ভাবনার তানপুরায় স্মৃতির ধুলোবালি পরতের পর পরত জমেছে। ধুলোবালির আস্তর সরিয়ে আজ মনে পড়ছে যে স্বরলিপির কথা তার নাম খোদেজা।
কাজের মেয়ে হিসেবে ভৈরব থেকে আনা হয়েছিল ওকে। কিশোরী একটা মেয়ে, বয়স তেরো কি চৌদ্দ,অসম্ভব রকমের সুন্দরী। কাজের মেয়ে এত বাড়াবাড়ি রকমের সুন্দরী সচরাচর দেখা যায় না। পান পাতার মতো ছিল তার মুখ খানি,উজ্জল হলুদ সাদা গায়ের রঙ, সেই মুখে পদ্ম ফুলের মতো ফুটে থাকতো পিংগল মণির বড় দুটি চোখ, পাতলা গোলাপী ঠোট আর সিল্কী খয়েরি রঙের চুলে সে ছিল আকর্ষনীয়া। মাঝে মাঝে মজা করে বলতাম,
--"হে রে খুদিস্তা আয় তোরে ফিল্মে নামায় দেই,দেখিস কি যে নাম করবি,এত্ত এত্ত টাকা কামাবি,মৌসুমী শাবনূর কোন বেইল পাবেনা!"
খোদেজাকে বাসার সবাই আদর করে বিভিন্ন নামে ডাকতাম, খুদি,খুদম,খুদিস্তা, রেগে গেলে মাঝে মাঝে খুইদ্দা বলেও ডাকতাম! তো খোদেজা বেগম লাজুক হেসে বলতো,
--ছুডু খালাম্মা যে কি কন!! সিনিমাত নামলে আল্লায় গুনা দিবো,দুযগে যাওন লাগবো।
খোদেজার ছুডু খালাম্মা ডাক ভারি পছন্দ করতাম,নিজেকে একটু মুরুব্বী মুরুব্বী মনে হোত,য্দিও বয়সে খোদেজা ছিল বড়!! বিকেলে কাজ সেরে বারান্দায় বসে থাকতো,স্কুল ফেরত আমাকে দেখলেই দৌড়ে নীচে নেমে হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে নিতো তারপর বাসায় নিয়ে যত্ন করে জুতা মোজা খুলে দিত। ও আমাকে পুতুলের মতো আদর করতো।
বাড়ীতে অতিথী এলে মনে করতো ও এই বাড়ীরই মেয়ে! একবারতো ঈদের দিন আব্বার এক শিল্পপতী বন্ধু বাসায় এসে খোদেজাকে অনেকটা জোর করে ঈদের সালামী দিয়ে বললেন-
"তোমার বাবাকে ডেকে দাও,বল অমুক চাচা এসেছেন"!
বেচারার আর কি দোষ! ওর পরনে আম্মার ইন্ডিয়া থেকে এনে দেয়া মাখন রংয়ের সিল্কের জামা।গায়ের রং মিলেমিশে একাকার,
দেখাচ্ছে ভদ্র বাড়ির মেয়ের মত।
ভর ভরন্ত গৃহস্থ বাড়ীর মেয়ে হওয়া সত্বেও সৎ মায়ের অত্যাচারে টিকতে না পেরে পাড়ি জমিয়েছিল ঢাকা শহরে আর কিভাবে কিভাবে যেন অতি অল্প সময়েই আমাদের পরিবারের একজন হয়ে গিয়েছিল। ওর মায়ের অন্যত্র বিয়ে হয়েছিল,সেই ঘরেও দু তিনটি সন্তান। অবাক হয়ে ভাবতাম এই শ্রেনীর মানুষ গুলো বেশ আধুনিক,ইচ্ছে মত একের পর এক বিয়ে করে আবার ছাড়া ছাড়ি করে!! যা বলছিলাম মেয়েটার আসলে যাবার জায়গা ছিল না !
