somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছদ্মবেশী মালী

২৭ শে এপ্রিল, ২০১৪ রাত ১২:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মূল আরবি- আলী আহমদ বাকাছীর
অনুবাদ- তামীম রায়হান

দ্বিতীয় শতাব্দী। তুরস্কের তারসুস শহরের উপকণ্ঠ। এখানে শহরের শেষ সীমানা। এখানে দাড়িয়ে পেছন ফিরে তাকালে পুরো শহরের বসতি দেখা যায়। এ রাস্তা সোজা গিয়ে নেমেছে মরুভূমির বুকে। মরুর বুক চিরে দেশ দেশান্তরে।
শহর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার এ পথ দিয়েই হেঁটে চলেছেন এক সাধক। ওদিকে, বিপরীত দিক থেকে শহরের পানে আসছেন আরেকজন। বেশভূষায় বোঝা যায়, তিনিও সাধক। দুজনের কাঁধেই ছোট ঝুলি। তাতে পানির পেয়ালা, দু মুঠো খেজুর। হাতে জীর্ণ লাঠি।
একজন যেমন শহর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন, আরেকজন অন্য শহর থেকে এসে এ শহরে প্রবেশ করছেন। প্রথম জনের নাম ইবরাহিম বিন আদহাম। দ্বিতীয় জনের নাম শকীক বলখী। দুজন দুদিক থেকে এগিয়ে এলেন। কাছাকাছি হলেন। সালামের শুরুটা করলেন ইবরাহিম বিন আদহাম।
আসসালামু আলাইকুম।
ওয়া আলাইকুমুস সালাম।
সালামের জবাব দিয়ে শকীক বলখী জানতে চাইলেন, আমার মনে হচ্ছে আপনি খোরাসানের লোক, সত্যিই কি তাই?
জি জনাব, আমি খোরাসানের মানুষ। জানালেন ইবরাহিম বিন আদহাম।
শকীক বলখী আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে বললেন, আমিও তো খোরাসানের। আমার বাড়ি বলখে। বলখ চেনেন আপনি?
মাথা নেড়ে সায় জানালেন ইবরাহিম। বললেন, আমার আবাসও বলখে।
এবার বুক মেলালেন দুজন। ইবরাহিমকে আলিঙ্গনে জড়িয়ে শকীক বললেন, স্বাগতম স্বদেশী ভাই আমার। আপনিও কি আল্লাহর রাহে একজন মুসাফির?
ইবরাহিম মাথা নেড়ে বলেন, মুসাফির নই। তবে রিজিকের অন্বেষণে ব্যস্ত ফকির।
শকীক জানতে চান, তবে আপনি তারতুস ছেড়ে চলে যাচ্ছেন কেন?
ইবরাহিম ঃ এখানে এমন কোনো কাজ পাইনি, যা দিয়ে আমার ভরণ পোষণ সম্ভব, তাই চলে যেতে চাইছি।
শকীক ঃ আপনি যদি এ তারসুসে কোনো কাজ না পান, তবে আর অন্য কোথাও তা পাবেন না।
ইবরাহিম ঃ আপনি কি তারসুসে থেকে যাওয়ার ইচ্ছায় এসেছেন?
শকীক ঃ না। এখানে আমার বেশ কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব থাকেন। আপনিও চাইলে আমার সঙ্গে শহরে ফিরে যেতে পারেন। হয়তো আমি আপনাকে কোনো কাজের সন্ধান দেব, যা আপনি চাইছেন।
ইবরাহিম ঃ আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুন। আপনিও কি খোরাসান থেকে রিজিকের খোঁজে এখানে চলে এসেছেন?
শকীক ঃ ভাই আমার! রিজিক তো সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। বলখেও তা আছে।
ইবরাহিম ঃ (মুচকি হেসে) তবে আপনি এখানে কেন?
শকীক ঃ পথ খোঁজার জন্য।
ইবরাহিম ঃ আল্লাহকে পাওয়ার পথ?
