পড়ন্ত দুপুর। সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে গেছে। সেন্টুর দোকানে বসে চায়ের ফরমাশ দিয়ে আয়েশ করে সিগারেট ধরাচ্ছি এমন সময় পেছন থেকে শুনলাম ''ফাঁস নিছে!'' কান খাঁড়া করে ফেললাম।
- বাইল্যাদিঘী গেরামে ইদ্রিসের বউ ফাঁস লইসে।
- হাছাই? ফাঁস লইসে ক্যারে?
- কইবার পারতাম না। বটগাছের লগে লাশ ঝুলতাছে।
এবার নিজেই সেধে জিজ্ঞেস করলাম কতক্ষণ আগের ঘটনা এটা?
- আধাঘন্টা হইব। আমার শালায় বাইল্যাদিঘী থাকে। ফোন দিয়া জানাইছে!
খবর কত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। বাঁধের ওপারের খবর তারাবোতে পৌছানোর দূরত্ব মা্ত্র একটা মোবাইল কল। যত্তসব!!
আচমকা মাথায় বাজ পড়লো! ''লাশ এখনও ঝুলছে''!! ফাঁসির দড়িতে ঝোলা লাশ আমি কখনও দেখিনাই। তারমানে এখনও সময় আছে। লাশ দেখার কৌতুহল এমন তীব্র হয়ে উঠলো যে, তখনই রওনা দিলাম।
বালিদিঘী গ্রামে যাওয়া বেশ ঝামেলার ব্যাপার। প্রথমত গ্রামটা আমি চিনিনা। দ্বিতীয় সমস্যা বাঁধের উপর দিয়ে যেতে হবে। বাঁধের রাস্তা ভাঙ্গাচোড়া। রিক্শা চলেনা। হেঁটে যাওয়া ছাড়া গতি নাই। অবশ্য এত সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামালে বেঁচে থাকা অসম্ভব। আমারও গলায় দড়ি দিতে হবে তাই চিন্তাভাবনা বাদ! হাঁটা দিলাম। লোকজনকে পথঘাট জিজ্ঞেস করে বাঁধের উপর মিনিট বিশেক হাঁটার পর বালিদিঘীর দেখা মিলল।
ঘটনাস্থল গ্রামের একেবারে শেষ প্রান্তে। বিরাট জটলা বেঁধে আছে। বাচ্চা থেকে শুরু করে বৃদ্ধ পর্যন্ত সবাই হাজির। হুলুস্থুল অবস্থা!
আমি অবশ্য লাশের বদলে ফাঁসির গাছ দেখে বিষ্মিত হয়ে গেলাম। গ্রাম থেকে কিছুটা দুরে শান্ত দিঘীর পাড়ে প্রকান্ড বটবৃক্ষ। কমপক্ষে দু-তিনশ বছরের পুরানো হবে। গা ছমছমে পরিবেশ। বিরাট ডালপালা আর শেকড়ে চারপাশ ছেয়ে আছে। একদিক ডুবে আছে দিঘীর পানিতে। গাছের মাঝখানে দড়িতে ঝুলছে গাঢ় সবুজ শাড়ি পরা এক মহিলা। বেকায়দা ভাবে ঘাড় বেঁকে আছে। জিভ বের হয়ে গেছে। মুখে রক্তের দাগ। বিভৎস দৃশ্য। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা সম্ভব না।
পাঠক!! একটা ব্যাপার কখনও খেয়াল করেছেন? দিঘী সম্পর্কে সবজায়গার মানুষের মধ্যে একধরনের ভয়-ভীতি কাজ করে। দিঘী নিয়ে লোকজন নানা ধরনের ভুত-প্রেতের গল্প ফাঁদতে পছন্দ করে। এখানেও তার ব্যাতিক্রম না। আশেপাশের টুকটাক কথাবার্তা কানে গেল। কয়েকমাস আগে কে বা কারা এই দিঘীতে এক মহিলাকে মেরে ফেলে রেখে যায়। পরবর্তীতে মহিলার পচে ফুলে ওঠা ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করা হয়। লাশ সনাক্ত করতে বেশ ভোগান্তি পোহাতে হয়েছিল কারন ভিক্টিমের শরীরের বেশ কিছু অংশ মাছ খেয়ে ফেলে। তারপর থেকে তার প্রেতাত্মা নিশি রাতে দিঘীর চারপাশ ঘুরে বেড়ায়। মাঝে মাঝে লোকজন মেয়ে মানুষের চিৎকার আর কান্নাকাটির শব্দ শুনতে পায়। মনে মনে বললাম, আজকের পর মহিলাকে সঙ্গ দিতে আরো একজন যোগ হল।
খবর সংগ্রহের উদ্দেশ্যে স্থানীয় এক লোকের সাথে আলাপ জমানোর চেষ্টা করলাম।
- ঘটনা কি?
