এই শতকে সূর্যের উপর দিয়ে শুক্রের প্রথম চলন ঘটেছিল ২০০৪ সালে। স্বভাবতই এই জোড়ার দ্বিতীয় চলনটি ঘটবে এই বছরে, বাংলাদেশের হিসেবে আগামী ৬ জুন, ২০১২ তারিখে। জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় ‘ট্রানজিট অব ভেনাস’। এক্ষেত্রে পৃথিবী ও সূর্যের মধ্যে একই সরলরেখায় শুক্র গ্রহ চলে আসে এবং সূর্যের উপরে শুক্রের চলমান ছায়া পৃথিবী থেকে দৃশ্যমান হবে। এই ব্যাপারটি অনেকটা সূর্যগ্রহণের মতই, শুধু চাঁদের পরিবর্তে শুক্র গ্রহ অবস্থান করে। এখানে লক্ষ্যণীয় যে, পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব চাঁদের দূরত্বের চেয়ে ৪০০ গুণ বেশি। তাছাড়া সূর্যের ব্যাসও চাঁদের ব্যাসের তুলনায় ৪০০ গুণ বড়। তাই পৃথিবী থেকে দেখলে চাঁদ ও সূর্যের আয়তন হুবহু একই রকম মনে হয়। একারণে সহৃর্যগ্রহণের সময় চাঁদ সূর্যের উজ্জলতম অংশকে পরিপূর্ণ বা আংশিকভাবে ঢেকে ফেলতে পারে। কিন্তু শুক্রের চলন বা ট্রানজিটের সময়ে তার অবস্থানগত কারণে সূর্যকে আড়াল করতে পারে না। ফলে সূর্যের উপর দিয়ে অতিক্রমের সময় সূর্যের উজ্জ্বল চাকতির উপর শুক্রকে একটি কালো বিন্দুর মত মনে হয়।
বুধ ও শুক্র গ্রহের কক্ষপথ পৃথিবীর কক্ষপথের উপর হেলানো রয়েছে বলেই পৃথিবী থেকে আমাদের সৌরজগতের এই দুটি গ্রহের ট্রানজিট দেখা সম্ভব। শুক্রের ক্ষেত্রে গড়ে প্রতি ১.২৫ শতকে দুটি ট্রানজিট ঘটে থাকে। দেখা গেছে শুক্রের কক্ষপথ পৃথিবীর কক্ষতলকে জুন এবং ডিসেম্বর মাসের শুরম্নর দিকে অতিক্রম করে। ফলে এই সময়ের দিকে শুক্র গ্রহ যদি সূর্য ও পৃথিবীর মাঝখানে অবস্থান করে তবেই এই ধরনের ট্রানজিট ঘটা সম্ভব।
কোন শতকে শুক্রের প্রথম ট্রানজিটটি ঘটার ঠিক ৮ বছর পরে দ্বিতীয় ট্রানজিটটি ঘটে থাকে। এর কারণ হলো শুক্রের (২২৪.৭০১ দিন) এবং পৃথিবীর (৩৬৫.২৫৬ দিন) কক্ষপথ পরিভ্রমন কালে প্রতি ৮ বছর পর পর পরস্পরের রেজোন্যান্স ঘটে। অন্যভাবে বলা যায়, এই সময়ে পৃথিবী সূর্যকে আটবার প্রদক্ষিণ করে আর শুক্র তেরোবার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। ফলে সূর্যের সাপেক্ষে পৃথিবী ও শুক্র এই ৮ বছর পর পর একই সরলরেখায় আসে।