শকীক ঃ হু, সেই পথ।
ইবরাহিম ঃ কিন্তু আল্লাহ পাকও তো সর্বত্র বিরাজমান। বলখেও তিনি আছেন।
শকীক ঃ (একটু বিব্রত হয়ে, ইবরাহিমের উদ্দেশ্য তিনি টের পেয়েছেন) কিন্তু তাঁর কাছ পর্যন্ত পৌছতে হলে তো সাধকের সাধনা এবং মুসাফির হওয়া প্রয়োজন।
ইবরাহিম ঃ তবে কি আপনি সাধক মুসাফির?
শকীক ঃ আল্লাহর কাছে এটাই চাই, তিনি যেন আমাকে গ্রহণ করেন। তওফিক দানে ধন্য করেন।
ইবরাহিম ঃ আমি কয়েকজন বুজুর্গের কাছে শুনেছি, মানুষ যখন হৃদয় থেকে একাগ্রচিত্ত হয়, তখন আল্লাহ পাক তাকে সে বিষয়ে তওফিক দান করেন।
শকীক ঃ কথা সত্য। আমরাও চাই, আল্লাহ পাক যেন আমাদেরকে ইখলাস দান করেন।
ইবরাহিম ঃ ভাই আমার, আমি এমনও শুনেছি, আমরা যদি নিজেরা একনিষ্ঠ না হই, তবে আল্লাহ পাকও হৃদয়ের একাগ্রতা দান করেন না।
শকীক ঃ অতি মূল্যবান কথা। আমি তো দেখছি, আপনিও একজন আল্লাহর প্রেমিক সাধক। তবে কি আপনিও পথের সন্ধানী পথিক?
ইবরাহিম ঃ আমি পথের পথিক। পথেই আছি।
শকীক ঃ আমি যদি আপনাকে কিছু বলতে চাই, তবে বলবো, ধোঁকা থেকে বেঁচে থাকবেন সবসময়।
ইবরাহিম ঃ কিন্তু অন্যকে ধোঁকায় থাকা মনে করাও এক ধরণের ধোঁকা।
শকীক ঃ (অবাক হয়ে) সত্যি করে বলুন তো, আপনি কতদিন এ পথে?
ইবরাহিম ঃ সাত বছর ধরে।
শকীক ঃ তবে তো আপনি বিতাড়িত নন এ পথ থেকে।
ইবরাহিম ঃ আর আপনি? আপনি কতকাল ধরে এ পথের সন্ধানে?
শকীক ঃ গত বিশ বছর ধরে। তবে আমি এখনও পথের গোড়ায়।
ইবরাহিম ঃ চিন্তা নেই। আল্লাহ পাক তো বলেছেন, তোমার রবের কাছে একটি দিন তোমাদের গণনায় একবছরের সমান।
শকীক ঃ আমি কি আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করব?
ইবরাহিম ঃ আপনি কি আমাকে যাচাই করতে চাইছেন?
শকীক ঃ হ্যা, যদি আপনি অনুমতি দেন।
ইবরাহিম ঃ বলুন।
শকীক ঃ শোকর এবং সবর সম্পর্কে আপনার মতামত জানতে চাই।
ইবরাহিম ঃ আমি কি প্রথমে আপনার মতামত জানতে পারি?
শকীক ঃ আমরা যখন কিছু পাই, তখন শুকরিয়া আদায় করি। আর যখন না পাই, তখন সবর করি।
ইবরাহিম ঃ এটা তো বলখের কুকুরগুলোও করে। কিছু পেলে কৃতজ্ঞ হয়। না পেলে ধৈর্য ধরে।
শকীক ঃ (এবার তিনি উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। তার মধ্যে যে বিব্রত ভাব ছিল, তা কেটে গেল) আল্লাহ! আল্লাহ! আপনিই তো আমার হারানো ধন, যাকে আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি। সব প্রশংসা আল্লাহর জন্য, তিনিই আমাকে আপনার পরিচয় চিনিয়ে দিলেন। আপনি ইবরাহিম বিন আদহাম।
ইবরাহিম ঃ (বিস্ময়ে চেহারায় ভ্র“ কুঁচকালেন) আর আপনিই কি তবে শকীক বলখী?
শকীক ঃ আশ্চর্য! আপনি কীভাবে টের পেলেন?