- ফাঁস লইসে।
- সেইটাতো বুঝলাম। কিজন্য ফাঁস নিসে?
- ইবলিসে ফুসলাইসে। দড়ি লইয়্যা লটকি দিসে!!
- লাশ নামাইতেসেন না ক্যান?
- পুলিশ আইয়্যা নামাইবো। ঠোলার পুতেরা ট্যাকা খাইবো না!!
হাল ছেড়ে দিলাম। এই লোকের সাথে আলাপ করার চেষ্টা করাও বৃথা! লাশ দেখার ছিল দেখা শেষ। অযথা সময় নষ্ট করে লাভ নাই। লাশ 'লটকি' দিয়ে রইল আমি ফিরতি পথে হাঁটা দিলাম।
তারাবো ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। বাঁধ থেকে নামতেই মুখোমুখি পড়ে গেলাম বন্ধু আলি হোসেন আর সবুজের। দুজনেই চরম উত্তেজিত।
- বাইল্যাদিঘী গেসিলি?
- হু।
- লাশ এখনও ঝুলতেসে?
- হাঁ।
ব্যাস! তাদের এখন লাশ দেখতে হবে। ভালো কথা, যাও দেখতে! কে মানা করে? না, তারা দুইজন একা যাবেনা। আমাকেও যেতে হবে তাদের সঙ্গে!
আমি কঠিনভাবে মানা করে দিলাম। লাশ দেখে আমি এইমাত্র ফেরত আসলাম। লম্বাপথ হাঁটা দিয়েছি। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত। কিসের কি! অসম্ভব জোরাজুরি করতে লাগলো। ইমোশোনাল ব্ল্যাকমেইল! বন্ধুত্বের কসম ইত্যাদি ইত্যাদি!! শেষে অতিষ্ট হয়ে সম্মতি দিলাম।
মাগরিবের ওয়াক্তে আবার হাঁটা দিলাম বাঁধের উপর দিয়ে বটতলা। সন্ধ্যাতারা ততক্ষণে জেগে উঠেছে। পশ্চিমের রক্তাক্ত আকাশকে ক্রমশ গিলে ফেলছে জমাট বাঁধা অন্ধকার।
গ্রামে ঢুকে লোডশেডিং এর মধ্যে পড়লাম। ঘরবাড়ির জানালা দিয়ে মোমবাতির হলদেটে আলো আসছে। সুর করে পড়া মুখস্ত করছে শিক্ষার্থীরা। লাশের বাড়ি থেকে থেমে থেমে শোনা যাচ্ছে মহিলাদের বিলাপ। দুর থেকে ভেসে আসছে কোরআনের ধ্বনি। আগরবাতি আর ধূপের গন্ধ বাতাসে। অদ্ভুত ঘোরলাগা পরিবেশ।
হাঁটতে হাঁটতে দিঘীর কাছাকাছি চলে আসলাম। জায়গাটা এখন একেবারে নির্জন। লোকজন সরে গেছে। পুলিশ আসলে দ্বিতীয় দফায় নাটক পর্ব শুরু হবে। তার আগে ক্ষনিকের বিশ্রাম।
হঠাৎ টর্চের আলো পড়লো আমাদের উপর।
- ক্যাডা?
হুমম.. পাহারায় একজন আছে দেখা যাচ্ছে!! গাছের একটু সামনে অন্ধকারে টুলে বসে গঞ্জিকা সেবন করছে লাশের প্রহরী। গাঁজার গন্ধে সুবাসিত চারিপাশ!
