- মিনার রশীদ এর কলাম- নয়া দিগন্ত
জাতিসঙ্ঘসহ আরো অনেক বিশ্ববিখ্যাত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও অন্যান্য সংস্থা নিকট অতীতে বাংলাদেশের ব্যাপারে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছে, উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সেসবের সংবাদমূল্য অনেক বেশি হলেও সেগুলো নিয়ে প্রথম আলোর মতো পত্রিকাগুলো কোনো সংবাদ প্রকাশ করেনি। কিন্তু আজ অজ্ঞাত, অখ্যাত কিংবা বিশ্ব পরিসরে অতি স্বল্প পরিচিত একটি প্রতিষ্ঠানের একটি জরিপকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করেছে । অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ওই জরিপটি ৫ জানুয়ারির সাধারণ নির্বাচনের সব লজ্জা ও কদর্যতাকে মুছে দিয়েছে । একই গোছের মিডিয়া ও পত্রিকাগুলোর ভাবখানা এমন যে, এখন থেকে এ দেশে নির্বাচনের কোনো দরকার নেই। অজ্ঞাত, অখ্যাত মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এরূপ একটি জরিপ হলেই চলবে।
গত রাতে অনলাইনে প্রথম শিরোনাম করা হয়েছিল, সরকারের চেয়ে অধিক জনপ্রিয় শেখ হাসিনা। শিরোনামটি একটু বেশি তৈলাক্ত হয়ে যাওয়ায় তা পরে সংশোধন করে লেখা হয়েছে- সরকারের জনপ্রিয়তা বেড়েছে/দুর্নীতি নিয়ে উদ্বেগ/মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জরিপ। পাঠকদের বিভ্রান্ত করতে রিপোর্টটিকে আরেকটু ভারিক্কি দেখাতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মুখপাত্রের মন্তব্য জুড়ে দেয়া হয়েছে। বিএনপির মুখপাত্র এখান থেকে তাদের দলের জন্য কোনো দরকারি তথ্য কিভাবে পাওয়া যায় সেই কোশেশটিও করেছেন। খোদ জরিপটি নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলার সাহস তিনি করেননি।
যা হোক, কৌতূহলবশত মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের (আইআরআই) ওয়েবসাইটটি ঘুরে দেখলাম। কারণ, মার্কিন মুল্লুকে এই কিছিমের গবেষণা প্রতিষ্ঠান যে কেউ করতে পারে। কোনো মুক্ত গবেষক এই প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে আরেকটু আলোকপাত করলে এ দেশের জনগণ খানিকটা উপকৃত হবে।
আইআরআই নামে প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তাদের পার্টনারদের নাম তুলে ধরেছে। বাংলাদেশে তাদের পার্টনার বা সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসাবে দিয়েছে Bangladrsh Women Chamber of Commerce and Industry (BWCCI))-এর নাম। সামাজিক সংগঠনের অবয়বে অনেকটা ব্যক্তিগত এই প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন নিটল-নিলয় গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান এবং এফবিসিসিআইয়ের বর্তমান চেয়ারম্যান মাতলুব আহমাদের সহধর্মিণী সেলিমা আহমাদ। ওই দম্পতির বর্তমান রাজনৈতিক আনুগত্য নিয়ে কারো কোনো সন্দেহ বা কনফিউশন থাকার কথা নয় । কাজেই সব আলামত দেখে মনে হয়, এই জরিপটি মার্কিন মলাট লাগিয়ে সরকারের জন্য নিটল ও অন্য একটি গ্রুপেরই যৌথ উপহার।
দেশের বহুল প্রচারিত একটি বাংলা ও আরেকটি ইংরেজি দৈনিকের দিনকাল ইদানীং খুব ভালো যাচ্ছিল না। তাদের নাকি ভাতে মারার, পানিতে মারার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বহুজাতিক ও দেশীয় বৃহৎ সংস্থাগুলোর বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়ে গেছে পত্রিকা দুটিতে। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, সরকারের একটি বিশেষ মহলের চাপে প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সব ধরনের বিজ্ঞাপন এ দু’টি পত্রিকা থেকে প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হচ্ছে। এ দু’টি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এক হাজারেরও বেশি সাংবাদিক-কর্মচারী এ ঘটনায় অনিশ্চয়তা আর আতঙ্কে ভুগছেন।
কাজেই এই জরিপটি প্রকাশ করে (আগে করে ফেলা) কিছু সত্য প্রকাশের জন্য হয়তো কাফফারা দেয়া হচ্ছে! করপোরেট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে দেশের গণমাধ্যম চলে যাওয়ার বিপদটি এখানেই স্পষ্ট হয়ে পড়েছে।
