(হুমায়ুন আহমেদ স্যারের সৃষ্ট হিমু চরিত্রের স্মরণে)
সেদিন প্রথম বুঝি যে আমি মানুষের গোত্রে পরি না। তাহলে আমি কে? আমি কি কোনো যন্ত্রমানব যাকে তার নিজস্ব প্রোগামের বাইরে কিছু করার অধিকার নেই। বাবা সব সময় চায় তার মত আমিও প্রতিটি ক্ষেত্রে ১ম হব। তার ভাষ্যমতে জীবনটা হল একটি রেসিং ট্র্যাক। এই ট্র্যাকে বেঁচে থাকার জন্য ছুটতে থাকতে হবে। সে না'কি তার সেই রেসিং ট্রেকে কোনদিন ২য় হয়নি। তাই সে চায় তার ছেলেও হবে তার মত ১ম স্থান অধিকারী রেসার। একমাত্র স্কুলে আমি আমার মত করে কিছুটা সময় কাটাতে পারতাম। যেমন আমি কোনদিন প্রথম বেঞ্চে বসতাম না। ক্লাসের পড়া মুখস্ত থাকার পরও সরি ম্যাম বলে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতাম। নিজের টিফিন পিয়ন মামার ছোট বাচ্চাটিকে দিয়ে আসতাম। বৃষ্টির জমা পানিতে খালি পায় হাঁটার কথা বাসায় কল্পণাও করতে পারি না। আর আমার শেষ কাজটি ছিল রিনির দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকা। রিনি ছিল আমাদের ক্লাসের খুব চঞ্চল এবং প্রাণবন্ত একটি মেয়ে। ক্লাসে লুকিয়ে লুকিয় আচার খাওয়া, পড়ার বইয়ের নিচে গল্পের বই রেখে টিচারকে ফাঁকি দিয়ে পড়া, নিজের টিফিন না খেয়ে এরটা ওরটা চুরি করা এসব ছিল তার দৈনন্দিন সূচির একটা ছোট অংশ। রিনির গল্পের বইগুলোর খুব পড়তে ইচ্ছে করত। আমার মন বলত এই বইগুলোর মাঝেই তার এমন স্বাধীনচেতা জীবনের রহস্য লুকিয়ে আছে। একবার রিনিকে বলেছিলাম তার এই বইগুলোর মাঝে কি এমন লেখা আছে যে সে সারাদিন পড়ার পরও ক্লান্ত হয়ে পরে না। সেদিন সে হলুদ রঙের কাভারের হিমু নামের অদ্ভুত ও রহস্যময় এক ছেলেকে নিয়ে লেখা বই পড়তে দিয়েছিল। আমি কখনো ক্লাসের পড়ার বাইরে কোনো বই পড়িনি। কারণ বাবা বলছে ওসব বই পড়লে না'কি মানুষ হওয়া যায় না। পরে আমি বুঝেছি আসলে কথাটা হওয়া উচিৎ ছিল বাবার মত মানুষ হওয়া যায় না। আমি হিমুর বইটি পড়ে নিজেকে হিমুর জায়গায় ভাবতে শুরু করলাম। তার সবকিছুতে আমি অভিভূত হতে লাগলাম। তার প্রতিটি অদ্ভুত কর্মকান্ডের পেছনে থাকত একটি সৎ উদ্দেশ্য । তার মত স্বাধীনচেতা মানুষ এই পৃথিবীর বুকে দ্বিতীয় পাওয়া হয়ত সম্ভব নয়। যেখানে খুশি সেখানে সে রাত কাটিয়ে দিতে পারত। তার কাপড় বলতে শুধু একটি পকেট বিহীন হলুদ পাঞ্জাবী। এমন মানুষের মত সুখি আর কে হতে পারে। কারণ অর্থের মোহো একজনের জীবনকে বিষাক্ত করে দেয়। সে হয়ে উঠে লোভী ক্ষুদার্থ বাঘের মত। অামি সিদ্ধান্ত নিলাম আমাকে হিমু হতে হবে । আর আমার হিমু হবার প্রথম পদক্ষেপ ছিল রিনির বাসা। হিমু যেভাবে চমকে দিত রুপাকে ঠিক সেইভাবে চমকে দিব আজ রিনিকে।