ইবরাহিম ঃ আপনি যেভাবে আমাকে চিনেছেন।
শকীক ঃ কখনোই নয়। আমি আপনার মতো নই হে ইবরাহিম! আপনি লোকমুখে প্রসিদ্ধ মানুষ।
ইবরাহিম ঃ মানুষের মুখ নিশ্চুপ হোক। মুখই তো সব বিপদের উৎসমুখ।
শকীক ঃ হে ইবনে আদহাম, মুখ তো আল্লাহকে জিকির করার মাধ্যম।
ইবরাহিম ঃ মুখের জিকিরে কী হবে, যদি অন্তর নিশ্চুপ থাকে!
শকীক ঃ হায় মাবুদ! আপনি আমাকে অনুমতি দিন, আমি আপনার সান্নিধ্যে থাকতে চাই।
ইবরাহিম ঃ তা তো হয় না। বরং আমাকে অনুমতি দিন আপনাকে বিদায় জানানোর।
শকীক ঃ কেন? কারণ, আমি আপনাকে চিনে ফেলেছি, তাই?
ইবরাহিম ঃ হ্যা।
শকীক ঃ আপনাকে কথা দিচ্ছি, কারো কাছে আপনার পরিচয় দেব না। আপনাকে কেউ চিনবে না।
ইবরাহিম ঃ আপনি আমার পেছনে পড়ে থাকতে চান?
শকীক ঃ না। আমি সবসময় আপনার পেছন পেছন ঘূরবো না। আমি শুধু চাই, আমি মাঝেমাঝে আপনার সান্নিধ্য পাবো। আমি জানি, আপনি মানুষের চেনা থেকে পালিয়ে এক শহর থেকে অন্য শহরে পালিয়ে বেড়ান।
ইবরাহিম ঃ হ্যা।
শকীক ঃ আমি আপনার এ ছদ্মবেশের সহযোগী হবো। কেউ আপনাকে চিনবে না। চলুন, তারসুসে ফিরে যাই। আমি ওখানেই আপনার জন্য একটি উপযুক্ত কাজ এনে দেব।
ইবরাহিম ঃ আমাকে আমার নাম ধরে ডাকবেন না।
শকীক ঃ আপনিই একটি নাম বলে দিন, যে নামে আপনাকে ডাকবো।
ইবরাহিম ঃ আবু ইসমাইল খোরাসানি। এ নামে আমাকে ডাকবেন।
শকীক ঃ তবে হে আবু ইসমাইল! কেমন কাজ আপনার পছন্দ?
ইবরাহিম ঃ এমন যে কোনো কাজ, যা আমাকে মানুষের সংশ্রব থেকে দূরে রাখবে। যা আল্লাহ পাকের জিকির থেকে আমাকে উদাসীন করবে না।
শকীক ঃ আমি এ শহরের প্রান্তে একটি বাগানের মালিককে চিনি। আপনি তার বাগানের প্রহরী হিসেবে কাজ করলে কেমন হয়?
ইবরাহিম ঃ উত্তম প্রস্তাব। আমাকে তার কাছে নিয়ে চলুন।

সুবিশাল সবুজ বাগান। সারি সারি আপেল ও আঙুর গাছ। এখানে ওখানে কিছু ডালিমের গাছও দেখা যাচ্ছে। ছায়াঘেরা পরিবেশ। দিনভর পাখিদের মুখরিত ডাক। বাগানের পেছনে মালিকের প্রাসাদ। এলাকার সম্ভ্রান্ত একজন রমণী বাগানটির মালিক। তিনি কখনো কখনো বেড়াতে এলে এখানে থাকেন।
বাগানের প্রবেশপথে বন্ধ ফটক। ফটকের কোণায় ছোট একটি কুঠুরি। এটাই বাগানপ্রহরীর ঘর। কুঠরির ভেতর এক কোণে বিছানো জায়নামাজ। ওখানে বসেন প্রহরী ইবরাহিম বিন আদহাম। অবসরে আল্লাহ পাকের জিকিরে তন্ময় হয়ে থাকেন।
শকীক বলখী এসেছেন তার সঙ্গে দেখা করতে।

শকীক ঃ আবু ইসমাইল! কেমন লাগছে আপনার এ জায়গাটি?
