ইংরেজদের হাতে বাংলা ভাষার ক্ষতিও কম কিছু হয়েছে কী? ক্ষতি যা হয়েছে তা বোধকরি রবীন্দ্রনাথ একা বোঝেন নি। তার আরো অনেক দোসর যে ছিলনা তা নয়। কিন্তু তারা পাদ-প্রদীপের আলোয় আসতে পারেন নি। রবীন্দ্রনাথের আলোয় তারা খানিকটা ম্লান ছিলেন হয়তবা। তির মধ্যে সবচেয়ে বড় তি যেটা হয়েছিল সেটা সম্ভবত সা¤প্রদায়িক জায়গা থেকে বাংলা ভাষাকে আলাদাভাবে বিবেচনা করা। বাংলা গদ্যে সংস্কৃত ভাষার জবরদস্তিমূলক প্রবেশের ফলে ভাষায় কৃত্রিমতা ঢুকে পড়ে এবং মুখের ভাষা থেকে দুরে সরে যায়। উপরন্তু বাংলা ভাষা হিন্দুয়ানি-মুসলমানি ব্রাকেটে আলাদা ও জগাখিচুড়ি এক ভাষায় পরিণত হবার শংকা তৈরী হয়। মুসলিম শাসনের অবসান হওয়ার পর পরই অপোকৃত শিতি শ্রেণীর হিন্দুরা ইংরেজ সাহেব ও ব্রাম্মণ পণ্ডিতদের আনুকূল্য পাওয়ার আশায় অজান্তে ঢুকে পড়া নানাবিধ মুসলমানি প্রভাবকে নিজেদের ভেতর থেকে মুছে ফেলার তাগিদ অনুভব করেন। এক ধরণের জাত্যাভিমান তাদের ভেতর বাসা বাঁধে। ভারতীয় প্রাচীন সংস্কৃতির প্রতি দরদ দেখাতে যেয়ে নিজেদের ভেতর এক ধরণের স্বজাত্যবোধ তৈরী করেন। ফলত মুসলমান শাসকদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ঝাড়তে যেয়ে তারা দেবভাষা সংস্কৃতকে বাংলা ভাষায় সমানে প্রবেশ করান এবং আরবী-ফারসি শব্দ সহ সকল মুসলমানি প্রভাবকে বাংলা ভাষা থেকে বের করে দেয়ার প্রয়াস পান। পরিণতিতে এই ভাষার উপর বদ জিনের আছর জিইয়ে রইল শত শত বছর ধরে। ভাষার কোনো বিশুদ্ধবাদী নীতি যে থাকতে পারে না একথা প্রমাণ করতে সংস্কৃতায়ণ শুরু হবার পর আরো একশ বছর পর্যন্ত অপো করতে হয়।
গবেষক গোলাম মুরশিদের একটা উদ্ধৃতি বিবেচনা করা যায়:
... সংস্কৃতায়ণ শুরু হবার একশো বছরেরও পরে, সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং উল্টোমুখী আর একটা প্রক্রিয়ায় বাংলা ভাষা অতি-সংস্কৃতায়ণের পথ ত্যাগ করে পুনরায় মুখের ভাষার ওপর ভিত্তি করে রচিত একটি লিখিত রূপ গ্রহণ করে। প্রমথ চৌধুরীর সবুজপত্র প্রকাশের উদযোগ কিংবা রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাইজ-প্রাপ্তি এই প্রক্রিয়াকে সহজ এবং দ্রুত করেছিলো; কিন্তু তাঁরা পথিকৃতের ভূমিকা পালন না-করলেও, বাংলা ভাষা, হয়তো কিছুকাল দেরি করে, কৃত্রিম ‘সংস্কৃততা’ ত্যাগ করতো। ... (বাংলা গদ্যের রূপান্তর:ঔপনিবেশিক প্রভাবে সংস্কার ও সংস্কৃতায়ণ)
দেশীয় পণ্ডিতদের সহযোগিতায় বাংলা ভাষায় সংস্কৃত উপাদান ঢুকিয়ে প্রাকৃতজনের ভাষাকে বিশুদ্ধ করার ইংরেজ প্রচেষ্টার জবাব প্রায় এক শতাব্দী পর মুসলমানসামাজ আরো বেশি বিকৃতভাবে দেয়ার চেষ্টা করে। একই রকম সা¤প্রদায়িক চেতানায় উজ্জ্বীবিত হয়ে শিতি হয়ে ওঠা মুসলমান সমাজের একটা অংশ সংস্কৃত প্রভাবিত বাংলাকে শুধু নয়, আরো সাহসী হয়ে বাংলা ভাষাকেই অস্বীকার করার স্পর্ধা দেখাতে শুরু করে। নবাব আবদুল লতীফের মতো কোনো কোনো বাঙালি মুসলমান বুদ্ধিজীবী এই ধরণের ধারণাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন এবং উর্দু ভাষাকে নিজেদের মাতৃভাষা হিসেবে দাবি করেন। সন্দেহ নেই এর সবকিছুই বাংলা ভাষার অমসৃণ বিকাশের ফল। রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত এটাকেই বাংলা ভাষার ওরিজিনাল সিন বা আদি পাপ হিসেবে দেখেছেন।
গেল শতাব্দীর চল্লিশের দশকে মুসলমানদের জাত্যাভিমান কোনো অংশে না কমে বরং আরো খানিকটা গতি পায়। বাংলা ভাষায় আরবী ও ফারসি শব্দের প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই ঘরাণার সবচেয়ে আলোচিত কবি ফররুখ আহমদের নাম এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায়। দেশ বিভাগে এইসব ঘটনার প্রভাব যে তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল তার জলজ্যান্ত প্রমাণ হলো এদেশের অনেক প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদেরও দেশবিভাগের পে অবস্থান নেয়া। সংস্কৃতায়ণের প্রক্রিয়াটা কদর্যরূপে হাজির না থাকলে হয়ত পূর্ব বঙ্গের কৃষকপ্রজা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের মধ্যে পাকিস্তান নামের একটা অসঙ্গতিপূর্ণ মুসলমান রাষ্ট্রের তাগিদ অনুভব হত না। সা¤প্রদায়িক খায়েসকে চরিতার্থ করার রাজনৈতিক দুরভিসন্ধিও পাকিস্তানের হর্তাকর্তারা সফল করতে পারতেন না। যাদের অতি সংকীর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য শেষপর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের মতো একটা মানচিত্রকে বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি থেকে চিরতরে মুছে ফেলার ভয়ংকর প্রচেষ্টা শুরু করেছিলেন। যার মোকাবেলা করতে আবার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল আরেকটি অসা¤প্রদায়িক চেতনার সামষ্টিক শক্তির।
বাংলা ভাষার উপর রাষ্ট্রের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ সম্ভবত সংস্কৃতায়ণের যুগ থেকে শুরু এবং এই নিয়ন্ত্রণ সাহেবদের বিদায়ের পর নব্য পাকিস্তান রাষ্ট্র মারফত আরো বেশি নিপিড়নমূলক কায়দায় জারি থাকে।
কথা হচ্ছে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রটির চর্চিত ভাষাটি মানচিত্রের এত রদবদলের পর শেষপর্যন্ত নতুন কোনো অবয়ব নিতে পেরেছে কী? নাকি রাষ্ট্রের চর্চিত ভাষাটি আদৌ সাধারণ্যের প্রচলিত ভাষা নয়। রবীন্দ্রনাথের কথিত কলকাতার ভাষা বা কেন্দ্রের ভাষার মতো কিছু একটা! অথবা আমরা কি আবার সংস্কৃত পণ্ডিতদের সাথে গোস্বা করে ভাষা থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করবো তাবৎ হিন্দুয়ানি শব্দ? একই রকম ােভে জারিত হয়ে ছেটে ফেলব কি পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের লেজ হয়ে থাকার অভিশাপ স্বরূপ যেসব পাকিস্তানি শব্দ আমাদের ভাষায় আটকে পড়েছে সেগুলোও? এসব প্রশ্নের সহজ কোনো উত্তর নেই। যা খুব সহজে অনুমান করা যায় তা হল স্বাধীন রাষ্ট্রের ভাষা কখনো এই মারপ্যাঁচের ভেতর আটকা পড়ে না। একটা সৃষ্টিশীল চেতনা নিয়ে নতুন রাষ্ট্রের ভাষা নতুন করে সবকিছু শুরু করে। তার ভেতর জারিত হতে থাকে অখন্ড বিশ্বের মানচিত্র। সকল ভাষাই তার ভাষা হয়ে ওঠে। বাংলা ভাষাকে এগুতে হবে একথা মাথায় রেখে যে সংস্কৃতায়ণ কেবল গুটিকয়েক সাহেব ও দেশীয় সংস্কৃত পণ্ডিতদের মাথামোটা তৎপরতা নয় বরং এটি ছিল সামাাজিক পরিতবর্তন ও বিকাশের একটি অবিচ্ছিন্ন অংশ।
রচনাকাল: ডিসেম্ভর, ২০০৮
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে মে, ২০০৯ সন্ধ্যা ৬:০৮