বাতাসের শনশন শব্দে নাহিদের ঘুম ভাঙল। ঘুম ভাঙার পরও সে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। বাতাসের শব্দে যে কারও ঘুম ভাঙতে পারে এটা নিয়ে চিন্তা শুরু করেছে। ঢাকায় আসার পর এইসব ফালতু বিষয় নিয়ে ভাবা ছাড়া তার কোন কাজ নেই। কিছুক্ষণ পর আবার বাতাসের আগমন। কিসের যেন একটা গন্ধ পাচ্ছে। সুগন্ধ না, দুর্গন্ধ। কিসের দুর্গন্ধ হতে পারে তা ভেবে বের করতে হবে। এটা কোন নর্দমার গন্ধ না, কোন পশু মরা গন্ধও না। অদ্ভুত ব্যাপার, সে বুঝতেই পারছে না যে এটা কিসের গন্ধ। নাহিদ উঠে বসেছে। রাত বেশি হয় নি। রাস্তায় এখনো যানজট লেগে আছে। এগারোটার পর যানজট থাকে না। তার মানে এখনো এগারটা বাজে নাই। চাচার দোকান থেকে একটা সস্তা সিগারেট ধরাল। সিগারেটে টান দিতেই নাহিদ বুঝল যে সে কিসের গন্ধ পেয়েছে আর সেই গন্ধেই তার ঘুম ভেঙেছে। সিগারেটের গন্ধ না, তার নিজের শরীরের ঘামের গন্ধ। মানুষের শরীরের ঘামের গন্ধ যে এত বিশ্রী হতে পারে তা নাহিদের চিন্তার বাইরে। তার অবশ্য কারণ আছে। গত এক সপ্তাহ ধরে সে গোসল করে নি। করবে বা কি করে? সে জানত যে ঢাকা শহরে থাকার যায়গা আর খাবার এর অভাব। নাহিদের কাছে ব্যাপারটা উল্টো। তার থাকার আর খাবারের অভাব নেই, গোসল করার পানির অভাব। এই সাত দিন তার গোসল করার চিন্তা মাথায় আসে নি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে গোসল না করে এক মিনিটও থাকা যাবে না।
-চাচা, গোসল করব কোথায় বলেন তো?
-এত রাইতে গোসল করবা ক্যান?
-ঢাকায় এসে এখনো গোসল করা হয় নাই, চাচা। তাই আজ গোসলের শুভ উদ্বোধন করব।
-জিয়া উদ্যানের পাশে লেকে চইলা যাও। ওইখানে গোসল করতে ট্যাকা লাগে না।
নাহিদ কিছু না বলে হাটা শুরু করল। ঢাকা শহরে তাহলে গোসল করতে টাকা লাগে? নাহিদের গলা ফাটিয়ে হাসতে ইচ্ছে করছে। এই রাতের বেলা জোরে হাসলে তাকে নগ্ন ট্রাফিক পুলিশ ভাবতে পারে।
নাহিদের কাছে অতিরিক্ত কোন কাপড় নেই। এক প্যান্ট আর এক শার্ট। নিজের গোসলের সাথে এগুলোকেও গোসল করাতে হবে। সে পানিতে নেমে গেল। ঠান্ডা পানিতে গোসল করার মজাই আলাদা। তার ইচ্ছে করছে সারারাত এভাবে থাকতে। গলা পানিতে নেমে সে এভাবে স্থির হয়ে দাড়িয়ে আছে। এভাবে প্রায় আধাঘণ্টা কেটে গেল। আর বেশিক্ষণ থাকলে তার জ্বর বেধে যাবে। সে উঠে ভেজা কাপড়ে জিয়া উদ্যানে এক বেঞ্চে বসে পড়ল।
কিছুক্ষণের মধ্যে সে অদূরে কাউকে আসতে দেখল। একটা মেয়ে। কেমন যেন তা ধিন ধিন তা এই তালে হাটছে। নিয়ন আলোয় মেয়েটার গায়ের রং বুঝা যাচ্ছে না, তবে মুখের অবয়বে ভিঞ্চির মোনালিসার মত লাগছে। তার পাশে এসে মেয়েটা দাঁড়িয়ে পড়ল।
-এক্সকিউজ মি, আমি কি আপনার পাশে বসতে পারি?
-পারেন, তবে না বসাটা ভাল হবে।
-কেন?
-আমার শরীর ভেজা আর এই লেকের পানিতে জীবানু মনে হয় খুব বেশি তাই শরীর চুলকাচ্ছে। চুলকানি সংক্রামক।
-এত বেশি কথা বলেন কেন?
মেয়েটা পাশে বসে পড়ল। কেউ কিছু বলছে না। মিনিট পাঁচেক পর মেয়েটা বলল, আপনার কাছে সিগারেট আছে?