সেই রাতে চুপ করে বাইরে বের হয়ে পরি আমি। হলুদ পাঞ্জাবী ছিলনা আমার কাছে তাই বাবার হলুদ গেঞ্জিটা পড়ে বেড় হই। তখন রাত্রি ১২ টা হবে। রাস্তায় খুব ভয় লেগেছিল তাই আমাদের পাড়ার রাস্তার একটি কুকুরের বাচ্চা কোলে নিয়ে আদর করতে করতে এগিয়ে গেলাম। রিনিদের বাসার ঠিকানা ঐ বইয়ের শেষ পাতায় লেখা ছিল। বাসার সামনে গিয়ে দেখি ওদের বাসাটি খুব ছোট দোচালা টিনের ঘর । এত রাতেও আলো জ্বলছে আর ফ্যানের বাতাসে জানালার পর্দা উড়ছে। জালানার সামনে আসতেই দেখলাম রিনি তার বাবা- মার সাথে লুডু খেলতে ব্যস্ত। এই খেলা আমি আমার বাসার ড্রাইভার হারুন কাকু ও দারোয়ান চাচা দুজনকে খেলতে দেখেছি। কিন্তু এটা যে বাবা মার সাথেও খেলা যায় তা কোনোদিন ভাবিনি। হঠাৎ রিনির গলা পাওয়া গেল,
- " বাবা হবে না, তুমি চুরি করছ কেন? হবে না, খেলব না"।
বাবার সাথে এভাবে কথা বলা যায় আমি প্রথম শুনলাম। রিনির মা রিনিকে জানালাটা বন্ধ করে দিতে বলল।
রিনি জানালার কাছে এসেই আমাকে দেখে ফেলল। কিন্তু তেমন অবাক হতে দেখলাম না। এত রাতে তাদের বাসার জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা যেন খুব স্বাভাবিক একটা বিষয়।
এতকিছু বলা হল কিন্তু আমার নামটাই বলা হয়নি। আমার নাম অনি। নিজকে বলি কোডিং অনি। কারণ আমার জীবন কোডিং করা হয়েছে বাবার কাছ থেকে। যার বাইরে আমার কিছু করার অনুমতি নেই। মানুষের না'কি অনেক ধরনের ভগবান,ঈশ্বর বা আল্লাহ্ রয়েছে যারা সবার জীবনের কোডিং নিজ হাতে করেন। আমারটাই ব্যতিক্রম সবার থেকে, রিনির থেকে, ক্লাসের শেষ বেঞ্চের সোহাগের থেকে। সোহাগ একদিন আমাকে বলেছিল তার বাবা বলেছে পরীক্ষায় ফেল করতে না পারলে না'কি মানুষ হওয়া যায় না। তাই শুনে আমি সপ্তম শ্রেণীতে ২য় সাময়িক পরীক্ষায় ফেল করেছিলাম। সব অংক পারতাম কিন্তু আমি যে মানুষ হতে চেয়েছি। একজন পুরপুরি মুক্ত মানুষ। ফলাফল প্রকাশের পর আমি মানুষ তো হতে পারিনি শুধু নিজেকে পরাজিত কোনো হলিউডের নায়ক মনে হয়েছিল। আর বাবাকে মনে হল মনস্টার যে আমাকে কেটেকুটে খাওয়াটাই বাকী রাখলো।
রিনি আমাকে দেখে বলল,
- " আমার মন বলেছিল যে তুমি এমন একটা কাজ করতে পার"।
জানালার কাছ থেকে সরে গিয়ে দরজা খুলে দিল। মজার বিষয় ওদের কোনো দারোয়ান নেই। রিনি বাবা আমাকে দেখে রাগ করল না। উল্ট হেসে হেসে বলল, -
"হলুদ গেঞ্জি, খালি পা, হাতে হুমায়ুন আহমেদের বই। হুম তো হিমু সাহেব বাসায় কি না বলে এসেছো?
