somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নানা রঙের দিনগুলি সোনার খাঁচায় রইলো না

২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ৮:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :





আমার বন্ধু সীমা গোমেজ। সমর কাকার বড় মেয়ে। বুদ্ধিমতি, পড়াশোনায় ভাল হলেও প্রচন্ড জেদী এবং মুখরা হওয়ায় ওর সাথে প্রায়ই বনিবনা হতোনা আমার। কিন্তু ওর বিশাল হৃদয় এবং সরলতা এড়িয়ে যাওয়াও সম্ভব ছিলনা। একবার ঈদের সময়, পাড়ার প্লাম্বার মিস্ত্রি ওয়াজেদ চাচার ছোট দুই মেয়ের নতুন জামা না পেয়ে মন খারাপ করতে দেখে সীমা কেঁদে-কেটে অস্থির। হৃদয়বান সমর কাকা সন্ধ্যেবেলায় দু'টো সুন্দর নতুন জামা কিনে সীমাকে সাথে নিয়ে হাজির হলেন ওয়াজেদ চাচার বাসায়। ঐ ১০/১১ বছর বয়সেই তা দেখে আমার চোখ ভিজে উঠেছিল। ঈদের দিন সীমা এবং ওর ছোট বোন সাথীও নতুন জামা পরে আমাদের বাসায় বেড়াতে এলো। ডিসেম্বরে পরীক্ষা শেষে দীর্ঘ ছুটি। তারসাথে যোগ হতো আর একটি আনন্দের দিন। পঁচিশে ডিসেম্বর বড়দিনে আমরা কত মজা করেই না ক্রিসমাস ট্রি সাজিয়েছি একসাথে। প্রতিবছর এমন করেই আমরা একসাথে নানান উৎসবে মেতেছি।


তুষার কান্তি বড়াল। আমার শৈশবের প্রিয় বন্ধু। ওকে আমরা টুটুল বলে ডাকতাম। ওদের বাসার বারান্দায় একটা সবুজ টিয়া পাখী সারাক্ষণ এর-ওর নাম ধরে ডাকাডাকি করে। ওর বড়বোন তপতী দিদি আমায় খুব ভালবাসতেন বলে তাদের টিয়াকে শিখেয়ে দিলেন আমার নামটাও। ব্যাস, টিয়া আমায় দেখার সাথে সাথে নাম ধরে ডাকাডাকি শুরু করে দিত। ওদের বাড়িতে আমার খেলতে যাবার এটা ছিল বড় আকর্ষণ। আর টুটুল! এক অসাধারণ ছেলে। সবার প্রিয় বন্ধু। একুশে ফেব্রুয়ারির জন্যে ফুল চুরি, ডাঙ্গুলির জন্যে ডান্ডা-ক্লুব বানানো, মরা পাখীর বাচ্চাকে মাটি খুঁড়ে কবর দেয়া, বালুর স্তুপে প্রাসাদ বানানো, দোকান-দোকান খেলা, যেকোন প্রয়োজনে তাকে সবাই পাশে পাবে। বন্ধুদের মধ্যে কোন কারণে ঝগড়া লেগে গেলে সে অবধারিতভাবে 'শান্তিদেব' এর ভূমিকায় থাকবে। খেলতে খলতে কারো কেটে-ছড়ে গেলে ও সবার আগে ছুটে গিয়ে গাঁদাফুলের পাতা হাতের তালুতে কচলে নিয়ে লাগিয়ে দেবে। একটা আইসক্রিম কিনে বন্ধুদের সাথে ভাগাভাগি করবে। বাড়ি থেকে মায়ের তৈরি চালতার আচার, কুল বা পেয়ারা চুরি করে এনে বন্ধুদের নিয়ে খাবে। ঈদের দিন টুটুল আর ওর ছোটবোন নতুন জামা পরে আমাদের সাথে খেয়ে-দেয়ে সারাদিন হৈহৈ করে বেড়াতো। আর দূর্গাপুজোর সময় ওরা ক'দিনের জন্যে বরিশালে চলে গেলে ওর জন্যে আর তপতী দিদির জন্যে আমার খুব মন খারাপ হতো। পূজোর সময় আমরা কত আনন্দ নিয়ে প্রতিমা দেখে বেড়িয়েছি। মেলায় গিয়ে শিংঅলা রঙিন বেলুন কিনে, ছোলা, চটপটি খেয়ে হুলুস্থুল আনন্দ করেছি।