-না।
-কি আছে আপনার কাছে?
নাহিদের বলতে ইচ্ছে করছে, ভেজা শার্ট আর প্যান্ট ছাড়া কিছু নেই। কিন্তু এটা না বলে বলল, কিছুই নেই।
মেয়েটা উঠে গেল। নাহিদের মনে হচ্ছে মেয়েটা কিছুক্ষণের মধ্যে সে আবার আসবে।
কিছুক্ষণের মধ্যে সত্যিই মেয়েটা ফিরে এল। তার হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। পাশে বসে নাহিদের দিকে সিগারেটের প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়ে বলল, চলবে?
নাহিদ চুপচাপ সিগারেটের প্যাকেট থেকে সিগারেট নিল। মেয়েটা দেশলাই এগিয়ে দিল। নাহিদ দেশলাইয়ের আলোতে মেয়েটাকে দেখছে। সত্যি অপরূপ লাগছে মেয়েটাকে। মেয়েটা ফুঁ দিয়ে আগুন নিভিয়ে দিয়ে বলল, এভাবে দেখলে হাত পুড়বে। চাইলে বাসায় নিয়ে মনের মত করে দেখতে পারেন।
নাহিদ সিগারেট জ্বালিয়ে হাটা শুরু করল। সে জানে মেয়েটা তার পিছু নিবে। রাস্তায় যানজট কমে গেছে। নাহিদ ফুটপাত থেকে রাজপথে হাটা শুরু করেছে। পিছনে সে তা ধিন ধিন তা তালে হাটার শব্দ শুনছে সে। এতক্ষণে শার্ট ও প্যান্ট প্রায় শুকিয়ে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে সে পার্কে এসে পৌঁছাল।
নাহিদ চাচার দোকানে গিয়ে কিছু খাবার নিল। এসে দেখে তার পছন্দের বেঞ্চে বসে আছে। খাবারগুলো এগিয়ে দিতেই অসংকোচে মেয়েটা খেতে লাগল। খাওয়া শেষে আবার সিগারেট ধরাল। মেয়েটার কাছাকাছি বসার কারণে একটা পরিচিত ফুলের গন্ধ পাচ্ছে। কিন্তু এটা কোন ফুলের গন্ধ তার নাম মনে করতে পারছে না। ইদানীং নাহিদের স্মরণশক্তি খুবই দুর্বল হয়ে গেছে। মেয়েটার নামও মনে করতে পারছে না। কি যেন নাম? আরে, মেয়েটা তো তার নামই বলে নাই। নাহিদ তার নাম জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করল না।
রাত প্রায় ২টা বাজে। ব্যস্ত শহর সুনসান হতে শুরু করেছে। মাঝে মাঝে দুই একটা গাড়ি শো করে চলে যাচ্ছে। মেয়েটা বেঞ্চে বসে ঘুমাচ্ছি। চাঁদের আলো আর নিয়ন আলোর মিশ্রণে নতুন একটা আভা তৈরি হয়েছে। এই আভাতে মেয়েটাকে কিছুটা জীবনানন্দের বনলতা সেনের মত, কিছুটা ভিঞ্চির মোনালিসার মত লাগছে। নাহিদ আবার সিগারেট জ্বালাল। আজ তার আর ঘুম আসবে না। জেগে জেগে রাত পাহারা দিতে হবে।
কোন পুরুষই কামের ঊর্ধ্বে নয়। কিন্তু কেউ যদি নিজের কামনাকে বসে রাখতে পারে তাহলে হয়তো সে মহাপুরুষ হতে পারবে। নাহিদ নিজেকে মহাপুরুষ ভাবছে আর মিটিমিটি হাসছে। শেষরাতের হালকা বাতাসে মেয়েটা ঠান্ডায় কেঁপে উঠছে। নাহিদ তার পাতলা হাওয়াই শার্টটা খুলে মেয়েটাকে ঢেকে দিল। নাহিদ ভাবছে, আমি মেয়েটার প্রতি সহানুভূতি দেখাচ্ছি কেন? আমি কি মেয়েটাকে ভালবেসে ফেলেছি? না, এটা সম্ভব নয়। নাহিদ মেয়েটার শরীর থেকে শার্টটা নিতে গেলে মেয়েটা নড়েচড়ে ওঠে। নাহিদ পার্ক থেকে উঠে রাস্তায় নেমে পড়ে। রাস্তার এক কুকুর তার সাথে হাটা শুরু করছে। নাহিদ কুকুরটার সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে।
-তোর নাম কী?
-ঘেউঘেউ।
-হাহহা, তোর নাম ঘেউ। বল তো আমার নাম কী?
-ঘেউঘেউ।
-আমার নামও ঘেউঘেউ। হাহাহাহা, এবার বল, পার্কে আমার বেঞ্চে যে মেয়েটা বসে বসে ঘুমাচ্ছে ঐ মেয়েটার নাম কী?
এবার কুকুরটা ঘেউঘেউ করল না।
-কি হল? তুই মেয়েটার নাম বলবি না? তুই যদি মেয়েটার নাম বলতে পারিস তাহলে তোর সুন্দর একটা নাম দিব। অবশ্য এছাড়া তোকে দেওয়ার মত আমার কাছে কিছু নেই। বল, মেয়েটার নাম কী?
-ঘেউঘেউ।
-হাহাহা, তোর কাছে সবাই ঘেউঘেউ। এটাই সত্য আমরা সবাই ঘেউঘেউ করি। কিন্তু আমাদের ঘেউঘেউ মূল্যহীন, তোদের ঘেউঘেউ মূল্যবান। কিভাবে জানিস? তোরা ঘেউঘেউ করে সম্পদ রক্ষা করিস।
প্রায় ঘণ্টাখানেক কুকুরের সাথে এভাবে কথা বলে কাঁটালো। পার্কে ঢুকতেই পাশের মসজিদ থেকে আজান শোনা গেল।
মেয়েটার ঘুম ভেঙেছে।
-ঘুম ভাঙল তাহলে? কেউ বসে বসে ঘুমিয়া রাত পার করতে পারে এই প্রথম দেখলাম।
-এক কাপ চা খাওয়াতে পারবেন?
-এই মুহূর্তে চা? একটু অপেক্ষা করেন। দেখি ব্যবস্থা করা যায় কি না।
নাহিদ উঠে চাচার দোকানে গেল। চাচা নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। দরজায় জোরে ধাক্কা দিয়ে নাহিদ ডাকল, চাচা, নামাজ পড়তে উঠবেন না?
কোন সাড়াশব্দ নেই। আরো জোরে ধাক্কা দিতেই চাচা ধড়ফড় করে উঠল। কি হয়ছে বাবা?
-বলছি নামাজ পড়তে যাবেন না?
চাচা দরজা খুলে অবাক চোখে নাহিদের দিকে তাকিয়ে আছে।
নাহিদ কখনোই তাকে ভোররাতে ডাকে নাই। আর চাচা নিয়মিত নামাজ পড়তেন না। কি মনে করে তিনি উঠে নামাজ পড়তে গেলেন। নাহিদ চুলা জ্বালিয়ে পানি গরম করতে লাগল। দশ মিনিটের মধ্যে চা তৈরি। দুকাপ চা নিয়ে নাহিদ মেয়েটার পাশে গিয়ে বসল। মেয়েটা কোন কথা না বলে চা খেতে লাগল। কারও চা খাওয়ার ভঙ্গি যে এত সুন্দর হতে পারে তা নাহিদের জানা ছিল না। প্রত্যেক চুমুকের পর উপরের তালুতে জিহ্বা দিয়ে টাক করে শব্দ করছে। অন্য কেউ এমন শব্দ করলে হয় তো নাহিদ বিরক্ত হত কিন্তু মেয়েটার এমন শব্দ সে বিভোর হয়ে শুনছে। চা শেষ করলে নাহিদ তাকে জিজ্ঞেস করল, আপনার নাম?
-সব মানুষের নাম থাকে না। আর সব মানুষের নাম জানতে হয় না।
-আপনি থাকেন কোথায়?
-যার নামই নেই, তার থাকার যায়গা থাকে না।
নাহিদ কিছু বলল না। সে চায়ের কাপের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। কিছু পিপড়া তার কাপের দিকে আসছে কিন্তু মেয়েটার কাপের দিকে একটা পিপড়াও যাচ্ছে না। নাহিদ খুবই অবাক হল।
-আচ্ছা, আপনার নাম ঠিকানা না বললেন, অন্য একটা প্রশ্নের উত্তর দিবেন?
-বলেন, কি জানতে চান?
-আমার কাপের দিকে পিপড়া আসছে কিন্তু আপনার কাপের দিকে পিপড়া যাচ্ছে না কেন?
প্রশ্ন শুনে মেয়েটা বিস্মিত হল। তারপরও তার উত্তর দিল, আপনি আমার চায়ে চিনি দেন নাই। ধন্যবাদ চিনি ছাড়া চা খাওয়ানোর জন্য।
মেয়েটা চলে যাচ্ছে। তার যাওয়ার মধ্যে কোন বিকার নেই। একবারও পিছনে তাকাল না। নাহিদের মনে হচ্ছে মেয়েটার নাম রুপা। তার খুবই ইচ্ছা করছে তাকে রুপা বলে ডাক দিতে।
-আপনার নাম কি রুপা?
মেয়েটা পিছনে তাকিয়ে একটা হাসি দিল।