somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দেখা...

০৮ ই মার্চ, ২০১১ সন্ধ্যা ৬:৫১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



প্রায়ই আমি দেখি তাদেরকে।
এখানে ওখানে সেখানে।
অনেকরকম রূপে কিংবা অনেকরকম রঙে।
কখনও মনে হয় আলাদা। আবার কখনও মনে হয় একইরকম।
তবু... দেখি।
ভালো লাগে দেখতে।

কাউকে কাউকে দেখি এই শহরের নিত্য আলোকোজ্জ্বল সাজঘরগুলোতে। উদয়াস্ত তাদের কাটে কেবল মানুষকে সাজাতে সাজাতে। খদ্দেরদের বউ সাজিয়ে দেয়া, ফরমায়েশ অনুযায়ী চুল কেটে কিংবা বেঁধে দেয়া, শাড়ি পরিয়ে দেয়া কিংবা পরম যত্নে হাত-পা-নোখ-মুখ পরিষ্কার করে দেয়া... এমনি করেই বেলা বয়ে যায় এদের। এরা অনেকেই উপজাতীয় মেয়ে- শহুরে নয়, বাঙালিও নয়। নেহাতই জীবিকার তাগিদে এসেছে এখানে, হয়তো এর ফলে তাদের সংসারে কিছু স্বচ্ছলতা এসেছে এখন। একবার এরকমই কিছু মেয়েকে খুব গল্প করতে শুনেছিলাম-- তাদের এলাকায় নাকি এমন একজন মানুষ আছে যে দিনের বেলা মানুষ থাকে আর রাত গভীর হলেই বাঘ হয়ে যায়, পাহাড়ের গহীন জঙ্গলে জঙ্গলে ঘোরে আর যার উপর প্রতিশোধ নিতে চায় তার রক্ত শুষে খায়! কি তীব্র বিশ্বাস নিয়ে তারা সেই মানুষটার কথা বলছিলো, শুনে অবাক হয়েছিলাম। একবার ভাবলাম বলি, "এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে, এতবড় একটা শহরের ঝকঝকে নিয়ন আলোর তলায় বসে, বিজ্ঞানের এই বিপুল ভাণ্ডারের সুফলভোগ করে আপনারা এগুলো বিশ্বাস করেন কিভাবে?"... কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে হলো, ওদের তো কোনও দোষ নেই। ওদের জায়গায় আমি হলেও হয়তো এরকমই ভাবতাম। হয়তো কেন, নিশ্চয়ই ভাবতাম!

কখনও তাদেরকে দেখি দলে দলে হাজারে হাজারে কাজে যেতে কিংবা কাজ থেকে ফিরতে। অনেক সকালে, আর অনেক সন্ধ্যায় কিংবা অনেক রাতে। সস্তার কাপড় গায়ে দিয়ে আর ততোধিক সস্তার কাপড়ে মাথা ঢেকে তীব্র গতিতে ভীড় করে তারা হাঁটে শহরের অলিগলি রাস্তায়। কারো কারো হাতে থাকে একটা করে অ্যালুমিনিয়ামের টিফিনবক্স। কোথায় যেন সেদিন দেখলাম, বাংলাদেশ এখন গার্মেন্ট প্রোডাক্ট উৎপাদনে এশিয়ার মধ্যে ২য় বৃহত্তম আর সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে ৩য় বৃহত্তম... এতবড় কৃতিত্বের দাবীদার এই মেয়েগুলো কি আদৌ জানে সে কথা?

