এক
আমার অত্যান্ত দুভার্গ্য যে আমার ফুফার আত্মহত্যাটা নিজের চোখে ধারণ করেছিলাম। আমার ফুফার আত্মহত্যার অন্যতম কারণ ছিল আমার ফুফু। ফুফার আত্মহত্যার দৃশ্যটা দেখে আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। আমরা থাকতাম, ঢাকার মোহাম্মদ পুরের নূরজাহান রোডে, চারতলা বিল্ডিং এর চতুর্থ তলায় ভাড়াটিয়া হিসেবে। আমার এখনো মনে আছে আমার বাবার পকেট থেকে দুইশ টাকা চুরি করে একটা কবুতর কিনে চারতলা বাসার ছাদে চিলেকোঠার রুমে লুকায় রেখেছিলাম। অবশ্য পরে মাকে বলেছিলাম "একটা ভুল হয়ে গেছে মাফ করে তোমার এই বাচ্চাটাকে অন্তরে রাখবা?" মা আমার দিকে তাকায় ছিল অনেকক্ষন তারপর বললো "বাপজান তুমি এখনো ছোট, ছোটরা ভুল করেই তবে এই ভুল গুলা থেইকা নিজেরে পরিশুদ্ধ করে নিবা তাইলে যখন বিস্তীর্ণ আকাশটার মাঝে মেঘ হয়ে শ্বাস নিবা তখন রোদ বৃষ্টির প্রবাহ ঠিক মত বুঝতে পারবা। কি এমন ভুল করছো এখন অনুতপ্ত হইতেছো?"
আমি মাকে সব বলি। আমার মাকে আমি কোন কিছু লুকাই না। চারপাশ যখন অন্ধকারে অন্ধকারে মিশে আলো নিভিয়ে দিত তখন আমার মনে হত আমার মা-ই দ্বীপ দ্বীপ করে জ্বলা একটা প্রদীপ। মা যখন জানলো তখন একটা গম্ভীর শ্বাস নিয়ে বাম গালে থাপ্পড় মেরেছিল। আমি মার খেয়ে কেঁদে জড়িয়ে বলেছিলাম "আব্বারে বইলবে না, আব্বা জানলে জানে মারি ফেইলবে তুমি তোমার এই অন্তরটাকে জানে মাইরতে দিবা?" মা আমার গালে আরেকটা থাপ্পড় মেরে বুকে জড়ায় ধরে রাখে। যে বুকে হাজার হাজার কষ্ট, হতাশার ছাপ থাকলেও জনম জনম শান্তি পাওয়া যায় প্রা্ণ ভরে শ্বাস নেওয়া যায়। আমাকে বলে "এমন ভুল আর করবা না বাপজান। এইসব পাপ। পাপে মন অন্ধকার হয় সেইখানে আলো আসে না, মেঘ আসে না। আমার অন্তরে আলো না আসলে আমার যে কষ্ট লাইগবে বাপজান।"
এমন ভুল আমি আর করিনি। মা, বাবাকে বলেছিল মা আমাকে কবুতর কিনে দিছে। কিন্তু আমি এই কবুতর চিলেকোঠার রুমেই রাখতাম। ফুফু আর ফুফা আমাদের বাসাই থাকত। ফুফার ব্যবসার কি যেন হয়েছিল। আমার সেই বয়সে আমি কিছুই বুঝতাম না। বুঝার বয়সই ছিল না। আমি শুধু খাওয়া দাওয়া, পড়া ঘুরা আর যখন ইচ্ছা হতো রৌদসীর সাথে ঘুরতাম। রৌদসী আমার থেকে বয়সে তিন মাসের বড় ছিল। ওর সাথে যেদিন দেখা হতো না আমার কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগতো। একদিন ওর সাথে হেটে আসতে আসতে বলেছিলাম "যখন কোন কিছু আড়াল হয় তখন তাকে মন হাসপাশ করে খুঁজে কেন বলতে পারো?" ও অনেকক্ষন চুপ থেকে বলেছিল "তুমি অনেক বড় হয়ে গেছো। তোমার থেকে সাবধানে থাকতে হবে। তুমি বাংলা বইয়ের কবিদের মত কথা বলো। আমি এইসব বুঝি না।" আমিও বুঝতাম না। আমার ১২ বছর বয়সে আমার ছোট্ট হৃদয় জুড়ে কেন ওর প্রতি এতো টান ছিল সত্যিই বুঝতাম না। বুঝলাম আরো কয়েক বছর পর যখন আমার সমস্ত অভিধানে একটা স্বচ্ছ শরৎ শহর তৈরি হয়েছিল। যে অভিধানের পুরো বাক্য জুড়েই ছিল ভালোবাসা। আমার প্রথম ভালোবাসা। আর এই ভালোবাসাকে আমি এক অদ্ভুত কারণে হারিয়ে ফেলেছি যেদিন সে আমায় একা করেছিল। সেই একা হওয়ার গল্পটা পরে বলছি।
