somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

জাহিদুল হক শোভন
এই শহরে অনেক হাজার হাজার ছেলে আছে যারা চুপচাপ থাকে, কথা কম বলে। পৃথিবীতে তারা বোকা, লাজুক, হাঁদারাম নামে পরিচিত। আমাকে এর সাথে তুলনা করলে তেমন একটা ভুল হবে না। নিজের ব্যাপারে বলাটা অনেক কঠিন। তবে নিজেকে মাঝে মাঝে অনিকেত প্রান্তর ভাবি।

গল্প: অপার্থিব

৩১ শে মে, ২০২৩ সকাল ১০:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এক

“দেখেন তো চোখে কি পড়েছে। চোখ মেলতে পারছি না। হঠাৎ চোখে কি পড়লো আমার?”

এই কথাটা বলার তার আগ পর্যন্ত আমি মেয়েটার নাম জানতাম না। জেনেছি একটু আগে যখন ওর বাবা ওর নাম ধরে ডাক দিয়ে বললো “প্রিতাশা মা, তুই তোর জুবাইদা আপার এখানে একটু থাক। আমি পাশের বাড়ির বরফ গুলো পরিষ্কার করে আসি।” নামটা শুনেই আমার শরীরটা কেপে উঠলো কয়েকবার। মুহুর্তেই ঘাম দিতে শুরু করলো। প্রিতাশার সাথে ইতিমধ্যে আমার কয়েকবার চোখাচোখি হয়েছে। চোখাচোখি হওয়ার পরই যখন উপরের দিকে তাকালো ওর চোখে কি যেন একটা পড়ে। সে ডান চোখটা হাত দিয়ে ধরে আমাকে যখন এই কথাটা বললো আমি একবার ভেবেছিলাম তাকে বলি “আমাকে বলেছেন?” কিন্তু পরক্ষনেই মনে হলো আমি একটা ছাগল। এই রকম বলাটা একদম বোকামি হবে। কারণ মেয়েটার আশে পাশে আমি ছাড়া এই মুহুর্তে কেউ নেই। দরজার বাহিরে আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। দাঁড়িয়ে দেখছিলাম এই কুইবেক শহরের তুষারপাত পড়ার দৃশ্যটাকে। কি মনে করে যেন আমিও আগ প্যাচ আর না ভেবে চোখ থেকে ওর হাত সরিয়ে ফু দিলাম। যখন ফু দিলাম আমার মনে হলো চারপাশ একদম ছেয়ে গেছে ঘন সাদায়। যেমন করে এই তুষারপাত হয়। কানাডার উইন্টারে কুইবেক শহরে রাত্রে বেলা ঘুমানোর আগে এক রকম দৃশ্য দেখা যায় আবার ঘুম থেকে উঠার পর যখন সকালটা দেখা হয় তখন এই তুষারপাতের কারণে অচেনা মনে হয়। ভীষণ অচেনা। সব কিছু ঘন তুষারে ছেয়ে যায়। কিন্তু আমি এমনটা করলাম কেন? ওর হাতটা তো না ছুয়েই চোখে ফু দিতে পারতাম। আমি বললাম “এখন স্বাভাবিক লাগছে?” সে চোখ কচলাতে কচলাতে বললো “না ছাতার কি পড়েছে? আর জায়গা পেল না?” আমি কিছুক্ষন ঝিম মেরে থেকে আমার গায়ের চাঁদরটার একাংশ বলের মত করে ফু দিতে দিতে গরম করে বললাম “দেখি এটা লাগান। ভালো লাগবে।” এর একটু পরই ও বললো “এই তুষারপাত বড় বেয়াদব হয়ে গেছে জানেন।ইদানিং আমার সাথে বেয়াদবি করছে।ওর একদিন কি আমার একদিন।সত্যি ওর খবর আছে।” আমি ওর কথায় হাসলাম এবং বললাম ওরা আপনাকে পছন্দ করে তাই হয়তো একটু দুষ্টামি করছে। আপনি আবার ওদের সাথে রাগ দেখাবেন না। এবারের মত ওদের মাফ করে দেন।কেমন?” আমার কথা শুনে সে নিজেই হেসে দিল।যখন হাসলো আমিও তার হাসির প্রত্যুত্তরে হাসি দিয়ে শুধু অনুভব করলাম এই শুভ্রমাখনো তুষারে রাতের চাঁদটাকে। যদিও এখন সকাল।

বাসার ভিতরে হাসতে হাসতেই প্রিতাশা যখন প্রবেশ করলো তখন জুবাইদা আপা আমার দিকে বেশ কিছুক্ষন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো।এমন করে তাকানো ব্যাপারটা আমি বুঝলাম না। তারপর প্রিতাশা, আপার কাছে গিয়েই বললো “উনি কি তোমার ভাই? যার কথা আমাকে বলতে? আমি কিন্তু দেখেই চিনেছি। তোমার সাথে উনার চেহারার মিল আছে তো।” তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো “কি জনাব এখানের আবহাওয়াটা বাংলাদেশের মত না। এখানে বারো মাসের প্রায় ছয় মাসই উইন্টার সিজন চলে এবং এমনকি এই উইন্টারেও বৃষ্টি হয়। এখানের জায়গা বা রাস্তা গুলো উচু নিচু। রাতে তো বাসা থেকে বের হওয়া যায় না। তবে আশ্চর্যের বিষয় কি জানেন আমার মনে হচ্ছে আপনি এই পরিবেশের সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারবেন। তা না হলে এই শীতেও আপনি একটা টিশার্টের উপর শুধু একটা শাল গায়ে দিয়ে রেখেছেন। এই আপনার শরীরে কি চর্বি বেশি? শীত লাগে না বুঝি?” আমি ফের হাসি ওর কথা শুনে।কি মায়া মায়া ভাবে কথা বলে মেয়েটা। আমার হাসি দেখে জুবাইদা আপা আবার অবাক হয়। এতোবার অবাক হওয়াতে কারণটা আমি বুঝতে পেরেছি। আপা হয়তো বিশ্বাস করছে না, আমি হাসতে পারি। আমার মত একটা মানুষ আবার হাসতে পারবে।