ইবরাহিম ঃ খুবই ভালো। আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদানে ভূষিত করুন।
শকীক ঃ তবে অনুমতি দিন, আজ যাই।
ইবরাহিম ঃ কিছুক্ষণ বসুন। (একটি রুটির টুকরো সামনে এগিয়ে) আমার সঙ্গে এ রুটিতে অংশ নিন।
শকীক ঃ আজ থাক। আরেকদিন। আমি গেলাম। (শকীক বলখী বেরিয়ে গেলেন)

ইবরাহিম ঃ (মনে মনে ভাবছেন) আল্লাহ পাকের প্রশংসা। আমি এখানে যতোদিন চাই, থাকতে পারবো। (তিনি রুটি মুখে দিলেন আর তখনই বাগানের দরজায় একজন ভিখারিনী এলো।ু)
ভিখারিনী ঃ আমি মিসকীন। কিছু দিন। আমি সত্যিই ক্ষুধার্ত।
ইবরাহিম ঃ এই নিন। এটাই আপনার রিজিক। (তিনি রুটির টুকরোটি তুলে দিলেন মহিলার হাতে)
ভিখারিনী ঃ অর্ধেক রুটি! এই কি আপনার সম্বল?
ইবরাহিম ঃ আমার কাছে এর চেয়ে বেশি কিছু নেই। আমাকে ক্ষমা করুন।
ভিখারিনী ঃ তবে আমাকে কিছু ফল এনে দিন।
ইবরাহিম ঃ আমার তো কোনো ফল নেই।
ভিখারিনী ঃ তবে এ পুরো বাগান কার?
ইবরাহিম ঃ বাগান তো মালিকের। আমার নয়। আমি এর মালী মাত্র।
ভিখারিনী ঃ আপনি কি ভাবছেন, আমাকে একটি আপেল কিংবা এক থোকা আঙুর এনে দিলে আপনার মালিক আপনাকে ধরবে?
ইবরাহিম ঃ আপনি যদি আগামীকাল আসেন, তবে মালিকের অনুমতি সাপেক্ষে আপনাকে কিছু ফল দিতে পারব।
ভিখারিনী ঃ আগামীকাল! ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো পাথেয় আমার কাছে থাকলে আমি আজ আপনার কাছে হাত পাততে আসতাম না। আমার ঘরে শিশুরা ক্ষুধার্ত, কাতর।
ইবরাহিম ঃ আপনি অপেক্ষা করুন। (ইবরাহিম বিন আদহাম উঠে চলে গেলেন বাগানের ভেতর। কিছুক্ষণ পর তিনি দুটি আপেল এবং কিছু আঙুর নিয়ে ফিরে এসে মহিলার হাতে তুলে দিলেন)
ভিখারিনী ঃ আল্লাহ আপনাকে উত্তম বিনিময় দান করুন। আপনি যে আমাকে এসব দিয়েছেন, তা কেউ জানবে না। (মহিলাটি বেরিয়ে গেলেন)
ইবরাহিম ঃ (আপন মনে ভাবছেন) দুটি আপেল এবং এক ছড়া আঙুর, এগুলোর মূল্য এক দিরহামের চেয়ে বেশি হবে না হয়তো। যাক, মালিককে এসবের বিনিময়ে দেড় দিরহাম দিয়ে দেব। সতর্কতা হিসেবে একটু বেশি ধরাই ভালো।

এরপর প্রায় প্রতিদিন ওই ভিখারি মহিলা ইবরাহিম বিন আদহামের কাছে এসে হাত পেতে বসে থাকতো। তিনিও তখন বাগানের ভেতর গিয়ে এক-দুটো আপেল বা ডালিম অথবা কিছু আঙুর এনে দান করতেন। তারপর সেগুলোর মূল্য হিসাব করে রাখতেন।
কয়েকদিন পর। বাগানমালিকের পক্ষ থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত বাগান পরিচালক মাতুক এসেছেন দেখাশোনারজন্য।
ইবরাহিম ঃ (দিরহাম হাতে নিয়ে) এগুলো নিন, হে মনিব!
মাতুক ঃ আবু ইসমাইল! এসব কী?
ইবরাহিম ঃ দুটো ডালিমের দাম। গতকাল আমি বাগান থেকে নিয়েছিলাম।
মাতুক ঃ প্রতিদিনই কি তুমি বাগান থেকে ফল-ফলাদি নিচ্ছো আর আমাকে বিনিময়মূল্য পরিশোধ করছো? আল্লাহ পাক জানেন, তুমি কি আমাদের বাগানের মালী নাকি ফলব্যবসায়ী?