১৬২৭ সালে জ্যোতির্বিদ জোহান্স কেপলার গ্রহগতি সংক্রানত্ম যে তালিকা প্রকাশ করেন সেখানে গ্রহগুলোর ভবিষ্যত অবস্থান এবং তাদের কিছু অদ্ভুত বিন্যাসের বিসত্মারিত তুলে ধরেন। তিনি তখন বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করেন, সৌরজগতের শুধুমাত্র বুধ ও শুক্র গ্রহ সূর্যের উপর দিয়ে অতিক্রম করতে পারে। তিনি হিসেব কষে বের করেন ১৬৩১ সালের শেষের দিকে বুধ ও শুক্র উভয়েরই এরকম চলন ঘটবে কিন' এই ঘটনার পূর্বেই কেপলার মারা যান। কিন্তু ফরাসী জ্যোতির্বিদ পিয়েরে গ্যাসেন্দি বুধের এই ট্রানজিটের প্রথম প্রতক্ষ্যদর্শী হয়েছিলেন। তিনি পরবর্তী মাসে শুক্রের ট্রানজিটটিও পর্যবেক্ষণের প্রস্তুতি নেন। কিন্তু আধুনিক হিসেবে দেখা গেল এই ট্রানজিটটি ইউরোপ থেকে দৃশ্যমান হবে না। কেপলার হিসেব অনুযায়ী পরবর্তী শতাব্দীর পূর্বে আর শুক্রের ট্রানজিট দেখতে পাবার কথা নয়। একজন তরম্নণ ও শৌখিন ব্রিটিশ জ্যোতির্বিদ জেরিমিয় হরক্স অনুমান করেন শুক্রের পরবর্তী ট্রানজিটটি ১৬৩৯ সালে সংঘটিত হবে। এই ট্রানজিটের মাত্র মাসখানেক আগে তিনি নির্ভূলভাবে ট্রনজিটের সময় হিসেব করতে সক্ষম হলেন। তিনি ও তার বন্ধু উইলিয়াম ক্যাবট্রি ১৬৩৯ সালের ৪ ডিসেম্বর প্রথমবারের মত এই মহাজাগতিক ঘটনার সাক্ষী হন।
এই ঘটনার প্রায় চলিস্নশ বছর পর তরম্নণ অ্যাডমন্ড হিলারি দক্ষিণ গোলার্ধের নক্ষত্রের ক্যাটালগ তৈরির সময়ে ১৬৭৭ সালের বুধের ট্রানজিট পর্যবেক্ষণ করেন। হ্যালি লক্ষ্য করেন এই ট্রানজিটের সাহায্যে পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব নিরূপণ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে বুধের চেয়ে শুক্রের ট্রানজিটই বেশি গ্রহণযোগ্য কারণ শুক্র অপেক্ষাকৃত পৃথিবীর নিকটবর্তী। তিনি ১৭১৬ সালে এই বিষয়ে একটি রচনাও প্রকাশ করেন।
৬ জুন বাংলাদেশ সময় রাত ৪টা ৯ মিনিট নাগাদ প্রথম সূর্যের গায়ে দাগ ফেলবে শুক্র। প্রক্রিয়াটি শুরুর ঘণ্টাখানেক পরে অর্থাৎ সূর্যোদয়ের সাথে সাথেই তা দেখতে পাবেন এ দেশের মানুষ। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ধরে মহাজাগতিক দৃশ্যটি দেখা যাবে। বাংলাদেশের সকল অঞ্চল থেকেই মেঘমুক্ত থাকা সাপেক্ষে এই ট্রানজিট দেখা সম্ভব হবে।
শুক্রের চলনের বিভিন্ন দশার সময় (সকাল):
১ম স্পর্শ ৪টা ০৯মি. ৩৮সে.
২য় স্পর্শ ৪টা ২৭মি. ৩৪সে.
সর্বোচ্চ চলন ৭টা ২৯মি. ৩৬সে.
৩য় স্পর্শ ১০টা ৩১মি. ৩৯সে.
৪র্থ স্পর্শ ১০টা ৪৯মি. ৩৫সে.
২১১৭ সালের ১১ ডিসেম্বরের আগে পৃথিবী থেকে শুক্রের ট্রানজিট আর দেখা সম্ভব হবে না। তাই আকাশ পরিষ্কার থাকলে এই দুর্লভ সুযোগটি মিস করবেন না। আর খালি চোখে কখনোই সূর্যের দিকে তাকাবেন না। যথাযথ ফিল্টার বা ওয়েল্ডিং গ্লাস ব্যবহার করুন।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুন, ২০১২ বিকাল ৪:৩২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




