somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার পর্বতারোহণঃ হানিমুন হাইক

২৪ শে জুন, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


জাপানের বসন্তকালীয় বৃষ্টি বড় বিরক্তিকর। ফোটায় ফোটায় কিছুক্ষণ পর পর পড়তেই থাকে। তাতে গা, হাত-পা খুব একটা ভেজেনা, তবে ঠাণ্ডায় দাঁত কপাটি লেগে যায়। এই বৃষ্টিকে আর যাই হোক, মোটেও রোমান্টিক বলা যায়না। শেষ এপ্রিলের এক সকালে উঠে দেখলাম এমন অরোমান্টিক বৃষ্টি হচ্ছে। অবাক হলাম না। জাপানিজ ওয়েদার অ্যাপগুলোর প্রায় শতভাগ নির্ভুল পুর্বাভাসের কারণে আগেই জানতাম আজ বৃষ্টি হবে। এই অবস্থায় পরবর্তী পদক্ষেপ হওয়া উচিৎ ছিলো মাংস খিচুড়ি রান্নার প্রস্তুতি নেয়া। কিন্তু আমি তা করলাম না। বাক্স পেটরা গুছিয়ে জামাইয়ের কাঁধে তুলে দিয়ে বললাম, চলো হাইকিং এ যাই। জনাব আগেই রাজী ছিলেন। অতঃপর আমরা রওনা করলাম টোকিওর অদুরে মাউন্ট মিতাকের উদ্দেশ্যে।
মাউন্ট মিতাকে-কে বলা হয় চিচিবু-তামা-কাই ন্যাশনাল পার্কের অন্যতম পপুলার হাইকিং ডেস্টিনেশন। টোকিওর মধ্যমনি শিনজুকু থেকে প্রায় ৯৫ মিনিটের লোকাল ট্রেনের পথ। কেউ যদি আবার এক্সপ্রেস ট্রেন ধরে যেতে যায় তো অন্য হিসাব। এই চিচিবু-তামা-কাই ন্যাশনাল পার্কের আয়তন প্রায় ১২৫০ বর্গকিলোমিটার। জাপানের চারটি প্রিফেকচারের পাহাড়, পর্বত, উপত্যকা আর ছোট ছোট পাহাড়ি গ্রাম নিয়ে এই বিশালাকার ন্যাশনাল পার্ক। আমাদের প্রাথমিক প্ল্যান ছিলো মাউন্ট মিতাকে থেকে শুরু করে, মাউন্ট ওদাকে হয়ে অকুতামা স্টেশন পৌঁছানো। হাইকিং এর ভাষায় ৯০০ মিটারের মতো অ্যাল্টিচুড পরিবর্তন করে ১,২৬৬ মিটার সর্বোচ্চ উচ্চতায় উঠতে হবে। ১০ কিলোমিটারের ট্রেইল; সব ঠিকঠাক থাকলে ৬ ঘন্টার মতো লাগার কথা। নির্ভেজাল প্ল্যান। তবে এখানে ছোট্ট একটা কিন্তু আছে।
জাপানিজ বৃষ্টি দেখলে, রোমান্টিসিজমের উদ্রেক হয়তো হয়না, তাই বলে একটু আলস্য চেপে ধরবেনা তাতো নয়। তারউপর ভোরসকালের ঘুম। যাত্রার শুরুই হলো এই প্রকার নানাবিধ প্রতিকুলতার মধ্য দিয়ে। এতসব প্রতিকুলতা পার হয়ে আমরা যখন মিতাকে স্টেশন পৌছুলাম ঘড়ির কাটায় তখন সাড়ে দশটা। ট্রেইল ম্যাপ যোগাড় করে বাসের সন্ধানে নামলাম এবং আবিস্কার করলাম মাত্রই একটা বাস ছেড়ে গেলো। পরবর্তী বাস আরো বিশ মিনিট পরে। এইভাবে ধুকে ধুকে যখন কেবল কার স্টেশনে পৌঁছুলাম বেলা প্রায় অর্ধেক গড়িয়ে গিয়েছে। এখন বেলা গড়িয়ে যাওয়ার টেনশনে তো আর প্রকৃতি থেকে মুখ ঘুরিয়ে রাখা যায়না। বাসন্তীয় বৃষ্টি তখনো চলছে। বৃষ্টির ছোঁয়া পেয়ে চারপাশের সবুজ যেন আরো জ্বলজ্বলে হয়ে উঠেছে। চেরী ব্লসমের মুল সময় শেষ হয়ে গেলেও, এপ্রিলের শেষদিকে চেরী প্রজাতির অন্যান্য ফুলের দেখা মেলে। ব্লসমের টাইমিং এর হিসেবে এরা কিছুটা পিছিয়ে পড়লেও সৌন্দর্যের বিচারে এদেরকে পেছনে ফেলা যাবেনা। পাহাড়ের গায়ে তাই সবুজের পাশাপাশি সাদা আর গোলাপী রঙের ছড়াছড়ি। কেউ যেন মনের ভুলে তার তুলোর ঝাঁকাটা পাহাড়ের এক পাশে কাত করে দিয়েছে। এমনকি কেবল কার-লাইনের দুই পাশেও চেরী ফুলের সমারোহ দেখতে পেলাম। ব্যপারটা যেন ফুলেল গার্ড অব অনার।
কেবল কারের শেষ গন্তব্য হলো মিতাকে সান স্টেশন। স্টেশনের পাশেই ভিউপয়েন্ট। সেখানে পাহাড়ের সারির উপর দিয়ে পেছনে ফেলে আসা টোকিওর একটা চমৎকার ভিউ পাওয়া যায়। আকাশের মন খারাপ থাকায় সেই ভিউ খুব একটা বিস্তৃত হলোনা। পাহাড়ের গা ঘেষে মেঘের দল নির্বিকারভাবে ভেসে বেড়াচ্ছে। মনে মনে বৃষ্টির মুন্ডুপাত করলেও সেই দৃশ্য দেখতে খুব একটা মন্দ লাগছিলোনা।
মাউন্ট মিতাকের চুড়ায় অবস্থিত মুসাশি মিতাকে শ্রাইন। টোকিওর অন্যতম পবিত্র তীর্থস্থান। হাতে সময় ছিলো কম। তাই বলে এরকম জনপ্রিয় শ্রাইন না দেখেই চলে যাবো। ভাবলাম এক ঝলক একটু দেখেই যাই। কিন্তু শুধু ভেবে বসে থাকলেই তো হবেনা, সিড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠতে হবে। সিড়ি ভাঙতে ভাঙতে যখন প্রায় কোমড় ভাঙ্গার উপক্রম তখন দেখতে পেলাম লাল টুকটুকে মিতাকে শ্রাইন। শ্রাইনের মুল বেদীর দুই পাশে সাদা নেকড়ের আকৃতির দুটি মুর্তি, জাপানিজ ভাষায় যাকে বলা হয় “অইনুসামা”। যার সোজা সাপটা বঙ্গানুবাদ হল “পবিত্র কুকুর”। পোষা কুকুরের সুস্বাস্থ্য প্রার্থনা করার জন্য প্রচুর দর্শনার্থীর আগমন ঘটে এই শ্রাইনে।