ইবরাহিম ঃ মনিব! আমি নিতান্তই একজন মালী। বাগানপ্রহরী।
মাতুক ঃ শোনো, তোমার যদি কিছু খেতে মন চায়, তবে বাগান থেকে খাও। এতে তো দোষের কিছু নেই।
ইবরাহিম ঃ কীভাবে! মূল্য পরিশোধ না করে এভাবে খাওয়া আমার কাছে হালাল মনে হয় না।
মাতুক ঃ আমি তোমাকে অনুমতি দিলাম। এখন থেকে খেও। মূল্য দেয়া লাগবে না।
ইবরাহিম ঃ আপনার বাগানমালিক যখন এ ব্যাপারটি জানবেন, তখন তিনি রেগে যান নাকি সম্মতি দেন- তা তো আমার জানা নেই।
মাতুক ঃ তাকে নিয়ে তোমার চিন্তা কী? আমিই তো এখানে তার স্থলাভিষিক্ত।
ইবরাহিম ঃ আপনাকে ধন্যবাদ। কিন্তু এ দাম পরিশোধের ব্যাপারটুকু আমার হাতেই ছেড়ে দিন জনাব!
মাতুক ঃ তোমার যা ভালো লাগে, তা-ই করো। আর শোনো, পরে যেন আমি ভুলে না যাই। আমাদের বাগানের মালিক তার কয়েকজন বান্ধবী নিয়ে বেড়াতে আসবেন। বান্ধবীরা সবাই উচু বংশের সন্তান। তুমি তাদের আপ্যায়নের জন্য কিছু আপেল, কিছু ডালিম আর আঙুর সংগ্রহের ব্যবস্থা করো। বাগানের সবচে ভালো ফলগুলো বেছে বেছে আলাদা করে রেখো।
ইবরাহিম ঃ আমি তা-ই করবো জনাব।
মাতুক ঃ (আপন মনে) এই বেটা ভাবছে, আমি এ দিরহামগুলো বাগানের মালিক মহিলার কাছে পৌছে দেব। এ তো দেখি আস্ত গাধা! কিন্তু কে জানে, সে হয়তো এর চেয়েও বেশি ফল চুরি করছে আর কয়েকটা দিরহাম দেখিয়ে নিজের সাধুতা দেখাচ্ছে। এটা হতে পারে তার ধোকার একটি কৌশল, যাতে তার প্রতারণা কেউ ধরতে না পারে। কী নামাজি আর কী জিকির যে সে করে! কিন্তু এ সবকিছু তো তার ভণ্ডামিও হতে পারে। শয়তানের কতো রকম ফন্দি-ফিকির!

বাগানের ভেতর প্রাসাদ। এর মজলিসঘরে আয়োজন। মালিক এসেছেন। তার বান্ধবীদের নিয়ে বসেছেন। খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ। এবার ফলাহার। খাদেমরা এসে ফলের ঝুড়ি পেশ করলো। আপেল, ডালিম আর আঙুরসহ নানা রকমের ফল-ফলাদির আয়োজন।
বান্ধবীদের একজন ঃ (মালিককে লক্ষ্য করে) এগুলো কি তোমার বাগানের ফল?
মালিক ঃ হ্যা। এই তারসুস শহরে আমার বাগানের চেয়ে আর কোনো উৎকৃষ্ট বাগান নেই।
আরেকজন বান্ধবী ঃ (একটি আপেল হাতে নিল এবং তাতে কামড় দিয়েই) ওয়াক! এটা দেখি টক আপেল!
মালিক ঃ টক!
প্রথমজন ঃ (আঙুরের ছড়ার দিকে হাত বাড়িয়ে একটি আঙুর মুখে দিতেই) একী! আঙুরও দেখি টক!
মালিকা ঃ টক!
প্রথমজন ঃ বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি! তুমিও একটু চেখে দেখো! নাও, মুখে দিয়ে দেখো!
দ্বিতীয়জন ঃ এ আপেলটিতে এক কামড় দিয়ে দেখো!