স্কুলের পরে বাসায় খোদেজার সাথেই খেলাধুলা করতাম। শহুরে আমার কাছে খোদেজা ছিল এক অচেনা উন্মুক্ত গ্রাম বাংলার প্রতিচ্ছবি। বেচারী প্রায়ই বারান্দায় বসে তার মনের দুঃখের কথা বলতো, সৎ মা কেমনে খাবারের কষ্ট দিয়েছে,কেমনে মেরেছে এইসব। কখনো ভাতের ফ্যান খেতে দিয়েছ,কখনও দেয়নি। খাবার না পেয়ে বেচারী আর তার একমাত্র ছোট বোন মটরের ক্ষেতে মটর,সীমের ক্ষেতে সীম, পাট খড়ির আগুনে পুড়িয়ে খেতো, আবার ক্ষেতের মালিকের ধাওয়া খেয়ে পালাতো, সে এক চমকপ্রদ কাহিনী ছিল! ওর দৌড়ানি খাবার গল্প শুনে বলতাম,
-- হে রে তেল মসলা ছাড়া সিম পোড়া আলু পোড়া খেতে কি ভাল লাগতো?
খোদেজা বিজ্ঞের হাসি হেসে বলতো,
--অনেক মজাগো ছুডু খালাম্মা!!! সেইরাম স্বাদ
খোদেজার প্রিয় কিছু গান ছিল,সবই গ্রাম্য লৌকিক, তার ধারনা দু:খের জায়গাটায় খুব মিল সেসব গানের সাথে তার জীবনের, তাইতো সুযোগ পেলেই গলা ছেড়ে ধরতো সেসব গান। একটা ছিল---
" উড়িয়া যাওরে মাছারাঙ্গী.........
কইয়ো বগার ধারে
তোমার বগি বন্দি রইছে..........
ধোলাই নদীর পারেগো...........
(বাচ্চার জন্য মাছ মারতে যেয়ে বগি আটকা পড়ে জেলের জালে, তখন সে উড়ে যাওয়া মাছরাঙার কাছে তার বন্দীত্বের খবর পাঠায় বগার কাছে,গান মারফত) করুন গলায় সে গাইতো..।
আরেকটা মজার আবোল তাবোল গান ছিল---
জাম্বুরা গাছের তলেলো
জাম্বুরা টেঙ্গাইছে
মায়ে ঝিয়ে গোছল করে
বইনরে সাজায়ছে
বাবালো বাবালো
মায় কি করে!!
তোর মার কান্দনে
গাছের পাতা ঝরে
উত্তর বাড়ীর কিনারে
নদী বইয়া যায়
সেই নদীতে লাল রং
নিশান দেখা যায়..............
শুনতে শুনতে মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল,আমিও মনে মনে ওর সাথে গাইতাম!
গ্রামের মেয়েদের সাজ সজ্জার কিছু অভিনব আইডিয়ার কথা প্রথম শুনেছিলাম ওর থেকে। যেমন ভ্রমরার কালো চিক চিক পাখা দিয়ে গ্রামের মেয়েরা কানের দুল বানায়,হলুদ সবুজ কাচ পোকা দিয়ে বানায় টিপ,ফলের বিচি দিয়ে বানায় কানের দুল,গলার মালা, হাওড় হাতড়ে পাওয়া ঝিনুকে কখনও কখনও মিলে যায় মুক্তো, লেসফিতা ওয়ালা দশ টাকায় দেয় এত্ত এত্ত মুখে মাখবার ক্রিম!! আর বলতো বাবুই পাখির বাসা বানাবার গল্প, টিয়ে পাখি ধরবার গল্প। সব শুনে মনে মনে দারুন উৎফুল্ল হয়ে উঠতাম,আদুরে গলায় বলতাম-
--আমার জন্য এগুলা সব নিয়ে আসবি, আমি দশ টাকা দিব, ঐ ক্রিমও নিয়ে আসবি।
ভাল ক্রীমের কি আর অভাব ছিল বাসায় তবু ওর গল্প শুনে ওই জিনিস গুলোর প্রতি আমার দূর্নিবার আকর্ষন কাজ করতো। তবে ও কখনো এগুলা আনতো না, ভাবতো হয়তো আমার প্রয়োজন নেই।
ওর আঞ্চলিক ভাষা ছিল বেশ মজাদার!! যেমন কোন কোন দিন একটু বেশী কাজ করলে বলতো-
--ছুডু খালাম্মা আইজগা আমার ডেনাডা বিষ করতাছে! এই কথা শুনে হাসতে হাসতে কুটোপাটি হয়ে যেতাম,বলতাম--
--এই ডেনা আবার কি রে! হাত বল হাত,তুই কি পাখি নাকি,তোর ডেনা থাকবে!!!