দিনশেষে ঘরে ফিরলে একজনকে দেখি একমনে কাজ করতে। প্রচলিত বাংলায় তাকে বুয়া বলে ডাকা হয়, আমি তাকে কখন বুয়া ডাকি আর কখন আপা ডাকি, মনেও রাখতে পারি না। এরকম প্রতি ঘরেই আছে তারা সবাই। এক বাড়িতে কাজ শেষ হলে তারা আরেক বাড়িতে যায়, কিছু অতিরিক্ত রোজগারের আশায়। আমরা যারা সারাদিন বাইরে থাকি তাদের এদেরকে ছাড়া চলেও না।... কাজ করতে করতে সে একদিন জানালো যে তার ঘরে ছোট ছোট দু'টো বাচ্চা, যতক্ষণ সে বাইরে থাকে ততক্ষণ তার স্বামী রিকশা নিয়ে বেরোতে পারে না (স্বামীটি রিকশাচালক), বাচ্চাগুলোকে দেখবে কে? কাজেই সে ঘরে ফিরলে তবেই স্বামী বেচারা তার রোজগারের খাতা খুলতে পারে। এদেরকেই আমরা রোজ দেখি ভোরবেলা থেকে ঠায় ওএমএসের ট্রাকের সামনে পাত্র হাতে তীর্থের কাকের মত দাঁড়িয়ে থাকতে, যদি সস্তায় কিছু চাল মেলে তাই। কথায় কথায় সে একদিন আমাকে জানালো যে এই আক্রার বাজারে সংসার টানতে তাদের অনেক কষ্ট হচ্ছে, একদিকে বাচ্চাগুলো বড় হচ্ছে কিন্তু অন্যদিকে চালের দাম ৫০টাকা কিলো! তারা ওএমএসের চাল কিনে খায় কিনা জিজ্ঞেস করতে সে তার ভাষায় যে জবাবটা দিয়েছিলো সেটা ছিলো অনেকটা এরকম- "আফা, ছোডকাল থিকা আমি আমার মা-বাপরে পাই নাই, তখন থিকাই অইন্যের সংসারে মানুষ। যেইখানে মানুষ হৈছি ঐডা অনেক বড়লোকের সংসার আছিলো, চিরকাল আমি চিকন চাইলের ভাত খায়া মানুষ হৈছি। ২৫টাকার চাইল আমার মুখে রুচতো না।" একটু অবাক হলেও ভেবেছিলাম, হতেও তো পারে এমন... ঐ দশায় আমি পড়িনি, পড়লে কি হতো কি করে বলি?... পরে অবশ্য সে যোগ করেছিলো যে, ওএমএসের চাল পাওয়া অনেক দীর্ঘসময়ের ব্যাপার, ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকলে তবেই মেলে... ছোট দু'টো বাচ্চা ঘরে রেখে সে কি করে অতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে ওখানে?

এরকমই বেশ কিছু মানুষকে দেখতাম ভার্সিটিতে থাকতে, হোস্টেল জীবনে। তাদের কেউ কেউ রান্না করতেন, হোস্টেলের মেয়েদের ঘরের কাজকর্ম করে দিতেন আবার কেউ সিকিওরিটির দায়িত্বে থাকতেন। এদেরও অনেক কষ্টের জীবন। একজন ছিলেন বেশ সুন্দরী, অল্পবয়সে বিয়ে দেয়া হয়েছিলো, স্বামীর অত্যাচারে সেই সংসারে অতিকষ্টে মাত্র ২২দিন টিকে ছিলেন তারপর বাধ্য হয়ে চলে আসেন সেখান থেকে। সেই ২২দিনের সংসারের ফসল হিসেবে একটি পুত্রসন্তান ধারণ করেছিলেন, এখনও তাকে নিয়েই আছেন। ছেলেটিকে ইলেক্ট্রিক মিস্ত্রির কাজকর্ম শিখিয়ে মানুষ করেছেন, বিয়ে দিয়েছেন, খুব আদর করেন ছেলের বউকে। শেষ যখন দেখা হয়েছিলো তখন ভালোই ছিলেন, অনেক যুগ ধরে বয়ে বেড়ানো কষ্টের শেষে হয়তো কিছু সুখের মুখ দেখেছিলেন ততদিনে। এরকম গল্প আরও অনেক দেখা হয়েছে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অবস্থায়... কোনটা রেখে কোনটা বলি বলুন?

