে দিয়ে বলল
কি দাদা !! লাশের কথা শুনে ভয় পেয়ে গেলেন নাকি ?? পেছনে গিয়ে বসলেন যে ??
পরেশ বাবু কথা শুনলেন কিনা বোঝা গেল না । আজ আড্ডায় আরেকজন নুতন এসেছে নাম হারান , এই এলাকায় নুতন । রাজমিস্ত্রির যোগালি হিসেবে কাজ করে । সে লাশের কথা শুনে তার জীবনের একটা ঘটনার কথা বলল , তার কথা গুলো সরাসরি তুলে ধরলাম ।
হারান বলতে শুরু করল ,
বাবুরা আপনারা আমার আগের পরিচয় পেয়ে ঘৃণা করবেন হয়ত বা তাড়িয়েও দেবেন , তবু বলছি কারন এই ঘটনাটা আজও আমাকে এক দুঃস্বপ্নের মতো তাড়া করে বেরায়, আজও এই ঘটনার চিহ্ন বহন করে চলেছি আমার গায়ে ।
আজ থেকে দশ বছর আগের কথা , আমি একজন পেশাদার চোর ছিলাম বাড়ি ছিল আমবাসা । চুরি করেই সংসার চলতো আমার । অভাবে পরেই এই পথে এসেছিলাম । রোজ রাতেই বেরিয়ে পরতাম , আমাদের দলটা ছোট ছিল কাজ ও করতাম আমবাসার আসেপাশেই । দুয়েকবার ধরাও পরেছিলাম , স্কুলঘর , পঞ্চায়েত অফিস, বাড়িঘর সবই আমাদের টার্গেট এ থাকতো । তখনি আমাদের এখানে একজন অফিসার আসেন, খুব ধনী মানুষ চলনে বলনে বেশ চাকচিক্য । আমরা তাকে ফলো করতে থাকলাম , আর সুযোগের অপেক্ষায় রইলাম । একদিন সুযোগ এসেও গেল । সেদিন ছিল অমাবস্যার রাত বাড়িতে কেউ নেই ঠিক হল আজই আমরা হানা দেব , আগের দিন ঝড় হয়ে গিয়েছে তাই এলাকায় কারেন্ট ও নেই আমাদের জন্য ভালই হল । অফিসারের বাড়ি গিয়ে ঢুকলাম দরজা খুলে ভেতরে ধুক্তেই কেমন যেন অন্যরকম লাগল এত রাতে ঘরে ধোঁয়া কেন ?? কেউ ধুনি জ্বেলে রেখেছে মনে হয় মানে কেউ এখনো জাগছে কিন্তু এতো রাতে !!! বাকীরা বলছিল চল যাই আজ থাক । কিন্তু আমার কেমন যেন রোখ চেপে গিয়েছিল ব্যাপার কি দেখতে হবে চুপিচুপি পাশের ঘরে ঢুকলাম । ঘরটা বেশ অন্ধকার ঘরের চারিদিকে বিভিন্ন পুজার জিনিস ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে , কিছুক্ষন আগেই কোন পুজা হয়ে গেছে মনে হয় মাঝখানে একটা যজ্ঞের ছোট চুলাও আছে আমার কাছে ব্যাপার স্যাপার কেমন জানি লাগছিল ঘরের পাশে অন্ধকারে ওটা কি নড়ছে ?? কি মনে করে হাতের টর্চটা জ্বেলে ওই দিকে তাক করতেই যা দেখলাম তাতে আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়েগেল , শিরদাঁড়া বেয়ে যেন শীতল স্রোত নেমে গেল যা দেখলাম তা যেন কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না । সেই অফিসার , সারাদেহে রক্ত আর পাশেই একটা আধখাওয়া লাশ !! যা দেখছিলাম তা দেখে যেন পাথর হয়ে গিয়েছিলাম । টর্চের আলো পরতেই অফিসার আমার দিকে ছুটে আসলো তার চকচকে