ছোট বেলা থাকতেই আমি খুব ডানপিটে ছিলাম। সারাদিন এইখানে সেখানে ঘুরে বেড়াতাম। পড়ালেখার ধারেও গা ঘেষাতাম না। আমার মনে হতো দুনিয়ার সব চাইতে কঠিন কাজ হলো এই পড়ালেখা। ক্লাস এইটে দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষায় আমি বাংলাতে ফেল করে যখন বাবার সামনে দাঁড়িয়ে একটা হাসি দিয়ে বললাম “বাবা এবারের বাংলা প্রশ্নটা খুব কঠিন হয়েছিল। তারপরও আমি ঠিকঠাক মত পরীক্ষা দিয়েছি। কিন্তু আমাদের বাংলা টিচার জনাব আরিফুজ্জামান স্যার তো আমাকে দেখতে পারে না। একটুর জন্য ফেল করিয়ে দিছে।” এই কথা বলার পরই আমি অনুভব করলাম আমার গাল দুইটা জ্বলতেছে। জ্বলার কারণ বাবা কষে থাপ্পড় লাগিয়েছে আর বলেছে হারামজাদা বাংলা পরীক্ষায় কেউ ফেল করে?” এই ফেল করার কারণে বাবা আমাকে দু দিন বাসায় জায়গা দেয়নি।ফেল করার পর ছেলেমেয়েদের মনে যে চিন্তাটা আসে, যে মন খারাপটা হয় এটা নিয়ে আমি একদমি মাথা ঘামাতাম না। তবে আমি মাথা ঘামালাম অন্যান্য সাবজেক্ট গুলোতে আমি কি করে পাস করলাম? তেমন ভালো পরীক্ষা তো দেইনি। বাবা বাসায় জায়গা না দিলেও ছোট চাচাকে বলে দিয়েছিল “হারামজাদা কোন রাস্তায় পইড়া আছে দেখ। আমার ঘরে ওর জায়গা নাই।তোর বাসায় একটু নিয়া যা। শোন রাতে ও না খেয়ে থাকতে পারে না। মাঝ রাতে ক্ষিধা লাগে। ওরে একটু তোর বাসায় নিয়া যা ভাই।” যেটা চাচা আমাকে রাস্তা থেকে ধরে নেওয়ার সময় সব বলে দিয়েছিল। বলে দিয়েছিল “তোর বাপ এতো ঢং করা শিখছে কোথ থেকেরে? তোর মায়ের থেকে?

এই আরিফুজ্জামান স্যার আমাকে দেখতে না পারার কারণ আছে।যখনই সময় পেতাম তখনই স্যারের বাসার সামনে গিয়ে উঁকি ঝুকি মারতাম।মাঝে মাঝে আমি মিথ্যা অভিনয় করে উনার সামনে গিয়ে বলতাম “স্যার আমি রাতে স্বপ্নে দেখছি আপনি অসুস্থ। খুব অসুস্থ। স্যার আপনার জন্য আমার মায়া হয়। দুঃখ লাগে। যদি আপনার কিছু হয় আমাদের কি হবে? কে আমাকে ক্লাসে কান ধরে দাঁড় করায় রাখবে?” স্যার মনে মনে কি ভাবতো আমি জানতাম না।তবে ঠিকি বুঝতো। কিন্তু আমার চোখ খুঁজে বেড়াতো উনার মেয়ে প্রিতাশাকে দেখার জন্য।প্রিতাশা আমার থেকে এক বছরের ছোট। ক্লাস সেভেনে আমি দুবার ছিলাম।সে কারণেই একই ক্লাসে পড়েছিলাম।

একদিন রোদের তাপটা হারিয়ে গিয়ে বিকেলের ছায়াটা যখন চারপাশে ছড়িয়ে পড়লো আমি আর আমার বন্ধু মিরাজ প্রিতাশার পিছন হাটছিলাম।তখন সবে স্কুল ছুটি হয়েছিল। মিরাজ প্রিতাশাকে ডাক দিয়ে বললো “তোমারে কি যেন বলতে চায় শোভন।” ও চোখ বড় বড় করে বললো “কি বলতে চায়? তোমার এই বন্ধু কি বলতে চায় সে নিজে এসে বলতে পারে না? নাকি তার সাহস নাই?” এই কথা শোনার পর মনে ভয় থাকা সত্ত্বেও আমি নিজেই সামনে গিয়ে কিছুক্ষন সময় নিয়ে বললাম “তোমার চোখ ভালো লাগে।এই চোখে তাকালে চেনা ভূবনটা অচেনা হয়ে ওঠে।নিজেকে হারিয়ে ফেলি। তখন বার বার মনে হয় এই স্বপ্নে হারিয়ে যাবার নীল মেঘটা ছুয়ে দেবার অধিকার কি আমি রাখি?” এটা বলার পরই আমি ভাবছিলাম এটা আমি কি বললাম? এই কথা আমার মুখ দিয়ে কেমন করে বের হলো? সে হাসতে হাসতেই বললো “তুমি যে একটা আহাম্মক আমি ভালো করেই জানি।কিন্তু মাঝে মাঝে বড় মানুষের মত কথা বলো তাতে আমার ভয় লাগে।আমি যাই।”

দুই

কানাডা শহরের মানুষের জীবন যাত্রা কেমন আমার জানা নেই।এখানে মানুষের বাড়ির বরফ পরিষ্কার করার জন্যও চাকরি দেওয়া হয়। প্রিতাশার বাবা তেমন একজন। তবে একটা বিষয় খেয়াল করলাম এটা একটা মেঘের দেশ।এই মেঘের দেশে আলো রোদ তেমন দেখা যায় না। কিন্তু রুপকথারা নগরীর গলিতে ঘুরপাক খায়, অসমাপ্ত গল্প তৈরি করে।আমার জীবনের গল্পটা সেদিনই অসমাপ্ত হয়ে গিয়েছিল যেদিন আমার ভালোবাসার মানুষটাকে আমি হারিয়ে ফেললাম। একেবারেই হারিয়ে ফেললাম।এসব ভাবতে ভাবতেই প্রিতাশা আমাকে বললো “আমার এই তুষারপাত খুব পছন্দের জানেন।চারপাশের ঘরবাড়ি, গাছপালা, সব কিছুতে এই তুষারে যখন আড়াল হয়ে যায় আমার তখন মনে হয় সবকিছুতে একটা মায়া জড়িয়ে আছে। ভালোবাসা জড়িয়ে আছে। পরম মমতা আর ভালোবাসা নিযে এই তুষারপাত সব কিছুকে নিজের মাঝে আবদ্ধ করে রেখেছে।ঠিক বলেছি কি? এমন করে আমাদের নিঃস্বার্থ ভাবে কে ভালোবাসতে পারে বলেন?” আমি শুধু ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম কিন্তু কিছু বললাম না।কানাডার এই প্রিতাশার সাথে আমার পরিচয় হয়েছে আজকে সহ পাঁচদিন। সে আজকে আমাকে তার শহর ঘুরাতে নিয়ে আসছে। অবশ্য জুবাইদা আপা ওকে বার বার বলেছে আমাকে সব কিছু ঘুরে দেখানোর জন্য। আমি কিছুই বলিনি।জুবাইদা আপা কেন ওকে বলেছে আমাকে সময় দেওয়ার জন্য? আমার মুখে আবার হাসি দেখে?

