~সমুদ্রবার্তা~
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
সমুদ্র তীর ধরে হেঁটে বেড়ানো, ছুটে আশা সমুদ্রস্রোতে পা ডুবিয়ে বালির ভাঙ্গা-গড়ার খেলা অনুভব করা, কখনোবা সমুদ্রের নোনা পানিতে শরীরটাকে ভিজিয়ে নেয়া বা কখনো সমুদ্র তীরে দাঁড়িয়ে ছুটে আসা বাতাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে দাঁড়িয়ে থেকে ডুবন্ত সুর্য্যটাকে বিদায় জানানো সবই খুবই রোমাঞ্চকর। শুধু আনন্দ দিয়েই ক্ষান্ত নেই এই বিশাল সমুদ্র, যোগান দিয়ে যাচ্ছে আপনার নিত্যদিনের খাবার, ঔষুধ, মুক্তো কিংবা বিভিন্ন খনিজ, তেল/ গ্যাস আর সমুদ্র থেকে আমাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হল অক্সিজেন।
সামুদ্রিক উদ্ভিদ পৃথিবীর ৭০ থেকে ৮০ ভাগ অক্সিজেন সরবরাহকারী, যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ন ভূমিকা রাখে সামুদ্রিক শৈবাল, এরপরেই আছে ম্যানগ্রোভ। মানুষ সৃষ্ট কার্বন-ডাই-অক্সাইড এর এক-চতুর্থাংশ শুষে নিচ্ছে এই সমুদ্র। গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। বিভিন্ন গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বিজ্ঞানীদের মতে বিভিন্ন সময়ে যে পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড আমাদের পরিবেশে যুক্ত হওয়ার কথা ছিলো তা হয় নি, তার ফলে যে পরিমাণ তাপমাত্রা বৃদ্ধি বা সমুদ্রের পানির স্তর বৃদ্ধির কথা ছিল তাও হয় নি। যদি প্রশ্ন হয় কেনো হয় নি, তবে কি বিজ্ঞানীদের ধারণা ভুল ছিল? উত্তর লুকিয়ে আছে রহস্যে ঘেরা বিশাল সমুদ্রে।
পৃথিবীর তিনভাগ জল আর একভাগ স্থল। এই একভাগ স্থলেই আমাদের বসবাস। বাকি তিনভাগ জলের প্রায় ৯৭ ভাগই দখল করে আছে মহাসাগর, সাগর আর উপসাগর। যদিও অনেক আগে থেকেই আমরা জেনে এসেছি মহাসাগর ৫টি কিন্তু বর্তমানে গোনা হয় একটি। মহাসাগর, সাগর কিংবা উপসাগর সবাই একে অপরের সাথে সংযুক্ত আর এই বিশাল সংযুক্ত জলরাশিই আমাদের একমাত্র মহাসাগর। আমাদের এই বিশাল জলরাশিতে বাস করে ২,১৩,৯৭১ প্রজাতির প্রাণী (প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী) আর বিজ্ঞানীদের ধারণা এখানে বাস করে ২০ লক্ষাধিকেরও বেশী প্রাণী। তারমধ্যে বিশাল একটি স্থান দখল করে আছে ফাইটোপ্লাঙ্কটন, অতি ক্ষুদ্রকায় আণুবীক্ষণিক (০.২ মাইক্রোমিটার থেকে ২০ মিলিমিটার হতে পারে) জীব যে সুর্যের আলোর উপস্থিতিতে নিজের খাদ্য নিজে তৈরি করতে পারে। খাদ্য প্রস্তুতির জন্য ফাইটোপ্লাঙ্কটন পানির উপস্থিতিতে ক্লোরোফিলের সাহায্যে কার্বন-ডাই-অক্সাইড আর সুর্যের আলো ব্যবহার করে নিজের খাদ্য তৈরি করে (কমবেশি সকলেই আমরা জানি)। এই ফাইটোপ্লাঙ্কটন পানির উপরিভাগ হতে প্রায় ২০০ মিটার নিচে পর্যন্ত