আশে পাশে তীর্থযাত্রীদের থাকার জন্য কিছু কটেজ, কিছু স্যুভেনির শপ আর রেস্তোরা। শ্রাইন থেকে খুব ক্লিয়ার কোন ভিউ পাওয়া গেলোনা তবে লালটুকটুকে মন্দিরের পাশে একটা ফুল-ব্লুম উইপিং চেরী গাছে নজর আটকে গেলো। এতো সুন্দর একটা গাছের এমন মন খারাপ করা নাম কেন দিতে হবে মাথায় ধরেনা। গাছটার ঝুলন্ত ডাল বেয়ে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত গোলাপী রঙের চেরী ফুল ফুটে আছে। হঠাৎ দেখলে মনে হবে ফুলের ফোয়ারা ছুটেছে। আমরা ফটাফট কিছু ছবি তুলে মাউন্ট ওদাকের ট্রেইল মার্ক ধরে হাঁটা শুরু করলাম।
পুরোনো দিনের বাংলা সিনেমার ভিলেনদের একটা প্রচলিত ডায়ালগ ছিলো, “সোজা আঙ্গুলে ঘি না উঠলে, আঙ্গুল বাঁকা করতে হয়”। আমরা তাদের যুগান্তকারী কৌশল প্রয়োগ করে সোজা রাস্তা বাদ দিয়ে চড়াই উৎরাই রাস্তা ধরলাম। সময় বাচাতে হবে। উঠা নামার সুবিধার্থে খাঁড়া ট্রেইলের অধিকাংশতেই মাটিতে কাঠ গেঁথে সিড়ির আকৃতি দেয়া ছিলো। তবে সেটা খুব একটা সুখবর ছিলোনা কারণ বৃষ্টিতে রাস্তা পিচ্ছিল হয়ে আছে। আমি শামুকের গতিতে এক পা এক পা করে নামতে লাগলাম। তবে বেশীক্ষণ এই অত্যচার সহ্য করতে হলোনা। কিছুক্ষনের মধ্যেই আমরা ২য় ভিউপয়েন্ট, নাগাওদাইরা অবজারভেশন ডেকে পৌঁছে গেলাম। এই ভিউপয়েন্ট থেকে চারপাশের পাহাড়ের রেঞ্জের পুরো ৩৬০ ডিগ্রী একটা ভিউ পাওয়া যায়। এটা ছাড়া প্রথম ভিউপয়েন্ট আর ২য় ভিউপয়েন্টের মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য নেই। আমরা আবার পা চালালাম।
এবার দুটো রাস্তা দুইদিকে গিয়েছে। একটা হল ওয়াকিং ট্রেইল, কিছুটা নির্ভেজাল। আরেকটা চড়াই উৎরাই, এবং বৃষ্টির কারণে স্লিপারি। তবে ২য় ট্রেইল ধরে ২০০ মিটার গেলেই গেলেই নানায়ো ফলস এবং ৫০০ মিটার গেলেই রক গার্ডেন দেখা যাবে। আমরা আবারো চিন্তা করলাম মাত্র কয়েকটা মিটারের জন্য ফলস দেখা বাদ দিবো। এসেছি যখন দেখেই যাই। অতঃপর এবড়ো থেবড়ো খাঁড়া পথ ধরে আবার নামো। কখনো ম্যান মেড পাহাড়ি পিচ্ছিল সিড়ি, কখনো নেচার মেইড গাছের শিকড় বাকড়ের ফাকফোকড় দিয়ে নামতেই থাকলাম নামতেই থাকলাম, কিন্তু ২০০ মিটার আর শেষ হয়না। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হওয়ার কারণে আলো কম। আর যত নিচে নামছি সেডার ট্রির বন আরো ঘন হচ্ছে। রিতিমতো ভুতুড়ে পরিবেশ।