বিকেলের সময়টাতে হাটতে হাটতেই প্রিতাশাকে বললাম “এখানের সব বাড়ি গুলো সুন্দর। সবকিছুতে একটা জাদুগড়ি স্নিগ্ধতা আছে।বাড়ি গুলো বেশ পুরানো রাজা বাদশাদের আমলের মত।নিজেকে এখন একটু রাজকীয় মানুষ মনে হচ্ছে।” সে আমার কথা শুনে কেমন করে যেন তাকিয়ে থাকলো। তারপর তার কালো জ্যাকেটটা ঠিক করে একটা স্বস্থি নিয়ে বললো “একটা ব্যাপার কি জানেন। আমার মা একজন কানাডিয়ান। আমার মায়ের নাম ছিল জারাহ। আমার বাবা একজন বাঙ্গালী। বাবার কেউ নেই আমি ছাড়া। বাংলাদেশে থাকতে একটা এতিম খানায় বড় হয়েছিল। বাবা এখানে আসার পরই একটা সময় মায়ের সাথে ভালোবাসা তৈরি হয়।আমি যখন মায়ের পেটে ছিলাম মা নাকি প্রায় বাবাকে বলতো “ভয় লাগে খুব ভয় লাগে। যদি আমি হারিয়ে যাই কি হবে?” কিন্তু আমার মা ঠিকি হারিয়ে গেলেন। হারিয়ে যাবার আগে বলে গেলেন “তোমাকে কিছু দিতে পারলাম না এই জীবনে।তোমার কাছে শুধু ওকে দিয়ে গেলাম। তোমার উপহার।উপহারটা গ্রহণ করবে না? ওকে খুব ভালোবাসা দিবে কথা দাও?” বাবা কিভাবে এই কানাডার শহরে আসলো সে কথা আমাকে বলেনি। আসলে আমি জিজ্ঞেস করিনি। করতে ইচ্ছে হয়নি। মায়ের ব্যাপারে বা পুরানো কিছু নিয়ে বাবাকে কিছু জিজ্ঞেস করলেই বাবার চোখে পানি দেখতাম। বাবার চোখের পানি আমার একদম ভালো লাগে না। মাঝে মাঝে আমার খুব খারাপ লাগে। মনে হয় মাকে আমিই বাবার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছি। আমি খুব খারাপ তাই না শোভন সাহেব?”

এইটুকু বলেই প্রিতাশা থেমে কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস নেয়। আমি কি বলবো বুঝতে পারি না। প্রিতাশা হাটতে হাটতে একমুঠো বরফ গাছ থেকে নিয়ে মুঠোয় বন্ধি করে ছুড়ে মেরে বলে “বাংলাদেশটা কেমন আমার দেখা হয়নি। আমার দেখার খুব ইচ্ছে। আপনারা বাঙ্গালীরা খুব ভাগ্যবান। ছয় ঋতুর সবকটা সৌন্দর্যই উপভোগ করতে পারেন। কানাডার শহরে ছয় ঋতু আছে বলে মনে হয় না। ছয় মাস থাকে শীত আর ছয় মাস থাকে গরম। আর আপনার, এখানের বাড়ি ঘর দেখেই রাজকীয় মনে হচ্ছে। রাজকীয় তা তারা যারা বাংলাদেশের মাটির গন্ধটা প্রান ভরে নিজের মাঝে ধারন করতে পারে। ইশ কেমন এই স্বাদটা? বাবাকে মাঝে মাঝে বলতাম নিয়ে যেতে কিন্তু বাবা কিছু বলে না। এই কিছু না বলাতে বাবাকে এই নিয়ে আমার আর কিছু বলতেও ইচ্ছে করে না। আমাকে একবার নিযে যাবেন?” আমি ওর দিকে তাকাই। তার নয়ন জোড়াতে কি ভয়ংকর এক আবদার। সে আমার এমন তাকানো দেখে একটা হাসি দিয়ে বললো “কঠিন আবদার করে ফেলেছি তাই না? আচ্ছা বাদ দিন। আপনি এতো চুপচাপ কেন হ্যাঁ। একটা কথা বলি?” আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক ইশারা দেই। সে বললো “জুবাইদা আপার কাছে শুনেছি আপনি চার বছর অসুস্থ ছিলেন। পাঁচতলা বাড়ির ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন।কিন্তু আপনি বেঁচে গিয়েছিলেন।”

আমি ওর কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস নেই। আমার একেকটা দীর্ঘশ্বাস আত্মার ভিতরে বিষাদ হয়ে জমা হয় আবার এই নগরীর মাঝে আমার বিষাদের দীর্ঘশ্বাস গুলো ছড়িয়ে পড়ে।আমি অনুধাবন করি এই বিষাদগ্রস্ত নিশ্বাস এই চমৎকার শহরে ছড়িয়ে দেওয়া কি আমার ঠিক হচ্ছে? কিন্তু আমি বললাম “আমি একটা সময়ের জন্য অপেক্ষা করছি জানেন।সেই সময়টার মাঝে ঝড় হবে, অসীম ঝড়। সামনের বাড়িটা দেখুন। কি চমৎকার।” সে চুল কানে গুজে বলে “আপনি অনেক কঠিন করে কথা বলেন। আমি এতো কঠিন কথা কি বুঝি?” আমি স্থির হয়ে বাড়িটার চারপাশ দেখতে লাগলাম। আমার এমন করে বাড়িটার দৃশ্য চোখে বন্ধি করা দেখে প্রিতাশা বললো “এই বাড়িটাতে “এনি” নামের একজন ভদ্র মহিলা থাকেন। তার বিয়ের পর তার স্বামী তাকে ছেড়ে চলে যায়।এই চলে যাওয়ার কারন হলো এনি কোন দিন মা হতে পারবে না।মানুষটা খুব কষ্ট পায় জানেন। যাকে মন প্রাণ দিয়ে ভালোবেসে ছিল সে মানুষটা ভালোবাসার বন্ধন ত্যাগ করতে একটুও কার্পন্যবোধ করেনি। এনির বাবা খুব বড়লোক ছিল। এনির আবার বিয়ে দিতে চেয়েছিল কিন্তু এনি আর বিয়ে করেনি। এনির বাবার মৃত্যুর পর এনি একদিন সিদ্ধান্ত নেয় মা হতে না পারলেও মা ডাকার এই মধুর ডাকটা সে শুনতে চায়। তারপর থেকেই এই শহরের বিভিন্ন ছেলে মেয়ে বিশেষ করে যাদের বাবা মা নেই তাদের সাহায্য করে। সেই বাচ্চারা তাকে মা বলে ডাকে। আমার মা নেই তো আমিও মা বলে ডাকি। আমাকে আদর করে প্রিতু বলে ডাকে।কিন্তু উনি এখন বাড়িতে নেই। না হয় আপনাকে আমার এই মায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতাম।

