এক. দেশের ব্যবসায়ীরা পড়েছেন মহাবিপাকে। উদ্যোক্তারা নিরুৎসাহিত হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছেন। দেশের লাখ লাখ ক্ষুদ্র, মাঝারি ও প্রান্তিক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের মালিকেরা পড়েছেন চরম বিপদে। খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যবসায়ীরা ধর্মঘট পালন করে রাস্তায় নেমে এসেছেন। হঠাৎই ট্রেড লাইসেন্স ফি বাড়ানো হলো ৩৩ গুণ পর্যন্ত। গত বছর লেগেছিল ৯০০ টাকা। এবার খরচ হচ্ছে ১১ হাজার টাকা। সাথে আরোপ করা হয়েছে বিবিধ কর। তবে ফি বৃদ্ধির প্রজ্ঞাপনে দেখা যায়, দেশে বিদ্যমান ২৯৮ ধরনের ব্যবসায়ের একটি ছাড়া প্রতিটির ট্রেড লাইসেন্স ফি বাড়ানো হয়েছে। একমাত্র কমেছে মদের ব্যবসায়ের ফি। তবে কি এবার আইন করেই একমাত্র মদ ছাড়া বাকি সব ব্যবসায়কে কঠিন করে দেয়া হলো?
দুই. গত ২ মার্চ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় (সিটি করপোরেশন শাখা-২) থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে দেশের সব সিটি করপোরেশনে শুধু মদ ও বেভারেজ ছাড়া বাকি সব ধরনের ট্রেড লাইসেন্স ফি ও কর বাড়ানো হয়েছে বহু গুণে। শুধু ট্রেড লাইসেন্স নয়, এই প্রজ্ঞাপনে বাড়িঘরের ওপর ১২ শতাংশ হোল্ডিং করের পরিবর্তে ২৭ শতাংশ ট্যাক্সও বৃদ্ধি করা হয়েছে। এ ছাড়া বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকেও এখন থেকে প্রতি বছর নির্দিষ্ট হারে অতিরিক্ত কর গুনতে হবে। লিমিটেড কোম্পানির মূলধন অনুযায়ী বছরে এক হাজার ৫০০ থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত কর বৃদ্ধি করা হয়েছে। দেশের সব আমদানি রফতানি বাণিজ্যেও ৩০০ শতাংশ কর বৃদ্ধি করা হয়েছে। এর প্রভাবে নতুন করে চাপিয়ে দেয়া বর্ধিত হারে হোল্ডিং ট্যাক্স, ট্রেড লাইসেন্স ফি, সারচার্জ ও বিবিধ বহুমুখী কর আরোপের ফলে এক দিকে যেমন ব্যবসায়-বাণিজ্যে ব্যয় বেড়ে মূল্যস্ফীতি বাড়বে, অন্য দিকে নগরবাসীর ওপর করের বোঝা বৃদ্ধির কারণে বাড়িওয়ালারা বাধ্য হয়ে বাড়িভাড়া বাড়িয়ে মহাবিপদে ফেলবে রাজধানীর ৯০ শতাংশ ভাড়াটিয়াকে।
তিন. বিভক্ত ঢাকার দুই সিটিতে মেয়র প্রার্থীরা যখন ভোটারদের ট্যাক্স না বাড়ানোর প্রতিশ্র“তি দিয়ে ভোট চাচ্ছিলেন, তখন কারো সাথে কোনো আলোচনা না করে চুপিসারে সরকার ‘স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন ২০০৯’-এর ৮৪ ধারার ক্ষমতাবলে ‘সিটি করপোরেশন আদর্শ কর তফসিল ২০১৫’ নামে সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি করে আগেভাগেই হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়িয়ে দিয়েছে। ভোটের পর মেয়রেরা এখন বলতেই পারেন, কই আমরা তো নিজেরা ট্যাক্স বাড়াইনি। ট্যাক্স তো নির্বাচনের আগেই বেড়েছে। এটা যেন নগরবাসীকে গোলাপ ফুল দেখিয়ে চোখে সর্ষে ফুল দেখানোর মতো অবস্থা! এবার আবার মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসাবে গত ১৬ সেপ্টেম্বর সিটি করপোরেশন থেকে প্রতিটি আঞ্চলিক কার্যালয়ে আরেকটি আদেশ পাঠানো হয়েছে। ওই আদেশের সাথে এনবিআরের একটি চিঠিকে সংযুক্ত করে দেয়া হয়েছে। সিটি করপোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়, ২০১০ সালের ৩ জুন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের জারি করা প্রজ্ঞাপনে ব্যবসায়ীদের ট্রেড লাইসেন্স নবায়নের ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট প্রযোজ্য হবে। ব্যাস আর যায় কোথায়! দীর্ঘ পাঁচ বছর অনাদায়ী হিসেবে পাঁচ বছরের সমুদয় ভ্যাট যোগ করে নগরবাসীকে ‘নির্বাচিত’ সিটি করপোরেশনের মজাটা দেখাতে ব্যস্ত আমাদের আমলা ভাইয়েরা। আর জুনের আগে এই প্রজ্ঞাপন জারি করায় করপোরেশনের অসাধু কর্মকর্তারা বাড়ির মালিকদের কাছ থেকে গত বছরগুলোর বকেয়াসহ অতিরিক্ত কর আদায় করছে। সাথে ভোগান্তি থেকে বাঁচার কৌশল হিসেবে মোটা অঙ্কের ‘স্পিড মানি’ দেয়া ছাড়া নগরবাসীর বিকল্প কোনো পন্থা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ট্রেড লাইসেন্স পাওয়ার ক্ষেত্রে বর্ধিত ফি ছাড়াও করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হাতে ‘নগদ নারায়ণ’ গুঁজে দিতে না পারলে ট্রেড লাইসেন্সের চেহারা দেখতে পাওয়াটা একেবারেই দুষ্কর একটা ব্যাপার বটে। তবে করপোরেশনের টেবিলে টেবিলে দৃশ্যমান ‘দালালদের’ শরণাপন্ন হলে নির্দ্বিধায় পাওয়া যাচ্ছে চাহিদামতো সবকিছুই।
চার. আসলে ঢাকা সিটির হোল্ডিং ট্যাক্স আদায়ে অনিয়মের অভিযোগ সরকারি অডিট আপত্তিতেই রয়েছে। সিটি করপোরেশনের রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তাদের দুর্নীতির কারণে বেশির ভাগ হোল্ডিং মামলাতেও হেরে যাচ্ছে সিটি করপোরেশন, এমন তথ্য বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে গঠিত টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনেও এসেছিল। পূর্বতন হারে যে রাজস্বের প্রাপ্যতা রয়েছে তা সততা, দক্ষতা ও দুর্নীতিমুক্তভাবে আদায় করতে পারলে করপোরেশনের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নে কোনো ধরনের সঙ্কট থাকার কথা নয়। কিন্তু হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়িয়ে নিজেদের দুর্র্নীতিকে আড়াল করতে ও দুর্নীতির টাকার জোগান দিতে হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়ালেও এতে যে লুটেরাদের পেট ভরানো যাবে, তার গ্যারান্টি কোথায়? ২০০২ সালে সাদেক হোসেন খোকা মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর ২০০৩ সালে শহরের হোল্ডিং ট্যাক্স পুনর্মূল্যায়নের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি সেলফ অ্যাসেসমেন্ট পদ্ধতি গ্রহণ করেছিলেন। তখন এ নিয়ে বাড়িওয়ালাদের পক্ষ থেকে জোর আপত্তি আসতে থাকে। একপর্যায়ে উচ্চ আদালতে রিট হয়। পরে আদালতের নির্দেশে রিঅ্যাসেসমেন্ট স্থগিত হয়ে যায়। এরপর মেয়র খোকা এ নিয়ে আর এগোতে পারেননি। কিন্তু এতদিন পর এবার হঠাৎ করেই চুপিসারে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা না রেখে হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়ানোর সিদ্ধান্ত রাজধানীর মোট অধিবাসীর ৯০ শতাংশ ভাড়াটিয়ার ওপর বাড়তি চাপ প্রয়োগের একটা কৌশল মাত্র। নাগরিক সেবা না বাড়িয়ে ট্যাক্স বাড়ানোর এই সিদ্ধান্ত সরকার নেয় কী করে?
