আমার বাবা হলেন দুনিয়ার সবচেয়ে সহজ সরল মানুষদের একজন। আমাদের পরিচিত সার্কেলে এইটা অবশ্য নতুন কথা না, সবাই জানে। আব্বার অফিসে বেশ কয়েকবার গিয়েছি, উনার প্রায় সব কলিগদের মুখে একই কথা - "তোমার বাবা খুবই ভাল মানুষ। তবে এই যুগে এরকম মানুষ................" বাকীটা আর বলেনা। আমি লাইনের মাঝখানে বুঝে নেই। আজ থেকে প্রায় ৪০ বছর আগে জীবিকার তাগিদে গ্রামের যে যুবক চাকরী নিয়ে শহরে এসেছিলো, নাগরিক জীবনের এত জটিলতা আর কুটিলতার মধ্যেও কিভাবে এতটুকু পরিবর্তন না হয়ে সে থাকতে পারে তা আমার কাছে এক মহা বিস্ময়ের ব্যাপার।
আব্বা জীবনে তেমন কিছু করতে পারেননি। সরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরী করতেন, মাসের ১০/১৫ দিন যেতে না যেতেই ধার-দেনা শুরু হয়ে যেত। তবে যার কেউ নেই তার আল্লাহ আছেন। আব্বার বউ ভাগ্য ভাল, আমার আম্মার মত বুদ্ধিমতী মহিলাকে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে পেয়েছিলেন। তাছাড়া আম্মা স্কুলে মাষ্টারী করে সংসারে কিছু আয়ও যোগ করতেন। আমাদের সংসার খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হলেও চলে যেত।
পড়ালেখায় ভাল ছিলাম, ক্লাসে ফার্স্ট-সেকেন্ড হতাম। তাই হয়ত কিছুটা অহংকারী হয়ে গিয়েছিলাম। বাবা-মা'র অতিরিক্ত আদর যত্ন প্রাপ্যই মনে করতাম। বহুদিন পর সেই ভুল ভাঙ্গালো আমারই এক ফুফাত ভাই। জুয়েল ভাইয়া আমাদের চট্টগ্রামের বাসায় বেড়াতে এসেছিলো। একদিন রাত দশটার দিকে বাড়ি আসলাম। আসার সাথে সাথে আমাকে খুব সিরিয়াস ভঙ্গীতে জিজ্ঞেস করলো, "আচ্ছা মামা যে তোর জন্য রাস্তায় হাটাহাটি করে তুই জানস?" আমি খুব স্বাভাবিক ভাবেই বললাম, "হ্যাঁ জানি"। আমি রাত ৯টার মধ্যে বাসায় না ফিরলেই আব্বার হাটাহাটি শুরু হয়। আমাকে অবশ্য কিছু বলেননা, শুধু একবার বলেন "আইছস?" এর মধ্যে খুব অবাক হবার কিছু আছে বলে আমার কখনো মনে হয়নি। জুয়েল ভাই মুক্তিযুদ্ধে বাবাকে হারিয়েছেন। খুব হাহাকার মেশানো গলায় বললেন, "আমাগো লাইগা তো কেউ হাঁটে নারে..........?"
১৯৯৬ সাল। বিরোধী দলগুলোর অবরোধে সারা দেশ অচল। আমি তখন আটকা পড়ে আছি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। টাকা পয়সা শেষ, হলের ডাইনিং এ গণ বাকী খাচ্ছি ছাত্ররা সবাই। হঠাৎ কে যেন ডাক দিলো, 'তোমার আব্বা আসছে'। গিয়ে দেখি আমার পঞ্চাশউর্ধ্ব বাপ প্রতিবেশী কার যেন সাইকেল ধার করে চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ২০কিলোমিটার পথ প্যাডেল মেরে ছেলের জন্য টাকা নিয়ে এসেছেন। আমাকে দেখেই তার চিরাচরিত বোকা-সোকা গাল ভরা একটা হাসি দিলেন। ক্লান্ত শ্রান্ত চেহারা, কিন্তু আহ্লাদের ছেলের মুখ দেখে আব্বার সেই হাসি দেখে- শরৎচন্দ্রের ভাষায় 'আমার সারা পৃথিবী যেন চোখের সামনে দুলিয়া উঠিলো'।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে নভেম্বর, ২০০৯ রাত ১১:১৫