বেশ কিছুক্ষণ চলার পর স্রোতের শব্দ শুনে বুঝতে পারলাম ২০০ মিটার শেষ হতে চলেছে। পিচ্ছিল পাথর পার হয়ে যখন ফলসের মুখোমুখি হলাম চুপচাপ কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম। পাথরের গা বেয়ে ১০/১২ ফিট উপর থেকে পানির শীর্ণ ধারা পড়ছে। মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। এই ফলস দেখার জন্য এতোটা নীচে নামলাম! আমার আক্ষেপ সম্ভবত পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বৃদ্ধ জাপানিজ দম্পত্তিও বুঝতে পারছিলো তাই তারা আমাকে পানির নিচে ডুবে থাকা আশ্চর্‍্য ব্যাঙ দেখাতে লাগলো। আমিও ভদ্রতাসূচক যতটা সম্ভব অবাক হওয়ার ভান করে ব্যাঙ্গের কয়েকটা ছবি তুলে ফিরতি পথ ধরলাম। এবার উঠার পালা। মনের দুঃখ বাড়ানোর জন্য উঠার পথে শিকড় বাকড়ের পাশাপাশি লোহার খাঁড়া সিড়িও ছিলো। ম্যাপের সতর্কতাবানী অনুযায়ী এই হ্যান্ড রেইল পিচ্ছিল ও বিপদজনক এবং উঠা-নামার সময় অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। আমি তাদের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করলাম। এইভাবে মিনিট বিশেক উঠার পর আমরা আবার ওয়াকিং ট্রেইলে ফিরে এলাম। পরবর্তী গন্তব্য “রক গার্ডেন”।
এইবারের পথ বেশ মনোহর। একপাশে ভেজা শুকনো পাতায় মোড়ানো পাহাড় আর অন্যপাশে ছোট থেকে মাঝারি আকারের পাথর, যার গা ঘেঁষে পাহাড়ি ঝর্ণার পানি ধীর লয়ে তার গন্তব্যের দিকে এগুচ্ছে। মনে হচ্ছিলো ক্যলন্ডারের পাতায় দেখা কোন ছবির ভেতর ঢুকে গিয়েছি। যত সামনে আগাচ্ছিলাম পাথরের সংখ্যা ও আকার উভয়েই বাড়ছিলো। একসময় আমার সন্দেহ হলো, এটাই রক গার্ডেন নয়তো। পাহাড়ের মাঝখানে এরকম থরে থরে সাজানো পাথর, তার উপর দিয়ে ক্যাসাক্যাড আকারে নেমে যাওয়া ঝর্ণার পানি, দুইপাশের গাছে বৃষ্টিভেজা কচি পাতা এই পার্থিব জগতের অংশ বলে মনে হচ্ছিলোনা একদমই। কেবল শরীরের ক্লান্তি একটু পর পর মনে করিয়ে দিচ্ছিলো পথ এখনো অনেক বাকী। পরবর্তী রেস্ট স্টেশনে বসে লাঞ্চ সারতে সারতে বুঝতে পারলাম আমার ধারনাই সঠিক। বাগান মানেই সেখানেই নানান রঙের ফুল ফলের সমাহার থাকবে ব্যপারটা জরুরী নয়। জরুরী হল, ঘন্টা খানেকের অমানুষিক পরিশ্রম নিমিষেই ভুলে গিয়ে অবচেতন মনে বলে উঠা, “এই চমৎকার পৃথিবীতে আমাকে আরেকটি দিন বাঁচিয়ে রাখার জন্য সৃষ্টিকর্তা তোমাকে ধন্যবাদ”।