মালিক ঃ (আঙুর এবং আপেল মুখে দিয়ে নিশ্চিত হলেন। এগুলো তো সত্যিই টক। তিনি রেগে গেলেন।) আল্লাহ আমার এই বাগানপরিচালককে ধ্বংস করুন। ও দেখি কাঁচা ফল নিয়ে এসেছে। এসব তো এখনও খাওয়ার উপযুক্ত হয়নি। (তিনি ডাক দিলেন) মাতুক!
মাতুক ঃ (দ্রুত মজলিসঘরে প্রবেশ করছেন) জি জনাবা!
মালিক ঃ আল্লাহ যেন তোমার ডাকে সাড়া না দেন! তুমি আমার অতিথিদের জন্য এসব কী ফল এনেছো? আহমক কোথাকার! আপেল টক, আঙুর টক। আল্লাহ তোমাকে লাঞ্চিত করুন। সব মিষ্টি ফলগুলো তুমি খেয়ে আমাদেরকে টক ফল খাওয়াতে চাও তুমি?
মাতুক ঃ মাফ করবেন জনাবা! ওই মালীর কাণ্ড এসব। সে এগুলো সংগ্রহ করেছে।
মালিক ঃ দূর হও! তুমি কীভাবে তার ওপর নির্ভর করলে? তুমি নিজে কেন বেছে বেছে আনলে না?
মাতুক ঃ আমি তো জানতাম না যে, সে ভালো ফল চেনে না।
মালিক ঃ তুমিই তো দায়ী। তুমিই তো তাকে ঠিক করেছো। কি করোনি?
মাতুক ঃ জি জনাবা! আমি ভেবেছিলাম সে যোগ্য এবং বিশ্বস্ত, তাই।
মালিক ঃ তাকে এখনই ডেকে আনো।
মাতুক ঃ জি, এখনই আনছি। (দ্রুতপায়ে বের হয়ে যাচ্ছে)
মালিক ঃ (তিনি লজ্জিত এবং বিব্রত। বান্ধবীদের সামনে এমন ঘটনায় তিনি চিন্তিত। ঝুড়ি থেকে ভালো একটি আপেল খুজে তুলে দিলেন বান্ধবীর হাতে এবং বললেন) এটা মিষ্টি। খেয়ে দেখো ফাতেমা। আর খাদিজা! তুমি এ আঙুর থেকে দুয়েকটা মুখে দাও।

মাতুক এবং ইবরাহিম বিন আদহাম ঘরে প্রবেশ করলেন।
মালিক ঃ (ইবরাহিমকে লক্ষ্য করে) তুমিই কি আজ এ ফলগুলো সংগ্রহ করেছো?
ইবরাহিম ঃ (লজ্জিত এবং অবনত দৃষ্টি) জি, জনাবা।
মালিক ঃ তুমি কি এসব টক আপেল-আঙুর খাইয়ে আমার বান্ধবীদের সামনে আমাকে অপমান করতে চেয়েছিলে?
ইবরাহিম ঃ আল্লাহর পানাহ! আমি এটা চাইতে যাবো কেন?
মাতুক ঃ আমি কি তোমাকে বারবার বলিনি যে, বাগানের সেরা ফলগুলো বেছে বেছে সংগ্রহ করো?
ইবরাহিম ঃ জি বলেছেন। কিন্তু আমি ভেবেছিলাম, তা-ই করার চেষ্টা করেছি। হয়তো ভুল করেছি।
মালিক ঃ (মাতুককে লক্ষ্য করে) দূর হও হতভাগা! কেমন মালী রেখেছো যে কিনা মিষ্টি ও টক ফলের পার্থক্য বোঝে না!
মাতুক ঃ বোঝাবুঝির ব্যাপার না জনাবা! আজ দেড়বছর ধরে সে এখানে কাজ করছে। কোনো শিশুও এতোদিন এখানে থাকলে সে সব শিখে নিতো।
ইবরাহিম ঃ (ইতস্তত ভঙ্গিতে) আমি... আমি..
মালিক ঃ কী বলতে চাও তুমি? বলো।
ইবরাহিম ঃ আমি এ বাগানের একটি ফলও খেয়ে দেখিনি।
মালিক ঃ এই এতোদিনে তুমি একটিও ফল খাওনি! (বান্ধবীদের দিকে তাকিয়ে) তোমরাও হাসো, কাণ্ড দেখো এই মালী বেটার!