- জ্বী, তারাবো থেকে দু:সংবাদ পেয়ে দেখতে এসেছি।
বিকট শব্দে কাশি দিয়ে একদলা থুতু আমাদের পায়ের সামনে ফেললো পাহারাদার। তারপর আবার গাঁজা টানায় ব্যস্ত। ভদ্রলোককে বিরক্ত না করে সামনে হাঁটা দিলাম।
গাছতলার ঘুটঘুটা অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আলি হোসেন বিড়বিড় করে উঠলো, 'ইশ!! টর্চ নিয়া আসা উচিৎ ছিল রে!! বিরাট ভুল কইরা ফালাইলাম!' আমার বিরক্তি ততক্ষনে চরমে পৌছেছে। ফকিন্নির পুত! ফুটানি মারার টাইমে একনম্বর। কামের বেলায় ঠনঠনা!
- সময় থাকতে মনে করলিনা কেন? ছাগল!!
গাছতলায় দাঁড়ানোর সাথে সাথে অশুভ একটা অনুভূতি গ্রাস করে নিলো আমাকে। চারিদিক শুনশান। এক ঝলকের মৃদু বাতাস খসখসে শব্দ তুললো। আবার সব চুপচাপ। নিস্তব্ধতা আর অন্ধকারে স্নায়ূর উপর ভয়ানক চাপ দিচ্ছে। মনে হচ্ছে ভয়াল সব প্রেতাত্মারা ঘাপটি মেরে আছে অন্ধকারে। দড়িতে ঝোলানো লাশ বিদ্রুপের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। যে কোন মূহুর্তে ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুত। প্রচন্ড আক্রোশে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। গা কাঁটা দিয়ে উঠলো।
আচমকা রাত্রির নিস্তব্ধতা চৌচির করে লাশটা ভয়ানক জোরে চিৎকার দিয়ে উঠলো। পাশে দাঁড়ানো আলি হোসেন কাটা কলাগাছের মত দড়াম করে ফিট লেগে পড়ে গেল। দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে পড়িমড়ি করে ছুট লাগালো সবুজ। আর আমি.. দাঁড়িয়ে রইলাম। দৌড় লাগানোর শক্তিটুকুও শেষ হয়ে গেছে। মনে হলো দুই পা মাটির সাথে পেরেক দিয়ে আটকে দেয়া। আতঙ্কে হাঁপানি উঠে গেল। হাপরের মত ওঠানামা করতে লাগলো বুক। যে কোন সময় হৃৎপিন্ড ফেটে বের হয়ে আসবে।
- হুরররর.... হুশ!! যা ভাগ!!
গাঁজাখোর পাহারাদার টর্চ হাতে ছুটে আসছে। টর্চ মারলো লাশের গায়ে। আবার শোনা গেল সেই পৈশাচিক চিৎকার। সমস্ত পৃথিবী টলছে। যে কোন মূহুর্তে অজ্ঞান হয়ে যাব।
- লাইথ্যায়া মাজা ভাইঙ্গা দিমু কইলাম!! গাছ থেইক্যা নাম!!
মনের সবটুকু জোর একত্র করে লাইটের আলো অনুসরন করলাম। শতছিন্ন কাপড়ে ফাঁসির ডালে পা ঝুলিয়ে বসে আছে এক পাগলী!! চোখে আলো পড়ায় আবারও চিৎকার দিয়ে উঠলো! সেই ভয়াল চিৎকার!
দড়িতে ঝোলানো লাশ তখনও জিভ বের করে ভেংচি কাটছে আমাদের।
______________________
পরিশেষ:- গত বছরের ফেব্রুয়ারীতে বন্ধুরা মিলে বেড়াতে গিয়েছিলাম তারেকের নানাবাড়ী শ্রীমঙ্গল। চা বাগানের পাশে বিরাট বাংলো। একদম খালি। অত্যন্ত আনন্দময় একটা ট্যুর হয়েছিল সেবার আমাদের। ঢাকায় ফেরত আসার আগের দিন গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডা দেই। স্বাভাবিকভাবেই রাত যত গভীর হয় ভূতের আড্ডা ততোটাই জমে উঠে। সেসময় রাব্বির কাছ থেকে তার এই অদ্ভুত অভিজ্ঞতার ঘটনা জানতে পারি।
গ্রাম এবং চরিত্রের নাম বাদে বাকি ঘটনা সত্য।