somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রশ্নশীল শামসুর রাহমান / আবু হাসান শাহরিয়ার

১৭ ই আগস্ট, ২০০৯ ভোর ৫:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আজ তাঁর তৃতীয় মৃত্যুদিবস । ১৭ আগষ্ট , আমাদের ছেড়ে চলে যান কবি। তাঁকে স্মরণ করছি শ্রদ্ধার সাথে ।

প্রশ্নশীল শামসুর রাহমান
আবু হাসান শাহরিয়ার
----------------------------------------------------------------
সমকালীন রাজনৈতিক ঘটনাবলিকে মিথ করে তোলার জাদুকরি ক্ষমতা ছিল তার কলমে। যেমন- তার ‘দুঃখিনী বর্ণমালা’ কবিতাটির অন্তঃশীলে আছে বাঙালির ভাষা-আন্দোলনের মিথ কিংবা ‘আসাদের শার্ট’-এর অন্তঃশীলে ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের মিথ। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কত কবিই তো কত কবিতা লিখেছেন; সেগুলোর কয়টি পেরেছে শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি’ বা ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’র মতো মিথ হতে? এরকম অসংখ্য মিথের (সমকালপুরাণের) ভাঁড়ার শামসুর রাহমানের কবিতা
বিকে উত্তমরূপে একজন প্রশ্নশীল মানুষ হতে হয়। কবির কাছে দীক্ষিত পাঠকের প্রথম দাবি- পূর্ব-অনাস্বাদিত স্বরভঙ্গি। দাবিটি পূরণ করতে হলে উত্তরকালের কবিকে পূর্বসাধকদের প্রকরণবলয় থেকে বেরিয়ে আসতে হয়। কেবল প্রশ্নশীল কবির পক্ষেই এটা সম্ভব। ধ্বনিময়তা না চিত্রময়তা, ছন্দ না ছন্দোহীনতা, দীর্ঘকথন না বাকসংযম, প্রতিমানির্মাণ না প্রতিমাবিসর্জন, নির্দিষ্টতা না অনির্দিষ্টতা, একরৈখিকতা না বহুরৈখিকতা- যে-কবির মনে একবারের জন্যও এ প্রকার প্রশ্ন উঁকি দেয় না, স্বরের স্বরভঙ্গিতে নিজেকে তিনি আলাদা করবেন কী করে? এর পর-পরই আরও একটি দাবি উঠে আসে, চাই নতুন ভাবনাবলয়ও। দ্বিতীয় এ দাবিটি পূরণ করতে হলে কবিকে তার পাঠাভিজ্ঞতা ও জীবনাভিজ্ঞতার কাছে ফিরে-ফিরে হাত পাততে হয়। প্রবহমান অক্ষরবৃত্তের পূর্ব-অনাস্বাংদিত প্রকাশপ্রকরণ দিয়ে শামসুর রাহমান দীক্ষিত পাঠকের প্রথম দাবিটি পূরণ করেছেন। দ্বিতীয় দাবিটি পূরণে তিনি পথ হেঁটেছেন পুরাণ (প্রধানত গ্রিকপুরাণ; কখনও-কখনও বাংলার লোকপুরাণও) এবং বাঙালির নিকট-ইতিহাসকে সঙ্গী করে। ‘কালের ঈগল ডানার বিস্তার’ শিরোনামের এক পাঠোদ্ধারমূলক গদ্যে, এ কারণেই, তাকে আমি ‘সমকাল পুরাণের রচয়িতা’ বলেছি। তার কবিতাকে বলেছি ‘বাঙালির প্রতিইতিহাস’। তারই ধারাবাহিকতায়, প্রশ্নশীল শামসুর রাহমানের খোঁজে, নতুন এ গদ্যের অবতারণা। ভাবনার বাহন বুদ্ধি নয়Ñ প্রেম।