মাতুক ঃ আবু ইসমাইল, আমি তো তোমাকে ভালো মানুষ ভেবেছিলাম। তুমি এমন মিথ্যা কী করে বলতে পারলে?
মালিক ঃ (অবাক হয়ে) কী? মিথ্যা? এ কেমন মালী? মিথ্যাও বলে নাকি?
ইবরাহিম ঃ আল্লাহর শপথ! আমি মিথ্যা বলছি না।
মাতুক ঃ এটা আরেকটা মিথ্যা। জনাবা, সে আমাকে প্রায়ই বলে, তার বেতন থেকে কিছু অংশ কেটে রাখার জন্য। সে সারা মাসে বাগান থেকে যেসব ফল নিয়েছে, সেগুলোর বিনিময়মূল্য হিসেবে। এখন কীভাবে বিশ্বাস করি যে, সে বাগান থেকে কিছুই খায়নি!
মালিক ঃ বুজুর্গ মালী মিয়া! এখন কী জবাব দেবে? দাও।
ইবরাহিম ঃ জনাবা! আপনারা অন্য আরেকজন মালী খুঁজে নিন। আমি আর এ কাজের যোগ্য নই।
ইবরাহিম বিন আদহাম নিশ্চুপ, মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। এমন বিব্রতকর পরিস্থিতিতেও তিনি এতোদিনের গোপন দানের কথা প্রকাশ করলেন না। ওই ভিখারিকে তিনি যা দিয়েছেন, সেটা তো আল্লাহর জন্য করেছেন। এখানে বলে কী লাভ!
মালিক এবং তার বান্ধবীরা হেসে উঠলেন উচ্চস্বরে। বললেন, হায়রে মিসকিন! এই পদে তুমি যদি অযোগ্য হও, তবে আর কোন কাজের যোগ্য তুমি হে!
ইবরাহিম ঃ জনাবা! আমাকে মাফ করে দিন। যা হয়েছে, আমার অনিচ্ছায় ভুল হয়েছে।
মালিক ঃ মাতুক! তাকে নিয়ে যাও। তার প্রাপ্য বুঝিয়ে বিদায় করো।
মাতুক ঃ আবু ইসমাইল, এসো আমার সঙ্গে। (দুজন বেরিয়ে গেলেন)

শকীক বলখী এবং মাতুক। দুজনই দাঁড়িয়ে আছেন ইবরাহিম বিন আদহামের কুঠুরির সামনে। তিনি এখন নেই। চলে গেছেন কয়েকদিন আগেই। শকীকের চেহারায় দুঃখ এবং অনুতাপের রেখা স্পষ্ট।
মাতুক ঃ আল্লাহর কসম করে বলছি, আমরা তাকে তাড়িয়ে দিইনি। সে নিজেই বিদায় নিয়ে চলে গেছে।
শকীক ঃ অবশ্যই তোমরা কোনো কথা বা কাজে তাকে কষ্ট দিয়েছো।
মাতুক ঃ সে-ই তো বরং আমার মালিকের সামনে আমাকে অপমানিত করলো। আমার মালিককেও তার বান্ধবীদের সামনে বিব্রত করলো। খোদার কসম, তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক না থাকলে ওই বেটাকে আমি দেখে নিতাম।
শকীক ঃ তুমি কি ভাবছো, সে যখন বললো, আমি এ বাগান থেকে একটি ফলও খাইনি- সে মিথ্যা বলেছে?
মাতুক ঃ ভাবার তো কিছু না। আমি নিশ্চিত, সে মিথ্যা বলেছে।
শকীক ঃ মাতুক, তুমি তার সম্পর্কে কিছুই জানো না। এই পৃথিবীর সব লোকও যদি মিথ্যা বলে, তবুও সে মিথ্যা বলার মানুষ নয়।
বাগানের ফটকে ওই ভিখারিনীকে আবার দেখা গেল। সে উকি দিয়ে শকীক এবং মাতুককে দেখছিল। তার দৃষ্টি ইবরাহিম বিন আদহামকে খুজছিল।
মাতুক ঃ কী ব্যাপার! এই যে মহিলা, কী চাও তুমি?