মুল কথায় ফিরে আসি। ফুফার কি একটা ক্যামিকেলের ব্যবসা ছিল। এই ব্যবসার জন্য মাঝে মাঝে বাবার সাথে দেখা করতে আসতো। আমি দেখতাম কথা বলার সময় ফুফার চেহরাটা এত্তোটুকু ছোট হয়ে যেত। একবার ফুফা আর ফুফু বেড়াতে আসলো্। অনেকদিন থাকলো কিন্তু এই থাকাটা যে একেইবারেই আসা ছিল আমি বুঝেছিলাম কয়েক মাস পরে। মাঝে মাঝে যখন ফুফু ফুফাকে বলতো “নিজের ব্যবসা তো শেষ করলা এখন আমার ভাই এর ঘাড়ে আইসা বসলা। সে তার সংসার নিয়ে নিজেই চলতে পারে না। তোমারে বলি নাই এই ব্যবসা কইরো না। শুনছিলা আমার কথা? শুনছিলা? তোমার লজ্জা না থাকতে পারে আমার তো লজ্জা শরম আছে। এই ভাবে আর কতমাস? হ্যাঁ কতমাস? হয় আমায় ছাড়ো আর না হয় কিছু একটা করো যদি পুরুষ মানুষ পুরুষের মত হয়ে থাকো।”
এমন করেই চলছিল। একটা সময় সব ঠিক হলো। ফুফা আবার ব্যবসা শুরু করলো। ব্যবসার জন্য অন্য শহরে গিয়েছিল। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিলো। আমার ফুফু, ফুফা থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিল। আমার মনে আছে ফুফা প্রায় বাবা আর মায়ের কাছে এসে কাঁদতো আর বলতো “ভাইজান আমি সালেহারে অন্তর দিয়া চাই। সে আমারে আমার দুঃখের সময়টায় একলা করছে আমার কোন অভিযোগ নাই। ওরে আমার সাথে আসতে বলেন। ওরে আমি নিতে চাই।ও আমার কাছে আলাদা একটা জগৎ। ও আমার সাথে রাগ করুক, এই সেই বলুক আমি কোন দিন এর প্রত্যুত্তর দেই নাই।ওরে একটু বুঝান না আবার আমার মাঝে ফিরে আসতে।”
আমার বাবা মা সেদিন কিছুই বলেনি। চুপ ছিল। বলার সাহস ছিল না। কারণ আমার ফুফু স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিল আরেক নতুন শহরে। সে শহর না ছিল আমার পছন্দের আর না ছিল আমার বাবা মায়ের পছন্দের। আর সেদিনের রাতটা ছিল আমার কাছে খুব ভয়ংকর। আমি চিলেকোঠায় কবুতরের সাথে কথা বলছিলাম। এই কবতুর কিনেছিলাম রৌদসীর জন্য। আমি টেলিভিশনে দেখেছিলাম ষাট, সত্তর দশকের নায়ক নায়িকারা কবুতর দিয়ে চিঠির মাধ্যমে তাদের মনের কথা হৃদয়ের কথা লিখে প্রেরণ করতো। আমি নব্বই দশকের ছেলে হয়েও পারতাম না। কিন্তু আমার কাছে ব্যাপারটা এতো ভালো লাগতো তাই মাঝে মাঝে চিঠি লিখে রৌদসীকে শুনাতে কিংবা ওর কাছে পাঠাতে না পারলেও কবুতরকে শুনাতাম। সেদিনও আমি ঠিক এই কাজটাই করছিলাম। ফুফা আমার কাছে এসে বলে “শোভন বাবারে, কোন কিছু নিজের মাঝে বন্দি করে আমরা কত কিছু ভাবি। স্বপ্ন দেখি। এই দেখার মাঝে কত কিছু হয়। আমরা মানুষেরা ভাবতে ভালোবাসি। আবার এই ভাবনার ভালোবাসা যতটা অন্তর্মুখী করা যায় পৃথিবীটা ঠিক ততদিন সুন্দুর। তুমি যখন ইচ্ছা নিজের মত করে ভাবতে পারবা, ভালোবাসতে পারবা। আর যখন প্রকাশ করবা তখন তুমি চাইলেই কিছু পারবা না। আমারেই দেখো, আমি মানুষটা অতি সাধারণ কিন্তু আমার মাঝে অসামান্য হাহাকার আছে। এই হাহাকারগুলো আপনা আপনি তৈরি হয় নাই। তৈরি হতে কারো না কারো সাহা্য্যর দরকার লাগে। মাঝে মাঝে মনে হয় এই হাহাকার গুলো বিক্রি করে হারায় যাই। কিন্তু এই হাহাকার ক্রয় করার মত কোন বিক্রেতা নাই। তাই নিজেই হারায় যাইতে হয়। না হয় এই হাহাকার গুলো বিস্তীর্ন হয়ে নিজেরেই একসময় জ্বালায় দেয় পুড়ায় দেয়। আমার জ্বলতে ভালো লাগে না।”
আমি ফুফার কথা কিছু বুঝতে পারছিলাম না। বুঝতে পারছিলাম শুধু উনার চোখ ভরা অসীম শূণ্যতার ছাপ। সেই শূন্যতার ছাপ নিয়ে চিলেকোঠার রুম থেকে বের হয়ে চার তলা বাড়ির ছাদ থেকে লাফ দিয়ে চোখের সামনে থেকে হারিয়ে যায়। আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না আমার সাথে এটা কি ঘটে গেলো। আমি বোবার মত দাঁড়িয়েছিলাম আর ভয়ে কাপঁছিলাম। এরপরের দিন আমার ভয়নাক জ্বর। মা দোয়া কালাম পড়ে বুকে ফু দেয়। আমি মাকে বলি “মা, চারতলা থেকে কেউ লাফ দিলে মারা যায়?