প্রচল প্রথাগুলোকে প্রশ্নে-প্রশ্নে যাচাই করার ক্ষমতা না-থাকলে, আর যা-ই হোক, কবিতায় নিজস্বতার দাগ কাটা যায় না। তার মানে এই নয়Ñ প্রথামাত্রই খারাপ। প্রথা নয়; প্রথার দাসত্ব খারাপ। জাতিতে-জাতিতে অনেক প্রথাই যুগ-যুগ ধরে টিকে আছে, যেগুলোকে আমরা কৃষ্টি বা ঐতিহ্য বলি। কবিতাও একটি প্রথা। প্রথা দিয়ে প্রথাকে প্রশ্নবিদ্ধ করাই শিল্পের কাজÑ কবিতার কাজ। দূর প্রস্তরযুগের মানুষ যেমন পাথরে পাথর ঠুকে আগুন আবিষ্কার করেছিল, বিষয়টি অনেকটা সেরকম। ঐ আগুনে মানুষ রান্নাবান্নাসহ দিনানুদিনের অনেক প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্ন করে আসছে যুগ-যুগ ধরে। আগুনের এই ব্যবহার একটি প্রথা। চিরকালীন প্রথা। প্রথাটি ইতিবাচক। কবিতার রন্ধনশালায়ও ঐরকম প্রথার আগুন দরকার হয়। আবার, মৃতস্বামীর চিতার আগুনে জীবন্ত স্ত্রীলোককে পুড়িয়ে মারার মতো অনেক নেতিবাচক প্রথাও চালু ছিল মানবসমাজে। প্রশ্নশীল মানুষের কারণে ঐ সব অপপ্রথা সমাজজীবন থেকে দূর হয়েছে। কবিতা থেকেও কখনও-কখনও সেকেলে প্রথাকে বিদায় জানাতে হয়। যুগোপযোগিতায় নবায়ন করে নিতে হয় পুরনো প্রথাকে। প্রথা ও প্রথাবিরোধিতার প্রশ্নে গ্রহণ-বর্জনের এই ভারসাম্য যিনি স্বতঃস্ফূর্ততাভাবে রক্ষা করতে পারেন, তিনিই প্রকৃষ্টরূপে কবি। সবার কবিতা যদি একই পোশাকে সাজল, তাহলে আর সেকেলে-পোশাক-পাল্টানো কেন? তাই পূর্ববর্তী কবিদের প্রকরণবলয় ছিন্ন করার পাশাপাশি যুগের অনেক লঘু প্রণোদনা থেকেও সরে আসতে হয় কবিকে।
পূর্বসাধকদের প্রকরণবলয় কী ভাবনাবলয় থেকে বেরিয়ে আসার কাজটি দশকের মৌজায় কী উৎসবের মঞ্চে কী মিডিয়ার ছাপাছাপিতে কী প্রতিষ্ঠানের পদক-পুরস্কারে ঠাঁই-পাওয়ার মতো সহজ কাজ নয়। কবিতায় সিদ্ধি পেতে হলে জীবনকে মোমের মতো পুড়িয়ে পাঠকমনে সলতে হয়ে জ্বলতে হয়। বর্তমানের ও চিরকালের পাঠকের মনে। প্রকৃত কবি সমকালের পাঠকের হাত ধরে ভবিষ্যতের পাঠকের কাছে যান। বইয়ের পর বই বেরিয়ে যাচ্ছে, একটি কবিতাও পাঠকের মনে দাগ কাটছে নাÑ সব সমকালে এমন কবির সংখ্যাই ছিল বেশি। তারা কেউ কবি নন। জীবনকে মোমের মতো পুড়িয়ে পাঠকমনে সলতে হয়ে জ্বলার ক্ষমতা ছিল বলেই জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসুসহ কেউ-কেউ, রবীন্দ্রবলয় থেকে বেরিয়ে, বাঙলা কবিতায় নতুন পথ রচনা করে গেছেন। জীবনানন্দ এই পর্বের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কবি। সমসাময়িক অন্য প্রধান কবিদের মতো তিনিও পাশ্চাত্যের কবিতায় তন্নিষ্ঠ চোখ রেখেছিলেন। কিন্তু ইউরোপমুগ্ধতায় ভেসে যাননি। শব্দের ব্রহ্মত্বকে চারিয়ে দিয়েছেন প্রাচ্যের মাটিতে। কাজটি তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে করেছেন। পেছনে ছিল একটি প্রশ্নশীল মন। বাঙলা কবিতায় জীবনানন্দ দাশ নিজস্বতার দাগ কেটেছেন এই স্বতঃস্ফূর্ত প্রশ্নশীলতা দিয়েই। এছাড়াও মাত্রাবৃত্তের ঢেউ-খেলানো অক্ষরবৃত্তের নতুন ছন্দোবন্ধ তার কবিতাকে বিশিষ্টতা দিয়েছে। মুখচোরা হলেও তিনি ছিলেন পরিপূর্ণ আত্মবিশ্বাসী এক কবি।ধূসর পাণ্ডুলিপি র ‘কয়েকটি লাইন’ সেই আত্মবিশ্বাসের ইশতেহার। কবিতাটির শুরুতেই আছে
কেউ যাহা জানে নাই- কোনো এক বাণী
আমি বয়ে আনি
একদিন শুনেছো যে সুর
ফুরায়েছে পুরনো তা- কোনো এক নতুন কিছুর
আছে প্রয়োজন,
তাই আমি আসিয়াছি, আমার মতন আর নাই কেউ।