আমি প্রিতাশাকে বললাম “সামনের সপ্তাহে কানাডার নায়াগ্রা জলপ্রপাত দেখতে যাবো। যাবেন আমার সাথে?” আমার কথা শুনে তাকে একটু খুঁশি হতে দেখলাম। সে বললো “সত্যি নিয়ে যাবেন? জানেন আমার খুব ইচ্ছে এই জলপ্রপাত দেখার। এই দেশটাতে থাকলেও এটা কখনো দেখিনি। জানেন এই নায়াগ্রা জলপ্রপাতে হাজার হাজার প্রজাপতি উড়ে বেড়ায়। তাদেরকে আমার খুব কাছে থেকে দেখার ইচ্ছে। একটু ছুয়ে দেওয়ার ইচ্ছে।

তিন

সাদা ধবধবে ছোট্ট দাঁতগুলো দেখিয়ে মেহেরিন হাসতে থাকে। আমি ওর এই হাসি দেখে ওর কুকড়ানো চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে বলি “কিরে বুড়ি মামার সাথে দুষ্টামি করতে মজা লাগে?” আমি ওকে আবার কাতুকুতু দেই। যখন ও হাসতে লাগলো ওকে আমার ছোট্ট একটা প্রজাপতি মনে হলো। জুবাইদা আপা সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। আমি বললাম “তোর মেয়ের হাসিটা সুন্দর।পড়ানটা জুড়ায় যায়রে আপা।” আপা আমার কথার ঠিকঠাক প্রতিভাষ না দিয়ে কিছুক্ষন পর আমার পাশে বসে বললো “জানিস তোকে কতদিন পর হাসতে দেখছি এই কয়েকদিন। তুই আমার কাছে থেকে যা ভাই। তোর দুলাভাইয়ের কাছে অবশ্য গতকাল রাতে এই বিষয়ে কথা বলেছিলাম।” আমি হাসি দিয়ে বলি “মায়ের মনটা আমার জন্য কাঁদে। মা কোনদিন আমাকে একা ছাড়েনি। এখানে আসার আগে মা অনেক কান্নাকাটি করেছে। আমাকে তো আসতে দিতে চাইলো না। কিন্তু আমার যে মন ছটফট করলো এখানে আসার জন্যরে আপা। তোর বিয়ের পর তো এখানে চলে আসলি। তারপর থেকেই মায়ের কাছে আমিই সব। কি করে এখানে থাকি বল? মায়ের মনটা চিৎকার দিয়ে ওঠেরে আমি এই সূদর কানাডার শহরে থেকেও বুঝতে পারি।মায়ের যে রাতে ঘুম হয় না।”

আমি একা একা এই বরফের রাজপথে হাটি।শ্বেতশুভ্র এই তুষারপাতে আমি এদেশের ছেলে মেয়েদের দেখি। এই রকম একটা শহরে বসবাস করেও তাদের মুখে কত হাসি। এই হাসিমাখা মুখ নিয়ে তারা স্কিংয়িং করে, আইস স্কেটিং খেলে কখনো কখনো তো এই তুষারপাতের বরফ নিয়ে ডুব দেওয়া শুরু করে।এসব দেখে আমার নিজেরও ভালো লাগে। কিন্তু আমি আমার নিজ দেশের খেলার চেয়ে আর কোন খেলা অপূর্ব বলতে পারি না কেন যেন। ছোট বেলায় কত খেলতাম “হা-ডু-ডু, কাবাডি, ডাংগুলি, গোল্লাছুট, বৌচি, দড়ি লাফানো, কানামাছি, ওপেন্টি বাইস্কোপ, এলাটিং বেলাটিং, আগডুম বাগডুম, ইচিং বিচিং, এক্কাদোক্কা, রাম সাম যদু মদু, চোর ডাকাত, মার্বেল, সাতচাড়া আরও কত কি। এগুলো মনে করলেই নিজেকে আবার সেই পুরানো দিনে হারিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। এসব ভাবতে ভাবতে চারপাশের গাড়িগুলোর দিকে যখন চোখ গেলো তখন দেখলাম তুষারের স্তুপে তারা বন্ধি হয়ে আছে।এ বিষয়টা আমার কেন যেন একটু খারাপ লাগলো। ঠিক এমন এই তুষারের স্তুপের মত আমিও আমার ভালোবাসার মানুষটার মাঝে বন্ধি ছিলাম।আমি কতটুকু ভালোবাসতাম জানি না।কিন্তু আমার মনে হতো আমি যতটুকু ভালোবাসতে শিখেছিলাম, ভালোবেসে ছিলাম তার থেকে হাজার গুন প্রিতাশা আমাকে ভালোবেসেছিল। সেই ভালোবাসায় সাদামাটা কবিতারা আমার জীবনে জোনাকীর মত গল্প তৈরি করতো। যে গল্পের মায়ায় পূর্ণিমার চাঁদ রোজ আমাদের চোখে হাজির হতো। সেই চোখে আমরা স্বপ্ন আঁকতাম। ভালোবাসার স্বপ্ন।কিন্তু এই ভালোবাসার স্বপ্নটাকে কি আমি আঁকতে পেরেছিলাম? আঁকার রং গুলো কি আমার কাছে ছিল।ছিল কি?