দুই
বেশ কিছুক্ষন নিরব থাকার পর সাবরিনা ম্যাডাম আমার কথার উত্তর দিচ্ছিলো না আমি বললাম “আপনি কি ভালো আছেন? আজ কেমন গম্ভীর দেখাচ্ছে।” উনি গ্লাস থেকে এক চুমুক পানি খেয়ে বললো “দেশের যে অবস্থা। কিছু দিন পর পর লকডাউন। এদিকে সরকার লকডাউন দিলেও দোষ আবার না দিলেও দোষ। আর ঝামেলা এসে পরে যারা চাকরি করে তাদের উপর। বেতনের অর্ধেক টাকাই চলে যায় যাতায়াত খরচে। আর যারা দিন এনে দিন খাওয়া লোক তাদের কথা তো নাই বললাম। মূলত আমরা সাধারণ মানুষেরাই সচেতন না। একবার ভেবে দেখছেন কোথায় যাচ্ছে আমাদের অবস্থাটা? তা আপনার দিনকাল কেমন চলছে? শুনলাম আপনার জন্য পাত্রি দেখছে। জীবনের অর্ধেক সময় তো পার করে দিলেন। তা সব ঠিকঠাক?” মুখ হা করার যে একটা ব্যাপার থাকে সেটা আমার সাথে এই প্রথম হলো্। আমি ভাবতে লাগলাম সাবরিনা ম্যাডাম এই কথা জানলো কিভাবে? আমি ইয়ে মানে ইয়ে করতে করতে বললাম “ফয়োডর দস্তয়েভস্কি একটা কথা বলেছিলেন “জীবন আমাদের মধ্যে থাকে না বাহ্যিকের মধ্যে” জীবনকে চলাতে হয় ম্যাডাম। চলতে চলতে একটা সময় থমকে গেলেও জগতের জন্য, চারপাশের মানুষের জন্য ইচ্ছা না থাকা স্বত্তেও জীবনের জন্য পথ খুঁজতে হয়। তাছাড়া বাবা মাকে আর বুঝ দিতে ভালো লাগছিল না। তাই তাদেরকে সম্মতি দিয়েছি।”
ম্যাডাম হাসলো আমার কথা শুনে। তারপর বললো “আমার বিয়েটাও ঘটা করে হয়েছিল। তখনো অনার্স কমপ্লিট করিনি। তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলাম। ক্লাস করে আসলাম। বিকেলের দিকে মা বললো এই শাড়িটা পর। আমার অবশ্য একটু সাজতে শাড়ি পরতে ভালো লাগতো। মায়ের শাড়ি। খুশিতে কিছু না ভেবেই শাড়ি পরলাম। আমি তখনো জানতাম না আমাকে পাত্র পক্ষ দেখতে আসবে। তারপর যা হবার হলো। খারাপ লেগেছিল। আমি শুনেছিলাম আমাদের ক্লাসের নিলয় আমাকে পছন্দ করতো।আমারও ভালো লাগতো ছেলেটাকে। কিন্তু ঐভাবে কথাও হতো না। এসব বলাও হতো না। পরে নিজেকে মানিয়ে নিলাম। শুনেছিলাম আমার বিয়ের দিন রাতে আমাদের বাড়ির ছাদে এসে খুব কান্না করেছিল। আমি যখন অসুস্থ হতাম তখন প্রায় বাড়ির সামনে এসে ঘুর ঘুর করতো। পরে দাড়োয়ান মামা আমায় বলতো “তোমাগো ভার্সিটির একটা ছেলে আইসা তোমার কথায় কয়। আমি কই হে অসুস্থ। ভিতরে যান, দেইখা আসেন। হে যায় না।” অনেক কষ্ট পেয়েছিল ছেলেটা। এখন অবশ্য ভালো আছে। মাঝে মধ্যে দেখা হলে কেমন আছি এসব কথা বার্তা হয়। ফয়োডর দস্তয়েভস্কির উক্তিটা সত্য “জীবন আমাদের মাঝে থাকে না, বাহ্যিকের মধ্যো” যাক আগামী শনিবারের মিটিং এর নোটিশ নিশ্চয় পেয়েছেন। কোয়ালিটি ডিপার্টমেন্টের যা যা রিপোর্ট তৈরি করতে হবে তার একটা লিস্ট আপনাকে আমি মেইলে দিয়ে দিচ্ছি। এটা অনুযায়ী রিপোর্ট গুলো মেইক করেন। আপনার উপর আমার সেই আস্থাটা আছে বলেই হাসিব সাহেবকে এবার রিপোর্ট তৈরি করতে দেইনি।”
শরৎ এর বিকেলে আমি রাস্তার ফুটপাত ধরে হেটে যাচ্ছিলাম ঠিক তখনি চমৎকার একটা গান শুনতে পাই। দুটো লাইন এমন...
কেন আমায় পাগল করে যাস
ওরে চলে যাওয়ার দল...