জীবনানন্দের পর বাঙলা কবিতায় যারা ঈর্ষণীয় সফলতা দেখিয়েছেন, শামসুর রাহমান তাদের অন্যতম। তার কবিতার প্রধান দুটি গুণের কথা শুরুতেই উল্লেখ করেছি। ঐ দুটি গুণের উত্তরোত্তর নবায়নের মধ্য দিয়েই পূর্বসাধক ও সমসাময়িক কবিদের থেকে নিজেকে আলাদা করেছেন তিনি। সমসাময়িক শঙ্খ ঘোষের কবিতা সামনে রাখলে অন্য ব্যাখ্যা উঠে আসে। শঙ্খর কবিতার বড় বৈশিষ্ট্য বাকসংযম, প্রশান্ত রস আর প্রাচ্যের লোকপুরাণের বিপুল ভাঁড়ার তার কবিতা, ছত্রে-ছত্রে আছে চিরকালীনতা। সমসাময়িক শক্তি চট্টোপাধ্যায় নিজেকে আলাদা করেছেন নিরূপিত ছন্দের নবায়ন দিয়ে। শব্দকে ছত্রিশ ব্যঞ্জনে বাজিয়ে উপেক্ষিত পদ্যকেই তিনি নিয়ে গেছেন কবিতার উচ্চতায়। নিজেকে পদ্যকার ভাবতেও ভালবাসতেন শক্তি। আবার, দিনানুদিনের তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয় নিয়ে ব্যঞ্জনাদীপ্ত কবিতা লিখেছেন বিনয় মজুমদার। নিজেকে তিনি এই গুণটি দিয়ে পূর্বসাধক ও সমসাময়িক কবিদের থেকে আলাদা করেছেন। অন্যদিকে আল মাহমুদের কবিতা প্রাচ্যের লোকনিজস্বতার স্বতন্ত্র ভাঁড়ার। এ কারণেই, মৌলবাদী শিবিরে যোগ দেওয়ার পরও, দীক্ষিত পাঠক তাকে উপেক্ষা করতে পারেন না।
শামসুর রাহমানের প্রথম কবিতার বই প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে । এ বইয়ের বেশ কিছু কবিতা জীবননান্দ দাশের কবিতার প্রভাবদুষ্ট। নিজস্ব প্রকাশপ্রকরণ ও ভাবনাবলয় নিশ্চিত করেছেন তিনি দ্বিতীয় কবিতার বই রৌদ্র করোটি থেকে। এ বইয়ের ‘রবীন্দ্রনাথের প্রতি’ কবিতায় আছে,
লোকে বলে বাংলাদেশে কবিতার আকাল এখন
বিশেষত তোমার মৃত্যুর পরে কাব্যের প্রতিমা
ললিত লাবণ্যচ্ছটা হারিয়ে ফেলেছে- পরিবর্তে রুক্ষতার
কাঠিন্য লেগেছে শুধু আর চারদিকে পোড়োজমি,
করোটিতে জ্যোৎস্না দেখে ক্ষুধার্ত ইঁদুর কী আশ্বাসে
চম্কে ওঠে কিছুতে বোঝে না ফণীমনসার ফুল।

