somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হ্যামিলনের গুজবওয়ালা এবং আমাদের স্বকীয়তা।

২৪ শে জুলাই, ২০১৯ রাত ৮:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


'নিরিক' শব্দটা শুনেননি এমন মানুষ বোধয় খুব কমই পাওয়া যাবে আমাদের আশেপাশে। আচ্ছা এটি কি খাটি বাংলা শব্দ? নাকি বিদেশি, তদ্ভব, সংস্কৃত? সে যাই হোকনা কেন, আমাদের সংস্কৃতির সাথে কিন্তু এই শব্দের খুব নিবিড় সম্পর্ক সেই প্রাচীনকাল থেকেই। বিয়ে বাড়ির দাওয়াত থেকে শুরু করে সুন্নতে খতনা পর্যন্ত যাই বলুননা কেন, নিরিক বলে চেঁচিয়ে উঠা লোক থাকবেনা এটা অসম্ভব। সাধারনত দাওয়াত খেতে গিয়ে যিনি বা যারা গরুর গোসত (কখনও অন্য কোনো গোসতও হতে পারে) খেতে চান না তারাই নিরিক বলে ওয়েটার বা শাহীদারিতে থাকা লোকদের ডাক দেন। এই নিরিকেরও আবার শ্রেনীবিন্যাস করলে এদেরকে সর্বনিম্ন দু'ভাগে ভাগ করা যায়। ১. যারা সত্যি সত্যি কোন শারিরীক সমস্যার কারনে গরুর গোসত খেতে চান না। ২. যাদের কোন শারিরীক সমস্যা নাই কিন্তু তবুও হুদাই নিরিক বলে চিল্লাবে। ২য় শ্রেণীর লোকেরা নিরিক বললেও এরা গরু খাসি, মুরগি সবই খায়। কিন্তু তবুও দাওয়াতে গিয়ে এদের বিসমিল্লাহ বলার আগে নিরিক শব্দটা না বললেই নয়। কারন ওনারা আপনার আমার মত সাধারন কেউ না। উনারা সবসময়ই চায় যেন অন্যদের চাইতে কিভাবে একটু ডিফারেন্ট থাকা যায়। আর সে চেষ্টা বাস্তবায়নের জন্যেই এই ক্ষুদ্র প্রয়াস।