একদিন হঠাতই এদের কয়েকজনকে দেখলাম ঢাকা কলেজের উল্টোদিকে, কাপড়ের মার্কেটের দোতলায়। স্বল্পখরচে তারা সেলাই করা কাপড় অল্টার করে, ইস্তিরিও করে দেয়। অনেকেই হয়তো জানে না এদের কথা, আমি নিজেও জানতাম না। খুব বেশি মানুষ জানে না বলে হয়তো তাদের ভালো উপার্জনের পথটাও খুব সুগম নয়। খারাপ লাগছিলো দেখে।

আবার কাউকে কাউকে দেখি আধুনিক কোনও হাসপাতালে কিংবা এরকমই কোনও সেবাপ্রদান সংস্থায়। শারীরিক অসুস্থতার কারণে এমন এক জায়গায় কিছুদিন নিয়মিত যেতে হয়েছিলো, সেখানে দেখতাম যারা কাজ করতো তারা প্রায় সবাই মেয়ে, ছেলেদের সংখ্যা খুবই কম। কাজের প্রতি তাদের নিষ্ঠা দেখে ভালো লাগতো। আগে দেখতাম তারা যে যে যার যার সাধ্যমত পোষাক পরে আসতো, কিছুদিন আগে দেখি তাদের জন্য ইউনিফর্মের ব্যবস্থা করা হয়েছে--- গোলাপি শার্ট আর তার সাথে কালো রঙের প্যান্ট আর ব্লেজার। চমৎকার মানিয়েছে মেয়েগুলোকে, নতুন কাপড়ে পুরনো মুখের হাসিটাও নতুনের মতই ঝকঝকে লাগছে দেখতে। হয়তো তারা সবাই খুব সাধারণ সাদামাটা সামান্য মানুষ কিন্তু তাদের হাসির সৌন্দর্য্যও নেহাত খুব সামান্য নয়।

হাসুক ওরা সবাই... বড় ভালো লাগে ওদের হাসতে দেখলে।...

ভালো লাগে কারণ যতই এই মুখগুলোকে দেখি, ততই আমার কেবল নিজের মুখটাই আয়নায় দেখছি বলে মনে হয়।
... ... ...
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই মার্চ, ২০১১ সকাল ১১:৪৭
৬৯টি মন্তব্য ৬৮টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

রাজত্ব আল্লাহ দিলে রাষ্ট্রে দ্বীন কায়েম আমাদেরকে করতে হবে কেন?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:০৬



সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ২৬ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৬। বল হে সার্বভৈৗম শক্তির (রাজত্বের) মালিক আল্লাহ! তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) প্রদান কর এবং যার থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) কেড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তির কোরাস দল

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ০৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৫



ঘুমিয়ে যেও না !
দরজা বন্ধ করো না -
বিশ্বাস রাখো বিপ্লবীরা ফিরে আসবেই
বন্যা ঝড় তুফান , বজ্র কণ্ঠে কোরাস করে
একদিন তারা ঠিক ফিরবে তোমার শহরে।
-
হয়তো... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাইডেন ইহুদী চক্তান্ত থেকে বের হয়েছে, মনে হয়!

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪৮



নেতানিয়াহু ও তার ওয়ার-ক্যাবিনেট বাইডেনকে ইরান আক্রমণের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলো; বাইডেন সেই চক্রান্ত থেকে বের হয়েছে; ইহুদীরা ষড়যন্ত্রকারী, কিন্তু আমেরিকানরা বুদ্ধিমান। নেতানিয়াহু রাফাতে বোমা ফেলাতে, আজকে সকাল থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আজ ২৫শে বৈশাখ। ১৬৩তম রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে আমার গাওয়া কয়েকটি রবীন্দ্রসঙ্গীত শেয়ার করলাম। খুব সাধারণ মানের গায়কী

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ০৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০৫

আপনারা জানেন, আমি কোনো প্রফেশনাল সিঙ্গার না, গলাও ভালো না, কিন্তু গান আমি খুব ভালোবাসি। গান বা সুরই পৃথিবীতে একমাত্র হিরন্ময় প্রেম। এই সুরের মধ্যে ডুবতে ডুবতে একসময় নিজেই সুর... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিশ্ব কবি

লিখেছেন সাইদুর রহমান, ০৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২৭

বৈশাখেরি পঁচিশ তারিখ
কবি তোমার জনম
দিন,
বহু বছর পার হয়েছে
আজও হৃদে, হও নি
লীন।

কবিতা আর গল্প ছড়া
পড়ি সবাই, জুড়ায়
প্রাণ,
খ্যাতি পেলে বিশ্ব জুড়ে
পেলে নভেল, পেলে
মান।

সবার ঘরেই গীতাঞ্জলী
পড়ে সবাই তৃপ্তি
পাই,
আজকে তুমি নেই জগতে
তোমার লেখায় খুঁজি
তাই।

যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×