সুধীন্দ্র জীবনানন্দ নেই, বুদ্ধদেব অনুবাদে
খোঁজেন নিভৃতি আর অতীতের মৃত পদধ্বনি
সমর-সুভাষ আজ। অন্যপক্ষে আর ক’টি নাম
ঝড়জল বাঁচিয়ে আসীন নিরাপদ সিংহাসনে,
এবং সম্প্রতি যারা ধরে হাল বহতা নদীতে
তাদের সাধের নৌকা অবেলায় হয় বানচাল,
হঠাৎ চড়ায় ঠেকে। অথবা কুসুমপ্রিয় যারা
তারা পচা ফুলে ব’সে করে বসন্তের স্তব ।

পূর্বসাধকদের কবিতা সম্পর্কে বিশদ-ধারণা ছাড়া নিজেকে আলাদা করার কাজটি সম্পন্ন করা প্রায় অসম্ভব। এ ব্যাপারে শামসুর রাহমান যে নিজেকে ফাঁকি দেননি, উপরের পঙ্ক্তিগুলো তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। কবিতাটি প্রশ্নশীল এক কবির আত্মপ্রস্তুতির ঘোষণাপত্রও। দীক্ষিত পাঠকের প্রথম দাবিপূরণে, ইতিমধ্যেই, প্রবহমান অক্ষরবৃত্তের নতুন এক প্রকাশপ্রকরণ আয়ত্ত করে নিয়েছেন তিনি। এবার দেখা যাক, দ্বিতীয় দাবিটি পূরণে বা ‘কেউ যাহা জানে নাই- কোনো এক বাণী’ বয়ে আনার ক্ষেত্রে তার কবিতা কোন নিজস্বতার পথ বেছে নিয়েছিল। ঐ কবিতারই অন্য দুটি পঙ্ক্তিতে এর উত্তর মেলে-
প্রতীকের মুক্ত পথে হেঁটে চলে গেছি আনন্দের
মাঠে আর ছড়িয়ে পড়েছি বিশ্বে তোমারই সাহসে।
শামসুর রাহমান জানতেন, কবিতা এক আনন্দের মাঠ; সেই মাঠে কবি এক খেয়ালী বালক। আর সে-কারণেই, খ্যাতির ডাকে সাড়া দিয়ে জীবনের শেষভাগে বিস্তর লঘু কবিতা লিখলেও, জীবনে একটিও বানানো কবিতা লেখেননি। তিনি আরও জানতেন, প্রথায়-প্রথায় বিদ্যান হওয়ার চেয়ে প্রশ্নে-প্রশ্নে চিরকালের বালক থাকা কবির জন্য বেশি জরুরি। মুশকিল এই যে, তকমাআঁটা বিদ্যানরা কদাচিৎ ঐ খেয়ালী বালকটিকে বুঝতে পারেন। কাব্যালোচনার নামে অজ্ঞানতার উন্মোচনই তাদের কাজ। তাতে কবিতার কিছু যায় আসে না। বালকস্বভাবী কবিরও জানা আছে
উল্লুকের বিশদ বিধানে
বিদ্বানেরা চোখ-বাঁধা বলদের মতো ঘানি টানে।
[কবন্ধের এলামেলো পোঁচে/বুক তার বাংলাদেশের হৃদয় ]
পদক-পুরস্কারে নয়, পাঠকেই কবির সিদ্ধি, কবিতার সিদ্ধি। মহার্ঘ কবিতা পাঠকের হৃদয়ে কড়া নাড়তে আসে- বিদ্যানের মগজে ঘণ্টা বাজাতে নয়। বাঙলা কবিতায়, জীবনানন্দ দাশের পর, শামসুর রাহমানই কবিতাপ্রেমী পাঠককে কাছে টানতে পেরেছেন বেশি। কেন পেরেছেন, সেই প্রশ্নে যাওয়ার আগে বালকস্বভাবী শামসুর রাহমানকে আরেকটু চিনে নেওয়া যাক। তার শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য এবং যৌবনের কিছু সময় কেটেছে পুরনো ঢাকায়। শৈশবজীবনের একটি প্রিয় চরিত্র ছিল রোজ সন্ধ্যায় কাঁধে মই নিয়ে মহল্লার রাস্তায় আলোজ্বালানিয়া বাতিঅলা। স্মৃতির শহর নামের আত্মজৈবনিক বইয়ে ঐ বাতিঅলার কথা বিশদ-ভালবাসায় লিখেছেনও তিনি- “গলি বেয়ে ছায়া নামত, অন্ধকার হামাগুড়ি দিয়ে আসত, দেখতাম; কিছু বলতাম না মুখ ফুটে। আলো ফুটত বাতিঅলার হাতের ছোঁওয়ায়, আলো ফুটলে সে খানিক মাথা নোওয়াত মই থেকে নামার আগে, একবার দেখে নিত কাঁচের ভেতর আলোর পদ্মটাকে।” একটি কবিতাও আছে তার ঐ বাতিঅলাকে নিয়ে ‘শৈশবের বাতি-অলা আমাকে’। সরল প্রশ্নাবলিতে কবিতাটির শুরু
সর্বাঙ্গে আঁধার মেখে কী করছো এখানে খোকন?
চিবুক ঠেকিয়ে হাতে, দৃষ্টি মেলে দূরে প্রতিক্ষণ
কী ভাবছো ব’সে?
হিজিবিজি কী আঁকছো? মানসাঙ্ক ক’ষে
হিসেব মিলিয়ে নিচ্ছো? দেখছো কি কতটুকু খাদ
কতটুকু খাঁটি এই প্রাত্যহিকে, ভাবছো নিছাদ
ঘরে থাকা দায়, নাকি বই-পত্রে ক্লান্ত মুখ ঢেকে
জীবনের পাঠশালা থেকে
পালানোর চিন্তাগুলো ভ্রমরের মতো
মনের অলিন্দে শুধু ঘোরে অবিরত?

প্রশ্নগুলো বালকস্বভাবী কবি নিজেকেই করেছেন। কবিতাটির শেষ স্তবকে পাঠকের প্রতিও একটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন তিনিÑ ‘তোমরা কি অন্ধকারপ্রিয়’। শেষের স্তবকের পুরোটাই নিচে উদ্ধার করছি,
তোমার পাড়ায় আজ বড়ো অন্ধকার। সম্ভবত
বাতিটা জ্বালাতে ভুলে গেছ, আমি অভ্যাশবশত
কেবলি আলোর কথা বলে ফেলি। মস্ত উজবুক
এ লোকটাÑ ব’লে দাও দ্বিধাহীন। ভয় নেই, দেখাবো না মুখ
ভুলেও কস্মিনকালে। তোমরা কি অন্ধকারপ্রিয়?
চলি আমি, এই লণ্ঠনের আলো যে চায় তাকেই পৌঁছে দিও ।।
[শৈশবের বাতিঅলা আমাকে/বিধ্বস্ত নীলিমা ]

শামসুর রাহমান ছিলেন ঐরকমই এক বাতিঅলা। বাঙালির জাতীয় জীবনে যখনই কোনও অন্ধকার হামাগুড়ি দিয়ে নেমেছে, তখনই তিনি আলো জ্বালিয়েছেন কবিতার বাতিদানে। প্রতিটি প্রগতিশীল আন্দোলন-সংগ্রামে মানুষের সঙ্গে রাজপথে থেকে, সেই আলোয় কীভাবে পথ হাঁটতে হয়, তা-ও দেখিয়ে দিয়ে গেছেন। শত্র“পরিবেষ্টিত ঘোর দুর্যোগেও কবিতার খাতায় নিবিষ্ট থেকেছেন কান্তিমান ঋষির মতো। ইকারুসের আকাশ-এর ‘ইলেক্ট্রার গান’ কবিতার কয়েকটি প্রাসঙ্গিক পঙ্ক্তি উদ্ধার করা যাক
শ্রাবণের মেঘ আকাশে-আকাশে জটলা পাকায়
মেঘময়তায় ঘনঘন আজ একি বিদ্যুৎ জ্বলে।
মিত্র কোথাও আশেপাশে নেই, শান্তি উধাও;
নির্দয় স্মৃতি মিতালি পাতায় শত করোটির সাথে।

