নীনাকে দেখতে ইচ্ছে করছে ভীষণ। মাঝে মাঝে কোন কারণ ছাড়াই বিশেষ কোন ব্যক্তিকে দেখতে ইচ্ছে করে। খুব জটিল কোন রোগে ধরলে এমনটা হয়। মন আলগা হয়ে যায়, একটা ছটফটানি ভাব চলে আসে। পৃথিবী ছাড়ার আগে পরিচিত মুখ গুলোকে আরেকবার দেখতে ইচ্ছে করে। কে জানে ওপারে গিয়ে যদি আর দেখা না হয়!
নীনা! সেই পাথুরিয়া গ্রামের নীনা। ভুল করে একটা মিসড কল এসেছিলো। আমার তখন নতুন মোবাইল। একটা মিসড কল কিংবা এসএমএস এর শব্দে রোমাঞ্চিত হবার সময়। একটির বদলে পরপর তিনটি মিসডকল দিয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিশোধ নিয়েছিলাম। শুরুটা সেদিন থেকেই হয়েছিলো।
নীনা ক্ষেপেছিলো ভীষণ। - ‘কোন ভদ্র মানুষ এভাবে মিসডকল দেয়?’
আমি টেক্সটের রিপ্লাই না দিয়ে পরপর আরো তিনটি মিসডকল দিয়েছিলাম! যথারীতি ঝাঁঝালো প্রতিক্রিয়া ছিলো। আমি এটাই চেয়েছিলাম। বলেছিলাম –
‘কোন ভদ্র মানুষের ভাষা এমন হয় ?’
তারপর সরাসরি ফোন করেছিলো নীনা।
মিসড কল থেকে এসএমএস, এসএমএস থেকে ফোনকল অতঃপর ইতিহাস!
নীনার তখন নিজস্ব মোবাইল ছিলো না। বাবার মোবাইলে লুকিয়ে সিম উঠিয়ে আমাকে টেক্সট করতো। আমিও এসএমএস পাঠিয়ে ডেলিভারি রিপোর্টের জন্য রাতভর অপেক্ষা করতাম। এসএমএস টা গেছে তো?
শুরুর দিক সব উদ্ভট আজগুবি খেজুরে আলাপ হতো। কোন আগা মাথা নেই। এসএমএস আসছে, এসএমএস যাচ্ছে এটাই ছিলো মূখ্য বিষয়।
মাসখানেকের মধ্যে ভার্চুয়াল সম্পর্কটা আরেকটু গভীর হলো। প্রতিদিনের ভালোলাগা-খারাপ লাগার খবর গুলো বিপ্ বিপ্ শব্দ করে আসতে শুরু করলো। একদিন আমি খবর না নিলেই পর পর দুই দিন টেক্সট এর রিপ্লাই করতো না নীনা। আমি অবশ্য ব্যতিক্রম ছিলাম। রিপ্লাই দেবো না দেবোনা করেও দুই মিনিটের মধ্যেই দিয়ে দিতাম!
এসব সেই সত্য যুগের কথাবার্তা। তারপর জল গড়াতেই থাকলো। নীনা মেডিকেল কলেজে চান্স পেলো আর আমি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয় মানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে তো ছিলামই। একদিন বিপুল পরিমাণ সাহস সঞ্চয় করে চুপিচুপি নীনার কলেজে গিয়ে উপস্থিত হলাম। অনেক তো লুকোচুরি হলো। এবার দেখা করলে ক্ষতি কি?
আমার ফোন পেয়ে নীনার তো ত্রাহী অবস্থা! ‘তুমি এখানে কেনো আসছো?? কেউ দেখে ফেললে আমার জীবন শেষ! না বাবা, আমি দেখা করতে পারবো না!’
নীনাকে মিথ্যে বললাম। ‘হা হা হা! ভয় পাইছো!! আমি আসছি তোমাকে কে বললো? তোমার কলেজ কি আমার বাসার পাশে যে হেঁটে হেঁটে চলে আসবো? আজব!’
তারপর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলো নীনা।
মেডিকেল কলেজে ভর্তির কয়েকমাস পর্যন্ত ভালই ছিলো। তারপর থেকে নীনা যেন কেমন হয়ে গেলো। টেক্সট দিলে দু’ ঘন্টা পর রিপ্লাই করে, ফোন দিলে তো রিসিভই করেনা! কখনো বন্ধুদের সাথে আড্ডার অযুহাত কখনো বা পড়াশুনার। নিজ থেকে খবর নেয়া তো প্রায় বন্ধ করেই দিলো। আমি অভ্যস্ত হতে থাকলাম। একজন মেডিকেল ছাত্রী আর ন্যাশনাল ভার্সিটির ছাত্রের মাঝের ব্যবধান টা মেনে নিতে থাকলাম ধীরে ধীরে।
সম্পর্কটা হাই-হ্যালোময় সামাজিক সম্পর্ক হয়ে গেলো। একঘেয়ে, প্রাণহীন, ম্যাড়ম্যাড়ে সম্পর্ক।
একমাস খবর না নিলেও নীনা আর অভিমান করেনা। অনেক দিন পর ফোন দিলে ব্যস্ততার কণ্ঠে নীনা বলে, - ‘কিছু বলবা?’
আমার অভিমান গুলো তীব্রতা হারাতে থাকে। সময় বাড়ার সাথে সাথে ক্ষয়ে যায়। একপাক্ষিক গুরুত্বহীন অভিমানটা নিজের কাছেই বড় হাস্যকর মনে হয়। পৃথিবীতে অভিমান ছাড়াও অনেক কাজ করার আছে মানুষের।
একদিন নীনাকে জিজ্ঞেস করেই বসলাম – ‘এমন কেনো হলো নীনা?’
নীনা আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেয় এটা বাচ্চামির বয়স না। আমরা বড় হয়ে গেছি! এখন আমাদের বড়দের মতো চলতে হবে!
দূরত্ব বাড়তে থাকে। স্বীয় জগতে লীন হয়ে যায় নীনা। আমি সরে আসি অলিখিত অধিকারের অনধিকার চর্চা থেকে। পরাজিত সৈনিকের মতো একদিন মোবাইল নাম্বারের পরিচয়টাও বদলে ফেলি। তারপর জল অনেকদূর গড়িয়েছে। গড়াতে গড়াতে একসময় শুকে গেছে। নীনা হয়তো টেরই পায়নি ব্যাপার টা!
আজ আট বছর পর সেই অদেখা নীনাকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে । নীনা হয়তো এতদিনে প্র্যাকটিস শুরু করে দিয়েছে। টুকটাক নাম ডাকো হয়তো হয়েছে ওর। শুনেছি ডাক্তারদের নাকি আবেগহীন হতে হয়। পাথুরিয়া গ্রামের আবেগী নীনাও কি আবেগহীন পাথর হয়ে গেছে?
আমার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে গেছে নীনা এ হসপিটালেই আছে। শুধু আমার চোখেই ধরা দিচ্ছে না।
একটা কোমল হাত আলতো করে আমার হাত চেপে ধরে। এটা নিশ্চয় নীনার হাত! নীনাকে দেখার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করি। কে যেন ষড়যন্ত্র করে আমার চোখের উপর কয়েকটনি ওজনের বোঝা চাপিয়ে দেয়। বারবার আমি ব্যর্থ হই। চারদিকে অন্ধকার দেখি! নিকষ-কালো-ঘুটঘুটে অন্ধকার!
কোমল হাতটা আমার হাত ছেঁড়ে দেয়। একটা নিরুত্তাপ কণ্ঠ কানে এসে বিঁধে- ‘মালেক ভাই, লাশটা দ্রুত হিমঘরে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন!’
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনতে থাকি! এ যে আমার নীনার কণ্ঠ!
ছবি-ইন্টারনেট
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জুন, ২০১৬ বিকাল ৫:৪০