মানুষটা আমাকে প্রায় বলতো “আমাকে তোমার বুকের ঠিক মাঝখানটায় রাখবা শোভন। আমার হাত সব সময় আগলে ধরে রাখবা।” কিন্তু আমি কি আগলে ধরবো? সে নিজেই আমাকে আগলে ধরে রাখতো। আমার পড়ালেখা থেকে শুরু করে, জীবনের পথ চলায় সে আমাকে শিখিয়েছিল কিভাবে চলতে হয়, কিভাবে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে মাথা উচু করে আকাশ ছোয়ার স্বপ্ন আঁকতে হয়।আমি প্রায় ভাবতাম কি করে এই মানুষটা আরেকটা মানুষের দায়িত্ব নিতে পারে?সে মানুষটাই আমার চোখের সামনে একেবারে শেষ হয়ে গেলো।একদম শেষ।

ভার্সিটি শেষ করে ওকে কক্সবাজারের নীল পানি কিভাবে ধাক্বা দিয়ে ছুয়ে দিয়ে যায় সেখানে নিয়ে গিয়েছিলাম। সেদিন রাতের আকাশের তারা দেখা যায়নি। আকাশটাও কি জানতো এমন কিছু একটা হয়ে যাবে? হাটতে হাটতে যখন অনেক দুরে চলে গিয়েছিলাম সে বললো “ভয় করে চলো রুমে যাই।অনেক রাত হয়েছে।” আমি শুনি নাই।আমি যদি তার কথা শুনতাম এমনটা তাহলে আর হতো না।তার এই কথা বলার পরই তিনটা ছেলে আমাদের ঘিরে ধরে।ওদের হাতে ছুরি ছিল।এরপর মুহুর্তেই কি থেকে কি হলো আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। আমাকে মারলো। আমি ওদের পায়ে ধরে বলেছিলাম “ভাই মাফ কর।ও তোদের ছোট বোনের মত।আল্লাহর দোহাই লাগে।” একথা বলার পরই দুর শালা বাঁচতে হলে ভাগ এটা বলেই আমার বুক বরবার একটা লাথি মারে। আরেকজন ওর চুলের মুঠোয় ধরে রেখে বলছিল “হাসান, শালীরে খাইতে সেই মজা পামুরে। পুরাই একটা মাল।” প্রিতাশা নিজেকে ছাড়ানোর বার বার চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু ও পারছিল না। আমি ওদের সাথে ধস্তাধস্তি করলে আমার পেটে ছুরি দিয়ে আঘাত করে।এতো কিছু হওয়ার পরও প্রিতাশা চিৎকার দিয়ে বলছিলো “ওরে মারবেন না, আল্লাহ তুমি রহম করো গো।” সেদিন আল্লাহ আমার মানুষটার কথা শুনেছিল কি? আমার হাত পা বেধে আমার সামনে আমার মানুষটারে শেষ করলো। আমি চোখ বন্ধ করে বার বার চিৎকার দিয়ে বলছিলাম “ভাই তোদের পায়ে পড়ি ছাইড়া দে।কেউ শুনেনি আমার কথা।কেউ না।

ওদের কাজ শেষ হলে পাথর দিয়ে প্রিতাশার মুখ থেতলে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু তারপরই কিছু লোকের আসা টের পাওয়াতে ওরা চলে যায়। এরপর আমার আর কিছু মনে নেই।হুশ আসলো এর একদিন পর।চোখ খুলে দেখি হাসপাতালে।আমি প্রিতাশাকে খুঁজতে থাকি।ওর পাশে বসে কাঁদতে থাকি।ও মুখ ওপাশ করে রেখেছিল। যখন আমি ওর হাতটা ছুতে চেয়েছিলাম ও চিৎকার করে বলেছিল “খবরদার এই হাত ছুবে না।ছুবে না, একদম ছুবে না। আমার শরীরটা এখন একটা নষ্ট শরীর। এই অপবিত্র শরীরটাকে ছুয়ে নিজেকে অপবিত্র করবা না। তোমার সাথে আমার থাকা হলো না শোভন।আমাকে মাফ করে দাও।করবা না মাফ?” আমি কাঁদি। ভয়ংকর কাঁদি। আমার ভালোবাসার মানুষটা আমাকে ছুতে নিষেধ করে। মনে কি পরিমাণ যন্ত্রনা থাকলে এমন কথা বলতে পারে? আমি কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলাম “আমি তোমার সাথে সব সময় থাকবো।কোথাও হারিয়ে যেতে দিব না। আমরা একসাথে থাকবো।তুমি সুস্থ হও।” কিন্তু ও কি সুস্থ হয়েছিল। তার পরের রাতই হাসপাতালের চারতলার রেলিং থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করে।

আমি ঠিক ছিলাম না। সারাদিন চিৎকার চেচামেচি করতাম। বাবা মা চোখে চোখে রাখতো। নিজের প্রতি ঘৃনা জন্মায়, আমি কেমন ভালোবাসলাম? নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে এই ভালোবাসা দিয়ে আটকাতে পারিনি।আমার কিছু ভালো লাগতো না।এর একমাস পরেই আমিও পাঁচতলা বাড়ির ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করতে চাইলাম।কিন্তু পাঁচতলা ছাদ থেকে লাফ দিলে কি মানুষ বাঁচে? প্রিতাশা তো বাঁচেনি। আমি বাঁচলাম কেন? তারপর অনেকটা বছর কেটে গেছে। চারটা বছর আমি বিছানায় পড়ে ছিলাম। হাটতে পারতাম না।মাঝরাতে হঠাৎ হঠাৎ করে প্রিতাশা এসে বলতো “আমাদের ভালোবাসাটা বাঁচিয়ে রাখতে চাও না?তুমি যতদিন বাঁচবা তোমার মাঝে আমাদের ভালোবাসাটা ততদিন বেঁচে থাকবে। কথা দাও এমন করবা না।”