নিহত জনক আগামেমনন, কবরে শায়িত আজ।

কবিতাটির অন্তঃশীলে আছে বাঙালির মহত্তম নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ট্র্যাজিক মৃত্যু। বাল্মীকি বা হোমারের যুগ হলে, একটি পরাধীন জাতিকে যিনি মুক্তির পথ দেখিয়েছেন, তার নির্মম মৃত্যুকে নিয়ে মহাকাব্য রচিত হত। শামসুর রাহমানের দুর্ভাগ্য, তিনি সে-যুগে জন্মাননি। তাতে কী? অনতিদীর্ঘ একটি কবিতাকেই মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনা দিয়েছেন। প্রতীক হিসেবে বেছে নিয়েছেন হোমারের ইলিয়াড থেকে আগামেমনন চরিত্রটি। কবিতাটির পরিপূর্ণ রসাস্বাদনে পাঠকেরও দীক্ষিত হওয়ার আছে। তবে সাধারণ পাঠককেও বঞ্চিত করেননি শামসুর রাহমান। কেমন? উদ্ধার করছি আরও কয়েকটি পঙতি ।
সেইদিন আজো জ্বলজ্বলে স্মৃতি, যেদিন মহান
বিজয়ী সে বীর দূর দেশ থেকে স্বদেশে এলেন ফিরে।
শুনেছি সেদিন জয়ঢাক আর জন-উল্লাস;
পথে-প্রান্তরে তাঁরই কীর্তন, তিনিই মুক্তিদূত।
নিহত জনক আগামেমনন, কবরে শায়িত আজ।

যে-পাঠক হোমারের ইলিয়াড পড়েননি কিংবা আগামেমননের নামও শোনেননি, জন্ম যদি তার বাংলাদেশে হয়, বাঙলা যদি হয় মাতৃভাষা, উপরের পঙ্ক্তিগুলো তাকেও শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশপ্রত্যাবর্তনের দিনটির (১০ জানুয়ারি ১৯৭২) কথা মনে করিয়ে দেবে। একইভাবে পরবর্তী স্তবকের পঙ্ক্তিগুলো ডেকে আনবে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের শোকাবহ স্মৃতিকে
নন্দিত সেই নায়ক অমোঘ নিয়তির টানে
গরীয়ান এক প্রাসাদের মতো বিপুল গেলেন ধসে।
বিদেশী মাটিতে ঝরেনি রক্ত; নিজ বাসভূমে,
নিজ বাসগৃহে নিরস্ত্র তাঁকে সহসা হেনেছে ওরা।

নিহত জনক আগামেমনন, কবরে শায়িত আজ।

লক্ষণীয় কবিতাটির কোথাও শেখ মুজিবের নাম নেই। এই না-থাকা কবিতারই বিভা , পরাবাস্তবতা। অন্যদিকে ‘নিহত জনক আগামেমনন, কবরে শায়িত আজ’ পঙ্ক্তিটির পৌনঃপুনিকতা প্রতীকি ব্যঞ্জনার উজ্জ্বল উদাহরণ। কেবল রাজনীতি নয়, এমন অনেক আন্তরবিভার সমষ্টি শামসুর রাহমানের কবিতা।
প্রত্যেক জাতিরই একটি অন্তঃশীল ভাষা থাকে (আজকের বিশ্বায়নদুষ্ট বণিক-পৃথিবী জাতিতে-জাতিতে বিরাজমান ঐ অন্তঃশীল ভাষাকে প্রতিদিন একটু-একটু করে হত্যা করছে) যার পেছনে থাকে ঐ জাতির হাজার বছরের জীবনাচার, গৌরবগাথা ও বঞ্চনার কাহিনী সামনে থাকে চরাচরবিস্তারী স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষা। শামসুর রাহমান বাঙালির জাতিগত এই ভাষা স্বতঃস্ফূর্ত রপ্ত করেছিলেন। সুনিপুণ প্রয়োগ করেছিলেন কবিতায়। সেই গুণেই সমকালীন রাজনৈতিক ঘটনাবলিকে মিথ করে তোলার জাদুকরি ক্ষমতা বর্তেছিল তার কলমে। যেমন তার ‘দুঃখিনী বর্ণমালা’ কবিতাটির অন্তঃশীলে আছে বাঙালির ভাষা-আন্দোলনের মিথ কিংবা ‘আসাদের শার্ট’-এর অন্তঃশীলে ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের মিথ। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কত কবিই তো কত কবিতা লিখেছেন; সেগুলোর কয়টি পেরেছে শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি’ বা ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’র মতো মিথ হতে? এরকম অসংখ্য মিথের (সমকালপুরাণের) ভাঁড়ার শামসুর রাহমানের কবিতা। বায়ান্নো থেকে একাত্তর কালখণ্ডের মুক্তিযুদ্ধোত্তরকালেরও বাঙালির প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামের স্পন্দন শামসুর রাহমানের কবিতায় ধরা পড়েছে। এখানেই তার কবিতার বড় সার্থকতা। এখানেই তার নিজস্বতার ভিত। বুকেপিঠে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক গণতন্ত্র মুক্তিপাক’ লিখে রাজপথে প্রাণ দিয়েছিলেন নূর হোসেন। তাকে নিয়ে একটি কবিতা আছে শামসুর রাহমানের ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’। ঐ বুক স্বয়ং কবিরই বুক। একটি জাতির স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষাকে যেমন কবিতায় মিথ করে রেখেছেন তিনি, তেমনি তুলে এনেছেন জাতিগত উৎকণ্ঠা ও আশঙ্কার কথামালাও। একটি বইয়ের নামই রেখেছেন বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে। আবার 'উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ' বইয়ের নামকবিতায় নৈরাশ্যের অকূল পাথারে হাবুডুবুও খেয়েছেন
উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ বিরানায়; মুক্তিযুদ্ধ,
হায় বৃথা যায়, বৃথা যায়, বৃথা যায়