আমিও একটু মুচকি হাসলাম। রিনির বাবা বললেন,
-" হিমুরা তো এভাবে হাসে না। তোমার কাজ হল এর উত্তরে এমন কিছু বলা যেন আমরা চমকে যাই। যেমন তুমি এত রাতে তোমার ক্লাসে এক মেয়ের বাসার এসে আমাদের চমকে দিয়েছ।"
কিন্তু আমি নিজে চমকে গেলাম তাদের দেখে । এমনও পরিবার হয় আমার জানা ছিল না। যখন দেখলাম রিনির বাবার একটি পা নেই তখন খুব খারাপ লাগল। রিনির মা আমাকে আদর করে বসিয়ে পানি এনে দিল। তারপর যে বিষয়টা আমাকে অবাক করল তা হল রিনি বাবা বলল রিনির উদ্দশ্যে,
-" আজ বাইরে ভরা জ্যোৎস্না। চল মা অনেকদিন জ্যোৎস্নায় বাইরে যাই না। ছেলেটা এত রাতে একা কিভাবে যাবে।
কিছুদিন পরের কথা। একদিন রিনি মোবাইল করে বলল তার বাবা কাল ভোরে তাদের বাসায় যেতে বলেছে। যদি না আমার বাবা-মার সাথে ভোরে প্রোগ্রাম থাকে। কিন্তু কি বলছে?কিসের প্রোগ্রাম? আমি বুঝতে পারছিলাম না। পরে জানতে পারি কাল ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। তখন মনে পরলো আমার বাবার কথা। একবার তাকে বলেছিলাম,
-" বাবা আমি শহীদ মিনারে ফুল দিতে যাব ।"
বাবা শুনে সেদিন আমাকে একটা চর মেরে বলল,
-" ওসব স্টুপিড জায়গায় কে যাবার কথা বলেছে তোকে। দ্বারা তোর স্কুলটা বদলাতে হবে। টিচারগুলো সব নোংরা থার্ডক্লাশ বস্তি থেকে তুলে এনেছে। "
আমি বুঝি না বস্তির ওরা কেনো মানুষ হিসেবে গণ্য হয় না। আমার দুঃখ হয় কেনো আমার ঐ বস্তিতে জন্ম হল না। তাহলে আমি রাস্তার পাশে জমে থাকা পানিতে দাঁড়িয়ে পাখিদের সাথে বন্ধুত্ব করতে পারতাম । বৃষ্টিতে বাতাস বিহীন ফুটো ফুটবলটি নিয়ে নেমে পরতাম আমাদের বাসার পেছনের মাঠে। হয়ত আমার মত কোনো ছেলে হিংসের চোখে তাকিয়ে থাকত চার দেয়ালের মাঝে ছোট্ট একটি জানালার ভেতর দিয়ে। হয়ত আমি তাকে ভেংচি দিয়ে খুব আনন্দ পেতাম। সেদিন প্রথম রিনিকে মিথ্যা কথা বলেছিলাম। কারণ আমার বাবা কখনো প্রভাত ফেরীতে যেতে দিবে না।
এরপর থেকে প্রায় রিনির কাছ থেকে বই নিয়ে পড়তাম। এভাবে আমরা এক সময় খুব ভাল বন্ধু হয়ে উঠেছিলাম। রিনিদের বাসাতে প্রায়ই যেতাম সুযোগ পেলেই। রিনির বাবার কাছ থেকে শুনতাম আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গল্প। কিভাবে এক কালরাত্রিতে হঠাৎ একটি গুলিতে হারিয়েছিল তার পা। পাকিস্তানিরা কিভাবে অত্যাচার করেছিল নিরিহ মানুষদের উপর। বুদ্ধিজীবিদের তুলে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলেছিল। কিভাবে রিনির বাবার মত মানুষেরা প্রাণের ভয় না পেয়ে ঝাঁপিয়ে পরেছিল ভারী ভারী অস্ক্রের মুখে। ছিনিয়ে এনেছিল বিজয়ের পতাকা। আজ আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজের শেষ বর্ষের ছাত্র। রিনি সব পরীক্ষায় আমাদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো ফলাফল করার পরও সে ভর্তি হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। গত বইমেলায় তার লেখা একটি উপন্যাস বেড়িয়েছে। বইটির নাম অনি। কেনো এই নাম দিয়েছিল তা আমি তাকে জিজ্ঞেস করাতে সে হেসে বলেছিল
-" ডাক্তার সাহেব এটা জানতে হলে যে পড়তে হবে একটু কষ্ট করে।"
আমি আজও বইটি পড়িনি। কিছু কিছু বিষয় রহস্য হয়ে থাকা্ই ভালো। আমি যেদিন বইটি কিনেছিলাম একুশে বই মেলা থেকে সেদিন বইয়ের প্রথম পাতায় নিয়েছিলাম রিনির একটি অটোগ্রাফ। সে ছোট করে লিখেছিল-
"তুমি রাতের আকাশ ভরা জ্যোৎস্না। তোমার আলোয় নিজেকে বিলিয়ে দিতে চাই। নেবে কি আমায়? "
আজ আকাশে ভরা পূর্ণিমা। জীবনে আরেকবার হিমু হয়ে রাস্তায় খুব হাঁটতে ইচ্ছে করছে। সারা রাত আজ হাঁটব এবং মেতে উঠব জ্যোৎন্সার আলো গায়ে মেখে। রিনিকে কোনদিন বলা হয়নি মনের কথা। হয়ত শেষ পর্যন্ত বলা হয়েও উঠবে না। জানি মেয়েটি অনেক কষ্ট পাবে। একটি পবিত্র মন ভেঙ্গে যাবে আমার কারণে। কিন্তু তার মত স্বাধীনচেতা মেয়েকে আমার অভিশপ্ত জীবনের সাথে জড়িয়ে তার জীবনটা নষ্ট করতে চাই না আমি।