আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার দুই বছর পেরিয়ে তৃতীয় বর্ষে পদার্পণ করল আজ। দুই বছর আগে দেশবাসীর নিরঙ্কুশ সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন এ সরকার। সংসদের ৮৮ ভাগ সদস্যের সমর্থনপুষ্ট এ সরকারকে সংখ্যাতত্ত্বের বিচারে দেশের ইতিহাসের অন্যতম জনপ্রিয় সরকার বলে অভিহিত করা যায়।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভের পর তারা দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেয় ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি। বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকার এবং ওয়ান ইলেভেনের বিতর্কিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে জনমনে যে ক্ষোভ দানা বেঁধে ওঠে ২০০৮-এর ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এ নির্বাচনে রেকর্ড পরিমাণ ভোটার ভোট দেন।
মহাজোট সরকার গঠন করে সংসদের ৮৮ ভাগ সদস্যের সমর্থন নিয়ে।
নির্বাচনে জোটগতভাবে বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতার পাশাপাশি আওয়ামী লীগ এককভাবেও দুই-তৃতীয়াংশের বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। মহাজোট সরকারের প্রতি জনগণের ম্যান্ডেট ছিল বিরাট। তাই প্রত্যাশাও অনেক বড়। এখনো সরকারের প্রতি বেশির ভাগ মানুষের সমর্থন আছে। যদিও জনপ্রিয়তা গত বছরের তুলনায় অনেক হ্রাস পেয়েছে। এটি সরকারের জন্য সতর্কসংকেতও। যেসব ক্ষেত্রে সাফল্য এসেছে, সেগুলো ধরে রাখার পাশাপাশি সরকারের কর্তব্য হবে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।
সরকারের দুই বছরের কাজের হিসাব নিলে দেখা যাবে, জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা বেশির ভাগই অপূর্ণ রয়ে গেছে। তবে শিক্ষা, কৃষিসহ কয়েকটি খাতে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। স্বাধীনতার ৩৯ বছর পর দেশ সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি শিক্ষানীতি পেয়েছে। কৃষকবান্ধব নীতির কারণে কৃষিপণ্যের উৎপাদন বেড়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে। শিল্প খাতে কিছুটা উন্নতি লক্ষ করা গেলেও কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসেনি বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসংকটের কারণে। দুর্নীতি দমনের ব্যাপারে সরকারের সদিচ্ছার প্রমাণ মেলেনি। দ্রব্যমূল্য নিয়ে মানুষের হতাশা সবচেয়ে বেশি।
নির্বাচনের আগে দেশে চালের দাম বেড়েছিল; জনগণ তখন প্রত্যাশা করেছিল, নতুন সরকার এলে চালের দাম কমবে। শুরুতে কিছুটা কমেও ছিল। কিন্তু গত এক বছরে চালসহ প্রায় সব নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি সীমিত আয়ের মানুষকে সংকটে ফেলেছে। আন্তর্জাতিক বাজারও অস্থিতিশীল। তথাকথিত ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে মন্ত্রীর হম্বিতম্বি শোনা গেলেও কার্যকর পদক্ষেপ কিংবা টিসিবিকে সচল করার উদ্যোগ নেই।গ্যাস ও বিদ্যুৎ সমস্যার সুরাহা ইত্যাদি ক্ষেত্রে সরকারের সাফল্য সত্যিকার অর্থেই প্রশ্নবিদ্ধ। এ ছাড়া সরকারকে ব্যাপক বিতর্কের মুখে ফেলে দিয়েছেন কয়েকজন এমপি। সরকারি দলের এসব এমপির বিতর্কিত কর্মকাণ্ড সরকারকে নাজুক অবস্থায় ফেলেছে। মন্ত্রী-উপদেষ্টাদের বেফাঁস মন্তব্যও বিপাকে ফেলে আওয়ামী লীগকে।