কবিতাটির পেছনে আছে ১৯৮০ কী ১৯৮১ সালের একটি ঘটনা। কোরবানির ঈদ উপলক্ষে ঐ বছর মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমদানিকৃত কিছু উট এসেছিল বাংলাদেশে। ধর্মান্ধ কিছু মানুষকে প্রকাশ্য রাজপথে ঐসব উটের পেচ্ছাব পান করতে দেখেছিলেন কবি। দৃশ্যটি তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল। বিষাদগ্রস্তও। তারই স্বতঃস্ফুর্ত প্রকাশ ঐ কবিতা। তবে কোনও বিষাদই শামসুর রাহমানকে পর্যুদস্ত করতে পারেনি। ‘ধ্বংসের কিনারে বসে’ও তিনি স্বপ্ন দেখেছেন সুদিনের। বিপন্ন মানুষকে জুগিয়েছেন ঘুরে-দাঁড়ানোর সাহস। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে লিখেছেন
আকাশের নীলিমা এখনো
হয়নি ফেরারী, শুদ্ধচারী গাছপালা
আজো সবুজের
পতাকা ওড়ায়, ভরা নদী
কোমর বাঁকায় তন্বী বেদিনীর মতো।
এ পবিত্র মাটি ছেড়ে কখনো কোথাও
পরাজিত সৈনিকের মতো
সুধাংশু যাবে না।

‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’ কবিতায় যে-আশঙ্কা, উপরের কবিতাটি (সুধাংশু যাবে না/ধ্বংসের কিনারে বসে) তারই সাক্ষাৎ খতিয়ান। আকাক্সক্ষা ও আশঙ্কার এই দোলাচলও শামসুর রাহমানের কবিতার স্বভাববৈশিষ্ট্য। দোলাচলভেদী দ্রোহও। যারা তাকে কাছ থেকে দেখেছেন, তারা জানেন, বাহ্যিক নম্রতার মধ্যেও তিনি ছিলেন একজন জেদী ও একরোখা মানুষ। দীর্ঘ ঘনিষ্ঠতার সুবাদে তার মধ্যে আমি মঙ্গলকাব্যের চাঁদসদাগরকে জ্বলে উঠতে দেখেছি অসংখ্যবার। পাঠাভিজ্ঞতায় তার কবিতায় ফিরে-ফিরে ঝলসে উঠতে দেখেছি চন্দ্রধর বণিকের হেঁতালের লাঠিটিকে। শামসুর রাহমানের প্রিয় ছিল বিজয় গুপ্তের মনসামঙ্গল । আমাকে টেনেছিল কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের মনসার ভাসান । পশ্চাদপট তো একই। মনসার পায়ে ফুল না-দেওয়ায় এবং তাকে কথায়-কথায় ‘চেঙমুড়ী কানী’ বলায় চাঁদসদাগরকে ছয়-ছয়টি পুত্র হারাতে হয়েছিল। বেহুলাকে নিয়ে লোহার বাসরে রাত্রিযাপনকালে সপ্তম পুত্র লখিন্দরও রেহাই পায়নি। তবু সংকল্পে অটল ছিল চাঁদসদাগর মনসার পূজা সে করবে না। স্ত্রী সনকাও তাকে এ সংকল্প থেকে টলাতে পারেনি। পুত্রবধূ বেহুলার অনুরোধে জীবনসায়াহ্নে হার মানতে বাধ্য হলেও মধ্যযুগের কৃষিসমাজে পুথির চাঁদসদাগর চরিত্রটি ছিল স্বপ্ন ও দ্রোহের প্রতীক। শামসুর রাহমানের কবিতার মৌলস্বরও তা-ই। ‘চাঁদ সদাগর’ নামে একটি দীর্ঘকবিতা আছে তার মঙ্গলকাব্যের রি-মেকিং প্রাসঙ্গিক কয়েকটি পঙ্ক্তি উদ্ধার করছি সেখান থেকে
চক্ষুদ্বয় ছানিগ্রস্ত দীপ যেন, সাগ্রহে তাকাই,
অথচ দেখি না স্পষ্ট কিছু, শুধু দেখি অমঙ্গল
এসেছে ঘনিয়ে চতুর্দিকে এই চম্পক নগরে।
যেন এ-নগরী আজ সম্পূর্ণ অচেনা পরদেশ,
যেখানে বিলাপ ছাড়া অন্য কোনো ধ্বনি নেই আর,
যেখানে নাগিনী ছাড়া অন্য কোনো প্রাণী নেই আর,
যেখানে বরণযোগ্য বীর নেই, কাকতাড়-য়ার মূর্তি ছাড়া
অন্য কোনো মূর্তি নেই, প্রকোষ্ঠে প্রকোষ্ঠে প্রেত ছাড়া
অন্য কোনো বাশিন্দার আনাগোনা নেই। তবু আমি
বাঁচার উপায় নেই জেনেও এখনো আছি বেঁচে
হিন্তাল কাঠের কারুকাজখচিত লাঠিতে ভর
দিয়ে আর সমুদ্দুরে পাড়ি দেবার দুর্মর স্বপ্নে
সর্বদা বিভোর হ’য়ে। আর এই শ্মশানের কালো
ভস্মময় মাটিতে উবুড়-হ’য়ে-থাকা কলসের
মতো থাকবো না প’ড়ে এক কোণে, এই তো আবার
আমাতে প্রত্যক্ষ করি বলীয়ান নবীন উত্থান।