কি সহজ দুটো লাইন কিন্তু কতইনা গভীর। আমার হঠাৎ করে খারাপ লাগতে শুরু করলো।পৃথিবীতে মায়া বিষয়টা ভয়ানক একটা বিষয়। এটা একটা সময় সম্পর্কে গড়ায়। কিন্তু এই সম্পর্ক যখন এই গানের কথার মত চলে যাওয়ার দলে নাম লিখায় তখন মায়াটা রুপ বদল করে হতাশা, জরাজীর্ণ, দুঃখে রুপ নেয়। আমার রৌদসীর কথা মনে পড়ে।আমাদেরও সম্পর্ক শুরু হয়েছিল। আমরা একে অপরকে চাইতাম, ভালোবাসতাম। ওর সাথে যখনি দেখা করতাম আমি পরম মমতা ভালোবাসার চোখে তাকায় থাকতাম। তখন সবে মাত্র স্কুল পাশ করে কলেজে উঠি। আমি মেধাবি ছাত্র ছিলাম না। তবে ও যথেষ্ট মেধাবী ছিল। ও প্রায় আমায় বলতো “তুমি আমার দিকে ড্যাব ড্যাব করে এই ভাবে তাকাও কেন? তোমার চোখের কি লজ্জা নেই? এইভাবে তাকায় থাকলে আমি কোন কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারি না।” আমি হাসছিলাম। আমার হাসি শুনে ও বিরক্ত হয়ে বলেছিল “বেশরম” আমি বলি “এই যে তোমার দিকে তাকায় থাকি, বা্চ্চাদের মত কুচমুচ করে তোমার বকা শুনি আমার একটুও বিধ্বস্ত লাগে না। আমার তখন আরো ইচ্ছা করে হাজার হাজার বছর তোমার দিকে এই ভাবে তাকিয়ে থাকতে, পাশে থাকতে।” ও বললো “বেশি ভালোবাসলে কষ্ট পেতে হয়। আমাদের মাঝে যদি হুট করে কষ্ট নেমে আসে?” আমি চুপ করে এই কথার কি উত্তর দেওয়া যায় ভাবছিলাম। আমি বললাম “তুমি আমার চোখে একটা কবিতা। এই কবিতা কখনো শেষ হয় না।যত পড়ি ততই আগ্রহ বাড়ে। তাই কবিতাকে নিজের কাছেই রেখে দিতে হয় যতনে, ভালোবাসায়।” রৌদসী আমার কথা শুনে হাসে। আমাকে বলে “তুমি এসব কথা কেমন করে বলো হ্যাঁ? অবশ্য একটা ফিল হয়। কিন্তু জনাব, পড়তে পড়তে তো একসময় ক্লান্ত হয়ে যাবা।তখন?”
.
আমি দীর্ঘশ্বাস নিয়ে চাচার পাশে বসি। চাচা আমার উপস্থিতি টের পেয়ে আমার দিকে ছলোছলো চোখে তাকিয়ে থাকে। আমি বললাম “এটা তো রবীন্দ্রনাথ এর গান চাচা। আপনি রবিন্দ্রনাথ কোথা থেকে শিখলেন? আপনার নাতনি কেমন আছে? তাকে দেখছি না। একবছর পর আপনার সাথে দেখা। ভালো আছেন?” চাচা আমার কথার কোন উত্তর দেয় না। আমি খেয়াল করলাম হঠাৎ করেই চাচার চোখ ভরা পানি। কাঁদতে কাঁদতেই আমাকে বললো “বাজান আমার নাতনিডা নাই। হগোলের মত হেও আমায় ছাইড়া গেছেগা।আমার সোনা মানিকটা, জাদু মানিকটা। মাইনষের বাড়িত বাড়িত একটু খাবারের লাই হাত পাতছি। হেরা দরজাও খুলে নাই। উলটা ঝাড়ি দিয়া খেদায় দিত। আমার নাতনিডার চাইরদিন ধইরা জ্বর আছিলো। মরবার আগে তোমারে মনে করছিলো। কইছিলো “আমি পড়ালেখা করবার চাই আরো। শোভন ভাইয়ার মত বড় হইয়া চাকরি করমু। একটা নতুন বাসা নিমু। আমাগো আর কষ্ট থাকবো না।আমাগো আর কেউ ভিক্ষুক কইয়া ডাকবো না। আমারে একটু ভালো হইতে দাও নানা। সব ঠিক হইয়া যাইবো। তুমি চিন্তা কইরো না। কাইদো না। তুমি নানা দোয়া কালাম পইড়া আমারে ফু দাও তো। এই যে এই বুকটাতে। তুমি না কও, যার কেউ নাই তার আল্লাহ আছে? তাইলে এতো কান্দো ক্যান?” বাজানরে এই করোনায় আমি আমার নাতনিডারে ডাক্তার দেখাইতে পারি নাই। ফার্মেসী থেইকা কইয়া কয়ডা টেবলেট আর শিরাপ খাওয়াইছি। কিন্তু আমার কাছে বাইন্ধা রাখবার পারি নাই। সবাই আমারে ছাইড়া যায় গা।”
কথাগুলো বলেই চাচা আবার কাঁদতে থাকে। আমার চোখ দিয়েও পানি। আমি কি বলবো, কি বলে শান্তনা আমার ভাষা নেই। চাচার নাতনির নাম ছিল নিতু। প্রথম যেদিন চাচার সাথে আমি ওকে ভিক্ষা করতে দেখি তখনি ওকে আমি বলি “কি নাম?” ও সুন্দর করে বলে “নিতু, নানা আদর করে ডাকে জাদুসোনা।” আমি চাচাকে বলি “কি হয় আপনার?” চাচা সব কিছু আমাকে খুলে বলে। একদম ছোট্ট বয়সে ডাস্টবিনে খুঁজে পাওয়া, অজানা, অচেনা এই বাচ্চাটাকে উনার নিজের নাতনি হিসেবে বড় করে তুলে পরম ভালোবাসায়। উনার একটা মেয়ে ছিল। সে মেয়ের নামও ছিল নিতু। একানব্বই এর বন্যায় উনার ঘরবাড়ি, পরিবার সবাইকে হারিয়েছিল।চাচার এই কুড়িয়ে পাওয়া নাতনিকে আমি একটা এনজিওর মাধ্যমে চলা স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলাম। কিছু কাপড়, বাজার আর সামান্য কয়টা টাকা দিয়েছিলাম। নিতুর পড়ালেখার সমস্ত খরচ আমি নিয়েছিলাম। কিন্তু এই করোনায় সব কিছু বন্ধ হওয়াতে এনজিওতে আমার যোগাযোগ করা হয়নি। আমার খারাপ লাগে। অনেক অনেক। আমি চাচাকে কিছু টাকা দিয়ে আবার হাটতে থাকি। মনে মনে বলি “নিতু মা তুমি অনেক ভালো থাকো।তুমি অনেক ছোট্ট ছিলে কিন্তু তোমার মন অনেক বড় ছিল। এই বিস্তীর্ন আকাশটার চেয়েও।