কারণ করপোরেট হাউজগুলোর নাকে সুতা লাগিয়ে রাখে সরকার। সরকারের চরিত্রটি ফ্যাসিবাদী হলে দরকার মতো এই সুতা ধরে যখন তখন টান দেয়, তখন করপোরেট হাউজের অধীনস্ত মিডিয়াগুলো আজব ইশারায় কাজ করতে থাকে।
অন্য একটি ব্যবসায়ী গ্রুপের মালিকানার স্বল্পমূল্যের একটি পত্রিকা গত কয়েক দিন ধরে একজন ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে লেগেছে। এই ব্যবসায়ীর শরীরে বিএনপির গন্ধ পেয়েছে পত্রিকাটি। কাজেই বিএনপি ও জামায়াতপন্থী ব্যবসায়ীদের সমূলে উৎপাটন করতে এরা সরকারের বুদ্ধিবৃত্তিক লাঠিয়াল হিসেবে কাজ শুরু করে দিয়েছে।
বিএনপি গন্ধযুক্ত যেকোনো বিজনেসম্যানকে সরকার ইতোমধ্যে মিসেস প্যাকলটাইডস টাইগার বানিয়ে ফেলেছে। আমরা কলেজে থাকাকালে এ ধরনের একটি গল্প পড়েছি। মিসেস প্যাকলটাইড নামক এক ইংরেজ ভদ্রমহিলা তার অন্য এক সামাজিক কম্পিটিটরকে পরাজিত করার নিমিত্তে বাঘ শিকারের পরিকল্পনা করে। শিকার কর্মটিকে সহজ ও আরামদায়ক করার জন্য বয়স্ক ও মরা গোছের একটি বাঘ খুঁজে বের করে। পরে বাঘটি মারা যায়, তবে মিসেস প্যাকলটাইডের গুলিতে নয়, গুলি করার আওয়াজে। এ থেকেই নাম হয়েছে মিসেস প্যাকলটাইডস টাইগার।
দেশের সচেতন ব্যক্তিই জানেন যে, অর্থনীতিতে কী মহালুটপাট এখন শুরু হয়েছে। এই লুটপাটের অর্থের জোগান দিতে বিশ্বে জ্বালানি তেলের দাম কমলেও আমাদের দেশে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। গত ছয় বছরে দেশের ব্যাংকগুলোতে পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে। অনুমান করতে একটুও কষ্ট হয় না যে, এসব লুটপাটে সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট ও সম্পৃক্ত ব্যবসায়ী এবং লুটেরারাই রয়েছে। কিন্তু দেশের পত্রিকাগুলো মূল বাঘ শিকার না করে এ ক্ষেত্রে মিসেস প্যাকলটাইডস টাইগার শিকার করতে বের হয়েছেন।
এই প্রবণতার মারাত্মক দিকটি হলো, এতে দেশের প্রাইভেট সেক্টর মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। আজকের বিএনপিপন্থী ব্যবসায়ীদের দুর্গতি দেখে আওয়ামী লীগের সাথে সুসম্পর্ক রাখা ব্যবসায়ীকুলও তাদের নিরাপদ রাখতে টাকা-পয়সা বাইরে বিনিয়োগের চেষ্টা করবে। ফলে দেশের প্রাইভেট সেক্টরে যে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল, তা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে।
আমাদের লাখ লাখ বেকারের কর্মসংস্থানের যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল, লোভনীয় বেতনের হাজার হাজার চাকরির যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল তা আর থাকবে না। ফলে আমার আপনার (যে যে দলই করি না বা সমর্থন করি না কেন) বংশধর ও সন্তান সন্ততিরা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সবকিছু দেখে মনে হচ্ছে, কেউ যেন ইচ্ছে করে আমাদের জবাই করছে, আমাদের এই দেশটির ওপর অজানা কোনো প্রতিশোধ নিচ্ছে। কিছুটা মারামারি হানাহানি করলেও আগে দেশে সব দলের মানুষ একসাথে থাকতে পারত। এখন পারবে শুধু একটি দলের।
কারণ সরকারে থাকা পলিটিশিয়ানরা নিজেদের আত্মা হালুম মালুম দৈত্যের মতো এক বোতলে রাখা আছে বলে মনে করেন। কিন্তু কিছুটা বাস্তববাদী ব্যবসায়ীরা জানেন, এসব দেশে ক্ষমতা হলো কচুপাতায় টলটলে পানির ফোঁটার মতো। নিজেদের বিনিয়োগের স্বার্থেই তাদের এই বাস্তববাদীটুকু হতে হয়। কাজেই সরকার ও তার সুতায় টানা মিডিয়া হাউজগুলো যে খেলা শুরু করেছে, তা জাতিকে ধ্বংসের শেষপ্রান্তে টেনে নিয়ে যাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এদের হাত থেকে বাঁচার একমাত্র উপায়, জনগণকে সচেতন করা। নিজ নিজ জায়গা থেকে এসব মতলববাজ মিডিয়া বা পত্রিকার বিরুদ্ধে সামাজিক ও রাজনৈতিক বয়কট সৃষ্টি করা। বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো আমাদের জন্য এ ধরনের একটা সুযোগ ও সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ৮:৫৬