পাঁচ. সরকার এবার বেসরকারি স্কুল-কলেজ ও ট্রেনিং সেন্টারেও ৫০০ শতাংশ কর বাড়িয়েছে। কিন্ডারগার্টেনে ১০০ শতাংশ কর বাড়ানোর পাশাপাশি ‘ডিজিটাল বাংলাদেশে’ কম্পিউটার প্রশিক্ষণেও কর আরোপ করা হয়েছে। আর লাইব্রেরি ও প্রকাশনায় ১০০০ শতাংশ কর বাড়ানো হয়েছে। ওষুধের দোকানের কর ৬৫০ শতাংশ এবং মাছের দোকানের কর প্রায় ১৩৩০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। প্রায় ৩০০ ধরনের ব্যবসায় শুধু মদ ছাড়া বাকি সবগুলোতেই এভাবে ১০০ থেকে ১৫০০ শতাংশ হারে কর বাড়ানো হয়েছে। ২০০৩ সালে মদের ব্যবসার লাইসেন্স নবায়ন ফি ছিল সাত হাজার ৫০০ টাকা। এবার এটা কমিয়ে এনে নির্ধারণ করা হয়েছে পাঁচ হাজার টাকায়। ইতোমধ্যেই উত্তরের মেয়র আনিসুল হকের একনিষ্ঠতায় সরকার দুই মাসের জন্য ট্রেড লাইসেন্স নবায়নের সময়সীমাকে বাড়িয়েছে। সাথে জারি করা ‘আদর্শ কর তফসিল’ পর্যালোচনার লক্ষ্যে একটি কমিটি গঠন করেছে। তবে এতে জনগণের কষ্টের কথাগুলোকে আমলে নেয়া হবে কি না সন্দেহ আছে। তা সত্ত্বেও উত্তরের মেয়র আনিসুল হক যেভাবে সিটি করপোরেশনের দীর্ঘ দিনের অচলায়তন ভাঙতে শুরু করেছেন, তাতে অন্ধকার সুড়ঙ্গের মধ্যে কিছুটা আশার আলো দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। এখন দলীয় লুটপাটতন্ত্র তাকে কতটা শান্তিতে কাজ করতে দেয় সেটাই আগামী দিনে দেখার বিষয়। তারপরও তিনি যেসব ‘অসাধ্য’ করে দেখাতে পেরেছেন, সে বিচারে হয়তো সরকারের এহেন অযৌক্তিক কর বৃদ্ধি রোধে তার একটি সাহসী ভূমিকাকে আমরা দেখতে পাব বলে ইতোমধ্যে জনমনে বিশ্বাস সৃষ্টি করতে পেরেছেন উত্তরের এই পরিশ্রমী মেয়র।
ছয়. অন্য দিকে, রাজনীতির নামে লুটেরাদের কথা না হয় বাদই দিলাম। জনগণের কর্ষ্টাজিত অর্থ নিজেদের পকেটে ভরার কৌশলী এক পন্থা আবিষ্কার করে সমানে লুটপাট চালানো হচ্ছে সর্বত্র। রাস্তার চাঁদাবাজ মাস্তানরা পর্যন্ত জনগণের প্রতিনিধির লেবেল গায়ে জড়িয়ে লুণ্ঠন করছে গরিব দেশের মানুষগুলোকে। থ্রিজি, ফোরজি আর ফাইভজি গতিতে রাতারাতি তারা মৎস্যচাষি থেকে শুরু করে ব্যাংক, বীমা, বিশ্ববিদ্যালয়, টেলিভিশন, বিদ্যুৎকেন্দ্র আরো কত কিছুর মালিক বনে যাচ্ছেন। আর আমাদের ‘ইচ্ছামতি সরকার’ ইচ্ছামতো দাম বাড়াচ্ছে গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সব দ্রব্যের। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা দেয়া তো দূরের কথা, বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী আবারো দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েই বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করলেন। অন্য দিকে, সরকারের স্বপ্ন দেখানোর ক্ষেত্রেও কোনো ঘাটতি নেই। ঘরে ঘরে চাকরি, ১০ টাকা কেজিতে চাল, একটি বাড়ি একটি খামার, ১০ টাকায় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, পঁচিশ হাজার টাকায় বিদেশে চাকরিÑ কত রকমের নিত্যনতুন বুলি! মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে নিজেদের দাবি করেও গত সপ্তাহে আবার আমরা স্বল্পোন্নত দেশের সভাপতির আসন কিভাবে অলঙ্কিত করলাম তার কোনো সদুত্তর নেই! সরকারি কর্মচারীর বেতন বাড়িয়ে সেই টাকার জোগান এভাবে জনগণের ওপর অন্যায়ভাবে আদায় করার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। একটি সংসার চালাতে গিয়ে দেশের প্রতিটি মানুষ আজ কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। বাড়িভাড়া, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, ফোন, কেবল আরো কত রকমের বিল পরিশোধ করে সন্তানদের স্কুলের খরচ, যাতায়াত, কোচিং, টিউশন ফি দিতে দিতে মানুষের আজ নাভিশ্বাস উঠেছে। সেই সাথে আবারো বেড়ে গেল গণপরিবহনের ভাড়া। সেই সাথে এবার সব ব্যবসায় বাড়ানো হলো কর। অথচ শুধু মদের দাম কমানো হলো। কম দামে মদ খাইয়ে মানুষকে সবকিছু ভুলিয়ে রাখার অপকৌশল হয়তোবা। আসলে দেশের মানুষ করের বিপরীতে সেবা পেতে চায়। উন্নয়নকে বক্তৃতা আর চাপাবাজিতে নয়, বরং বাস্তবে দেখতে চায়। সরকার বলে চার দিকে উন্নয়নের জোয়ার, অথচ জনগণ দেখে চার দিকে শুধুই জলাবদ্ধ পানির জোয়ার। -
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই অক্টোবর, ২০১৫ রাত ৮:০০