খালেদাজিয়ার বক্তব্যেরসমালোচনায়হাইকোর্ট
লেখক: ইত্তেফাক রিপোর্ট | বুধ, ২৯ ফেব্রুয়ারী ২০১২, ১৭ ফাল্গুন ১৪১৮
++সাগর-রুনির খুনিদের গ্রেফতার করতে রুল জারি
++অনুমাননির্ভর সংবাদ প্রকাশ বন্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ
সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড নিয়ে লালমনিরহাটে বিরোধী দলীয় নেত্রীর দেয়া বক্তব্যকে হাইকোর্ট আদালত অবমাননাকর, তদন্ত ও বিচারকাজকে প্রভাবিত করার শামিল বলে অভিহিত করেছে। আদালত বলেছে, ব্রিটেন বা যুক্তরাষ্ট্র হলে এ বক্তব্যের জন্যে বিরোধী দলীয় নেত্রীকে কারাগারে পাঠানো হত। আদালত জানায়, বিরোধী দলীয় নেত্রী একটি রায় দিয়েছেন যে, ‘সরকারই খুন করেছে।’ তার এই মন্তব্যের সমালোচনা করার ভাষা এই আদালতের নেই। । তার এ বক্তব্য তদন্তকে প্রভাবিত করতে বাধ্য।
আদালতের আদেশে বলা হয়, দেশের মানুষ এ ঘটনার সঠিক তদন্ত দেখতে চায়। দু’টি সংবাদপত্র রিপোর্ট করেছে ‘জজমিয়া খোঁজা হচ্ছে ও জজ মিয়া প্রস্তুত’। এসব নিউজও তদন্তকে প্রভাবিত করতে পারে। তদন্তে নিয়োজিত দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের উদ্বৃতি ছাড়া ভিন্ন কোন সূত্র ব্যবহার করে এমন কোন কিছু লেখা ঠিক হবে না যা তদন্তকে প্রভাবিত করতে পারে। আদালত আরো বলে, যারা মারা গেছেন তাদের আত্মার প্রতি তার (খালেদার) কোন শ্রদ্ধা নেই। এবং দুই সাংবাদিকের পরিবারের প্রতিও সমবেদনা নেই। একই সঙ্গে হাইকোর্ট সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের খুনিদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা এবং হত্যার কারণ নির্ণয়ে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করে। এছাড়া অনুমান নির্ভর সংবাদ প্রকাশ বন্ধে আদালত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ব্যবস্থার নিতে তথ্য সচিবকে নির্দেশ দিয়েছেন। সুনির্দিষ্ট তথ্য ছাড়া তদন্ত প্রভাবিত হবে এমন কোন মন্তব্য না করতে তদন্ত কর্মকর্তাকেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার এ সংক্রান্ত এক রিট আবেদনের শুনানি শেষে বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিমকে নিয়ে গঠিত হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ এ আদেশ দেয়। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন এডভোকেট মনজিল মোরসেদ। এছাড়াও আদালতের আহবানে শুনানিতে অংশ নেন এডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, এডভোকেট এএম আমিন উদ্দিন, এডভোকেট শ.ম রেজাউল করিম, এডভোকেট নুরুল ইসলাম সুজন এমপি এবং দৈনিক ইত্তেফাকের আইন, সংবিধান ও নির্বাচন কমিশন বিষয়ক সম্পাদক সালেহউদ্দিন। জনস্বার্থে রিটটি দাখিল করেছেন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে এডভোকেট মনজিল মোরসেদ।
শুনানিতে মনজিল মোরসেদ বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তদন্ত সঠিকভাবে হচ্ছে। কিন্তু কিছু সংবাদপত্র জজ মিয়া নাটকের কথা বলছে। এখন যদি এ বিষয়ে আদালত আদেশ না দেন, তাহলে সত্যিকার আসামি গ্রেপ্তার হলে তাকেও জজ মিয়া হিসেবেই মানুষ জানবে। তাই এ বিষয়ে একটি আদেশ দরকার। মিডিয়ায় বিভিন্ন কথা আসার কারণে তদন্তের গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট হবে।
