আজকে একটা ব্রীজের গল্প বলবো। বেশ কয়েক বছর আগে প্রথম আলো পত্রিকার মাধ্যমে এই ব্রীজের কথা প্রথম জেনেছিলাম। সেই থেকেই তাকে দেখবার একটা গোপন ইচ্ছার বীজ মনের ইচ্ছে ভূমিতে রোপিত হয়েছিল। তো সেখানে ফরাসিদের পাগলামিপণার এক নিদর্শন হিসেবে ব্রীজটাকে তুলে ধরা হয়েছিল। ব্রীজ খানা ফ্রান্সের প্যারিস শহরে এবং সীন নদীর উপরে অবস্থিত। সৌভাগ্যক্রমে গেলো সপ্তাহে ইচ্ছে খানা পরম করুনাময় পূরন করেছেন। যদিও ব্রীজের চেহারা পালটে গেছে বেশ অনেকটাই।
এবার আসল কথায় আসি,কেন এই ব্রীজ নিয়ে এত মাতামাতি। কারন তামাম দুনিয়ার রোমান্টিক যুগলরা এসে এই ব্রীজের রেলিং এ তালা ঝুলান। না না হুদাই ঝুলান না, এই আজাইরা পয়সা খরচের পিছনে একটা সেই রকম উদ্দেশ্য আছে বৈকি,যদিও অনেকের কাছে তা পাগলামীপণার নামান্তর মাত্র। প্রথমে তালার গায়ে নিজেদের নামের প্রথম অক্ষর লিখেন, কেউ কেউ লাভ ম্যাসেজ লিখেন তারপর লক করেন ব্রীজের গ্রীলে আর ফাইনালি চাবি খানি সীন নদীতে ছুড়ে মারেন। তারা মনে করেন এতে তাদের ভালোবাসাও লক হলো মানে চিরস্থায়ী হলো আজীবনের জন্য। এই কর্ম সাধিত করতে দুনিয়ার তাবৎ টুরিস্টরা এখানে জমা হয়। তো বুঝতেই পারছেন সারা ব্রীজ জুড়ে অসংখ্য অসংখ্য তালা ঝুলে আছে! সে এক দেখার মতো জিনিস।
এইবার ব্রীজের ইতিহাস ধরে একটু টান দেই। জনাব নেপোলিয়ান সাহেবের আমলে প্যারিসের "পন্ট দা আর্টস" নামক স্থানে ১৮০২-১৮০৪ সালে পথচারীদের জন্য প্রথম এই ব্রীজ তৈরী হয়েছিল। নয় আর্চের তৈরী এই ব্রীজই প্যারিসের প্রথম লোহার ব্রীজ যা যুক্ত করেছে institute da France এবং the central square of the Palais du Louvre কে। কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে পর্যবেক্ষনে দেখা গেল ব্রীজে বেশ কিছু ত্রূটি তৈরী হয়েছে যার জন্য দায়ী প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্বের বোমা বিস্ফোরন এবং নৌযান গুলোর একাধিক আঘাত। তাই ১৯৮১-১৯৮৪ সালে সংস্কার করা হয় বর্তমান ব্রীজ। ১৯৯১ সালে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের আন্ডারে নেয়া হয় "পন্ট দা আর্টস" এলাকাকে।
সংস্কারের পর থেকেই ভালোবাসার ঝামেলা লাগা শুরু হয়। ২০০৮ থেকে টুরিস্টরা এই ব্রীজে তালা দেয়া শুরু করে আর ধীরে ধীরে নাম হয়ে যায় "লাভ লক ব্রীজ"। ২০১৪ তে এসে পুরো ব্রীজ তালায় ঢেকে যায়। প্রায় ৭লক্ষ তালা ইতিমধ্যে আটকানো হয়েছে। যার ওজন গিয়ে দাঁড়ায় ৪৫ টন যা বিশটি হাতীর ওজনের সমান। জায়গা না পেয়ে তখন তালার উপর তালা দেয়া হচ্ছিল। এই অতি ওজনের কারনে ইতোমধ্যে ব্রীজের একটি প্যানেল ক্ষতিগ্রস্তও হয়। বাধ্য হয়ে কর্তৃপক্ষ ২০১৫তে এই তালা অপসারন করা শুরু করে। আর ক্যাম্পেইন করা শুরু করে "লাভ উইদাউট লক" আর "তালার বদলে সেলফি তোল"।
আমিতো ভেবেছিলাম এত্ত এত্ত তালা একসাথে দেখবো,দারুন ব্যাপার হবে। সেই রকম ব্রীজতো খুজেই পাচ্ছিলাম না,পুরো এলাকাটায় অনেক গুলো ব্রীজ। সব গুলো ব্রীজ দেখি একদম ফকফকা। শেষে একটা ব্রীজে দেখলাম বেশ মোটা গ্রীল লাগানো,তার উপর আবার গ্লাস বসানো,বুঝলাম এটাই সেই ব্রীজ, নো চান্স ফর তালা দেয়া। কোথাও যেন পড়েছিলাম তালা অপসারনের খবর,শিওর ছিলাম না, মনের কোনে ক্ষীণ আশা ঘাপটি দিয়ে বসে ছিল তালা দেখবো বলে! ব্রীজে ঢুকার মুখে আমার আশা কিঞ্চিত পূরণ হলো। সেখানে ব্রীজ সংলগ্ন পার্কের গেটে অতিশয় রোমান্টিক কিছু টুরিস্ট তালা ঝুলায়ছেন। ভাগ্যিস তালা কিনি নাই,বের হবার মুখে লাইফ পার্টনার অবশ্য বলতেছিল তালা কেনার কথা!!!!
ঐতিহাসিক এই লোকেশন বেশ সুন্দর, ঘুরে আসতে পারেন প্রিয় জনকে সাথে নিয়ে। সম্পূর্ণ এলাকাটাই তৈরী হয়েছে নদীকে কেন্দ্র করে। নদীর পাড়ে বিনোদনের সব ব্যবস্থা আছে, মানুষ শুয়ে বসে আড্ডা দিয়ে সময় কাটাচ্ছে। চাইলে রিভার ক্রজ রাইড নিতে পারেন। কিছু ক্রজ দেখলাম পুরোটাই রেস্টুরেন্ট। পছন্দের খাবার খেতে খেতে ভালোবাসার মানুষের সাথে নদী দেখার মজা নিশ্চয়ই আলাদা হবার কথা।
ছবি গুগল থেকে এবং আমার তোলা
লাভ লক ব্রীজের বর্তমান অবস্থা