লাঞ্চ শেষে আবারো যাত্রা শুরু। এবারের রাস্তা একমুখী তাই আর কোন দোটানায় পড়তে হলোনা। কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে ২য় ফলসের দেখা পেলাম। এর নাম আয়াহিরো ফলস। এই ফলস আগের ফলসের চেয়েও রোগা পটকা তবে এটি সিনতো ধর্মালম্বীদের জন্য একটি পবিত্র স্থান। স্থানীয় সন্যাসীরা প্রায়ই তপস্যার অংশ হিসেবে এর ঠাণ্ডা জলে স্নান থাকে।


আমরা ফলস পার হয়ে সামনে মাউন্ট ওদাকের উদ্দ্যেশে আগালাম। এবার রাস্তা উর্ধমুখী। একটানা উপড়ে উঠতে উঠতে একটু পর পরই দম ফুরিয়ে যায়। অবস্থা দেখে সোয়ামী বললো, “ফিরে যাবা নাকি?”। আমি আবারো চিন্তা করলাম, “এতো কাছে এসে ফিরে যাবো! মাউন্ট ওদাকেটা একটু দেখেই যাই”। এরপর পুরোদস্তুর হাইকিং শুরু। কখনো পাহাড়ের পাশে সোজা রাস্তা দিয়ে যাই। কখনো বিশাল বিশাল পাথরের উপর দিয়ে চার হাত পা ব্যবহার করে স্পাইডারম্যান স্টাইলে উঠি আর নামি। আর মনের ভুলে নিচে একবার চোখ পড়ে গেলে বুকের ভেতর ধড়াস ধড়াস শব্দ করে। পাথরে উপর কিছু কিছু জায়গার ট্রেইল এতোটাই সরু আর খাঁড়া যে হ্যান্ড সাপোর্টের জন্য লোহার শিকল গেঁথে রাখা হয়েছে। এইরকম স্ব আমন্ত্রিত অত্যাচার সহ্য করতে করতে যখন মনে হলো ফিরে যাওয়াটাই উচিত ছিলো, তখন বড্ড দেরী হয়ে গিয়েছে। সামনে যতটুকু পথ, পেছনেও ঠিক ততটাই। তারউপর এই খাঁড়া পাথরের চাই বেয়ে আবার নামতে হবে চিন্তা করতেই বুক ধড়াস ধড়াস করতে লাগলো। বেলা পড়ে আসছে। আমরা সামনে এগুতে থাকলাম। পথিমধ্যে মাঝে মাঝেই মনে হলো স্বামী প্রজাতির লোকজনের কথা অল্পবিস্তর শোনা উচিৎ।
এইবার শরীর মনে যত শক্তি ছিলো সব প্রয়োগ করে রাস্তায় চলতে থাকলাম কিংবা বলা যায় রাস্তা বাইতে থাকতাম। দিনের আলো থাকতে থাকতে এবড়ো থেবড়ো রাস্তা যতটা পার হওয়া যায়। ঘন্টাখানেকের মাথায় আমরা মাউন্ট ওদাকের চুড়ায় উঠে পড়লাম। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, আমাদের প্ল্যানিং টাইমিং কোনটাই আসলে বাস্তবসম্মত ছিলোনা। তবে ভাগ্যে থাকলে ঠেকায় কে। ওদাকের চুড়ায় উঠে দেখলাম আকাশ আস্তে আস্তে পরিস্কার হচ্ছে। যদিও মাউন্ট ফুজি দেখতে পারলাম না তবে শ্বাসরুদ্ধকর দৃশ্য যাকে বলে, তা খুব ভালো করেই দেখলাম। যতদুর চোখ যায় শুধু পাহাড়ের সারি। এক পাশ থেকে ধীরেধীরে মেঘ কেটে গিয়ে নীলচে আকাশ উঁকি দিচ্ছে। অন্যপাশে পাহাড়ের সাথে মেঘের ছোয়াছুয়ি খেলা। এই দৃশ্য বহুবার দেখার পরেও পুরোন হয়না। প্রতিবারই শিহরিত হই, রোমাঞ্চিত হই। প্রতিবারই মনে হয় “এই অপার বিশালতায় এই নগণ্য আমাকে টিকিয়ে রাখার জন্য সৃষ্টিকর্তা তোমাকে ধন্যবাদ”।