মহৎ কবি আগাম আসেন পৃথিবীতে। তার পেছনে থাকে বিস্তীর্ণ ইতিহাস সামনে চরাচরবিস্তারী স্বপ্ন। সে-কারণে তাকে রাজনীতি-সচেতনও হতে হয়। কবিতায় রাজনীতি এলেই সমালোচকদের অনেকে আঁতকে ওঠেন। রাজনীতিকে বিষয় করায় শামসুর রাহমানের কবিতার শিল্পমান ক্ষুন্ন হয়েছে বলেও মনে করেন কেউ-কেউ। লেখা বাহুল্য, এ ব্যাপারে আমি ভিন্নমত পোষণ করি। লঘুতার দায় শুধু রাজনীতির উপর কেন বর্তাবে? বাঙলা ভাষায় রাজনীতি বিষয়ক লঘু কবিতার চেয়ে প্রেমের লঘু কবিতা বোধকরি বেশি রচিত হয়েছে। প্রেম বা প্রকৃতির মতো রাজনীতিও কবিতার বিষয় হতে পারে। স্লোগান না-হলেই হল। প্রেমের কবিতার মধ্যেও রাজনীতি আসতে পারে, রাজনৈতিক কবিতার মধ্যে প্রেম। কবির আরও-আরও অভিজ্ঞতাও তাতে যুক্ত হয়। মহার্ঘ কবিতামাত্রই বহুরৈখিকতার যৌগ। চেশোয়াভ মিউশের দুটি অনূদিত পঙ্ক্তি মনে পড়ছেÑ “কাকে বলে কবিতা, যদি তা না-বাঁচায়/দেশ কিংবা মানুষকে?” প্রশান্ত রসের আধার রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি তেও রাজনীতিচেতনা আছে “পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।/অজ্ঞানের অন্ধকারে/আড়ালে ঢাকিছ যারে/তোমার মঙ্গল ঢাকি গড়িছে সে ঘোর ব্যবধান।/অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান”। এ তো সাক্ষাৎ কার্ল মার্কসের কথা আবার, ব্যঞ্জনাগুণে মহার্ঘ কবিতাও। কোনও রাজনৈতিক দলের সদস্য না-হয়েও কবি একজন রাজনীতিক। কবির দলের নাম মানুষ। সমগ্র পৃথিবীই কবির স্বদেশ। যার-যার কালের প্রেক্ষিতে প্রত্যেক মহৎ কবিই রাজনীতিসচেতন ছিলেন। মঙ্গলকাব্যের যুগে, রাজার খেয়েও, সাধারণ মানুষের পক্ষ নিয়ে ‘নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়’-এর মতো পঙ্ক্তি রচনা করেছেন ভারতচন্দ্র পঙ্ক্তিটি কবির প্রশ্নশীলতারও সাক্ষ্য দেয়। তাই শামসুর রাহমানের রাজনীতিচেতনাকে তার কবিসত্তার ত্র“টি মনে করার কোনও কারণ দেখি না। বরং একথাই মনে হয় ঐ সচেতনতা দিয়েই পূর্বসাধক ও সমসাময়িকদের থেকে নিজেকে তিনি সবচেয়ে বেশি আলাদা করেছেন।
পূর্বসাধক ও সমসাময়িকদের থেকে আলাদা হওয়ার পাশাপাশি আরও। শামসুর রাহমান ছাড়াও, এ লেখায়, যাদের নাম নিয়েছি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু, শঙ্খ ঘোষ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, আল মাহমুদ, প্রত্যেকেই সে-দাবি পূরণ করতে পেরেছেন। মহত্ত্বের দাবিদার হতে গেলে, তারপরও, কিছু দাবি পূরণ করার থাকে। কবিকে রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বে উঠে বৈশ্বিক হতে হয়। ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষ হতে হয়। মানুষের ঊর্ধ্বে উঠে প্রকৃতির সব সদস্যের প্রতি সহমর্মী হতে হয়। ফররুখ আহমদ, আল মাহমুদের মতো কেউ-কেউ এই পর্বে এসে আটকে যান। ধর্মাধর্মেরই ঊর্ধ্বে উঠতে পারেন না তারা। গোটা পৃথিবীই কবির স্বদেশ; মুক্তচিন্তাই কবিতার রথ; শব্দই কবির সারথী। শামসুর রাহমানের ‘প্রকৃত কে আমি’ শিরোনামের কবিতাটিও সেই কথা বলে
যে-ছিলো অঞ্জলি পেতে সপ্তম শতকে অষ্টাদশী
গৌরীর সমুখে একা তৃষ্ণার দুপুরে, বৌদ্ধমঠে
যার বাস, অনেক শতাব্দী আগে পটে ছবি এঁকে যিনি
হাটে করেছেন বিকিকিনি, কিংবা খাব-ঝলসিত
ইমরুল কায়েস, উটের পিঠে কাব্যের নেকাব
উšে§াচন করেছেন যিনি, সেই তো প্রকৃত আমি।
আবার কখনো মনে হয়, ধীমান হেরোডোটাস
আমি, ইতিহাস যার নর্মসখী, অথবা সুদূর
এথেন্সের আঁধার প্রকোষ্ঠে ওরা আমারই অধরে
দিয়েছিলো ঢেলে কালকূট। কিংবা বলা যায়, যুগে
যুগে হেঁটে যায় নির্দেশনাহীন কণ্টকিত পথে,
দুর্গম পর্বতে যে-মানুষ স্বর্গ-নরক এবং
বিস্মৃতির প্রতি উদাসীন, আমি সেই দুঃখ-চাওয়া
নিঃসঙ্গ পথিক, রিক্ত, ক্লিষ্ট অগ্নিবলয়ের তাপে।

