বাংলা গদ্যের সাম্প্রতিক পাঠ নিতে গিয়ে আমি মূলত সমাজবিজ্ঞানী বিনয় ঘোষ, গবেষক গোলাম মুরশিদ, কবি ফরহাদ মজহার এবং স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের সাথে বোঝপড়া করার ইচ্ছে রাখি।
রবীন্দ্রনাথ যে ভাষায় কথা বলতে শিখিয়েছেন তা নাকি এখন আমাদের মুখের বেড়ি হয়ে উঠেছে। বেরোবার পথও যেন তিনি রুদ্ধ করে দিয়েছেন। তার বিশাল ও অনতিক্রম্য মেধার ছায়ায় যারাই জিরোতে যান তাদের সবাই আর উঠে দাঁড়াতে পারেন না। সাহসী পর্যটকের পরিভ্রমন থমকে যায়। ফলে নতুন পথের সন্ধান লাভে তারা ব্যর্থ হয়। ফলত রবীন্দ্রনাথ আমাদের জন্য প্রকারান্তরে একটি বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। একজন রবীন্দ্র সমালোচকের এমন মন্তব্যের সাথে দ্বিমত পোষন করতে হলে আমাদের ঘাঁটতে হবে বাংলা গদ্যের নানান পথ ও মত। সেই মেধার জোর আমার আছে তা বলার সময় ও সাহস এখনো হয়নি। তবু জানবার প্রচন্ড লোভ হয় কেমন ছিল রবীন্দ্রনাথের ভাষা?
বাংলা গদ্যের উৎপত্তি প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ প্রচলিত জনপ্রিয় ধারণার বাইরে যাননি, অর্থাৎ বাংলা গদ্যের জন্ম বেনিয়াদের ফরমাশে এবং তাদের দোসর ছিলেন সংস্কৃত পণ্ডিতগণ। সোজা কথায় ঔপনিবেশিকতার ঔরসে এ গদ্যের জন্ম। মজার ব্যাপার হল কবি ফরহাদ মজহারও তার রবীন্দ্রপাঠের কোথাও এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে শক্তভাবে কলম ধরেন নি। বরং তার রবীন্দ্রপাঠের পুরোটাই এগিয়ে গেছে এই সারসত্যকে কেন্দ্র করে। বোঝা গেল রবীন্দ্রনাথ আমাদের জন্য কেন বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছেন!
ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা গদ্যের জন্ম হয়নি বরং সাহেব-সুবারা তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থে এফিডেভিট করে চারপাশের আকাশকে বাংলা গদ্যের আগমনী বার্তা জানিয়েছিলেন এমনটা ভাবতেই ভাল লাগে। ঔপনিবেশিক মানসিকতার ভূত যেভাবে আমাদের মগজকে অধিকার করে নিয়েছে এ ধরণের প্রি-অ্যাজামপশন যুগ যুগ ধরে সেই সত্যকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে বলে অনুমান করতে দোষ কী। বাংলা কাব্যের বয়স যদি হাজার বছরেরও বেশি হয় সেক্ষেত্রে বাংলা গদ্যের বয়স মাত্র দুশ বছর হয় কী করে! গবেষক গোলাম মুরশিদের ব্যাখ্যায় এর একটা কারণ হতে পারে মধ্যযুগের বংলা কাব্যের বহু নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। অথচ সে তুলনায় বাংলা গদ্যের ব্যাপক সংখ্যক নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়নি। মূলত বাংলা গদ্যের সূচনা ষোড়শ শতাব্দী থেকে হওয়া বিচিত্র নয়। ভাবপ্রকাশের বাহন হিসেবে এসব গদ্য যথেষ্ট উপযোগী হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। বাংলা গদ্য নিজের অবয়বটা মোটামুটি দাঁড় করায় অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে এমন মূল্যায়ন ছিল কোনো কোনো গবেষকের। অবশ্য সেকালের বাংলা গদ্যকে যথেষ্ট পরিমান আমলে নিতে ঐতিহাসিকদের খানিকটা কুন্ঠাও ছিল এবং সেটা বোধকরি প্রাপ্ত উপকরণ নিয়ে নিজেদের হীনমন্যতার কারণে। ধারণা করা হয় পুরনো গদ্যের সহজ ও আড়ম্বরহীন গঠন সত্ত্বেও ধারাবাহিক গদ্য অনুশীনলের নজিরের অপ্রতুলতা এর কারণ। যেসব নমুনা আমাদের হস্তগত হয়েছে তা যে কেবল দলিল দস্তাবেজ ও চিঠিপত্র তা নয়। এর সাথে যুক্ত হয়েছে বাংলা গদ্যে বৈষ্ণবদের অসামান্য অবদানও। এই সময়ে অন্যান্য গদ্যের সাথে বড় আকারের গদ্য চর্চা হয়েছে বৈষ্ণব ধর্মীয় সাহিত্যের মাধ্যমে। যাহোক সত্য এটাই যে উনিশ শতকের আগেকার বাংলা গদ্যের প্রাপ্ত নমুনা নেহায়েৎ সামান্য নয় এবং তা একথা প্রমাণ করতে যথেষ্ট যে বাংলা গদ্য ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে জন্ম নেওয়া কোনো জারজ সন্তান নয়। বাংলা গদ্যের শক্ত ও পেশিবহুল শরীরের ভিত্তি তৈরী হয়ে উঠছিল এই প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হবার অনেক আগেই। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ বাংলা গদ্যের গলায় বেড়ি পরানোর প্রথম পাঠশালা এতে কোনো সন্দেহ নেই। আবার এটাও সত্য যে বাংলা গদ্যকে প্রাতিষ্ঠানিক একটা রূপ দেবার প্রাথমিক ও দীর্ঘস্থায়ী উদ্যোগ হিসেবে এর গুরুত্বও কম নয়।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুলাই, ২০০৯ সন্ধ্যা ৭:২৯