তিন
রাত ১০ টার নাগাত আমি একটা ফোন পাই। আমি রিসিভ করতেই বললো “শোভন সাহেব বলছেন?” আমি বললাম “জ্বি কে বলছেন?” কিন্তু ওপাশ থেকে কোন সাড়া শব্দ নেই। একটু চুপ থাকার পর বললো “আপনি মানুষটা অনেক ক্লান্ত তাই না?” এটা বলে একটু থামে তারপর আবার বলে “একটা সময় আমাদের ঘাড়ে বিশাল দায়িত্ব এসে জমা হয়। জীবনজুড়ে অনেক পরজায় থাকে। এই পরাজয়ে আমরা একটা সময় বাঁচার মত বাঁচা শিখে যাই।আমাদের ভিতর যে ক্ষুদ্র অস্তিত্বটা থাকে সেটার সাথে ক্রমাগত যুদ্ধ করতে করতে আমরা মনকে শান্ত করি। কারন সেই মনে কোন একজনের জন্য ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে।”
আমি নিবার্ক হয়ে কথা গুলো শুনছিলাম। এতো আবেগ নিয়ে চমৎকার করে কথাগুলো বলে ফেললো। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললাম “আপনার পরিচয় দিলেন না। কিন্তু আপনিও দেখছি গাম্ভীর্যের মত কথা বলেন।” ওপাশ থেকে আমি হাসির শব্দ শুনতে পাই। আমাকে বললো “অুনমান করুন তো কে হতে পারি?” আমি বললাম “আমার স্মরণ শুক্তি খুবই কম। আমার জানা মতে এমন কণ্ঠের সাথে আমি পরিচিত না।” আমাকে বলে “আমি ইবনাত।গত সপ্তাহে আপনাদের পরিবার থেকে আমাকে দেখতে আসছিলেন। আপনি একদম চুপচাপ ছিলেন। আমার মনে হচ্ছিলো আপনি কোন একটা কিছু নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। আমার ধারণা কি ঠিক?”
আমি কিছুক্ষন সময় নিয়ে বললাম “আমি আসলে বিয়ের জন্য এখনো প্রস্তুত না। বাব মায়ের অনুরোধে গিয়েছিলাম।দুঃখিত আপনার সাথে আমি সেদিন একটা কথাও না বলার জন্য। বিয়ের আগে অন্তত আমার মতে একে অপরকে জানতে ও বুঝতে হয়। আমি বাবা মাকে বলেছিলাম মেয়েকে আগে বুঝি, শুনি তারপর না হয় বিয়ে। আমার মা বলেছিল “মেয়েকে তোর বুঝতে হবে না। মেয়েকে তুই শুধু একবার দেখ। মেয়ে লক্ষি, আমি সব খোঁজ নিছি। মা ছবিটা টেবিলে রেখে গিয়েছিল। আমি একবার ছবিটাও দেখার আগ্রহ দেখায়নি। সেদিন বাবা মায়েরা আপনাদের বাসায় চলে গিয়েছিল। আমি তখনো অফিসে ছিলাম। পরে অফিস থেকেই আমি একা গিয়ে এটেন্ড হই। যতক্ষন আমি বাসায় থাকি আপনার সম্পর্কে নানা প্রকার প্রশংসা আমার বাবা মা দুজনই কিছুক্ষন পর পর এসে কানে গুজে দিয়ে যায়।”
ইবনাত আমাকে বলে “একই কাজটা আমার বাবা মাও, আপনার সম্পর্কে কিছুক্ষন পর পর এসে বলে যাচ্ছে। আপনি মানুষটা অন্য রকম। মনে কোন প্যাচ নেই। যা বলার সহজে বলে ফেলেন। আমারো এখন বিয়ে করতে ইচ্ছে নেই। এমবিএটা শেষ করে নিজে একটা কিছু করবো তারপর বিয়ে নিয়ে ভাবনা। কিন্তু দেশের যে অবস্থা বাবা মা চাচ্ছে আমার বিয়েটা দিয়ে তারা একটু রিলেক্স হোক। আমি তাদের একমাত্র মেয়ে। আমাকে নিয়ে ওদের চিন্তা বেশি। আমার বাবার ডায়াবেটিস এবং পেশার দুটোই আছে। তাই আমিও না করতে পারিনি। আপনাকে ফোন দেওয়ার মূল কারণটা হলো অবশ্য কারণ না একটা রিকুয়েস্ট বলতে পারেন। আমি কয়েকটা টিউশিনি করি। ছেলে মেয়েকে পড়াতে আমার ভালো লাগে। আমি একটা স্কুলে জবও পেয়েছি। কিন্তু এই করোনার জন্য আপাতত অফ আছে। আপনি কি অনুগ্রহ পূর্বক বিয়ের পরও আমাকে এই শিক্ষকতার কাজটা করতে দিবেন? আপনার থেকে অনুমতি এইজন্য চাচ্ছি, মায়ের কাছে শুনেছি বিয়ের আগে ফ্যামিলির বাবা মা এবং বড় ভাই থাকলে কোথায় যেতে বা কোন কিছু করতে চাইলে তাদের কাছে সব কিছু শেয়ার করতে হয় অনুমতি নিতে হয়। আর বিয়ের পর স্বামীর কাছ থেকে। আপনি না চাইলে অবশ্য সম্মতি দিব না।” আমি ইবনাতের কথায় আরো অবাক হই। আমি বললাম “আমরা পৃথিবীটাকে খুব কঠিন মনে করি। আসলে পৃথিবীটা নয় আমরা মানুষেরাই কঠিন। তাই পৃথিবীটাও কঠিন মনে হয়। আর কঠিন পৃথিবীটাতে মানুষ গড়ার দায়িত্ব আমার কাছে অনেক ভালো একটা কাজ। আপনি মানুষ, আমিও মানুষ। সবার চিন্তার বা ভাবনার স্ব স্ব স্বাধীনতা আছে। ঠিক তেমনি আপনারও। আমার কাছে শেয়ার করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। তবে আমি এখনো আপনার স্বামী হইনি।আজ রাখি?”