জন্মাতে পারে আর পৃথিবীর বিশাল জলরাশির সবত্রই কমবেশি ফাইটোপ্লাঙ্কটন পাওয়া যায়। এই বিশাল ফাইটোপ্লাঙ্কটন সম্প্রদায় নিজের খাদ্য তৈরির সময় শুষে নেয় কার্বন-ডাই-অক্সাইড আর সাথে উপজাত হিসেবে অক্সিজেন তৈরি করে তা পরিবেশে ছেড়ে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। অক্সিজেন- কার্বন-ডাই-অক্সাইড অনুপাত রক্ষার কাজে বিরাট ভূমিকা রেখে যাচ্ছে এই আণুবীক্ষণিক সম্প্রদায়।
সমুদ্র কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে দুইভাবেঃ একটি বায়োলজিক্যাল পাম্প আর অন্যটি ফিজিক্যাল পাম্প নামে পরিচিত। বায়োলজিক্যাল পাম্প বলতে ফাইটোপ্লাঙ্কটন দ্বারা কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহন, অক্সিজেন উৎপাদন আর মৃত ফাইটোপ্লাঙ্কটনের সমুদ্র তলদেশে গিয়ে জমা হওয়া এবং পরবর্তিতে অরগানিক কার্বন আর কার্বনেটে পরিণত হওয়াকে বুঝায়। ফিজিক্যাল পাম্প ধাপে কার্বন-ডাই-অক্সাইড পারিপার্শিক চাপ, সমুদ্রের পানির সাথে বাতাসের বার বার ঘর্ষণের ফলস্বরূপ পানিতে মিশে যায়। মিশে যাওয়া কার্বন-ডাই-অক্সাইড তিন রূপে সমুদ্রে অবস্থান করেঃ জলীয় CO2 রূপে(১%), বাই কার্বনেট (HCO3- ) আয়ন রূপে (৯১%) আর বাকি অংশ কার্বনেট (CO32- ) আয়ন রূপে থাকে। কার্বন-ডাই-অক্সাইড মিশ্রিত এই পানি (সমুদ্র পৃষ্ঠ হতে প্রায় ১০০ মিটার গভীর পর্যন্ত হয়ে থাকে আর এই পানি সমুদ্র পৃষ্ঠে প্রায় ৫-৬ বছর অবস্থান করে, প্রতিনিয়ত বাতাসের সাথে CO2 আদান-প্রদান চলতে থাকে যা CO2 ভালোভাবে মিশে যাতে সহায়তা করে আর সমুদ্রের CO2 ধারন ক্ষমতাও বৃদ্ধি করে) সমুদ্র প্রবাহের সাথে একসময় সমুদ্র তলদেশে চলে যায়। একটি সমুদ্র প্রবাহ [একটি নির্দিষ্ট স্থান হতে শুরু করে আবার ঐ স্থানে পৌঁছা পর্যন্ত(Ocean Circulation)] সম্পূর্ণ হতে সময় লাগে ১০০০ থেকে ১৬০০ বছর পর্যন্ত। বলাবাহুল্য সমুদ্র প্রবাহ একটি চলমান ধারা। তাই প্রতিনিয়ত সমুদ্র প্রবাহের সাথে ওঠে আসছে হাজার বছর পুর্বে সংরক্ষিত কার্বন-ডাই-অক্সাইড যা সমুদ্র পৃষ্ঠের তাপমাত্রায় আয়তনে বেড়ে কিংবা বাষ্পীভূত হয়ে পরিবেশে ফিরে আসে (উল্লেখ করা প্রয়োজন তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে সমুদ্রের CO2 ধারন ক্ষমতা হ্রাস পায়)। তবে হাজার বছর পুর্বে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ পরিবেশে কম থাকায় সমুদ্র যতটুকু কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ করে তার তুলুনায় অধিক শোষণ করে। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে সমুদ্র পৃষ্ঠ হতে (বর্তমানে) প্রতিবছর ৮৮ হাজার মিলিয়ন টন কার্বন নিঃসরণ হয় অপরদিকে প্রতিবছর ৯০ হাজার মিলিয়ন টন শোষিত হয় অর্থাৎ ২ মিলিয়ন টন কার্বন প্রতি বছর CO2 রূপে শোষিত হয়। কিন্তু সমুদ্রের CO2 শোষণের নিজস্ব মাত্রা আছে যা ইতিমধ্যেই অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। বর্তমানে সমুদ্র মানুষ দ্বারা সৃষ্ট CO2 এর এক-তৃতীয়াংশ শোষণ করছে যা ফাইটোপ্লাঙ্কটন দ্বারা গৃহিত CO2 এর তুলনায় অনেক গুন বেশী। একসময় CO2 শোষিত এই পানি সমুদ্রের উপরের পৃষ্ঠে আসবে আর তখন সমুদ্র গ্রহনের তুলনায় নিঃসরণ অধিক মাত্রায় করবে (কারন সমুদ্রে CO2 গ্রহন-ত্যাগ একই সাথে ঘটে আর ভবিষ্যতে তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রের CO2 ধারন ক্ষমতা হ্রাস পাবে আর অপর দিকে তার মধ্যে ঠেসে ঠেসে সঞ্চিত CO2 পরিবেশে মুক্ত হওয়া শুরু করবে) যা হঠাৎ করেই পৃথিবীর CO2 এর মাত্রা বাড়িয়ে দিবে। ফলশ্রুতিতে তাপমাত্রা হঠাৎ করেই কয়েক ডিগ্রী বেড়ে যাবে। এরপর কি হবে তা আমরা কমবেশি সবাই জানি।
শোষিত CO2 এর যে ১% জলীয় দ্রবন হিসেবে উপস্থিত থাকে তা মুলত কার্বনিক এসিডে (H2CO3) পরিণত হচ্ছে তা সমুদ্রে এনে দিচ্ছে ভয়ংকর পরিণতি। সমুদ্রের পানিতে বিভিন্ন লবনের উপস্থিতির কারনে সমুদ্রের পানি ক্ষারীয়। অম্লত্ব আর ক্ষারীয়তার হিসেব করা হয় pH মিটারে। সমুদ্রের পানির pH গড়ে ৮.২ (pH স্কেলে ৭ হল নিরপেক্ষ কিন্তু ৭ এর নিচে অম্লীয় আর ৭ এর উপর ক্ষারীয়)। প্রি-ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইরা থেকে আজ পর্যন্ত pH মাত্রা কমেছে ০.১ যা দেখতে খুবই কম মনে হলেও এই ০.১ সমুদ্রের পানিতে গত ২০০ বছরের তুলনায় ৩০% হাইড্রোজেন আয়ন মুক্ত করে অর্থাৎ এসিডের পরিমাণ ৩০% বেড়ে গেছে। আর বিজ্ঞানীদের নানা পরীক্ষা হতে প্রাপ্ত উপাত্ত অনুযায়ী পরবর্তি ১০০ বছরে pH এর মান ০.৫ কমে যাবে। সমুদ্রে যত CO2 বেশি শোষিত হবে সমুদ্রের অম্লত্ব (ocean acidification) ততই বেড়ে যাবে। আর এই জন্য সমুদ্রের প্রানীদের গুনতে হচ্ছে মাশুল। কোরালসহ কিছু ফাইটোপ্লাঙ্কটন, মলাস্ক-আর্থ্রোপোডা পর্বের অনেক প্রাণী তাদের খোলস বা কঙ্কালতন্ত্র তৈরির কাজে ক্যালসিয়াম আর কার্বনেট ব্যবহার করে থাকে যা অম্লত্বের কারনে আর সম্ভবপর হবে না। সমুদ্রের পানিতে উপস্থিত জলীয় CO2, বাই কার্বনেট (HCO3- ) আয়ন আর কার্বনেট (CO32- ) আয়ন মিলে বাফার জোন তৈরি করে। পানিতে যুক্ত হওয়া জলীয় CO2 বা কার্বনিক এসিড (H2CO3) সমুদ্রের পানিতে প্রচুর হাইড্রোজেন আয়ন (H+) মুক্ত করে। ফলে অম্লত্ব বৃদ্ধি পায়। এই অম্লত্ব হ্রাস করতে পানিতে উপস্থিত কার্বনেট (CO32- ) হাইড্রোজেন আয়নের (H+) সাথে বিক্রিয়া করে বাই কার্বনেট (HCO3- ) আয়ন উৎপন্ন করে অম্লত্ব হ্রাস করে। কিন্তু বর্তমানে শোষিত CO2 এর সাথে তাল