চুড়ায় বসে থেকে হয়তো আরো কিচ্ছুক্ষণ আবেগাপ্লুত হওয়া যেতো কিন্তু কনকনে বাতাসের কারণে আর টেকা গেলোনা। কিছু ছবি তুলে আর গলা ভিজিয়ে ফিরতি পথ ধরলাম। কিছুদূর কসরত করে পার হয়ে আমরা মাযুকারি রিজলাইনে পৌঁছে গেলাম। একটুখানি সমতল ভুমি পেয়ে পা দুটো যেন হাপ ছেড়ে বাঁচল। আকাশে তখন মেঘ সরে গিয়ে সুর্য উঁকি দিচ্ছে। রিজের দুইপাশে খাঁড়া ঢাল। সেডার ট্রির ফাঁকফোকর দিয়ে দুরের পাহাড়গুলোর চুড়ো দেখা যাচ্ছে। বিকেলের মিস্টি রোদ পোহাচ্ছে যেন।
চুড়া থেকে কিছুটা নিচে নেমে আসায় বাতাসের গতিও কম। আমরা দুইজন ছাড়া জনমানব আর কেউ নেই। ব্যপারটা যদি কোন সমুদ্রের পারে ঘটতো, তাহলে হতো আবেগের। কিন্তু সমুদ্রপৃষ্ট থেকে প্রায় ১১০০ মিটার উচ্চতার পাহাড়ি জঙ্গলে ব্যপারটা হয়ে দাঁড়ালো উদ্বেগের। স্থান কাল পাত্রভেদে এভাবেই অনুভূতি বদলায়। রিজলাইনটা আমরা খুব দ্রুতই পার হয়ে আসলাম। এরপরে আরেকটি চুড়া, মাউন্ট নোকোগিরি। এরপর আমাদের ফিরতি স্টেশন অকুতামা। মাউন্ট নোকোগিরির চুড়ায় পৌঁছানোর আগে ছোটোখাটো বেশ কয়েকটা চুড়া পার হয়ে এলাম। তবে স্বস্তির বিষয় দিনের আলো থাকতে থাকতেই নোকোগিরির চুড়ায় উঠে পড়লাম। কিন্তু চারপাশে সেডার ট্রির কারণে ভালো ভিউ পেলাম না। অতঃপর দুটো কলা গলাধকরণ করে আবারো নামা শুরু করলাম।