চার
রৌদসীর সাথে এইভাবে দেখা হওয়ার আমার কোন ইচ্ছা ছিল না। শেষ দেখা হয়েছিল ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারীর ৯ তারিখে। সেই দেখাটাই ছিল শেষ দেখা। ওর জীবন থেকে একা হওয়ার সেই দিন। আমি ভালো ছাত্র ছিলাম না বলে ঢাকাতেই ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির আন্ডারে অনার্স করি আর ও রাজশাহী ইউনিভার্সিটিতে। কিন্তু মাঝে মাঝে আমি ওর সাথে দেখা করতে যেতাম। ও আমার সাথে অভিমান করতো, খেচ খেচ করে বলতো “এতো পাগল হলে হয়? প্রতি মাসে আসার দরকার কি শোভন? আমি কি হারিয়ে গিয়েছি? এই ভাবে আর আসবা না। আমার যখন দেখতে মন চাইবে বা যখন ইচ্ছা হবে শুধু তখনি আমি বলবো। আর তাছাড়া বন্ধের সময় তো আমি বাড়ি যাবই তাই নয়কি? অতিরিক্ত পাগলামি আমার পছন্দের না। আমাদের সামনে ক্যারিয়ার আছে ওটাতে ফোকাস দিতে হবে। সারাক্ষণ এই সব প্রেম নিয়ে ভাবলে চলবে? রিলেশনটা করেছি এবং এটার একটা সুন্দর ভবিষ্যত আছে। নিজেকে গড়ে তুলতে না পারলে এসব রিলেশনের ভ্যালু থাকে না।ঐ যে বলে না অভাবে ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালায়। এই রকম অবস্থা হবে।বুঝছো?” আমি ওসব কথা ভ্রক্ষেপই দিতাম না। আমি উলটা আরো বলতাম “আরো একটু বকো না। তোমার বকা খাইতে ভালো লাগে। এখানে না আসলে বকাটা কি খাইতে পারতাম। আমি এমন বকা খাইতে শুধু রাজশাহী না তুমি যেখানে যাবা সেখানে যাইতে আমার কোন আপত্তি নাই।” ও বিরক্ত হয়ে চোখ বড় বড় করে দাঁত কিড়কিড় করে বলতো “উফ শোভন, তুমি কি? নিজেরে কখন বুঝবা? আল্লাহ এই মানুষটারে যদি একটু বুদ্ধি দিত।”
আমাদের সম্পর্কটা ভালোই চলছিল। আমি সিরিয়াস হলাম, ভাবলাম। আসলেই রিলেশনকে একটা সুন্দর নাম দেওয়ার জন্য নিজেদের গড়ে তোলা প্রয়োজন। আমি রাজশাহীতে আর যেতাম না। কিন্তু যখন কথা বলতে মন চাইতো ফোন দিতাম। কথা বলতাম। একদিন এটাও আস্তে আস্তে কমিয়ে দিলাম। ওকে ওর মত করে থাকতে দিলাম। পড়াশোনাটা ভালো ভাবে করার জন্য। আর কথা বলা কমিয়ে দেওয়া বা দেখা না করাটাই হয়তো আমার ভুল ছিল। একটা সময় যখন কথা বলতে চাইতাম বা বলতাম আমি ঠিক উপলব্দি করতে পারছিলাম। রৌদসী কথা বলার জন্য কথা খুঁজে পেত না। কথা বলার মাঝ পথেই চুপ হয়ে যেত। বেশির ভাগই শুধু কথার উত্তর দিত। একটা সময় পড়া আছে বা প্রেজেনটেশন তৈরি করতে হবে বলে বিদায় নিত। আমি যে ব্যাপার গুলো বুঝেত পারছিলাম সে ব্যাপারেও আমি তাকে কোন কিছুই আস্ক করিনি।”
২০১৪ সালে ডিসেম্বরের শেষের দিকে। গভীর রাতে একদিন ও আমায় ফোন দিল। ফোন দিয়েই কাঁদতে কাঁদতে লাগলো। আমি বলতে লাগলাম “কি হয়েছে আমাকে বলো। কাঁদছো কেন। প্লিজ আমাকে বলো।” কান্না একটু থেমে আমাকে বললো “আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিছি তাই না? আমার না খুব পাপবোধ হয়। আমি আসলে মানসিক ভাবে ঠিক নেই শোভন।” আমি ওকে শান্তনা দিয়ে বলি “এসব কিছুই না। তুমি ওখানে ফ্যামিলির সবাইকে ছাড়া আমাকে ছাড়া আছো তো তাই এসব মনে হয়। তুমি একটা ভালো ঘুম দাও তো। সকাল হলেই দেখবা সব মাথা থেকে সড়ে গেছে।” ও একটু চিৎকার করে বলতে লাগলো “না না এসব কিছুই না। তুমি বুঝবা না।” এটা বলেই লাইনটা কেটে দেয়। আমার খুব ওর কাছে যাওয়াটা দরকার ছিল। কিন্তু আমি ভাবছিলাম একেবারেই ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েই ওর কাছে যাবো। আর একটু সময় যাক।