ও তবু জোর দিয়ে বলতো,
-- আমরার দেশে হাতেরে ডেনাই কই,হুম!!
যত্ন করে পড়াতাম ওকে,নিজের পড়া বাদ দিয়ে হলেও মাস্টারী করতাম ওর উপর। চাকরী জীবনে প্রভাবশালী রিজিওনাল ম্যনেজার/এরিয়া ম্যনেজারদের ক্লাশ নিলেও এরকম আগ্রহী আর মনোযোগী ছাত্রী কমই পেয়েছি। আদর্শলিপি শেষ করে নিজের স্কুলের স্টাইলে সিটি পরীক্ষা,হাফ ইয়ারলি,বার্ষিক সব পরীক্ষা নিতাম,কঠিন চাপ দিতাম তাকে! ফলাফল খোদেজা লেখতে পড়তে শিখে গেলো অল্প সময়েই। সেবা প্রকাশনীর ইউরোপিয়ান লৌকিক কাহিনী "গ্রানাডার উপাখ্যান" পড়ে শেষ করে ফেলল!! নায়ক,নায়িকার সে কি দাত ভাঙ্গা সব নাম!! নায়িকার নামটা সহজ তাই মনে আছে এখনো গাদরাদা!! দারুন খুশী ছিল ও।বলতো,
--ছুডু খালাম্মা,আমি জীবনেও স্কুলে যাই নাই, তবু আপনের লাইগা পড়তে লিখতে পারলাম।
পেপারের বড় বড় হেডিং গুলো পড়তো আর রাস্তার সাইনবোর্ড গুলো পড়ে বলতো,
--ছুডু খালাম্মা,আপনে না শিখাইলেতো এগুলা আমার কাছে আন্ধার থাকতো।এখন বুঝি কেন বিদ্যারে আলো কয়!!
সব আদর,মায়া,মমতা,ভালোবাসা জলাঙ্জলি দিয়ে ও একদিন চলে গেল,ওর বাবা এলো নিতে,ভালো ছেলে নাকি পাওয়া গেছে,পাত্রস্থ করতে হবে। আম্মা সোনার দুল গড়িয়ে দিলেন। এরপর অনেক গুলো বছর আর কোন খোজ নেই। আমার আর আম্মার অনেক দিন পর্যন্ত খুব মন খারাপ লাগতো! মাঝে মাঝেই মনে পড়তো ওর কথা।
বেশ অনেক গুলো বছর পর একদিন, ছেলে সন্তান কোলে নিয়ে খোদেজা ফিরে এলো।ছেলেটা দেখতে হয়েছে ওর মতোনই ফুটফুটে সুন্দর। সারসংক্ষেপে যা বলল তা হলো স্বামী আর শ্বশুর বাড়ীর মানুষের অত্যাচারে ও ঘরছাড়া হয়েছে। ওকে পাত্রস্থ করে ওর পরিবার যেন হাফ ছেড়ে বেচেছিল। আর কখনো কোন খোজ খবর নেয়নি। যাইহোক,শ্বশুর বাড়ীতে কয়েকবার বিষ খাইয়ে ওকে মেরে ফেলারও চেষ্টা করা হয়েছে,ভাগ্যক্রমে বেচে গেছে শুধু তাই নয় পাড়ার বখাটে দিয়ে মাঝ রাত্রিরে নির্যাতনের চেষ্টাও হয়েছে যাতে অপবাদ দিয়ে বের করে দেয়া যায়। তবু ও মুখ বুজে সহ্য করে গেছে। ওর স্বামী যখন দেখল শ্বশুর বাড়ী থেকে আর কিছু পাবার সম্ভাবনা নেই তখন লাইন ঘাট করে পাকিস্তানে ভাগ্য বদলাতে চলে গেল। বেচারী আর দাড়াতে পারলো না ও বাড়ীতে, বাধ্য হয়ে ঢাকা পাড়ি জমাতে হলো। নিজের বাবার পরিবারও ওকে আশ্রয় দেয়নি.