উপজেলা চেয়ারম্যানদের ক্ষমতা খর্ব, তৃণমূলে সন্ত্রাস, রাজধানীর যানজট পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া, গ্যাস-বিদ্যুৎ খাতে স্থবিরতা, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা, ছাত্রলীগ-যুবলীগের টেন্ডারবাজি সরকারকে বিব্রত করেছে। এ কথা ঠিক, মহাজোট সরকার উত্তরাধিকার সূত্রে দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থা পেয়েছে। গ্যাস, বিদ্যুৎ সংকটও ছিল পূর্বসূরিদের রেখে যাওয়া। তারপরও এসব সমস্যার সমাধানে বিগত দুই বছরে যতটুকু এগিয়ে যাওয়া উচিত ছিল সে ক্ষেত্রে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ব্যবধান বিস্তর। বিশ্লেষকরা বলছেন, দুই বছরে নানা ব্যর্থতার পাশাপাশি সরকারের সাফল্যও আছে। এই সময়ে সরকারের বিরুদ্ধে বড় কোনো দুর্নীতির অভিযোগ ওঠেনি। জঙ্গি দমনে সরকার সফলতা দেখিয়েছে। বিডিআর বিদ্রোহ দমন করেছে সফলভাবে। কূটনীতিতেও কিছু সফলতা আছে। বহির্বিশ্বে প্রধানমন্ত্রীর অনেক কার্যক্রম প্রশংসিত হয়েছে। জঙ্গিবাদ দমন ও দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রী অসাধারণ সাফল্য দেখিয়েছেন। কৃষি ও কৃষকদের উন্নয়নেও সরকারি কার্যক্রম সর্বস্তরে প্রশংসিত।
সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই উপজেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু নির্বাচিত চেয়ারম্যান-ভাইস চেয়ারম্যানদের ঠুঁটো জগন্নাথ করে রাখা হয়েছে। উপজেলা চেয়ারম্যানদের অভিযোগ, এলাকায় এমপি ও ইউএনওদের দাপট ধরে রাখতেই তাদের ক্ষমতা দিচ্ছে না সরকার। এ ছাড়া প্রায় দুই বছর আগে অনেক পৌরসভার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও সরকার নির্বাচন দেয়নি। ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে প্রায় সাড়ে তিন বছর আগে। কিন্তু সরকার নির্বাচন না দিয়ে প্রশাসক নিয়োগের চিন্তাভাবনা করছে। ইউনিয়ন পরিষদের তারিখ এখনো ঘোষণা হয়নি। মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান হওয়ার আইন থাকলেও তা মানা হয় না। এটা দুঃখজনক।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতি ও সন্ত্রাসমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার পাশাপাশি সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি তথা দিনবদলের প্রতিশ্রুতি ছিল। নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নে বেশির ভাগ মন্ত্রণালয়ই চরমভাবে অসফল। শিক্ষা ও কৃষি এ দুই মন্ত্রণালয় ছাড়া সরকারের সাফল্য অনেকে খুঁজে পাননি। যোগাযোগ, বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের উন্নয়নের গতি ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। তবে শিল্প মন্ত্রণালয় সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলা হচ্ছে, মন্ত্রণালয়টির সাফল্যও নেই আবার ব্যর্থতাও নেই। আর যোগাযোগ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দুই মন্ত্রী কথা বলেন বেশি কিন্তু কাজ করেন কম। পদ্মা সেতু নির্মাণ, ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন মহাসড়ক ও উড়াল-সড়কের কাজ এখনো শুরুই করতে পারেনি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়। ঢাকার যানজট নিরসনে বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ নেই।
সরকারের দুই বছরের কার্যক্রম সম্পর্কে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান বলেন, নির্বাচনী ইশতেহারের বেশির ভাগই বাস্তবায়িত হয়নি। বিশ্লেষকদের মতে, সরকারকে নির্বাচনী অঙ্গীকারের দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। দুই বছর চলে গেছে। উন্নয়নের গতি না বাড়ালে শেষ বছরে গিয়ে সরকার যে সমস্যায় পড়বে, এতে সন্দেহ নেই। আশা করব ভবিষ্যতে সরকার নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নে মনোযোগী হবে।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জানুয়ারি, ২০১১ সন্ধ্যা ৭:২৫