ধর্ম, গোত্র, জাতি, রাষ্ট্র নামের প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ঘাপটি মেরে আছে অসংখ্য অলীক ঈশ্বর। খাঁটি কবি সব ঈশ্বরকেই প্রশ্নে-প্রশ্নে যাচাই করে নিতে জানেন। প্রশ্নই কবিকে ব্যক্তি থেকে সমষ্টিতে, সমষ্টি থেকে জাতিতে, জাতি থেকে বিশ্বজনীনতায় উত্তীর্ণ করে। স্বদেশ-স্বভাষার প্রতিনিধি হয়েও কবি একজন বিশ্বজনীন মানুষ। শুধু প্রকরণগতই নয়, সব রকম প্রথার খোলস ছিন্ন করাই তার কাজ। নিজের কবিতাকেও তিনি প্রশ্নবিদ্ধ করতে জানেন। প্রশ্নে-প্রশ্নে নিরন্তর নবায়ন করতে জানেন নিজেকে। নবায়নের স্বার্থে, শুধু পূর্বসাধক আর সমসাময়িকদেরই নয়, পরিণত বয়সে, উত্তরসাধকদের কবিতাতেও তন্নিষ্ঠ চোখ রাখতে হয় তাকে। আমৃত্যুই শামসুর রাহমানের পছন্দ ছিল অনুজ-সঙ্গ। সবুজতম পঙ্ক্তির খোঁজে অনুজতম কবির কবিতাও মনোযোগ দিয়ে পড়তে দেখেছি তাকে। এক্ষেত্রেও তিনি সমসাময়িক অন্য কবিদের থেকে আলাদা ছিলেন। অনতি-অনুজ কবিদের থেকেও। এর একটিই মাত্র ব্যাখ্যা- তিনি ছিলেন উত্তমরূপে একজন প্রশ্নশীল মানুষ।
====== দৈনিক যুগান্তর । ১৪ আগষ্ট ২০০৯















১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিসিএস-পরীক্ষার হলে দেরিঃ পক্ষ বনাম বিপক্ষ

লিখেছেন BM Khalid Hasan, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



বর্তমানের হট টপিক হলো, “১ মিনিট দেরি করে বিসিএস পরীক্ষার হলে ঢুকতে না পেরে পরীক্ষার্থীর স্বপ্ন ভঙ্গ।” প্রচন্ড কান্নারত অবস্থায় তাদের ছবি ও ভিডিও দেখা যাচ্ছে। কারণ সারাজীবন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৮




আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না। আমাদের দেশে মানুষ জন্ম নেয়ার সাথেই একটি গাছ লাগানো উচিৎ । আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানবতার কাজে বিশ্বাসে বড় ধাক্কা মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৭


মানুষ মানুষের জন্যে, যুগে যুগে মানুষ মাজুর হয়েছে, মানুষই পাশে দাঁড়িয়েছে। অনেকে কাজের ব্যস্ততায় এবং নিজের সময়ের সীমাবদ্ধতায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে না। তখন তারা সাহায্যের হাত বাড়ান আর্থিক ভাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

জব্বারের বলীখেলা ও বৈশাখী মেলা-২০২৪

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩৭



ছবি সৌজন্য-https://www.tbsnews.net/bangla




ছবি- মঞ্চে তখন গান চলছে, মধু হই হই আরে বিষ খাওয়াইলা.......... চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী গান।

প্রতি বছরের মত এবার অনুষ্ঠিত হল জব্বারের বলীখেলা ও বৈশাখী মেলা-২০২৪। গত ২৪/০৪/২৪... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

×