এ সময় আদালত কক্ষে উপস্থিত বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনকে আদালত জিজ্ঞাসা করেন, দেশের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা বলেছেন ওই হত্যাকাণ্ডে সরকার জড়িত। এ ধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য দেওয়া ঠিক কিনা? জবাবে মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, আইনজীবী হিসেবে বলবো বিচারাধীন বিষয়ে কোন পক্ষেরই মন্তব্য করা ঠিক নয়। মাহবুব উদ্দিন বলেন, এসব বিষয় নিয়ে দু’জন মন্ত্রীও বক্তব্য দিয়েছেন। এটা আমাদের দেশে কালচার হয়ে গেছে। তিনি আরো বলেন, লালমনিরহাটে বিরোধী দলীয় নেতার সঙ্গে আমি ছিলাম। তিনি যে কথা বলেছেন সেটি হচ্ছে, গত কয়েকদিনের পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের একটি সারমর্ম। এডভোকেট নুরুল ইসলাম সুজন এমপি বলেন, এই হত্যাকাণ্ডের এখানে তদন্ত হচ্ছে, মামলা হয়েছে। এখানে সবার সহযোগিতা করা উচিত। এডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেন, মৃতদেহ নিয়ে রাজনীতি করা ঠিক না। মুক্ত মনে বিষয়টির তদন্ত করতে দেয়া উচিত। এডভোকেট শ.ম রেজাউল করিম বলেন, সরকার এ হত্যাকাণ্ডের রহস্য বের করতে অনেক বেশি তাগিদ দিয়েছে। যা কখনো হয়নি আগে। আরো দ্রুত তদন্ত করলে প্রকৃত বিচার থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ হত্যাকাণ্ড তদন্তে ছয়টি টিম কাজ করছে। এখানে সরকারের সদিচ্ছার কোন অভাব নেই।
এডভোকেট এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, যদি ওনার (খালেদা জিয়া) কাছে এ ধরনের কোন তথ্য থাকে, তাহলে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাকে এ ব্যাপারে সহযোগিতা করতে পারেন। এসময় আদালত বলেন, এদেশে এসব কথা বলা অন্যায়। আমাদের বিচার ব্যবস্থা স্বাধীন। এ অবস্থায় মন্তব্য করলে বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতে কাঁদবে।
এরপর আদালত দৈনিক ইত্তেফাকের আইন, সংবিধান ও নির্বাচন কমিশন বিষয়ক সম্পাদক সালেহউদ্দিনের বক্তব্য শুনতে চান। সালেহউদ্দিন বলেন, আমরা এ দেশের নাগরিকরা অপরাজনীতির শিকার। তদন্তাধীন বিষয় নিয়ে কারোরই বক্তব্য দেওয়া ঠিক নয়। কিন্তু দুই পক্ষ থেকে এই ইস্যুতে বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য আসছে। তদন্ত সূত্রেও একেক সময় একেক তথ্য সরবরাহ করা হচ্ছে। সাংবাদিকরা দায়িত্বশীলতার সঙ্গে তদন্ত কার্যক্রমের পর্যালোচনা সংবাদপত্রে তুলে ধরছে। আমরা চাই আদালত এমন নির্দেশনা দেবে যাতে এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হয়। অতীতে সতেরোজন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। এখনো পর্যন্ত এর একটি হত্যাকাণ্ডেরও বিচার হয়নি।
এ পর্যায়ে হাইকোর্ট তার আদেশে বলে, আমরা লক্ষ্য করেছি, দুই সাংবাদিকের হত্যার ঘটনা তদন্তে সরকার সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে। এ তদন্তে কোন ধরনের ভুল অথবা অবহেলা আমাদের চোখে এখনো পড়েনি। একাধিক তদন্ত সংস্থা এ ঘটনার সত্য বের করে আনার জন্য কাজ করছে। সরকারের প্রধান ঘটনাটি মনিটরিংয়ের দায়িত্ব নিয়েছে। কিন্তু আমরা অত্যন্ত দুখের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, কিছু সংখ্যক রাজনীতিবিদ তদন্তকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য করছেন। তারা নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য এ ধরনের মন্তব্য করেছেন।
প্রসঙ্গতঃ সোমবার লালমনিরহাটে এক জনসভায় বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন, সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরকারের লোকজন জড়িত। তাদের ল্যাপটপে সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ছিলো। যা প্রকাশ হলে দেশে-বিদেশে সরকারের ভাবমূর্তি বিনষ্ট হতো। তাই তাদের খুন করা হয়েছে।