গাঙ্গে নতুন পানির ঢল নামছে! ভরা বর্ষার উথাল পাথাল গাঙ্গের পানি জামিল শেখের মনের পালে খুশীর হাওয়া বইয়ে দিয়ে যায়। আজ তিন মাস পরে নাইওর আনতে যাচ্ছেন বউকে। বউ নূরজাহান বেগম ভয়াবহ রকমের রুপবতী! গারো খয়েরী চোখের মনিতে রুপালি তারা ঝিলিক দেয়, তার উপর আবার নরম কাশফুলের মতো গায়ের রঙ, টিকোলো নাকে নীল পাথরের ফুলটা পরলে রুপে যেন আরো বান ডাকে ! এক বন্ধুর বাড়ীতে কিশোরী নূরজাহান বেগমকে প্রথম দেখেছিলেন। সেই দেখাতেই মনে ধরেছিল, হয়েছিলেন দিওয়ানা! আর সেই বছরই বউ করে ঘরে তুলে আনা।
জামিল শেখও কম যান না! সম্ভ্রান্ত সৈয়দ বাড়ীর বড় ছেলে তিনি,পেশায় ইলেকট্রিকেল ইঞ্জিনীয়ার। অটোমোবাইলসের ব্যবসা করেন সারা দেশ জুড়ে। তাইতো ছুটে বেড়াতে হয় প্রায়ই। অনেক সময় দেখা যায় সেই সুবাদে দীর্ঘ সময়ের জন্য বাড়ীর বাইরে থাকা লাগে,কখনও কখনও তা দিন পেরিয়ে মাসে গড়ায়। তখন স্ত্রী আর কলিজার টুকরা তিন বছরের ফুটফুটে মেয়ে আমিনাকে পাঠিয়ে দেন শ্বশুর বাড়ী। এবারের সফরটা বেশ দীর্ঘই হয়ে গেছে। তাই প্রিয় জনদের ফিরে পাবার আনন্দটাও আজ দ্বিগুণ বেগে শত সহস্র ফল্গু ধারায় ছুটেছে।
সেই আনন্দে বউকে আনতে জামিল শেখ ভাড়া নিয়েছেন বিরাট পানসী নাও। আত্মীয় পরিজনে নাও ভরপুর। সবাই হাসি আনন্দে কুটুম বাড়ীতে মজাদার ভূড়িভোজের পর, বউ নিয়ে বাড়ীর ফিরতি পথ ধরেছে। উচু লয়ে বাজছে কলের গান। বাতাসে সে গান ছুয়ে যায় নদীর ঢেউ,উদাস করে নদী পারের কারো কারো পোড়া অন্তর!! বৃটিশ কাল শেষ হয়ে পাকিস্তানী আমল চলছে সবে,বিনোদন বলতে এগুলোই ছিল ভরসা! উজান ভাটির জলের স্রোতে পাল তুলে দিয়েছে মাঝি,আর সেই বাতাসে তিরতির করে এগিয়ে চলেছে নাও।
নূর জাহান বেগমের মনটা আজ খুব ভাল। স্বামী হঠাৎ এসে এমন চমকে দিয়েছে! কত কত দিন অপেক্ষা করেছিলেন এই দিনটির জন্য! আর মেয়ে আমিনার খুশী দেখে কে !! সে ঢেউয়ের দোলায় দুলে দুলে,বাবার কোলে চড়ে আনন্দে হাত তালি দিয়ে হাসছে। মেয়েটা বড্ড বাবা অন্তপ্রাণ ! বাবাও মেয়ের জন্য জীবন। সৈয়দ পরিবারে মেয়েমানুষ যে সংখ্যায় বড় কম! জামিল শেখের নিজের ছিল না কোন বোন! তারা ছিলেন পাচ ভাই, ছিল না ফুপু খালা বলতে তেমন কেউ। তাইতো বংশের প্রথম মেয়ে হবার পাশাপাশি আমিনা ছিল তার প্রাণ ভ্রমরা ! ছেলে হলেও তিনি এত খুশী হতেন না যতটা হয়েছিলেন মেয়ে হওয়াতে। একবারতো মেয়ের দাতে প্রবল ব্যাথা, তাকে ডাক্তার দেখানো প্রয়োজন। তিনি মেয়েকে কাধে চড়িয়ে তিন ঘন্টা পায়ে হেটে সদরে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। মেয়ের প্রতি ভালোবাসার সেই ঘটনা রিতীমত সবার মুখে মুখে ফিরেছে বহুদিন।