পরীক্ষা শেষে ওর সাথে যখন আমি দেখা করলাম ও কেমন যেন আমার সাথে রিয়েক্ট করলো। আমি বুঝলাম আমার আরো আগে আসার দরকার ছিল হয়তো ওর মন খারাপের কথা শুনার পরও কেন আসলাম না।এরপর হঠাৎ করেই রৌদসী কেমন যেন ফোঁপাতে লাগলো। আমার ভীষণ খারাপ লাগছিল। কারণ এর আগে আমি কখনো ওকে এমন চেহারায় দেখিনি। ও আমাকে বললো “তুমি আমাকে ভুলে যাও। আমার সাথে আর যোগাযোগ করবা না। তোমার জন্য এটাই ভালো হবে।” আমি নির্বাক হয়ে বললাম “আমার প্রতি অনেক রাগ তাই না?” তারপর অবাক করে দিয়ে বললো “রাগ? শোভন আমি তোমায় শান্তভাবেই বলি। তোমার প্রতি আামর কোন রাগ নেই। রাগ তার সাথেই মানায় যাকে ভালোবাসা যায়। আমার মনে কোন ভালোবাসাই নেই। আমি অনেক ভেবেছি। এই সম্পর্ক আর আগানোর নয়। আমায় মাফ করো প্লিজ।”
আমি ওর কথা বার্তা কিছুই বুঝছিলাম না। আমি ওকে বার বার বলি “এমন করে কথা বলছো কেন? আমাকে বলো তোমার কি হয়েছে। প্রবলেমটা কোথায়?” ও কোমড়ে দুই হাত রেখে ছলোছলো চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো।তারপর একটা সময় বললো “তোমাকে একটা কথা বুঝানোর চেষ্টা করতেছি কেন বুঝতেছো না? বললাম তো এই সম্পর্ক আর আগানোর নয়।” আমার মেজাজটা অন্যরকম হয়ে গিয়েছিল। ওর গালে একটা চড় মারি। ধমক দিয়ে বলি “সেই তখন থেকে একই কথা বার বার বলতেছো। আমাকে একটু বলবা তো তুমি।” ও চড় খেয়ে ফ্যাল ফ্যাল চোখে তাকিয়ে থেকে কাঁদতে কাঁদতেই মাটিতে বসে বলতে লাগলো “এখানে ফাহাদের সাথে আমার পরিচয় হয়। আমরা খুব ভালো বন্ধু ছিলাম। আমি কোন কিছু বুঝতে না পারলে ওর সাথে শেয়ার করতাম। ও আমাকে পড়াটা বুঝায় দিত। আমরা কখনো ভালো বন্ধুত্ব ছাড়া আর কিছুই ভাবিনি। এই বন্ধুত্বের মাঝে না ছিল কোন কমিটমেন্ট আর না ছিল অন্য কিছু। আমার মাঝে মাঝে খারাপ লাগতো আর এই ব্যাপারটা ও বুঝতো। আমার মন ভালো করার জন্য ও উৎকট সব কান্ড করতো। মাঝে মাঝে গান করে শোনাতো। ও ছবি আকঁতো, কখনো মেঘের আবার কখনো পাহাড়ের। একদিন একটা পাহাড় আকঁলো সেই পাহাড়ে একা দাঁড়িয়ে থাকা একটা মেয়ে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করি “তোমার আঁকার ছবির মেয়েটাকে এতো বিষণ্ন দেখাচ্ছে কেন?” সে আমাকে বলে “ভালো করে খেয়াল করো রৌদসী এই মেয়েটা তুমি। এতো বিষণ্ন থাকলে হয়?” ওর প্রতি আমার একটা আলাদা অনুভূতি জন্মালো। ও আমাকে কখনো ভালো লাগার কথা বলেনি। কিন্তু আমরা একে অপরের অনুভূতি গুলো বুঝতাম।” এইটুকু বলেই ও থেমে কাঁদতে থাকে। আমার বুক ধড়ফড় করতে লাগলো। আমি ওর বাকি কথা শুনার অপেক্ষায় থাকি। তারপর ও মাথা নিচু করে বলতে লাগলো। “আমাদের মাঝে কি যেন একটা হয়েছিল। আমি ওকে আমার সব কিছু দিয়েছি। সব সব। আমি এই গুলা মুখে বলতে পারবো না। আমার আজকাল পাপবোধ হয়। আমার রাতে ঘুম আসে না। আমি খুব লজ্জিত, নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে হয়। আমি না এখন তোমার সাথে কথা বলি আর না কথা বলি ফাহাদের সাথে। আমার কিছুই ভালো লাগে না। আমি তোমাকে ঠকিয়েছি। তোমাকে ভালোবাসা দেওয়ার মত আমার কিছুই নেই। আমাকে মাফ করো।”
আমার এতোটা খারাপ লাগছিল। আমি কাঁদছিলাম। অনেক কাঁদছিলাম। মনে হচ্ছিলো কেউ আমার গলা টিপে ধরেছিল। ও আমার সামনে থেকে উঠে চলে যায়। চলে যাওয়ার সময় আমাকে বললো “পারলে আমাকে এখন ঘৃনা করতে শিখো। আর অনুগ্রহ পূর্বক আমাকে তোমার মন থেকে ছুড়ে ফেলে দিও।”