মিলিয়ে কার্বনেট (CO32- ) আয়ন উৎপন্ন না হওয়ায় ধীরে ধীরে সমুদ্রের অম্লত্ব বেরে চলছে আর সাথে সাথে কমে যাচ্ছে কার্বনেট আয়নের পরিমাণ। এই কার্বনেট আয়ন কোরালসহ ফাইটোপ্লাঙ্কটন, মলাস্ক-আর্থ্রোপোডা পর্বের অনেক প্রাণীর কংকালতন্ত্র আর খোলস তৈরির প্রধান কাঁচামাল। কার্বনেটের পরিমাণ কমে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এইসব প্রাণী, ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে ধ্বংসের দিকে। কোরালসহ অনেক প্রাণীর পরিমাণ ৫০% এর বেশি কমে গেছে খুব কম সময়ে। আর অম্লত্বের পরিমাণ দিন দিন বেড়ে যাওয়ার প্রভাব পড়ছে সকল প্রাণীর জীবনচক্রে, কমিয়ে দিচ্ছে তাদের প্রজনন ক্ষমতা, সৃষ্টি করছে নানা ধরনের চর্মরোগ। ক্রমবৃদ্ধিশীল অম্লত্বের সাথে যুক্ত হচ্ছে দূষণসহ মানুষ সৃষ্ট নানা কারন যা দিন দিন আমাদের পরিবেশের আশির্বাদস্বরুপ বিদ্যমান ফাইটোপ্লাঙ্কটনকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।
সমুদ্র নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে আন্তর্জাতিকভাবে ৮ই জুন পালিত হয়ে আসছে বিশ্ব সমুদ্র দিবস। আজ এই দিনে সমুদ্র সম্পর্কে এই তথ্যগুলো শেয়ার করে সমুদ্রের বিশালতা আর তার পরিবেশের উপর ভূমিকার সামান্য কিছু অংশ তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। ভালো লাগলে জানাবেন। ভুলত্রুটি হয়ে থাকলেও জানাবেন শুধরে নেবার চেষ্টা করবো।
তথ্যসুত্রঃ
http://www.marinespecies.org/index.php
Click This Link
http://www.ghgonline.org/co2sinkocean.htm
Click This Link
Click This Link
আরো অনেক ....................
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।
ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন
সিকান্দার রাজার চেয়ে একজন পতিতাও ভালো।
সিকান্দার রাজা কোকের বোতল সামনে থেকে সরিয়ে রাতারাতি হিরো বনে গেছেন! কিন্তু তাকে যারা হিরো বানিয়েছেন, তারা কেউ দেখছেন না তিনি কত বড় নেমকহারামি করেছেন। তারা নিজেদেরকে ধার্মিক বলে দাবি... ...বাকিটুকু পড়ুন
ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা
সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন
...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না
...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না
ছোটবেলায় মুরব্বিদের মুখে শোনা গুরুত্বপূর্ণ অনেক ছড়া কবিতার মত নিচের এই লাইন দুইটাকে আজও অনেক প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়।... ...বাকিটুকু পড়ুন
আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়
প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন