somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আবুল হোসেন ও বাচ্চাভূত পঞ্ছর

২৩ শে আগস্ট, ২০১৪ বিকাল ৪:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

তখন ঢাকা শহর ততটা ছড়াতে পারেনি। শহর বলতে ওদিকে বুড়িগঙ্গার তীর থেকে নাজিরা বাজার, সিদ্দিক বাজার, ওয়ারী আর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ফুলবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশন। বাকি অংশটা বলতে গেলে খানাখন্দ আর বিশাল খেতের প্রান্তর। কোথাও কোথাও সারা বছরই পানি থাকে। তাদের আবার নামও আছে মতির ঝিল, হাতির ঝিল, হিরাঝিল এমন। মতির ঝিলের পানিটা অদ্ভুত রকমের দেখতে। টলটলে পরিষ্কার মনে হলেও দেখতে যেন কালো কাচের গলিত সিরা। পুরো ঝিল জুড়ে কচুরি পানা, হেলেঞ্চা, মালঞ্চ আর কলমি নামের গুল্ম-লতার উল্লাস চোখে পড়ে।

বনগ্রামের আবুল হোসেন মায়ের সঙ্গে রাগ করে প্রায় পুরোটা সকাল মন খারাপ করে শুয়েছিল বনগ্রাম বাজারের বটগাছটার নিচে একটি মোটা শেকড়ের গায়ে হেলান দিয়ে। গাছের উঁচু ডালে ঝাঁকে ঝাঁকে নাম না জানা পাখির সঙ্গে আছে কাক, ঘুঘু, চড়ুই, টুনটুনি, বউ কথা কও নামের হলুদ কালোর মিশেল দেয়া অত্যাশ্চর্যতম পাখিটিও। মাঝে মধ্যে দু একটা বকও উড়ে এসে বসতে দেখা যায়। দেখা যায় কিছুক্ষণ পর ফের উড়াল দিচ্ছে কাক নামের পাজি পাখিটার যন্ত্রণায়। নানা রকমের পাখি দেখতে দেখতে ভাবছিল নানা কথা। মায়ের সঙ্গে রাগ করে বেরিয়ে এলেও মূল রাগটা ছিল তার বাবার ওপর।

কারো বাবা যদি ঠিক মতো কাজ-কর্ম না করে সন্তান কি বলতে পারে, বাবা কাজ কর না কেন? কাজ না করলে খাবার আসবে কোত্থেকে? এমনও তো হতে পারে, বাবা যদি বলে বসেন- তোর খাবার তুই নিজেই যোগাড় করে আন, তাহলে তার ভিক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। সে তো গরুর জন্যে ঘাস তুলবার কাজ ছাড়া আর কোনো কাজ জানে না। আর এ কথা বাবা জানতে পারলে হয়তো তাকে ঘাস খেয়েই থাকতে বলবেন।

দুপুরের খানিকটা আগে দিয়েই সে মনে মনে ঠিক করে ফেলেছে যে, ঘরে আর ফিরে যাবে না। গোপালের বাবার মতো নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে। আর তাই নিরুদ্দেশ হবার জন্যে সে শোয়া থেকে উঠে পড়ে সামনের দিকে হাঁটতে থাকে। বড়দের মুখে শুনেছে যে, ফুলবাড়িয়া রেলের ইস্টিশন। সেখান থেকে রেলে চড়লে অন্য দেশে চলে যাওয়া যায়। আর অন্য দেশে চলে গেলেই তো কেউ জানবে না সে কোথায় আছে। বিনা কারণে বকাঝকাও করতে পারবে না কেউ। সকাল সকাল উঠে ঘুম নষ্ট করে মক্তবেও যেতে হবে না কায়দা পড়তে। মক্তবের হুজুরটাকে তার মোটেও পছন্দ হয় না। প্রতিবারই এই পড়! বলেই হাতের বেত দিয়ে একটি বাড়ি দেয় পিঠের ওপর। চিকন জালি বেতের বাড়ি যে খায়নি সে বুঝবে না কতটা যন্ত্রণার। আর তেমন একটি যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে নিশ্চয় কারো আনন্দ করে পড়বার মন থাকবার কথা নয়। কাজেই সন্ধ্যার দিকে পাহারাদারদের চোখ ফাঁকি দিয়ে সে উঠে পড়বে রেলের কোনো বগিতে। সেটা যে স্টেশনে গিয়ে আর সামনে যেতে পারবে না সেখানেই নেমে পড়বে। একবার ইচ্ছে হয়েছিল যে, স্টিমারে চড়ে নিরুদ্দেশ হবে। কিন্তু সে সাঁতার জানে না বলে স্টিমার তো দূরের কথা নৌকাতে চড়তেও সাহস পায় না।

একবার হরেন আর সামসুর সঙ্গে বুড়িগঙ্গার পাড়ে সদরঘাট গিয়েছিল। সেখানে কত নৌকা, লঞ্চ আর স্টিমার দেখেছে। কিন্তু ভয়ের কারণে সেখানে থাকতে পারেনি। যদি সদরঘাট ভেঙে পানিতে ডুবে যায়। তাহলে সেও পানিতে ডুবে মারা যাবে। তাই সে অনেক ভেবে ঠিক করেছে রেলে চড়ে নিরুদ্দেশ হবে। কিন্তু ক্ষুধা আর গরমের কারণে তার খারাপ লাগছিল খুব। পানির পিপাসাও পেয়েছিল খুব। সামনেই দেখা যাচ্ছিল মতিঝিল। একবার এখানে সে এসেছিল তার আরেক বন্ধু দিনেশ আর মজিবরের সঙ্গে। সেদিন দেখেছিল পুরোটাতে পানি তেমন একটা দেখা যায় না কচুরি পানা আর নানা জাতের লতার কারণে। দিনেশ সেদিন বলছিল যে, কলমি শাক খেতে খুব ভালো। সে তুলেও নিয়েছিল অনেকগুলো। কিন্তু মজিবর যখন বলছিল যে, কালো পানির কিছু ভালো হয় না। ওতে বিষ থাকে।

দিনেশ সে কথা শুনে বলেছিল, তাইলে এইটার জল খাইয়া কেউ মরতে শুনছস?

এমন কথা অবশ্য তারা কেউ শোনেনি। নিজের কথার সত্যতা প্রমাণ করতে দিনেশ নিজেই দুহাতে পানি তুলে নিয়ে অনেকগুলো খেয়েছিল চুমুক দিয়ে। কিন্তু হঠাৎ কেমন করে যেন মজিবর পানিতে পড়ে গিয়ে ডুবে যাচ্ছিল। দুজনে মিলে তাকে টেনে তুলেছিল সেদিন। এরপর ভয়ে মজিবর বা দিনেশ এদিকে আসতে চায়নি।

হাঁটতে হাঁটতে ঝিলের পানিতে নামে আবুল হোসেন। প্রায় হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে কচুরি পানা আর লতানো নানা গাছের ফাঁকে দুহাত চুবিয়ে পানি তুলে খায় দুবার। তারপর হাত মুখ ধুয়ে ঠাণ্ডা হবে বলে আবার পানিতে হাত দিতেই মনে হলো কিছু একটা যেন হাতে লাগলো। কিন্তু কী সেটা বুঝতে না পেরে কচুরি পানা দুহাতে ঠেলে সরিয়ে জায়গাটা বড় করতে চাইল। অথচ অবাক হয়ে সে দেখলো যে, যতবার কচুরি পানা ঠেলেছে ততবারই সেগুলো আরো কাছে চলে এসেছে। শেষে পানিই আর দেখতে পাচ্ছিল না সে। তাই কচুরি পানার ভেতর হাত দিয়ে হাতের আঁজলায় পানি তুলতেই মনে হলো ধাক্কা দিয়ে পানিটা কেউ ফেলে দিল।

আবুল হোসেন প্রথমটায় মনে করেছিল যে, এমনিতেই হাত কেঁপে যাওয়াতে পানি পড়ে গেছে। কিন্তু পরের বার আবার দুহাতে পানি তুলতেই মনে হলো তার দুহাতের কব্জি টেনে ধরে পানিটা ফেলে দিল। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তার মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি চলে এলো। তারপর খুব ভালো করে তাকায় কচুরিপানার দিকে। তেমন কিছু চোখে পড়ে না। হঠাৎ সে হেসে উঠল। আবার আঁজলা ভরে পানি নিয়ে দুটো হাত একসঙ্গে চেপে রাখল জোর করে। তখনই আবার দেখলো অদৃশ্য কেউ হাত দুটো দুদিক টানছে। কিন্তু বেশিক্ষণ পারলো না, ছুটে গেল দুটো হাত। এরপর আগের মতো পানি দুহাতে না তুলে নিচ থেকেই দুহাতে পানির ঝাপটা দিয়ে মুখ ভিজিয়ে ফেলল। এমন করে সে ঘাড়ে আর গলাতেও পানি দিয়ে ঠাণ্ডা করে নিলো নিজেকে। তখনই তার সামনের কোনোদিক থেকে মিহি একটা কান্নার শব্দ ভেসে আসতে লাগল। শব্দ শুনতে পেলেও কাউকে দেখতে পায় না। ঝিলের আশপাশে কোনো মানুষ এমন কি কুকুর বিড়ালও দেখা যায় না। ঝিলের ওপাড় থেকে চোখ সরিয়ে আনতেই আবছা মতো যেন একটি বাচ্চাকে দেখতে পেল কচুরি পানার দঙ্গলের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। তার কাছে মনে হলো এটা কোনো ভূতের বাচ্চা হবে। তাই সে আগের মতোই দু হাতের আঁজলায় পানি নিয়ে ওপরের দিকে তুলতেই কান্নাটা থেমে যাওয়ার সঙ্গে আবার হাতে টান অনুভব করলো এবং আগের মতোই পানিটা পড়ে গেল। কিছুক্ষণ এমন দুষ্টুমি করে ক্লান্ত আর বিরক্ত হয়ে সে বলে উঠল, আর ভাল্লাগে না। না দেইখ্যা কারো লগে খেলন যায়?

তখনই সে শুনতে পেল মিহি স্বরে কেউ বলছে, আমারে দেখতে পাও না?

-না। একবার খালি আলাঝিলা দেখছিলাম। এমন পিচ্চি চিনির পুতুলের মতন।

তারপরই কিছুটা জায়গা জুড়ে কচুরিপানাগুলো নড়ে ওঠে। কচুরিপানার আড়ালে পানিতে ছপছপ শব্দ হয়। যেন কুয়াশা দিয়ে তৈরি একটি ছোট শরীর ভেসে ওঠে। নাক চোখ কিছু না থাকলেও মুখটা দেখা যাচ্ছিল। বয়সের দিক দিয়ে তার ছোটবোন রানীর মতোই হবে। কিন্তু বোঝা যাচ্ছিল না সে ছেলে না মেয়ে। তাই আবুল হোসেন বলল, তুমি পোলা না মাইয়া?

মিহি কণ্ঠে সে বলে উঠল, আমি পোলা। নাম পঞ্ছর। আগে মানুষ আছিলাম। ভূত হইয়া গেছি দেইখ্যা এমন মনে হয়।

-ভূত আর ভূতের বাচ্চারা সবতেই কি দেখতে এমন?

-না। আমি চুনের ভিতর আছিলাম দেইখ্যা এমন হইয়া গেছি। অনেক ভূত ঝাড়ুর মতন, চিকন মোটা জীব জানোয়ারের মতন, আবার মানুষের মতনও আছে।

আবুল হোসেন অবাক হয়ে বলল, ঝাড়ুর মতনও ভূত আছে? আমারে দেখাইতে পারবা?

-আজকে না। ঝাড়ু ভূতের রাইত ছাড়া বার হইতে পারে না। যারা বিষ খাইয়া মরে তারা ঝাড়ু ভূত হয়। আরেক রকম আছে খাটাস। দেখতে শিয়াল-কুত্তার মতন হয়। গায়ে খুব খারাপ গন্ধ।

-কারা এমন ভূত হয়?

-যারা কোনো লোভের কারণে মারা যায়, চোর-ডাকাইত, পরের হক মিছা কইয়া খায় তারা মইরা খাটাস হয়।

-আর অন্যরকম ভূত নাই?

-আছে। অনেক রকমের ভূত আছে। কেউ গলায় ফাঁস দিয়া মরলে তিন ঠ্যাঙের শুওর ভূত হয়। পিছনের এক ঠ্যাং থাকে না।

পনছরের কথা যত শুনছিল ততই অবাক হচ্ছিল আবুল হোসেন। একবার গণেশের মুখে শুনেছিল ক্ষুদিরামের কাহিনী। সে কথা মনে পড়তেই সে বলে উঠল, ক্ষুদিরাম কী হইছে? সেও তো ফাঁসিতে মারা গেছে।

-ক্ষুদিরাম আবার মানুষ হইয়া পয়দা হইছে পরে।

-ভূত হইল না ক্যান?

-সবাই ভূত হয় না। বেওয়ারিশ লাশ আর খারাপ মানুষ ভূত হয়।

-তুমি জমিদার বংশের হইয়াও বেওয়ারিশ হইলা ক্যান?

-আমার চাচায় আমারে মাইরা চুনের বস্তায় ভইরা মাটি চাপা দিয়া রাখছিল। বাবা-মা মনে করতো আমি হারাইয়া গেছি।

-তাইলে তোমার চাচারে শাস্তি দিতে পারলা না?

-চাচারে বাঘে খাইছে। আমরা এক জাগাতেই থাকি এখন। চাচায় এখন কানা সাপের ভূত হইছে।

আবুল হোসেনের খিদে খুব বেড়ে গিয়েছিল। সে হঠাৎ অস্থির হয়ে বলল, তোমরা কী খাও? আমার অনেক খিদা।

-ভূ্তেরা বাতাস খায়। তার লাইগ্যা খালি চোখে কেউ ভূত দেখতে পায় না। আমি জমিদার বংশের বইল্যা কুয়াশা খাই। তাই আমি দেখতেও কুয়াশার মতন। সব সময় কুয়াশা হয় না বইল্যা মাঝে মাঝে উপাস থাকি।

আবুল হোসেন বলল, আমিও আজকে উপাস। বাবা আর মায়ের সঙ্গে রাগ কইরা ঘর থাইক্যা বার হইয়া আসছি নিরুদ্দেশ হইতে।

-খুব খারাপ কথা!

পনছরের মুখ কেমন থমথমে হয়ে গেল। তারপর আবার বলল, বাপ-মার কথা যারা শোনে না, তারা খারাপ। তারা যেমনেই মারা যাউক তারা ভূত হইয়া যাবে।

-কী ভূত হয় তারা?

আবুল হোসেনের মনটা খারাপ হয়ে গেল। বাবা-মায়ের জন্য মনটা কেমন কেমন করতে আরম্ভ করল।

পঞ্ছর খুব গম্ভীর স্বরে বলল, তারা হয় ডাস্টবিন ভূত।

আবুল হোসেন অবাক হয়ে বলল, ডাস্টবিন আবার ভূত হয় কেমনে?

-হয়, হয়। যেই ডাস্টবিনগুলোতে অনেক ময়লা হয়, অনেকদিন পর পর পরিষ্কার হয়, ভাঙ্গা থাকে। আশে পাশেও ময়লা ছড়াইয়া যায়। ডাস্টবিন ভূতগুলা দুর্গন্ধে দিন রাইত কান্দাকাটি করে। কিন্তু তাদের কান্না কেউ শুনতে পায় না। সেই সব ভূত ডাস্টবিন খুব বেশি ঠিকও করায় না কেউ।

আবুল হোসেনের ইচ্ছে হচ্ছিল তখনই বাড়ি ফিরে যায়। বাবা-মা দুজনের কাছেই ক্ষমা চায়। পঞ্ছর তখনই কথা বলে উঠল। যেন সে বুঝে ফেলেছে আবুল হোসেনের মনের কথা। তাই বলল, বাড়ি যাইবা? খুদা আছে?

আবুল হোসেন বুঝতে পারে না তার খিদা আছে কিনা। তাই সে চুপ হয়ে থাকে।

পঞ্ছর হঠাৎ শূন্যে ভেসে উঠে আবুল হোসেনের হাত ধরে বলল, চল হোটেলে যাই। ওইখানে অনেক খাবার। যা ইচ্ছা খাইতে পারবা।

আবুল হোসেন হাঁটতে আরম্ভ করে বলল, আমার কাছে তো টাকা নাই।

-হেই চিন্তা তুমি করতে হইবো না।

তারপর পঞ্ছর আবার বলল, এমন কইরা হাঁইট্যা যাইতে দেরি হইবো। তোমারে ভাসাইয়া নিয়া যাই রেল লাইন পর্যন্ত। বলার সঙ্গে সঙ্গেই তারা রেল লাইনের পাশে এসে পড়ল।

আবুল হোসেন বলল, একবারে রেল লাইন পার হইয়া গেলেই তো পারতা।

-সেই দিন আর নাই। যেদিন থাইক্যা দেশে রেল লাইন হইছে সেদিন থাইক্যা ভূতেগো কষ্ট আরম্ভ হইছে। লোহা দেখলেই ভূতেরা থাইম্যা যায়। তাদের শক্তি কইম্যা যায়। দেখবা বড় শহরে ভূতেরা থাকে না। সেইখানে অনেক লোহার জিনিস। অনেক আলো জ্বলে। আলো আর লোহা এই দুইটা খারাপ।

পঞ্ছর হঠাৎ আবুল হোসেনের কাঁধে চড়ে বসে। বলে, লাইন পার হইয়া ওই হোটেলে যাও।

আবুল হোসেন সে হোটেলে যেতেই একজন বেয়ারা হেসে উঠল তাদের দেখে।

একটি টেবিলের সামনে দুটো চেয়ারে তারা বসতেই পঞ্ছর আবার বলল, কয়দিন আগে রেলের নিচে ঝাঁপ দিয়া একজন মানুষ মারা গেছে। সে এখন কাক ভূত হইছে। ডাস্টবিনের কাক। ভূত কাকেরা দুনিয়ার সব খারাপ আর পচা জিনিস খায়। কখনো খাবার না পাইলে গুও খায়।

-কাক ভূত কেন হইল?

আবুল হোসেন টেবিলের ওপর থেকে মগে পানি ঢেলে খায়।

পঞ্ছর বলল, যারা নিজেরা ইচ্ছা কইরা মারা যায়। ছাদের উপর থাইক্যা পইড়া মরে। গাড়ির নিচে, রেলের নিচে, পানিতে ঝাঁপাইয়া পইড়া মরে, তারা কাক ভূত হয়।

এই যে এখানে আমাদের মালী ভজা দা আছে। চাকরি করে আর চুরি করে ভাত খায় যখন খুশি। ভূত হইয়া তার নাম হইছে পান্তা ভূত।

-ভূতেরাও কি চাকরি করে?

অবাক হয়ে বলল আবুল হোসেন।

-অনেক করে।

বলেই পঞ্ছর টেবিলের ওপর উঠে দাঁড়ায়। বলে, ভজা দা ভাত ছাড়া আর কিছু খাইতে পছন্দ করতো না। ভাতের সঙ্গে কিছু হইলেই চলতো। কখনো শুধু লবণ হইলেও সে খেয়ে খুশি হইতো। মরার সময় সে ভাতের জন্য কান্না করতেছিল।

-কান্না করতে করতে করতেই সে মারা গেছিল?

-হুম। কিন্তু গলায় আর পেটে কি একটা অসুখ হইছিল। সেই অসুখের জন্য সে খাইতে পারতো না। তাই মরার সময় ভাতের জন্য কান্না করতেছিল। কান্না করতে করতে মারা গেলে তার হওয়া উচিত ছিল গাড়ি, ইস্টিমার নয়তো লঞ্চের ভেঁপু ভূত। কেউ কেউ এইটারে হর্নও কয়।

-কান্না কইরা মরলেও খারাপ?

-হুম। কোনো কোনো হর্নের আওয়াজ দেখবা কান্নার মতন শোনা যায়। শোনা যায় অনেক ব্যথায় কোঁকাইতাছে।

তাদের দেখেই যে লোকটা হেসে উঠেছিল, সে খাবার নিয়ে এলো অনেকগুলো। কিন্তু আবুল হোসেন সব খাবার খেতে পারে না। অল্প খেয়েই যেন তার পেট ভরে যায়। পানি খেয়ে বের হয়ে আসবার সময় সে ভয়ে ভয়ে তাকাচ্ছিল ম্যানেজারের দিকে। কিন্তু তাদের দিকে কেউ ফিরে তাকালো না।

বাইরে বের হয়ে আসতেই যেন আবুল হোসেনের ভয়টা কেটে গিয়েছিল পুরোপুরি। কিন্তু তার মনে হচ্ছিল খুব বেশি খাওয়া হয়ে গেছে। কোথাও বসে বিশ্রাম নিলে ভালো হতো। কিন্তু তার মন ছুটে গেছে বাড়িতে। অনেকক্ষণ হয় বাবা-মাকে দেখতে পায়নি।

পঞ্ছর বলল, তুমি বাড়ি চইলা যাও। প্রতি শনিবার আর আমাবস্যায় আমি মতির ঝিলে আসি। তারপর গারো পাহাড়ে গিয়া ঘুমাই।

তখনই একটি রেলগাড়ি কোথাও কুউউ করে ওঠে। পঞ্ছর বলল, আমি যাই। রেলগাড়ি আইলে আমার অনেক শীত লাগে। ঠাণ্ডায় অসুখ হইয়া যায়। আরেক শনিবারে আইসো। আমাদের রানীর কাছে নিয়া যাবো।

আবুল হোসেন চমকে উঠে বলল, ভূ্তের রানী, নাকি রানী ভূত?

তখনই ট্রেনটা চলে আসলে পঞ্ছর হঠাৎ হাওয়ায় মিশে যায়। তাই হয়তো কিছু বলবার সুযোগ পায় না। আবুল হোসেনের মন খারাপ হলেও আগামী শনিবার দেখা করতে পারবে ভেবে ততটা মন খারাপ তার থাকে না। পঞ্ছরকে তার খুব পছন্দ হয়ে গেছে। যদি এমন একটা ভাই থাকতো তার তাহলে আরো বেশি মজা হতো।

আবুল হোসেন ভরা পেটে আস্তে আস্তে হাঁটছিল আর মনে মনে ভাবছিল, আর কখনোই বাবা-মার সঙ্গে রাগ করবে না। অমান্য করবে না তাদের কোনো কথা। বাবা-মাকে দেখার জন্য তার ইচ্ছে হচ্ছিল এক দৌড়ে বাড়ি চলে যায়। কিন্তু একটু জোরে হাঁটতে চেষ্টা করলেও তার পেট ব্যথা করছিল। তাই আস্তে আস্তেই তাকে পথ চলতে হয়।
(সমাপ্ত)

(সুমাইয়া বরকতউল্লাহ ভয় দেখিয়েছেন যে, ছোটদের জন্য না লিখলে আমার সঙ্গে তার আড়ি। ছোটদের ভীষণ ভয় পাই আমি। কিন্তু লেখাটা আবারও বড় হয়ে গেল।)

সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে আগস্ট, ২০১৪ বিকাল ৪:৫২
১৮টি মন্তব্য ১৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাম গাছ (জামুন কা পেড়)

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ০৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:০৩

মূল: কৃষণ চন্দর
অনুবাদ: কাজী সায়েমুজ্জামান

গত রাতে ভয়াবহ ঝড় হয়েছে। সেই ঝড়ে সচিবালয়ের লনে একটি জাম গাছ পড়ে গেছে। সকালে মালী দেখলো এক লোক গাছের নিচে চাপা পড়ে আছে।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনির্বাণ শিখা

লিখেছেন নীলসাধু, ০৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



রাত ন’টার মত বাজে। আমি কি যেন লিখছি হঠাৎ আমার মেজো মেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলল, বাবা একজন খুব বিখ্যাত মানুষ তোমাকে টেলিফোন করেছেন।

আমি দেখলাম আমার মেয়ের মুখ উত্তেজনায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

=ইয়াম্মি খুব টেস্ট=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:১৪



©কাজী ফাতেমা ছবি
সবুজ আমের কুচি কুচি
কাঁচা লংকা সাথে
ঝালে ঝুলে, সাথে চিনি
কচলে নরম হাতে....

মিষ্টি ঝালের সংমিশ্রনে
ভর্তা কি কয় তারে!
খেলে পরে একবার, খেতে
ইচ্ছে বারে বারে।

ভর্তার আস্বাদ লাগলো জিভে
ইয়াম্মি খুব টেস্ট
গ্রীষ্মের... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিরোনামহীন দুটি গল্প

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৫৫

গল্প ১।
এখন আর দুপুরে দামী হোটেলে খাই না, দাম এবং খাদ্যমানের জন্য। মোটামুটি এক/দেড়শ টাকা প্লাস বয়দের কিছু টিপস (এটা আমার জন্য ফিক্সড হয়েছে ১০টাকা, ঈদ চাদে বেশি হয়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

এশিয়ান র‍্যাংকিং এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান !!

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:২০

যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী 'টাইমস হায়ার এডুকেশন' ২০২৪ সালে এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে। এশিয়ার সেরা ৩০০ তালিকায় নেই দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়।তালিকায় ভারতের ৪০, পাকিস্তানের ১২টি, মালয়েশিয়ার ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×