যেতে যেতে শেষ অবধি অন্ধকার হয়েই গেলো। আরো ঘন্টা দুই তিনেকের পথ তখনো বাকী। মাঝি মনে মনে জোয়ারের প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছে! জোয়ারটা এলে আর চিন্তা নাই,অর্ধেক সময়ে পৌছে দেয়া যাবে আর তার কষ্টও কমে যাবে বৈকি। নাও এবার মেঘনা ছেড়ে ডুকে পড়েছে কোন এক খালে। খালটা বেশ চওড়া বলা যায়,তবে অন্ধকারে দেখা যায় না কিছুই!! হারিকেনের টিম টিমে আলো আর আধ খাওয়া চাদটাই যা একটু ভরসা আর সেই সাথে আছে মাঝির অভিজ্ঞতা। ঘুটঘুটে অন্ধকার চারিদিকে,গাছপালার কারণে আরো অন্ধকার দেখায়। এমন সময়ে নূরজাহান বেগম স্বামীর পাঞ্জাবীর খুট ধরে টান দেয়, আর ফিস ফিসিয়ে কানে কানে বলেন,
----- মাইয়াটারে নাওয়ের কিনারে বসানতো,ওর পিশাব ধরছে।
জামিল শেখ মাঝিকে নাও ভিড়াতে বলেন। অতপর অন্ধকারে নাওয়ের কিনারে মেয়েকে ধরে কোন রকমে কাজ সারাতে হয়। নাও আবার চলতে শুরু করে কিন্তু হঠাৎ কি হয় কে জানে, মেয়েটা ভীষন ভাবে কাদতে শুরু করে!! কাদতে কাদতে খুন হবার উপক্রম প্রায়! মেয়ের অবস্থা দেখে বাবা মায়ের মন কষ্টে মরে যায় !! অনেক বার জিজ্ঞাসার পরে মেয়ে কোন রকমে জানালো হঠাৎ তার পেটে ভীষণ ব্যাথা করছে! বাবা মা চোখে অন্ধকার দেখেন। এমন ঘুটঘুটে রাতে, চারিদিকে এমন পানির মধ্যে, কই ডাক্তার কবিরাজ পাবেন!! অতিথীদের মধ্যে একজন বলে উঠলো,
-----নাও ভিড়ানের আগেতো মাইয়াটা কান্দে নাই, ওই মাঝি কই নাও ভিড়াইছিলা?
তারপর খোজ খবর করতে করতে বের হয়ে এলো আসল ঘটনা,যে জায়গাটায় মাঝি নাও ভিড়িয়েছিল তা ছিল শ্মশান ঘাটা। বলাই বাহুল্য বেশ খারাপ জায়গা। সেখানেই খারাপ কোন অশরিরির কুনজর পড়েছিল মেয়েটার উপর। মাঝিরও দোষ দেয়া যায় না, অন্ধকারে বুঝে উঠতে পারেনি, কোথায় কার কোলে নাও ভিড়ালো সে !! অগত্যা সেই এক উপায় বের করলো। জামিল শেখকে উদ্দ্যেশ্য করে বলল,
------এই পানশিউলি গেরামের নামকরা কবিরাজ গণি মিয়া,যারে কয় পিশাচের জম!! লন যাই মিয়া ভা্ই তার ধারে। হ্যায় কুন একটা ব্যবস্থা করবোই।
আর কথা না বাড়িয়ে জোরে নাও ছুটানো হলো। এবার সেটা ঘুরে গেলো আর এক খালের ভিতর। কবিরাজের বাড়ি খুব একটা দূরে ছিল না। বাড়ির কাছে যেতেই হারিকেন তুলে জামিল শেখ লম্বা হাক দিলেন,
-----গণি মিয়া বাড়ি আছোনি? গ্ণি মিয়া ও গ......ণি মি......য়া...............
গ্ণি মিয়া তখনো বাড়ি থেকে বের হয়ে আসেনি। দেখা গেলো এক অদ্ভুত ঘটনা, আমিনা হাসছে!!! তার পেটে আর ব্যাথা নেই, একদম ভাল হয়ে গেছে ! সবাইতো অবাক ! যেই মানুষ এতক্ষন কেদে কেটে অস্থির হঠাৎ সে ম্যাজিকের মতো কেমনে ভাল হলো? তখন এক প্রবীন অতিথী দিলেন এক চমকপ্রদ তথ্য-
------যারা খুব ভাল কবিরাজ, ভূত প্রেত তাগো ডরায় ! এমন কি নাম শুনলেই ভাগে!! রোগির ত্রিসীমানায় এগোরে তখন আর খুইজা পাওয়া যাইবো না। গ্ণি মিয়ার ক্ষেত্রেও তাই ঘটছে, নাম শুইনাই বেটা পিশাচ ভাগছে!!
সবাই স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। জামিল শেখ মেয়েকে বুকে জড়িয়ে স্রষ্টাকে শুকরিয়া জানালেন আর প্রার্থনা করলেন, পরম করুনাময় এভাবেই সব সময় যেন তার কলিজার টুকরাকে, সকল বিপদ থেকে রক্ষা করেন। আবার সরবে কলের গান বেজে উঠলো নাওয়ে, হইহই আনন্দ খেলে গেলো সবার মনে। গুমোট বাতাস উড়িয়ে মংগল আলোক ঝরে পড়তে লাগলো মেঘনার বুকে।