আমার নিজেকে স্বাভাবিকে আনতে দুইটা বছর সময় লেগেছিল। বাবা মা আমাকে চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল। আমি কাউকে এসব কিছু বুঝতে দিতাম না। সারাদিন রুমে একা পড়ে থাকতাম। যাক সেসব কথা। এতোবছর পর রৌদসীর সাথে দেখা হওয়ার পর ও নিজেই প্রথমে আমাকে বললো “এইভাবে দেখা হবে আশা করোনি তাই না? পৃথিবীটা খুব ছোট মানুষ না চাইলেও দেখা হয়ে যায়।ঠিক করে বলো তো তুমি কি আমায় ঘৃনা করা শিখতে পেরোছো?” আমার মোটেও ইচ্ছা নেই পুরানো বিষয় নিয়ে কথা বলার। আমি বললাম “আমাদের প্রত্যেকের কাছে আমাদের জীবনটা একটা ব্যস্তার জীবন। সবাইকেই এই জীবনে ক্রমাগত দৌড়াতে হয়। এসব কিছু মনে রাখার বা ভাবা সময় কই বলো। শুনলাম বিয়ে করেছো। কিন্তু ফাহাদ নয়। অন্য একজনকে। তা কেমন চলছে সংসার।” সে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো “ঠিক বলেছো, সবাইকে এই জীবনে দৌড়াতে হয়। দেখোই না আজও আমি দৌড়াচ্ছি মনের দিক দিয়ে। আমাকে খুব যন্ত্রনা দেই এই বিষয়গুলা। এই জীবনে কাউকে কষ্ট দিয়ে কেউ সুখি হতে পার না।” আমি বললাম “বাদ দাও ওসব কথা। আমি খুব স্যরি, তোমার সাথে এমন একটা সময় দেখা হলো আমার একটু তাড়া আছে। একজনের সাথে দেখা করার কথা। আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি যাই?”
এটা বলেই আমি চলে আসি। আমি মনে মনে বলি প্রিয় রৌদসী যাকে ভালোবাসা যায় তাকে কখনো ঘৃনা করা যায় না। আমি একরাশ হাহাকার নিয়ে হেটে যাই ইবনাতের সাথে দেখা করতে। আমি ইবনাতকে গতকাল ফোন করে রবীন্দ্র সরোবরে দেখা করতে বলেছি। ওকে যে আমার সব বলা দরকার। যখন রাতে ফোন করে বললাম “আপনি সেদিন বললেন না আমাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। আমার ক্লান্ত হওয়ার সব কথা আপনাকে বলতে চাই। সব শুনেই আপনি সিদ্ধান্ত নিবেন আমাকে আপনি বিয়ে করতে রাজি কিনা।” ও শুধু বললো “শাড়ি পরে আসবো?” আমি বললাম “আপনার যেটা ভালো লাগে।” আমি হেটে যাই এক জীবনের রুপকথা শুনাতে...
পরিশিষ্ট
আমি চা খাচ্ছিলাম। ঠিক এমন সময় আফজাল ভাই ফোন করে বললো “শোভন, তুই যে প্রত্যাবর্তন গল্পটা লিখলি এটা তো শেষ করলি না। শেষ না করেই ছাপানোর লেখা জমা দিছিস। দেখ একবছর পর তুই লিখা দিছিস ম্যাগাজিনে লেখাটা গেলে পাঠকের মাঝে মনে প্রশ্ন থেকে যাবে। আরে আমারো তো জানতে ইচ্ছা করতেছে ইবনাতের সাথে পরে কি হলো। গল্পের শেষের অংশটা আজকেই কমপ্লিট করবি।” আমি একটু সময় নিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললাম “দেখো আফজাল ভাই তোমার সাথে আমার সম্পর্ক অনেক বছরের। তুমি আজও আমায় বুঝতে পারলে না। আর তোমাকে কে বললো আমি গল্প লিখি? আমি গল্প লিখি না। আমি জীবন লিখি। যদিও গল্প জীবন থেকে নেওয়া। গল্প তো একটা আবেগ। এই আবেগ ক্ষনিকের জন্য। গল্পের কথা শেষে হয়ে যায়। জীবনের কথা কখনো শেষ হয় না। জীবন একেকবার একেক জায়গায় নতুন করে সাজে, নতুন করে জন্ম নেয়। বাকি অংশ পাঠকরা যার যার মতে করে বুঝে নিবে।” আফজাল ভাই বললো বুঝলাম। তোর সাথে কথা বা সিদ্ধান্তে আমি কখনো দ্বিমত জানাইনি। যদি এটা জীবনই হয়ে থাকে তাহলে এটা কার জীবনের কথা লিখলি? তোর?” আমি বললাম “সেটা তোমায় একদিন বলবো। এখন রাখি কে যেন বাসায় আসছে।” এটা বলেই ফোনটা রেখে ইবনাতকে বললাম “দেখো তো কে আসছে।” ইবনাত দরজা খুলে সালাম দিয়ে বললো “ফুফা আর ফুফু আসছে।” আমাকে দেখেই ফুফা বললো “কিরে তোর খবর কি? নতুন বিয়ে করে আমাদের ভুইলা গেছিস?” আমি বললাম “জীবনে কখনো কাউকে ভুলা যায় না ফুফা। আমাদের জীবনটা অতি ক্ষুদ্র তবুও এখানে জমা থাকে হাজার হাজার স্মৃতি। চাইলেই ভুলা যায় না। যত ভুলতে যাবে ততে বেশি মনে পড়বে...