ভিখারিনী ঃ অপেক্ষা করছি একজনের জন্য। দেখি, সে আসে কিনা?
মাতুক ঃ কে? কে আসবে?
ভিখারিনী ঃ এ বাগানের মালী।
মাতুক ঃ কেন? তার কাছে তোমার কী প্রয়োজন?
ভিখারিনী ঃ (অন্যদিকে চোখ ঘুরিয়ে) কিছু না। সে আসুক তো আগে।
শকীক ঃ (সহজ ভঙ্গিতে) কিছু বলার থাকলে আমাকে বলতে পারো। আমি তার বন্ধুদেরই একজন।
মাতুক ঃ সে কি তোমাকে বাগান থেকে ফল এনে দিতো?
ভিখারিনী ঃ জি হ্যা। বড়ো ভালো মানুষ তিনি। আল্লাহ তাকে উত্তম বিনিময় দান করুন। কিন্তু তিনি আজ কোথায়, একটু বলুন দয়া করে।
শকীক এবং মাতুক দুজনই পরস্পরের দিকে তাকালেন।
মাতুক ঃ একটু দাঁড়ান। (দ্রুত বাগানের ভেতর চলে গেলেন)
ভিখারিনী ঃ (শকীক বলখীর দিকে তাকিয়ে) ওই ভদ্রলোক কোথায় গেলেন, আপনি কি জানেন?
মাতুক ঃ (কিছু ফল হাতে নিয়ে ফিরে এলেন) নিন। আপনার জন্য।
ভিখারিনী ঃ ওই মালীই কি আপনাকে এসব দিতে বলে গেছেন?
মাতুক ঃ হ্যা।
ভিখারিনী ঃ আল্লাহ তাকে ভালো পুরস্কারে সম্মানিত করুন। আপনাদের দুজনকেও তিনি উত্তম বিনিময় দান করুন। আজ আমার সন্তানেরা এ ফলগুলো পেয়ে বেশ আনন্দিত হবে।
ভিখারিনী চলে গেলেন।
শকীক ঃ দেখলে তো। তিনি তোমাদের কাছ থেকে চলে গেছেন, তোমরা অনেক কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয়ে গেলে। ভাই, তুমি কি জানতে কে তিনি?
মাতুক ঃ কে তিনি?
শকীক ঃ তিনি ইবরাহিম বিন আদহাম।
মাতুক ঃ (বিস্ময়ে মুখ হা হয়ে গেল তার) ইবরাহিম বিন আদহাম!
শকীক ঃ হ্যা, হ্যা।
মাতুক ঃ আমি অবশ্যই তাকে খুঁজে বের করব। শহরের সবপ্রান্তে অলিগলিতে।
শকীক ঃ আহারে! তিনি এতক্ষণে শহর ছেড়ে পথ ধরেছেন অন্য শহরের।
মাতুক ঃ তুমি কেন আমাকে আগে তার পরিচয় দিয়ে রাখলে না?
শকীক ঃ তিনি যদি জানতেন যে তুমি তাকে চেনো, তবে তিনি এক মুহূর্তও এখানে থাকতেন না।
মাতুক ঃ (বিষণœ অবয়বে) হায় কপাল! কী রতœটাই আমি হারিয়ে ফেললাম। আহা! তার বিদায়ের আগে যদি একবার বুঝতে পারতাম!

http://tamimraihan.com/
৩টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায় কারো হাত না ধরে (ছবি ব্লগ)

লিখেছেন জুন, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৯

ঐ নীল নীলান্তে দূর দুরান্তে কিছু জানতে না জানতে শান্ত শান্ত মন অশান্ত হয়ে যায়। ১৯২৯ সালে রবার্ট মোস নামে এক ব্যাক্তি লং আইল্যান্ড এর বিস্তীর্ণ সমুদ্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদীর পরিবার সংক্রান্ত আপডেট

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯


মার্চ মাস থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম। ক'দিন আগেও খুলনায় যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানিয়েও আমার বিগত লিখায় কিছু তথ্য চেয়েছিলাম। অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেহেদীর পরিবারকে দেখতে আমার খুলনা যাওয়া হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×