এবার একটু ভিন্ন একটা টপিক নিয়ে কথা বলি। আমরা যখন অনেক ছোট ছিলাম, আইমিন সেই পিচ্চিকালের কথা বলছি। তখন আমাদের সবার মাঝে একটা প্রবনতা ছিল। আমরা কেউই চাইতাম না আমাদের কোন কিছু অন্য কারও সাথে যেন হুবহু মিলে না যায়। জামা, খেলনা, জুতা, ফিতা যাই হোকনা কেন আমরা সবকিছু চাইতাম ইউনিক। কখনও যদি এমন হল যে নিজের একটা কিছু অন্যের সাথে মিলে গেল তাহলেই মনটা খারাপ হত। আর পিচ্ছিকালের মন খারাপ মানে তো কানে হেডফোন গুজে আরিজিত সিং এর গান শুনা নয়। ভ্যা ভ্যা করে কান্না করে দিতাম। (আমার খেলনার মত কেন ওর খেলনা হল! আর খেলতাম না!)
উপরের নিরিক আর পিচ্চিকালের গল্পদুটোর মধ্যে কি কোন মিল খুঁজে পেয়েছেন? মোরাল অব দ্যা স্টোরি কিন্তু একটা আছে! এখানে ছোটকালের পিচ্চি আর বড়কালের নিরিক উভয়ই অন্যদের চাইতে একটু ডিফারেন্ট থাকতে চাইছে। এবং এটাই হচ্ছে মানুষের কতগুলো সহজাত প্রকৃতির মধ্যে একটি। সে তার পছন্দ ও ইচ্ছা অনুযায়ী তার চাওয়া ও আকাঙ্ক্ষাগুলো প্রকাশ করবে। সেকারনেই জমজ ভাই বোনেরও একেক জনের একেক রকম ইচ্ছা ও অভিব্যক্তি থাকতে দেখা যায়।
কিন্তু আমার মনেহয় দিনদিন আমরা আমাদের স্ব-স্ব ইচ্ছা পোষন ও সেটা প্রকাশে অধিকাংশরাই সফল না। আমাদের সাথে থাকা ২য় কিংবা ৩য় ব্যাক্তিটি আমাদের চিন্তার উপর ব্যপক প্রভাব বিস্তার করছে। এই প্রভাব এতটাই শক্তিশালী হচ্ছে যে প্রায়শই আমাদের সবল কোন মতামতও অপরপক্ষের প্রভাবে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে, অথবা সেটা মোড় নিচ্ছে সম্পূর্ণ ভিন্ন কোন দিকে। অর্থাৎ আমরা আমাদের সঠিক অভিব্যক্তি প্রকাশ না করে প্রকাশিত করছি প্রভাবিত অভিব্যক্তি।
এরকমটা ঘটার পেছনে বর্তমানে অন্যতম কারন হচ্ছে সোশাল মিডিয়া। কিংবা আরও সহজ করে বলতে গেলে ফেসবুক। অতীতে যেখানে একটা ছোটখাটো খবরের রেশও থেকে যেত অনেকদিন, সেখানে বর্তমানে বড় বড় গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলোও দুদিন না যেতেই মানুষ ভুলে যাচ্ছে। কারন আগের খবরের চাইতে রসালো খবরে নিউজফিড প্রতিনিয়তই আপডেট হচ্ছেই। একটার পর একটা খবর কিংবা ঘটনা ভাইরাল হচ্ছে। আর এসব ভাইরাল করছি আমরাই। কারন আমরা আমাদের নিজস্ব স্বকীয়তা দিনদিন হারিয়ে ফেলছি। একটা লিখা, ছবি, কিংবা ভিডিও দেখামাত্র সেটা ভালভাবে যাচাই তো দূরে থাক, অনেক সময় পুরো লিখা না পড়ে, পুরো ভিডিও না দেখেই শেয়ার করে দেয়া মানুষের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। যাচাই শব্দটা বলা যাবে যদি ব্যক্তিটি সেই বিষয়ে আগ্রহ বোধ করেন। কিন্তু বিন্দুমাত্র আগ্রহ না থাকার পরও শুধুমাত্র লোহমোর্ষ, চাঞ্চল্যকর ভেবে, কিছু না ভেবেচিন্তেই একটা খবর হুট করে আমরা নিজেদের টাইমলাইনে ছেড়ে দিচ্ছি। আর সেটা মুহূর্তেই ভাইরাল হচ্ছে। এখানে শুধু একজন সিঙ্গেল মানুষকে দোষ দিলেও ভুল হবে। সংবাদপত্রের পেইজ গুলো থেকেও যখন প্রতিনিয়ত অপ্রাসঙ্গিক, অপ্রয়োজনীয় ও অপেশাদারি পোস্ট দেখি তখন সত্যিই খারাপ লাগে। আমাদের দেশের বর্তমান সার্বিক পরিস্থিতির জন্যে আমরা নিজেরাও কম দায়ী না! আমাদের নিজস্বতা বলতে আজ কিছু নেই। একটা কিছু পেলেই হল। ওমনি ওটাকে টিপে, চিপে, ফুলিয়ে, তেতো করা না পর্যন্ত আমাদের ক্ষান্ত নেই। ছেলে মেয়ে আবাল বৃদ্ধ প্রায় সবার মাঝেই আমি এই প্রবনতা লক্ষ্য করেছি। আর কোন একটা বিষয়ে সোশাল মিডিয়ায় যখন ওরা মন্তব্য প্রকাশ করে, তখন প্রায় সকল মন্তব্য একই ধরনের হয়। যেন মন্তব্যের ঘরে হ্যামিলনের বাশিওয়ালা এসেছিল, আর সবাই সেই বাসির সুরের পেছনেই দৌড়িয়েছে। আমি এমনও দেখেছি (উউদাহরণ) যে কেউ একজন প্রশ্ন করল দ্রুত সময়ে ওজন কমাতে চাই, কি করনীয়। এর মাঝে একজন মন্তব্য করেছে বেশি বেশি ব্যায়াম করুন। আরেকজন লিখল, বেশি বেশি ব্যায়াম করুন (১) আরেকজন বেশি বেশি ব্যায়াম করুন (২) এভাবে সিরিয়াল কখনও কখনও ১০ এরও অধিক হয়ে যায়। ভাবাযায় আমাদের আচরণ কতটা শিশুসুলভে পরিনত হচ্ছে দিনকে দিন? অথচ এখানে মন্তব্যকারী একটু ভেবে চিন্তে অন্যদের চেয়ে আলাদা তার নিজস্ব একটা মতামত প্রকাশ করতে পারতেন। হাটে ঘাটে গনপিটুনিগুলিতেও আমাদের নিজস্ব অভিব্যক্তি আমরা প্রকাশ করতে পারছিনা। আমরা কেবল হ্যামিলনের বাশিওয়ালার পেছনেই পরে থাকি। আর হই হই করে উঠি। নিজের মনের কথা এখন আর আমরা মুখ ফুটে বলিনা। কেউ প্রথমে একটা কথা বলে দিলেই হল। ওটা কি মানব, নাকি তার প্রতিবাদ করে নিজস্ব মতামত দিব সেই সময় আমাদের আজ নেই।
কিন্তু ভাবতে অবাক লাগে, আমরাই সবাই ছোট থাকতে নিজেকে ইউনিক রাখতে চাইতাম সবসময়। দাওয়াতে গিয়ে নিরিক নিরিক বলে চিল্লাতাম। আবার খাবার বেলায় সব খেয়ে সাবাড় করে দিতাম। ঠিক এই সময়ে আমাদের নিরিক বাছাই করে চলাফেরাটা সত্যিই খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। নইলে হ্যামিলনের নষ্ট বাশির সুর আমাদের নিয়ে নিক্ষিপ্ত করবে এক অন্ধকার আইয়ামে জাহিলিয়াতের জগতে!
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জুলাই, ২০১৯ রাত ৮:৫৯
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×