চার

আজকের এই সময়টা আমার কাছে রঙ্গিন লাগছে। তারচেয়ে সুন্দর লাগছে কানাডার নায়াগ্রার এই জলপ্রপাত দৃশ্য।চারপাশের এই অপার সৌন্দর্য মুগ্ধ করে ভিতরটাকে।প্রকৃতি তার এই সৌন্দর্য কেমন করে বিলিয়ে দিয়েছে তা আমি অনুধাবন করতে থাকি।পাহাড়ের বুক ঘেষে পানির স্রোত বয়ে গেছে। আর ঝমঝম শব্দ। যতদুর চোখ যায় আমি আঁকতে থাকলাম এই মনোমুগ্ধকর দৃশ্য গুলোকে।প্রিতাশা আমাকে বললো “আপনাকে অনেক ধন্যবাদ জনাব, আমাকে এই চমৎকার একটা জায়গা দেখানোর সুযোগ করে দেওয়াতে।দেখুন চারপাশে সবুজে ঘেরা, সব কিছু সবুজে সবুজে ছেয়ে গেছে।মনে হচ্ছে সবুজের মায়াজালে আটকে যাচ্ছি।পরম করুনাময় তাঁর এই অপার মহিমা যেন এখানে উজাড় করে ঢেলে দিয়েছে।কি সুন্দর শীতল জলধারা বয়ে যাচ্ছে আর প্রজাপতি গুলো এলেধুলে উড়োউড়ি করছে।” আমি প্রিতাশার দিকে তাকাই। তারপর এই নায়াগ্রার শীতল জলপ্রপাত এর দিকে তাকিয়ে বললাম “আপনি অনেক সুন্দর করে কথা বলেন। এটা কি আপনি কখনো বুঝতে পেরেছেন?” সে একটা হাসি দেয়। আমি আর কিছু বললাম না। চারপাশ ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকলাম। একটা সময় বললাম “সন্ধ্যা হয়ে আসবে একটু পর। রুমে আপনাকে রেখে আমি একটু বের হবো। ভয় লাগবে না তো?” সে অনেকক্ষন পর আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললো “অভ্যাস আছে জনাব।বাবাকে যখন এখানে আসার কথা আর আপনার কথা বললাম বাবা আমাকে নিষেধ করেনি। বাবা কি বললো জানেন? বললো আপনি মানুষটা অনেক ভালো।বাবা কাজের জন্য কতদিন বাহিরে থেকেছে।বাসায় একা থাকার অভ্যাসটা হয়ে গেছে।” আমি শুধু চুপ করে প্রিতাশার কথাটা বুঝার চেষ্টা করলাম।

এখানে রাত আটটা যখন বাজলো আমি ঠিক বসে থাকলাম আফরাজের সামনে। দেয়ালে একটা হরিণের চিত্র। আমি ভালো করে দেখতে লাগলাম হরিণের চোখ গুলোকে। ঠিক তখন আফরাজ নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো।মুখ দিয়ে শব্দ করতে লাগলো। আমি মুখের টেপটা খুলে দেই। তারপর সে চোখ বড় করে হাপাতে হাপাতে বললো “আমাকে এভাবে বেধেছেন কেন?” আমি নিচের দিকে তাকিয়ে তারপর ওর দিকে তাকিয়ে চুল গুলো ঠিক করে বললাম “খানকির পোলা তোরে আমি কত খুজছিরে বিশ্বাস কর।খুঁজতে খুঁজতে এখানে চলে আসছি।বিশ্বাস কর তুই যেখানেই থাকতি সেখানে অবশ্যই তোর সাথে আমি দেখা করতাম। মনে আছে ছয় বছর আগের কথা? চারটা বছর আমি অসুস্থ ছিলামরে ভাই। দুইটা বছর ধরে আমি তোদের খুঁজতেছি। তোরা তিনজন ছিলি। আমি শুধু হাসানের নামটা জানতাম। ওই বাইনচোদের বাচ্চারে তো আমি খাইয়া ফেলছি।ওর বিচি কাইটা কুত্তারে খাওয়াইছি। জিহ্বাটা ফাইড়া ফেলছি।ওর থেকে জেনেই এখানে আসছি। সময়টার জন্য আমি অপেক্ষা করছিলামরে। কি বিশ্বাস হয় না? একটু পর তোরেও আমি এমন করবো।তোর এখানে আসার আগে আমাকে ছদ্মবেশ ধরতে হয়েছে।মুখে মেকাপ করতে হয়েছে। বহুত কষ্টে রুমে ঢুকতে পারছি। ছয় বছর আগে কক্সবাজারের কথা মনে আছে? মেয়েটার চিৎকারের কথা মনে আছে? ছেলেটা তোদের পায়ে ধরছিল না? তুই শুয়রের বাচ্চা আমার বুকে লাথি মারছিলি। এই যে, এই পায়ে লাথি মারছিলি না?” এটা বলার পরই বান্দির বাচ্চা বলে ওর মুখে টেপটা আবার লাগিয়ে ওর পায়ে মারতে মারতে আমি পা ভেঙ্গে ফেলি। সে ব্যাথায় কুকড়াতে থাকে। আমি বললাম “মুহিতের ঠিকানা কই পাবো বল। হাসান শুয়রের বাচ্চা শুধু তোর ঠিকানা বলতে পারছেরে ভাই।” সে যখন মুহিতের ঠিকানা বললো আমি একটা হাসি দিয়ে বললাম “তোরা আমাকে জানোয়ার বানায় ফেলছোস। আমি তো এমনটা চাই নাইরে ভাই।ক্যান এমন করলি?

রুমে ঢুকতেই প্রিতাশা আমার দিকে তাকিয়ে বললো “অনেক ক্লান্ত আপনি তাই না? ফ্রেশ হয়ে নিন।” ও এই কথাটা কেন বললো আমি বুঝতে পারলাম না। কিন্তু এটা বুঝতে পারলাম আমি সত্যি অনেক ক্লান্ত।ও কি করে বুঝতে পারলো?

