নরম্যালি অফিসে কাজের চাপ কম থাকলে আমি কলিগদের সাথে ফাউ প্যাচাল পাড়ি, আজাইরা গল্প মারি। মাঝে মাঝে নাহিদকে জিজ্ঞেস তার গার্লফ্রেন্ড কেমন আছে?নাহিদ বরাবরই বলে 'এই ভাই আপনে এইডা কি কন? জানেননা আমার গার্লফ্রেন্ড নাই?' আমি আসলেই জানিনা নাহিদের গার্লফ্রেন্ড আছে নাকি নাই।আবার তার কথা বিশ্বাসও করিনা।কারন তার যে বয়স এবং সে দেখতেও যে সুন্দর টুন্দর তাতে গার্লফ্রেন্ড থাকাটাই স্বাভাবিক। তো যাই হোক আজ নাহিদকে এসব জিজ্ঞেস করিনি।শুধু একটি মেয়ে (ব্যাচমেট ট্যাচমেট হইতে পারে) এসে তাকে যেন কি বললো। আর তার উত্তরে সেও যেন কি বললো। তখন শুধু একটু ভ্রু নাচিয়ে বলেছিলাম, 'কি নাহিদ'।নাহিদ বরাবরের মতোই হাসি দিয়ে বললো,'আরে না বাই'।আমিও আর কথা না বাড়িয়ে ফেইসবুকে নজর দিয়ে ভাইরাল হওয়া অসংখ্য কমেন্ট পড়ছিলাম।
কমেন্টগুলো পড়তে গিয়ে হঠাৎ অনুভব করলাম আমি হতবিহ্বল হয়ে যাচ্ছি,আমার খুব খারাপ লাগছে,আমার বিশ্বাস হচ্ছেনা এই কমেন্টগুলো কোনো মানুষের করা!কি বিভৎস,কি বাজে,কি নোংরা সেসব কমেন্ট! অনুবীক্ষন যন্ত্র দিয়ে খুজেও একটা ভালো কমেন্ট সেখানে পাওয়া যাচ্ছিলোনা। কি জিঘাংসা সেসব কমেন্টে! গা শিউরে উঠে কমেন্টগুলো পড়ে।কি উল্লাস কমেন্টকারীদের! আমার তখন মনে হলো এদেশে মানুষের সংখ্যা খুবই কম।কেননা কোনো মানুষের দূঃসময়ে তার মৃত্যু কামনা করে, তার দুরবস্থায় উল্লাস করে কোনো মানুষের পক্ষে কমেন্ট করা সম্ভব না।তাদের একটাই আফসোস জাফর ইকবাল স্যার খুন হলোনা কেন?অথচ এই মানুষগুলো আবার সিরিয়ায় আক্রান্তদের জন্য চোখের জল ফেলে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদে।আর নিজের দেশের একজন সোনার মানুষ মৃত্যুর মুখোমুখি, তাতে তারা উল্লাস করে!
তাদের এই উল্লাস করার কারন জাফর ইকবাল নামের মানুষটা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কথা বলে,এই দেশটা কোনো সাম্প্রদায়িক উগ্রবাদীদের ভূখন্ড হোক তা জাফর ইকবাল নামক মানুষটা মেনে নিতে নারাজ।জাফর ইকবাল নামক মানুষটা তরুন প্রজন্মকে সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখায়।এগুলোই জাফর ইকবাল নামক মানুষটার দোষ।এজন্যই সে আজ কোপ খায়,এজন্যই মানুষটার মারাত্মক দুঃসময়ে ওরা উল্লাস করে।
মানুষ কতবড় অমানুষ হলে এমনটা করতে পারে!মানুষ কতবড় জানোয়ার হলে এমনটা করতে পারে! চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষন ভাবছিলাম।জাফর ইকবাল স্যারের ওপর হামলা করা হয়েছে জেনে যতটা খারাপ লেগেছে, তার চেয়ে বেশী খারাপ লাগছিলো স্যারের দূরবস্থায় এই জানোয়ারদের বাজে ও নগ্ন কমেন্টগুলো পড়ে।খুব অবাক হচ্ছিলাম আমি।
পরে অবশ্য মনে হলো, যে জাতি তার জাতির পিতাকে নির্মমভাবে হত্যা করতে পারে,যে জাতি তার জাতি পিতাকে মেনে নেয়ার ব্যাপারে এখনও কঠোরভাবে দ্বিমত পোষন করে সে জাতির পক্ষে এটা কোনো ব্যাপারই না।মুজিব নামের যে মানুষটির জন্য এই জাতি আজ বিশ্বের বুকে স্বাধীন জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, স্বাধীনভাবে বাচতে পারছে একটি স্বাধীন পতাকার তলে, তার নামেইতো এই জাতির একটি বিরাট অংশ সারাদিন কুৎসা রটায়, গালাগাল করেও ক্ষান্ত হয়না। তার প্রতিকৃতিকে অসম্মান করে।মুজিব নামের যে মানুষটি জীবনের সোনালী সময় এই জাতির জন্য কাটিয়েছে কনডম সেলে, জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছে লোহার গারদের ভিতর।