লেখার টাইটেলটা একটু নাটকীয় কিন্তু বিষয়বস্তু সাদামাটা। আমার খুব প্রিয় একজন শিক্ষককে নিয়ে লিখছি। হয়ত আমার সহপাঠিরা কেউ আগেই ব্যাপারটা লিখে ফেলেছে অন্য কোথাও। কিন্তু তাতে কি, স্যারের প্রতি আমার যে শ্রদ্ধা তা তো একান্ত নিজের। আজ ব্লগে তা প্রকাশ করলাম।
চট্টগ্রামের পাহাড়তলী রেলওয়ে হাই স্কুলের সহকারী প্রধাণ শিক্ষক বাবু অমরেন্দ্র নাথ দাস। আমি ১৯৯১ সালে মেট্রিক পাস করি। ক্লাস ফাইভ সিক্স থেকেই উনাকে দেখে আসছি- গৌর বর্ণ, লম্বা, উন্নত নাসা, একহারা, দারুন সুদর্শণ। বড় একটা চশমা চোখে থাকায় সৌন্দর্য্যটা চোখে পড়তো না সবসময়। বগলে একটা খাতা হাতে বিশাল দোতলা স্কুল বিল্ডিংয়ের এ কোণা সে কোণা ঘুরে বেড়াতেন আর খবর নিতেন শিক্ষকরা ঠিকমত ক্লাস নিচ্ছে কিনা। একটু পাগলাটে আর আত্নভোলা ছিলেন, জোরে কখনো হাসলে শিশুর মত লাগত।
আমি উনার ক্লাস পাই ক্লাস টেনে গিয়ে, ইংরেজী ক্লাস নিতেন। ব্লাকবোর্ডে কিছু গ্রামার প্রবলেম লিখে দিয়ে স্কুল পরিদর্শনে বের হতেন। আধাঘন্টা পর এসে আমাদের প্রবলেম সল্ভ করে দিতেন। আমাদের দারুন খুশী, কারণ এই আধাঘন্টা নিরুপদ্রবে বান্দরামী করা যেত। দুয়েক জন ইংরেজীতে ভাল ছিল, সবাই ওদের কাছে সমাধান জেনে নিত। কিন্তু একদিন মহাবিপর্যয় ঘটে গেল.....
স্যার পড়াচ্ছিলেন, এমন সময় নোটিস বই হাতে দপ্তরী হাজির। আমরা লোভী চোখে তাকিয়ে, নিশ্চয়ই কোন ছুটির ঘোষনা আসবে। স্যার গম্ভীর মুখে বললেন, পাশের এক স্কুলের সিনিয়র এক টিচার মারা গেছেন। এই ঘন্টার পর স্কুল ছুটি। আমাদের লোভী চোখে আনন্দের বান ডাকলো, পুরো ক্লাস একসাথে হৈ করে একটা চিতকার দিয়ে উঠলাম। স্যারের প্রচন্ড হুংকারে সম্বিত ফিরে পেলাম, দেখি যে পাগলা খেপছে। "একজন শিক্ষক মারা গেছে আর তোরা আনন্দে নাচছিস? তোরা ছাত্র নামের কলংক" ফর্সা মুখ পুরো লাল করে রাগে কাঁপতে কাঁপতে স্যার আমাদের এসব কথা বলছিলেন আর আমরাও ভয়ে কাঁপছিলাম না জানি কপালে কি আছে। দপ্তরীকে পাঠালেন হেড স্যারের রুম থেকে বেত আনার জন্য। আল্লাহর কি হুকুম বেত পাওয়া গেলনা, দপ্তরী খালি হাতে ফিরে এল। ওদিকে স্যার তখন প্রায় হিস্টিরিয়া রোগীর মত হয়ে গেছেন, পারলে কামড়ে দেন। শেষ পর্যন্ত দপ্তরীকে পাঠানো হলো স্কুলের পাশে মান্দার গাছের ডাল ভেংগে নিয়ে আসার জন্য। সেই ডাল দিয়ে স্যার গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে ক্লাসে থাকা আমাদের প্রায় চল্লিশ জনকে দু'দফা পেটালেন। সবগুলো ভেংগে যাওয়াতে রক্ষা, নাহলে আরো মারতেন।
যখন আমাদের পেটাচ্ছিলেন তখন বারবার একটা কথাই বলছিলেন শিক্ষক হচ্ছে বাপের মত। নিজের বাপ যখন মারা যাবে তখন কি হাসবি, হাসতে পারবি? খাস চিটাগাংয়ের ভাষায় 'বাপ মইল্লে হাসিবিনা ব্যাডা'?
আজ ১৮ বছর পর যখন এই লেখা লেখছি বুকের ভেতরটা হু হু করছে। অমর বাবু তখনই বৃদ্ধ ছিলেন, আজ এত বছর পর বেঁচে আছেন কিনা জানিনা। স্যারকে শুধু একটা কথাই বলতে পারি "স্যার, আপনার মৃত্যু সংবাদ যদি পাই- কসম খোদার একটুও হাসবোনা। বাপ মরলে কেউ হাসে"?