চোখ সারাগায়ে রক্ত কপালের বড় লাল তিলক আমি কিছু ভেবে পাচ্ছিলাম না , মনে প্রানে চাইছি সেখান থেকে পালানোর জন্য কিন্তু কেন জানি আমি নড়তেই পারছিনা পা গুলো বরফের মতে জমে গিয়েছে ওইদিকে অফিসার এর হাত আমার টুটি প্রায় ছুয়ে ফেলেছে আমি সম্বিৎ ফিরে পাবার আগেই আমার গলার ঠিক নিচে একটা কামড় বসিয়ে দিল আমি তখন প্রানপনে ধাক্কা দিয়ে সরানোর চেষ্টা করতে লাগলাম গলা দিয়ে তখন দরদর করে রক্ত পড়ছে বেশ খানিকটা মাংস তুলে নিয়েছে যন্ত্রণায় আমি প্রানপনে আর্তনাদ করে উঠলাম তখন দেখলাম অফিসারের হাতে একটা ধারালো ভোজালি , আমি তখন অচৈতন্য হয়ে পড়েছি ততক্ষণে আমার দলের লোকরা এসে পরায় সেদিন আমি প্রানে বেঁচে যাই কিন্তু আমাকে বাঁচাতে গিয়ে আমার দলের একজন সেই নরপিশাচ হাতে মারা যায় । পরের দিন থেকে ওই বাড়িতে কাউকে পাওয়া যায়নি ছিলনা কোনও রক্তের ছাপ, কোন যজ্ঞের চুলা ,এত ধ্বস্তাধস্তির কোনও চিনহমাত্র নেই যেন কিছুই হয়নি । ওইদিনের পর ঘটনার পর দুই সপ্তাহ ধরে হাসপাতালে বেহুঁশ ছিলাম্ । ওইদিনের ঘটনার পর থেকে আর না , আর চুরি করবনা আর কারো বাড়িতে রাতে যাবনা । এরপর সেখানে আমি আর থাকি নি বউকে নিয়ে চলে যাই বিলোনীয়া সেখানেই আছি , এখন থেকে পরিশ্রম করে সংসার চালাই চুরির কথা ভাবলেই ওইদিনটার কথা মনে পরে যায় এখনো মাঝে মাঝে স্বপ্নে ওইদিনের ঘটনা দেখি , অফিসারের লাল চকচকে চোখ আধ খাউয়া দেহটা সব ছবির মত ভেসে উঠে ।
ঘটনটা বলা শেষ করে হারান তার গলায় সেই মরন কামড়ের দাগ টা দেখায় সবাই দেখে আঁতকে উঠলো । পরেশ বাবু যেন দেখেও দেখলেন না ।
আড্ডা শেষ হল সবার যাওয়ার পর পরেশ বাবু উঠলেন , কোনও কথা না বলে চুপচাপ হাটা দিলেন বাড়ির দিকে । আর মনে মনে ভাবছেন সেদিনের চোরটাকে আজ পাওয়া গেল সেদিন ছেড়ে দেওয়াটা ঠিক হয়নি কামড়টা জায়গা মতো বসেনি তাই সে যাত্রায় বেচেগেল । উফফ সেদিনের ভুলটার জন্য অসম্ভব আফসোস হচ্ছে পরেশ বাবুর রক্তের পিপাসাটা কমেনি বিন্দু মাত্র সিদ্ধিলাভ করতেই হবে ।
দুদিন হল পরেশ বাবুর স্ত্রী মেয়ের বাড়ি গিয়েছেন । আজ অমাবস্যা ঘরে ধুনির ধোঁয়া যজ্ঞের আগুন ঘি খেয়ে আরও ফুলেফেঁপে উঠেছে তার লিকলিকে জিভটার আলোয় পরেশ বাবুর চোখ ঝলমল করে উঠলো , ঠিক সেদিনকার মতো । পাশেই গলায় লাল জবা ফুলের মালা পড়া হারান হাত পা বাঁধা অবস্থায় পরে আছে । পরেশ বাবু তার রামদা টা হাতে নিয়ে হারানকে তেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলেছেন হাড়িকাঠের দিকে সিদ্ধিলাভ তার করতেই হবে ।