পথে একটা রুটমার্ক দেখালো আমাদের স্টেশন এখনো সাড়ে তিন কিলোমিটারের রাস্তা। আমার তো মাথায় হাত। রাস্তা যেন চুইংগামের মতো বড় হচ্ছে। আর ওইদিকে সুর্যও অস্তগামী। যতজোরে সম্ভব পা চালালাম। রাস্তা এখনো আগের মতোই পাথুরে এবং উঁচুনিচু। ট্রেইলের সরু অংশগুলো পাথরের গায়ে গেঁথে রাখা শিকল ধরে পার হলাম। কিছু কিছু যায়গায় ট্রেইল অতিরিক্ত খাঁড়া হওয়ায় লোহার সিড়ি বসানো ছিলো। জাপানিজ ট্রেইলের কমন বৈশিষ্ট্য। একটা সময় ট্রেইল খুবই বন্ধুর হয়ে আসলো। শরীরও প্রচন্ড ক্লান্ত। হেঁটে আর নামতে পারছিলাম না। বসে বসে নামতে হচ্ছিলো। এই অবস্থাতেই ছোট একটা মুর্তির অবয়ব পার হলাম। অন্ধকার হয়ে আসায় ভালো করে খেয়াল করতে পারিনি তবে মুর্তির পায়ের নিচে পড়ে থাকা কয়েনগুলো চোখ এড়ালোনা। জাপানিজ ট্রেক্কারদের নিবেদিত শ্রদ্ধার স্মারক। এবার পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে এলো। আমরা তখনো সেডারের বন পার হচ্ছি। ট্রেইল এবার পাহাড়ি সিড়ির আকৃতি ধারণ করেছে। আমরা মোবাইলের আলোয় নামতে থাকলাম। তবে সৌভাগ্যের বিষয় পথিমধ্যে আর উঁচুনিচু পাথরের চাই পড়েনি। এমনকি শেষবেলায় আমাদের মতো লেটুস আরেক ট্রেকার কাপলেরও দেখা পেলাম।


অতঃপর আমরা লোকালয়ে পা রাখলাম। আমার ছোটখাটো হাইকিং অভিজ্ঞতায় দুটো অনুভূতি সবসময় কমন পেয়েছি। প্রথমটা হলো চুড়ায় উঠে বিশ্বজয় করার মতো অনুভূতি আর দ্বিতীয়টা হলো, সমতলে নেমে এসে “বিশাল বাঁচা বেঁচে গেলাম”-ধরণের অনুভূতি। উভয় অনুভুতিই আমার ভীষণরকম প্রিয়।
এখন নামকরণের প্রসঙ্গে আসি। সমুদ্রের পারে বা বিলাসী রেস্তোরায় ক্যান্ডেল লাইট ডিনার অনেক রোমান্টিক ব্যপার, কোন সন্দেহ নেই। সে তুলনায় জীবনের কঠিনতম সময়গুলো একে অপরের হাত ধরে পার করে আসতে পারাটা অতোটা রোমান্টিক নয়, কিন্তু অনেক বেশী প্রাসঙ্গিক। বিয়ের তিনবছর পর এই প্রথম আমি আমার স্বামীর সাথে হাইকিং এ গিয়েছি। একে অপরের হাত ধরে ট্রেইলের বিপদজনক অংশগুলো পার হয়েছি, অন্ধকারে রাস্তা খুঁজে নিয়েছি। আমাদের এখনো ক্যান্ডেল লাইটে ডিনার করা হয়নি কিন্তু মোবাইলের লাইটে হাইকিং করা হয়ে গিয়েছে। প্রচলিত সংজ্ঞায় আমরা অতোটা রোমান্টিক নই। কিন্তু হাতে হাত রেখে একটা জীবন কাটিয়ে দেয়ার জন্য সেটা খুব একটা জরুরী নয়। সুতরাং আমার সংজ্ঞায় এটাই আমার হানিমুন। আমার হানিমুন হাইক। এই হানিমুন হাইকের জন্য সৃস্টিকর্তা তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জুন, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:৫০
৬টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মুসলিম কি সাহাবায়ে কেরামের (রা.) অনুরূপ মতভেদে লিপ্ত হয়ে পরস্পর যুদ্ধ করবে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৯




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৫। তোমরা তাদের মত হবে না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি করেছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গল্পঃ অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১২

(১)
মাছ বাজারে ঢোকার মুখে "মায়া" মাছগুলোর উপর আমার  চোখ আটকে গেল।বেশ তাজা মাছ। মনে পড়লো আব্বা "মায়া" মাছ চচ্চড়ি দারুণ পছন্দ করেন। মাসের শেষ যদিও হাতটানাটানি চলছে তবুও একশো কুড়ি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×