ঘন্টাখানেক পর রাত যখন আরও গভীর হলো আমি ওকে দেখলাম বারান্দায় আকাশের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আকাশের দিকে তাকিযেই বললো “কি ঘুম আসে না? এখানে আসুন। রাতের আকাশটা দেখে যান।” আমি কিছুক্ষন পর ওর পাশে গিয়ে রাতের আকাশের দিকে তাকালাম। সে ইতস্তত করে বললো “আমি জানি আপনি কোথা থেকে এসেছেন। আর কেনই বা আপনার ক্লান্ত লাগছে। জানেন আমি না তেমন গাইতে পারি না। কিন্তু এখন ইচ্ছে করছে আপনাকে একটু গান গেয়ে শুনাই। দেখুন তো এই গান আপনাকে কেমন শিহরিত করে। যদি একটু আপনার চোখে ঘুম আসে।” আমি কি বলা উচিৎ আমি কিছুই জানি না। প্রিতাশা একবার আমার দিকে তাকিয়েই আকাশের দিকে মুখ করে চোখ বন্ধ করে গাইতে থাকলো…

চার পায়ার ওই ঘুমের গাড়ি
আসমান ভরা জোছনার তরী
পাল ভিড়াইয়্যা উঠানে মোর
সাদা জোছনার চাদর পরি।
শুইয়্যা একজন আজ দিবে পাড়ী
রাইখা স্বাদের বসত বাড়ী
স্বাধের সংসার পিছে থুইয়্যা
আজ দেবে পাড়ী…

আমি ভরা চোখে ওর দিকে তাকিয়ে শুধু অনুভব করলাম এই মানুষটা কেনই বা আমাকে এমন করে সময় দিচ্ছে। সে আমাকে বললো “আপনার ভালোবাসার মানুষটার নামও প্রিতাশা ছিল তাই না?” আমি বেশ অবাক হই। সে আবার বললো “আসলে আমিও জানতাম না। কিছুদিন আগে আমি জুবাইদা আপার বাসায় গিয়েছিলাম। আপনি ছিলেন না।হঠাৎ টেবিলের একটা কাগজে প্রিতাশা লেখা নাম দেখলাম। আমি খুব অবাক হয়েছিলাম আমার নাম দেখে। অনেক ভাবলাম এই নাম কেন লিখলো? তারপরই জুবাইদা আপা রুমে আসে। আমি জিজ্ঞেস করাতে সব বলেছে আমাকে। তাই সেদিন পাঁচ তলা ছাদ থেকে লাফ দেওয়ার কথাটা আপনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। আমার কথায় কি আপনার মন খারাপ হয়েছে? আপনার জন্য আমার কেন যেন মায়া হচ্ছে খুব।আপনার সাথে খুব অন্যায় হয়েছে শোভন সাহেব।” আমি ওর এই কথার প্রতিভাষ না দিয়ে বললাম “কিছুদিন পর আমি দেশে চলে যাবো। প্রথম যেদিন আপনার নামটা আমি শুনেছিলাম বিশ্বাস করেন আমার শরীরটা কেপে উঠেছিল।দোয়া করি আপনার জীবনটা সুন্দর হোক।” সে চুল কানে গুজে বললো “আপনার কথা আমার সব সময় মনে থাকবে। যতদিন আপনার সাথে চলেছি, কথা বলেছি এই যে এখনো বলছি সব গুলো আমার ভিতরে জমা করে রাখবো। যাবার সময় আপনার ই-মেইলটা দিবেন? দেশে যাবার পর কখনো যদি ইচ্ছে হয় ই-মেইলটা চেক করবেন।খুব ভালো থাকুন।

পাঁচ

আমি চারপাশে ভালো করে তাকাই।শুধু পানি আর পানি। এই পানিকে যখন বর্ষার পানি ছুয়ে দেয় তখন সে আরও গভীর হয়।মাথার উপর দাড়কাক, বক, উড়তে থাকে।পানির ঢেউ এর দিকে তাকালে তার মত ভাসতে ইচ্ছে করে। আরও অন্যরকম লাগে পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় এই নদীর মোহনীয় স্নিগদ্ধতা দেখলে। আমি এখন পদ্মা নদীর প্রায় মাঝখানটায় নৌকার মাঝে বসে আছি।রাতটা এখানে বসেই হারিকেনের আলোতে কাটিয়েছি। সকালের রোদটা যখন মুহিতের মুখে এসে পড়লো। সে কয়েকাটা আড়মোড়া দিয়ে চোখ কচলাতে কচলাতে আকাশটার দিকে চোখ পড়লে হঠাৎ করে উঠে বসে। আমি তাকে বললাম “শুভ সকাল।ভালো আছেন?”

সে বেশ অবাক হয়।অবাক হয়ে চারপাশে তাকাতে থাকে। আমি বললাম “আমি সব জেনেছি তুই হারামির বাচ্চা সাঁতার জানোস না। এই রাজশাহীতে গতকাল সকালে এসে তোরে সারাদিন খুঁজছি।নদীর পারে আইসা সাধারন মানুষ হওয়ার চেষ্টা করতেছিস। পাপ বাপরেও ছাড়ে না এটা জানোস?” সে আবার চারপাশে তাকায়।তারপর আঙ্গুল নেড়ে আমাকে বললো “তুই কেরে শুয়রের বাচ্চা। কি চাস?” আমি হাসি দিয়ে বলি “আকাশের কালো মেঘ দুর করে আকাশ পরিষ্কার করতে আসছিরে শুয়রের বাচ্চা।ভাই মাল মানে কি?” সে আমাকে বললো “আমার সাথে মজা করোস কুত্তার বাচ্চা? তুই চিনোস আমাকে?” আমি ঘাড়টা নেড়ে বললাম “তোরে আমি চিনবো না এটা কি কোন কথা ভাই? বল না মাল মানে কি? ছয় বছর আগে কক্সবাজারে মেয়েটার চুলের মুঠোয় তুই ধরে বলছিল ও একটা মাল। কস না ভাই মাল মানে কি? ছেলেটা বার বার তোদের কাছে হাত জোর করেছিল। পায়ে ধরেছিল। তোরা কেউ শুনোস নাই। তোর বাকি বন্ধু দুইটারে ঐযে উপরে দেখ উপরে পাঠায় দিছি। বিশ্বাস কর শান্তিতে ঘুমাতে পারি নাই একটা দিনও। আর কাল রাতে আইসা দেখলাম তুই ঘুমাইতেছিস।আমি মানুষটা ছয়টা বছর ধরে ঘুমাতে পারি নাই। আর তুই হারামির বাচ্চা নাক ডাইকা ঘুমাইতেছিলি তা কেমন করে হয়।তোরে ঘুমের মধ্যেই তুইলা নিয়ে আসছি।অবশ্য টাকা দিয়ে কিছু পোলাপাইন যোগাড় করে বলছি পুরানো বন্ধু সারপ্রাইজ দিব।” সে আমার কথা শুনে অবাক হয়। এবার আমি তার চোখে মুখে ভয়ের ছাপ দেখতে পেলাম। আমি চিৎকার দিয়ে বললাম “শুয়রের বাচ্চা কথা বল। বল মাল মানে কি? ও কি মাল ছিলরে কুত্তার বাচ্চা।” এটা বলেই নৌকার বৈঠা দিয়ে বাড়ি মেরে নদীতে ফেলে দেই। আমার চোখের সামনে সে পানির মাঝে কেমন যেন করতে লাগলো। আমি মনে মনে বললাম “আকাশ পরিষ্কার হবেই।”