একবার খেলতে খেলতে সময় ভুলে গিয়ে বাসায় ফিরতে একটুখানি দেরী হয়ে গেলো। জান ঢিপঢিপ করছে, মা আজ আর বাড়ি ঢুকতে দেবেনা। মাগরিবের আজানের আগে অবশ্যই বাসায় ফিরে আসতে হবে- এটা ছিল আমাদের পারিবারিক আইন। ব্যাস, যা ভেবেছি, তাই হলো। মা রেগে আগুন, কোন অনুনয়-বিনয়ই কাজে লাগলো না। শাস্তিস্বরূপ আমাদের দুই ভাই-বোনকে সিঁড়ির নীচে দাঁড় করিয়ে রেখে দরজা বন্ধ করে দিলেন কিছুক্ষণের জন্যে। ডিসেম্বরের হীম হাওয়ায় আমরা জমে যাওয়ার উপক্রম। স্কুল টিচার আভা বরুয়া, আমাদের সবার আহ্লাদের জায়গা। আভা মাসী তা দেখতে পেয়ে ছুটে এসে দাঁড়িয়ে রইলেন আমাদের সাথে। আমাদের আদর করে বললেন, ভুল করেছো শাস্তিতো পেতেই হবে। এরপর থেকে দেখো আর কোনদিন একই ভুল করতে ইচ্ছে হবেনা। সময় কাটানোর জন্যে আভা মাসী আমাদের একটা ভূতের গল্প শোনালেন। কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে মা আভা মাসীকে দেখে কোনভাবেই বিরক্ত হতে পারলেন না বরং ভেতরে এসে বসতে অনুরোধ করলেন। আর একটু পরে আমি শুনতে পেলাম, আভা মাসী মা'কে বলছেন 'বাচ্চাদের কিন্তু শাস্তি পুরণ হয়েছে আপা, ওদের আর বকবেন না যেন।' আভা মাসীর গোলাপি রঙের শিফন শাড়ীটা আমার খুব পছন্দ ছিল বলে, পরে খানিকটা কেটে আমার পুতুলের শাড়ী বানিয়ে দিয়েছিলেন। আমার মা আভা মাসীকে খুব ভালবাসতেন। এইসব মধুর স্মৃতিময় শৈশব কম-বেশী আমাদের সবার জীবনেরই অংশ। সুস্থ্য, নির্ভয় এবং উন্মুক্ত শৈশবই মানুষকে প্রগতিশীল করে তোলে। শেখার ভিতটাতো শৈশবেই।


ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নিয়ে আমাদের কখনো, কোনদিন কোন টানা-পোড়েন দেখতে হয়নি। আমরা শিখিনি যে আমি কারোর থেকে আলাদা বা কেউ আমার চেয়ে অন্যরকম বলে তার প্রতি আমার বিদ্বেষ জন্মাবে। আজকের প্রজন্ম সম্পূর্ন অস্থিরতায় বেড়ে উঠছে। মসজিদ, মন্দির, প্রতিমা ভাংচুর, বিদ্বেষ, হানাহানি যেন অবলীলায় ঘটে চলেছে। চুড়ান্ত রাজনৈতিক অস্থিরতার পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক অসহনশীলতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বাঙালীর হাজার বছরের ঐতিহ্য-সংস্কৃতির বৈচিত্র্যময় বৈশিষ্ট্য ও সহাবস্থান নিয়ে দূর্ভাবনার পথ প্রশস্ত হচ্ছে। মানুষের একটি বিশেষ আশ্রয় এবং বিশ্বাসের জায়গা, ধর্মকে স্বার্থান্বেষীরা নির্দ্বিধায় ব্যবহার করে চলেছে। এমন কি আমাদের শিক্ষা ব্যাবস্থাতেও তার আঁচ লেগেছে। ক্রমবর্ধমান এই কর্কটের প্রতিকারের কোন উদ্দ্যোগ নেই কোথাও।


ধর্ম-বর্ণ-গোত্র বিষয়টি বাদ দিয়েও মানুষতো স্বাভাবিকভাবেই ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির, ভিন্ন স্বভাবের, ভিন্ন মতের। নিজের ব্যক্তিত্ব, রুচি, ভাবনা, মতাদর্শ, যুক্তি কোনটাই অন্যের উপর জোর করে চাপিয়ে দেয়া অন্যায় এবং অস্বাভাবিকতা। মানুষ মানুষে পরষ্পর সহযোগিতা, সহমর্মিতা এবং সহনশীলতার ধারনা বিবর্জিত মানুষ একদিন গুহায় বাস করতো, হত্যা-হানাহানি করেই হিংস্র, উলঙ্গ, দুর্বিসহ জীবন কাটাতো। আজকে আমাদের এই সভ্য, স্বাস্থ্যসম্মত, শিক্ষিত, প্রযুক্তিনির্ভর জীবন যাপনে আমরা সেই গুহার জীবন-যাপন ডেকে আনতে পারিনা। আমাদের সার্বিক আচরণ, পরিকল্পনা এবং তার প্রতিফলনের উপর নির্ভর করছে আমাদের প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের বোধ এবং মুক্তি। নির্ভর করছে একটি সুস্থ্য, সভ্য এবং সত্যিকারের উন্নত জাতীয় জীবন। আমাদের দুরদর্শিতা প্রসারিত হোক, শুভবুদ্ধির জয় হোক।


সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ১:০০
৩৫টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×