ড. মুহম্মদ কুদরাত-এ-খুদার জন্ম ১৯০০ সালের ১ ডিসেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বীরভূম জেলার মাড়গ্রাম গ্রামে। ১৯৭৭ সালের ৩ নভেম্বর এই মহান দেশপ্রেমিক বিজ্ঞানী ঢাকায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি মাড়গ্রাম এম.ই হাই স্কুলে এবং কলকাতা উডবার্ন হাই স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। ১৯১৮ সালে তিনি কলকাতা মাদ্রাসা থেকে প্রথম বিভাগে মাধ্যমিক পাস করেন। কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯২৪ সালে রসায়ন শাস্ত্রে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে এমএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন এবং এই কৃতিত্বপূর্ণ ফলের জন্য তিনি স্বর্ণপদক লাভ করেন। রসায়ন শাস্ত্রে উচ্চতর গবেষণার জন্য মুহম্মদ কুদরাত-এ-খুদা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ বৃত্তি লাভ করেন। ্তুঝঃধরহষবংং ঈড়হভরমঁৎধঃরড়হ ড়ভ গঁষঃরঢ়ষধহসবঃ জরহম্থ শীর্ষক অভিসন্দর্ভের জন্য তিনি ১৯২৯ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি.এসসি ডিগ্রি অর্জন করেন।
কুদরাত-এ-খুদা প্রেসিডেন্সি কলেজে রসায়নের প্রভাষক হিসেবে ১৯৩১ সালে কর্মজীবন শুরু করেন । ১৯৪২ সাল থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত তিনি ইসলামিয়া কলেজের অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৬ সালে অধ্যক্ষের দায়িত্ব গ্রহণ করে পুনরায় প্রেসিডেন্সি কলেজে ফিরে আসেন। একই সময়ে কুদরাত-এ-খুদা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ফেলো এবং সিনেট সদস্য ছিলেন। ভারত বিভাগের পর ১৯৪৭ সালে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) চলে আসেন এবং ১৯৪৭ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান সরকারের জনশিক্ষা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৯- এ তিনি পাকিস্তান সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞান উপদেষ্টা পদে নিযুক্ত হন।
১৯৫২ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত তিনি পূর্ব পাকিস্তানের মাধ্যমিক শিক্ষা বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৫ সালে পাকিস্তান বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বর্তমানে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ বা সায়েন্স ল্যাবরেটরি) পূর্বাঞ্চলীয় গবেষণাগারগুলোয় প্রথম পরিচালক নিযুক্ত হন এবং ঢাকায় গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৬৬ সালে পরিচালকের পদ থেকে অবসর গ্রহণের পর মুহম্মদ কুদরাত-এ-খুদা কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড-এর চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর কুদরাত-এ-খুদা কে ১৯৭২ সালে গঠিত জাতীয় শিক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন এবং সমসাময়িক সমাজ গঠনমূলক একটি সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থার রূপরেখা হিসেবে বাংলাদেশ শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট প্রণয়ন করেন। ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত এই কমিশনের রিপোর্ট ্তুকুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট নামে পরিচিতি লাভ করে। তিনি ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং প্রফেসর নিযুক্ত হন এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ওই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
কুদরাত-এ-খুদার গবেষণাক্ষেত্র ছিল জৈব রসায়ন। তিনি বনৌষধি, পাট, লবণ, কাঠ-কয়লা, মৃত্তিকা ও খনিজ পদার্থের ওপর গবেষণাকার্য পরিচালনা করেন। অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে তিনি স্থানীয় গাছ-গাছড়া থেকে জৈব রাসায়নিক উপাদান নিষ্কাশনে সক্ষম হন, যা ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কুদরাত-এ-খুদা ও তাঁর সহকর্মীবৃন্দ ১৮টি বৈজ্ঞানিক পেটেন্ট আবিস্কার করেন। পাটকাঠি থেকে পারটেক্স উৎপাদন ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় বৈজ্ঞানিক অবদান। এছাড়া আখের রস ও গুড় থেকে মল্ট ভিনেগার, পাট ও পাটকাঠি থেকে রেয়ন এবং পাটকাঠি থেকে কাগজ তৈরি তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য বৈজ্ঞানিক অবদান।
বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চাকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রেও তার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। তিনি বাংলা ভাষায় অসংখ্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক গ্রন্থ্থ রচনা করেন, যার মধ্যে উলেল্গখযোগ্য কয়েকটি হচ্ছে: বিজ্ঞানের সরস কাহিনী, বিজ্ঞানের বিচিত্র কাহিনী, বিজ্ঞানের সূচনা, জৈব রসায়ন (চার খণ্ড), পূর্ব পাকিস্তানের শিল্প সম্ভাবনা, পরমাণু পরিচিতি এবং বিজ্ঞানের পহেলা কথা। পুরোগামী বিজ্ঞান (১৯৬৩) এবং বিজ্ঞানের জয়যাত্রা (১৯৭২) নামে দুটি বিজ্ঞান বিষয়ক বাংলা পত্রিকা তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকাশিত হতো। স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালনসহ বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশে তাঁর অবদান ছিল উলেল্গখযোগ্য। তাঁর বিশিষ্ট কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ পাকিস্তান সরকার তাঁকে তমঘা-ই-পাকিস্তান এবং সিতারা-ই-ইমতিয়াজ খেতাব প্রদান করে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ১৯৭৬ সালে একুশে পদক এবং ১৯৮৪ সালে স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার প্রদান করে। বিজ্ঞানে নেতৃস্থানীয় অবদানের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কুদরাত-এ-খুদাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে। গত ৩ নভেম্বর ৩৪তম মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষ্যে তাকে গভীরভাবে স্মরণ করছি।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




