খুব ছোট বেলার কোন স্মৃতি যখন হাতড়াই, আমার সাগর ভাইদের বাসার কথাই শুধু মনে পড়ে। সাগর ভাই, মানিক ভাই, শান্তা আপু আর এনো আঙ্কেল- আন্টির কথা। আঙ্কেল কোন এক অদ্ভুত কারণে আমাকে এনো বলে ডাকতেন তাই আমিও এনো আঙ্কেল বলে ডাকতাম। আর যতদুর মনে পড়ে এবং আম্মুর কাছ থেকে যা শুনেছি তাতে সন্দেহ নেই আন্টির কোলে- পিঠেই বড় হেয়েছি। আমাকে খাইয়ে- দাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে তবেই আম্মুর কাছে দিয়ে আসতেন। মনে পড়ে সকাল বেলা নারকেলের চিড়ার কৌটা যখন আমার হাতে তুলে দিতেন, কী যে আনন্দ হতো। সেই আনন্দময় স্মৃতিটুকু আজো আমাকে ছুঁয়ে যায়! কলোনী ছেড়ে যাবার সময় আন্টি আমাকে জড়িয়ে ধরে গভীর কেঁদেছিলেন। আন্টির সাথে অনেকদিন দেখা হয় না, আঙ্কেলের সাথেও না। জানি না আর কখনো দেখা হবে কিনা। শুধু প্রার্থণা করি, উনারা যেন সুখে থাকেন।
আর সাগর ভাইয়ের কাঁধে চড়াটা ছিল একটা নিয়মিত ঘটনা। লোডশিডিংয়ের সময় অন্ধকার সিঁড়িতে উনার কাঁধ থেকে পড়ে গিয়ে আমার কপালের এক পাশে ভীষণ কেটে গিয়েছিল। আজ এত বছর পরেও আয়নার সামনে কপালের কাটা জায়গাটা চোখে পড়লে আমার কেবলি সাগর ভাইয়ের কথা মনে পড়ে। তিন চার বছর আগে শান্তা আপুর সাথে দেখা হলো। বিয়ের পর যেন আরও সুন্দরী হয়েছেন। ভীষন মিষ্টি সেই হাসিটা উপহার দিয়ে বললেন, এখনও আগের মতোই আছিস। স্বাস্হ্য আর হলো না। আমি বললাম, তোমরা ছেলেদের ব্যাপারে এত স্বাস্হ্য স্বাস্হ্য করো ক্যান? নিজেরা তো ঠিকই সারাক্ষণ ডায়েট করো। আপু হেসে দিয়ে বললেন, ছোটকালে কী গোবদাগাবদা ছিলি। কোলে নিয়ে সারাক্ষণ চুমু খেতাম। আমি উদাস ভাবে বললাম, ''এখনও খাওনা। কে মানা করেছে?'' ''ওরে, খুব শয়তান হয়েছিস না তলে তলে। আয়, কাছে আয়।'' আমি কাছে যেতেই আপু মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। কী মায়া, কী মায়া! ঈশ্বর মানুষের বুকে কেন এত মায়া পুরে দিয়েছেন কে জানে!
আমার চোখের পানি দেখে আপু বুঝলেন। আমার মতো উনারও হয়তো মানিক ভাইয়ের কথা মনে পড়ল। মানিক ভাই। যে বন্ধুর কম্পিউটার কিনতে গিয়ে আর ফিরে আসেন নি। সন্ধ্যের মুখে রাকিব ভূতের মতো এসে খবর দিল, জনি মানিক ভাই তো নাই! বুকের ভিতর রক্ত চলকে উঠল। উন্মাদের মতো দুজনেই সিঁড়ি ভেঙে নামতে লাগলাম। নিচে নেমে দেখি পুরো কলোনী জুড়ে পৈশাচিক নিরবতা। কলোনীর সব ছেলে এসে জড়ো হয়েছে। আমার কেবলি মনে হচ্ছে সব মিথ্যে, সব মিথ্যে। এসব কিছুই সত্য নয়।
আরও অনেক সময় পরে মানিক ভাইকে যখন নিয়ে এলো, কী শান্ত শিশুর ভঙিতে ঘুমিয়ে আছে। কপালের কাছটায় রক্তে কালচে হয়ে আছে। রক্তের ধারা কানের পাশ দিয়ে চিবুকে গিয়ে ঠেকেছে। বিশ্বাস করুন এতটুকু কাঁদিনি। কাঁদব কেন! আমার যে তখনও বিশ্বাস মানিক ভাই মারা যায় নি। মানিক ভাই চলে গেলে আমরা ক্রিকেট খেলব কার সাথে। আমাদের ক্রিকেট খেলা যে চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে। মাথার উপর থেকে একটা স্নেহের আকাশ যে ভয়ঙ্কর ভাবে ধ্বসে যাবে!
সেদিন শেষ রাতে শুতে গিয়ে এতদিনের যে মায়ার জল বাড়তে বাড়তে উপচে পড়ছিল তাই যেন সমস্ত বাঁধ ভেঙে বেরিয়ে এলো। এই আমি নতুন করে জানলাম স্বজন হারানোর বেদনা।
আজ এই স্মৃতিময় কলোনী ছাড়ার মুখে কত কিছু যে মনে পড়ছে। কত মুখ, কত স্মৃতি। ১৫ বছর পাশাপাশি কাটানো শিমুদের কথা হয়তো ভুলতে পারব না কোনদিন। আর আমার অতি প্রিয় চার পিচ্চি, রিমিয়া, জিনিয়া, স্মৃতি, এষা। সাইফুল ভাই, লিটন ভাই, লিমন ভাই, টগর ভাই, তোতা ভাই, মংচি ভাই, মংলাপ্রু ভাই, স্বপন (ম্যাকগাইভার) ভাই, নাজমুল ভাই, পলাশ ভাই, শ্যামল ভাই, তুহিনদা, তপুদা, বগা জাহিদ ভাই, রুপক ভাই, মাহবুব ভাই, শফিক ভাইসহ আরও কত কত নাম। বন্ধু ও বড় ভাইদের সাথে কাটানো ছোটবেলার সেইসব চমৎকার স্মৃতিময় দিনগুলোর কথা মনে পড়ছে। ফুটবল, ক্রিকেট, পুকুরে ঘন্টার পর ঘন্টা সাঁতরে বেড়ানো, লাল চোখ নিয়ে ঘরে ফেরা, মায়ের বকুনি, সময়মতো রামধোলাই। ছুটির দিনে দলবেঁধে সাগরপাড়ে চলে যাওয়া, টকফল বন। কী সুন্দর ছবির মতো ছিল সেইসব দিন!
স্মৃতির জানালা খুলে বসলে কত স্মৃতি যে শরতের মেঘের মতো মনে ছায়া ফেলে চলে যায়। কিছু স্মৃতি কষ্ট দেয়, তবু বসি। মাঝে মাঝে ঐ কষ্টটাই বড় আপন মনে হয়। মনে হয় ভাল নয় ভাল নয়, তবু কী ভীষণ ভালো!
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জানুয়ারি, ২০১১ বিকাল ৪:২০