মুজিব নামের যে মানুষটি এই জাতির মঙ্গলের জন্য স্বীকার করেছেন সকল প্রকার ত্যাগ, মাথায় রাখেননি নিজের স্ত্রীরও কিছু আহ্লাদ থাকতে পারে স্বামী হিসেবে তার কাছে,নিজের সন্তানদেরও কিছু আবদার থাকতে পারে পিতা হিসেবে তার কাছে।সেই মানুষটিকেই এরা ছেড়ে কথা বলেনা,সেই মানুষটির অবদান ও ত্যাগ নিয়ে সন্দেহ পোষন করতেও এরা এক সেকেন্ড ভাবেনা আর বিদেশের লোভনীয় চাকুরী ত্যাগ করে স্ত্রী সন্তান নিয়ে দেশে চলে এসে তরুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে চাওয়া একজন জাফর ইকবাল স্যারকে মূল্যায়ন করতে অক্ষম হবে এটাইতো স্বাভাবিক।তার ওপর হামলা করায় এরা উল্লাস করবে এটাইতো স্বাভাবিক।জাফর ইকবালের ওপর হামলা করায় সে জাতি নগ্ন নৃত্য করবে এটাইতো স্বাভাবিক।আস্তিক নাস্তিকের তফাৎ বোঝার ক্ষমতা না থাকা স্বত্তেও এরা এই মানুষটিকে নাস্তিক,মুরতাদ বলে গালাগাল করে উগ্র সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীদের তাকে খুন করতে উৎসাহ দেবে এটাইতো স্বাভাবিক।
এরা বরাবরই অকৃতজ্ঞ,এরা বরবরই বেঈমান।এরা আর কোনো কিছু না করতে পারলেও বেঈমানীর সাক্ষর রাখার ব্যাপারে দারুন মুন্সীয়ানা দেখাতে পারে।এরা সেই মুন্সীয়ানা দেখিয়েছে পলাশীর প্রান্তরে একদল মীরজাফরের সাথে মিলে ইংরেজদের সাথে জোট বেধে নিজের দেশের জন্য লড়ে যাওয়া নবাবের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করে, আর আরেক বিশাল দল (সমগ্র আমজনতা) পলাশীর প্রান্তরে তাদের স্বাধীনতার জন্য লড়ে যাওয়া নবাবের করুন পরাজয় দেখার নিরব দর্শক হয়ে।সম্ভবত লর্ড ক্লাইভ বলেছিলো, 'এদেশের যে বৃহৎ জনতা দাড়িয়ে দাড়িয়ে যুদ্ধ দেখছিলো তার প্রত্যেকে যদি একটি করে ঢিল ছুড়তো তা হলেও আমাদের নিশ্চিত পরাজয় বরন করতে হতো।'
এরা বরাবরই অকৃতজ্ঞ।যারাই এদের কল্যানের জন্য নিবেদিত হয়েছে তাদেরই এরা বাঁশ দিয়েছে।আর যারাই এদের লাথি মেরেছে তাদেরই এরা দুধভাত মেখে খাইয়েছে।আর এই জাতির মাঝে এদের সংখ্যাটাই বেশী।তার জলজ্যান্ত প্রমান আজন্ম রাজাকার নিযামী,সাঈদী,কামরুজ্জামান প্রমুখদের এরা ভোট দিয়ে জনপ্রতিনিধি বানিয়ে পবিত্র সংসদে পাঠিয়েছে, তাদের গাড়ীতে জাতীয় পতাকা বেধে দেশমাতৃকাকে লজ্জায় ফেলেছে।কুখ্যাত রাজাকার গোলাম আযমকে নাগরিকত্ব দান করে এই দেশে বসবাসের অধিকার দিয়ে স্বাধীনতাকে লাঞ্চিত করেছে।তাদের বিচারের বিরুদ্ধে হেফাজতকে দাড় করিয়েছে। গ্রাম্য শালিশের মাধ্যমে জনৈক মুক্তিযোদ্ধাকে গলায় জুতার মালা পর্যন্ত পরিয়েছে। এরা কবি শামসুর রাহমানকে হত্যাচেষ্টায় ছুরি নিয়ে তাড়া করেছে। আজও এরা তাকে নাস্তিক মুরতাদ বলে গালাগাল করে।
এরা বরাবরই এমন স্রোতের বিপরীতে হেটেছে।যারা এদের ভালবাসা দিতে এসেছে তাদের সাথেই এরা এমন বিরুপ আচরন করেছে।তাদের সাথে সৎ ভাইয়ের মত আচরন করেছে।আজীবন এরা লক্ষীরর থালা পায়ে ঠেলে অলক্ষীকে বুকে ঠাই দিয়েছে। জাফর ইকবাল স্যারের সাথেও তাই করছে।এসব নতুন কিছু নয়।এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।এরা এমনই। এটা আর কেউ না বুঝলেও রবীন্দ্রনাথ ঠিকই বুঝেছিলেন।আর সেজন্যই তিনি লিখেছিলেন-
"হে বঙ্গজননী,
রেখেছো বাঙালী করে,মানুষ করোনি।"
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মার্চ, ২০১৮ সকাল ১০:২৮