পরিশিষ্ট

দু বছর পর আমি আমাকে নিয়ে ভাবি।এই জীবনে কি আছে? যা ছিল এই মেঘের আড়ালে, আলোর ভিড়ে? সে মানুষটার সাথে আমার রোজ কথা হয়। কথা হয় মনে মনে। তাকে বলি তোমাকে সাজিয়েছি এই হৃদয়ে। আমি কথা রেখেছি, আমি বাঁচিয়ে রেখেছি আমাদের ভালোবাসাটাকে।

আজকে হঠাৎ করেই কানাডার প্রিতাশার কথা মনে পড়লো। এতোবছর পর মাঝ রাতে আমি ই-মেইল অন করতেই দেখি কত ই-মেইল। একটা মানুষ আমাকে প্রায় ই-মেইল করে যাচ্ছে। আমি একটার পর একটা পড়তে থাকলাম। আর ভাবি এতো ধৈয্য মানুষকে কেমন করে দিয়েছে? ঠিক তিন দিন আগের সেন্ড করা মেইল…

আমার এখন কিছু ভালো লাগে না। না ভালো লাগে এই তুষারপাত, আর না ভালো লাগে এই শহর। এই শহরটা আমার কাছে এখন মৃত মনে হয়। আপনাকে ছাড়া কিছু ভালো লাগে না। জানি আমার এই সস্তা কথা গুলো খুব বেমানান। কিন্তু এই আপনি কি জাদু করে গেলেন আমাকে? পাঁচ দিন হলো আমার ডাক মা “এনি” মারা গেছেন। আল্লাহ তাকে বেহেস্ত নসিব করুক। মানুষটার মনে কি পরিমান কষ্ট ছিল আমি বুঝতাম।শোভন সাহেব আমাকে না বাংলাদেশের মাটি দেখানোর কথা? সবুজের রুপ রস গন্ধটা অনুভব করানোর কথা? এই আমি কবে থেকে অপেক্ষা করছি। কবে আসবেন? কবে নিয়ে যাবেন?

আমি এই এতো এতো ই-মেইলের কি প্রত্যুত্তর দিব বুঝতে পারি না। কাপা কাপা হাতে কিবোর্ডে টাইপ করতে থাকি। কিন্তু একটা সময় ব্যাকস্পেস চেপে বিরক্ত নিয়ে ই-মেইল লগ আউট করে দেই। আমার কিছু ভালো লাগে না। একটা ধুসর ছায়া আমাকে ঘিরে ধরে। তার আরও কিছুক্ষন পর ই-মেইলটা আবার লগ ইন করলাম। তাকে লিখলাম…

“ভালোবাসা অনেক গভীর। এটা বুঝার ক্ষমতা আমার নেই। তবে যে মানুষটা আমার থেকে হারিয়ে গেছে এই যে আমি একাই ওকে ভালোবেসে যাচ্ছি এটাই কি পবিত্র ভালোবাসা? আবার আমাকে নিয়ে, যে ভাবনাটা আপনার মাঝে ধারণ করেছে সেটাও কি পবিত্র ভালোবাসা? এতো ধৈর্য্য নিয়ে আপনার মনে ভালোবাসাটাকে কেন গভীর করছেন? ভালোবাসা কি কখনো পুরানো হয়? কখনো মলিন হয়? নাকি ধূসর বা বর্ণহীন হয়? আমি কিছুই জানি না। শুধু এই টুকুই জানি কারো জন্য বেঁচে থাকাটাই হলো ভালোবাসা। কারো হাত সারা জীবন মুঠোয় বন্ধি করে ধরে রাখার ধৈর্য্যটাই ভালোবাসা।প্রিতাশা আপনি সব জানেন। এতো কিছু জানার পরও আমাকে ভালোবেসেছেন? এই অপার্থিব জীবনের আমি কোন নাম দিতে পারবো না। তবে আপনাকে এই শহরটা দেখাবো। অনুভব করাবো এই শহরের সকাল আর সন্ধ্যার স্নিগ্ধতাটা।”

এর ঠিক তিন দিন পর প্রিতাশার রিপ্লে আসে। ছোট করে লিখা ছিল। “জীবন আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। শিখিয়েছে।এই দেওয়া নেওয়ার মাঝে আমাকে হারিয়ে যেতে দিয়েন না।” আমার কি রিপ্লে দেওয়া উচিৎ আমি জানি না। শুধু ভাবতে লাগলাম প্লেনের টিকিটটা কবে কাটবো…
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মে, ২০২৩ সকাল ১০:০৪
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস-পরীক্ষার হলে দেরিঃ পক্ষ বনাম বিপক্ষ

লিখেছেন BM Khalid Hasan, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



বর্তমানের হট টপিক হলো, “১ মিনিট দেরি করে বিসিএস পরীক্ষার হলে ঢুকতে না পেরে পরীক্ষার্থীর স্বপ্ন ভঙ্গ।” প্রচন্ড কান্নারত অবস্থায় তাদের ছবি ও ভিডিও দেখা যাচ্ছে। কারণ সারাজীবন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৮




আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না। আমাদের দেশে মানুষ জন্ম নেয়ার সাথেই একটি গাছ লাগানো উচিৎ । আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানবতার কাজে বিশ্বাসে বড় ধাক্কা মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৭


মানুষ মানুষের জন্যে, যুগে যুগে মানুষ মাজুর হয়েছে, মানুষই পাশে দাঁড়িয়েছে। অনেকে কাজের ব্যস্ততায় এবং নিজের সময়ের সীমাবদ্ধতায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে না। তখন তারা সাহায্যের হাত বাড়ান আর্থিক ভাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস দিতে না পেরে রাস্তায় গড়াগড়ি যুবকের

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৫৫

আমাদের দেশে সরকারি চাকরি কে বেশ সম্মান দেওয়া হয়। আমি যদি কোটি টাকার মালিক হলেও সুন্দরী মেয়ের বাপ আমাকে জামাই হিসেবে মেনে নিবে না। কিন্তু সেই বাপ আবার ২০... ...বাকিটুকু পড়ুন

×