ফিরে আসা খোদেজা অনেকটাই বদলে গেছে।জীবনের নতুন অভিজ্ঞতায় অভিজ্ঞ,পরিনত,বাচ্চা সামলাতে ব্যস্ত, আরো একটু বেশী শান্ত।তবু সময় পেলে শ্বশুর বাড়ীর নির্যাতনের গল্প বলে মন হালকা করতো।একদিন বললাম,
কিরে তুই এত সুন্দর জামাই তোকে আদর করতো না?খালি মারতোই?
ও কোন মতে বললো,
আদরের দিন তার বেশী দিন যায়নি।ওর সবচেয়ে সুন্দর স্মৃতি হলো জামাই তাকে মাঝ রাত্তিরে ডিংগী নৌকায় বসিয়ে চরে ঘুরাতে নিয়ে যেত,সেখানে জোছনার আলোতে কাশবন বাতাসে দোলে।আরেক দিন বলল,
-জানেন ছুডু খালাম্মা বিয়ার কাবিননামায় আমি নিজে হাতে সই দিছি,যেনে আমরার গেরামে কেউ এমুন কাম করে নাই! সবাই কইছে বউ শিক্ষিত!
আর তোর জামাই?
-হ্যায় আবার কি! টিপসই মারছে
তোর কি তখন আমার কথা মনে পড়ছে?
-পড়ছে না আবার! অনেক গর্ব হইছে
দূরে গেলে পুরুষের ভালোবাসা বাড়ে। নারীর মনও সেই মিষ্টি মিষ্টি ভালোবাসার কথায় আকুল হয় বইকি।খোদেজার স্বামী ফোনে যোগাযোগ করা শুরু করলো।যথারিতী খোদেজাও অতীত স্মৃতি সব ভুলে গেল।বেশ কমাস পরে তার স্বামী প্রবর পাকিস্থান থেকে ফিরে এল এবং খোদেজাও তার হাত ধরে সংসার করতে চলে গেল।আবারো কষ্ট পেয়েছি ওর চলে যাওয়ায় কিন্তু নিষ্ফল তাকিয়ে ছাড়া আর কিবা করার ছিল।যাবার সময় ওর হাসিমুখ দেখে ভেবেছি তবু সুখী হোক।
এরপর সময়ের ডানায় চড়ে অসংখ্য মুহূর্ত হারিয়ে গেছে,যে মুহূর্ত গুলোতে ওর স্মৃতি হানা দিয়েছে প্রায়শই।অনেক গুলো বছর আর ওর কোন খোজ জানিনা। তখন মোবাইলের যুগ শুরু হয়নি।ওর বাড়ীর এক মেয়ে, যে কিনা কাজ করে গিয়েছিল আমাদের বাড়ীতে এক সময় খোদেজার রেফারেন্সেই,প্রায়ই আসতো দেখা করতে।ওর কাছ থেকে একদিন জানলাম খোদেজা মারা গেছে। কিভাবে?মারা যাবার তিন দিন পরে ওর শ্বশুড়বাড়ী থেকে খবর পাঠানো হয়, ও মারা গেছে অসুস্থ হয়ে কিন্তু পাড়া প্রতিবেশী সবাই বলাবলি করেছে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলেছে।
আমি আবেগপ্রবন মানুষ, মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম,
কেউ কাদেনিরে ওর জন্য?ছেলেটা কই?ছেলেটাতো বেশী বড় হবার কথা না! ও চেয়েছিল ছেলেটাকে পড়াশোনা করাবে।বলল,
না কেউ কান্দে নাই।খালি সৎ ছোড ভাইডা কবর খান দেকতে গেছে আর ইকটু কানছে! পোলাডা বাপের ধারেই আছে। আরকি বাপে আবার বিয়া করবো, পোলাডা লাত্তি উষ্টা খাইয়া ছেউড়া মেউড়া অইয়া বড় অইবো!
হায়রে জীবন!!একটু সুখের জন্য জীবনটাও বিকিয়ে দিতে হয় অনায়াসে।গ্রাম বাংলার আনাচে কানাচে এরকম অসহায় মেয়ে মানুষের জীবন বড় সস্তা!ওর কথা ভুলতে পারিনা।মাঝে মাঝেই স্মৃতি বড় জ্বালায়!