”শুনতে শিখুন, সুযোগ কখনো খুব মৃদু স্বরে কড়া নাড়ে ।”
”যে জানে সে বক্তা, যিনি শোনেন তিনি জ্ঞানী ।”
”যখন আপনি বলেন, তখন জানা বিষয়ই আবার বলছেন, কিন্তু যদি আপনি শোনেন তাহলে আপনি নতুন কিছু শিখতে পারেন ।”
- দালাই লামা
কর্পোরেট সাফল্যের সূত্র-৪: ’সক্রিয় শ্রবন’-এর দশটি টোটকা-তদবীর
আজকে যে আমরা যে বিষয় নিযে কথা বলবো সেটা হল ’সক্রিয় শ্রবন’, এই জিনিস অলমোস্ট তিবেটিয়ান কাল্ট বা কামরুপ-কামাক্ষ্যার তন্ত্রগুরুদের মত ধ্বনন্তরী এক যাদুমন্ত্র । ইহা সঠিক ব্যবহারে বিবিধ সমস্যা সমাধান হয়, যেমন চাকুরীতে বেতন বাড়ে না, ব্যবসায় উন্নতি নাই, স্বামী-স্ত্রীর/বফ-গফ এর মধ্যে মতের অমিল, পরিবারে সদস্যদের মধ্যে অশান্তি ইত্যাদী সমস্যার ১০০% অব্যর্থ তদবীর- গ্যারান্টি দেওয়া হল, ইয়েস- ইট’স ট্রুলি ফেইল সেফ; যদি আপনি ঠিকমত মেনে চলেন ।
শ্রবণ করা বা শোনা, জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ লাইফ-স্কিল, সেটা কর্পোরেট থেকে শুরু করে আপনি যে কোন এনজিও, নন-প্রফিট, স্বায়ত্ব-শাসিত, কর্পোরেশন, আধা-সরকারী, এমনকি সরকারী অফিসের কর্মকর্তা হন, অথবা আপনি যদি হন স্বাধীন পেশাজীবি, ব্যবসায়ী বা রাজনীতিবিদ; আপনি যেই হন- আপনার দাম্পত্য, পেশাগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের সব জায়গাতেই সক্রিয় শ্রবন অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ন । লক্ষ্য করে দেখবেন, আমরা নিজেরা যতটা মনে করি যে আমাদের চারপাশে যারা আছে তাদের কথা খুব শুনি, আসলে হয়তো অতটা নাও হতে পারে।
’সক্রিয় শ্রবণ’ বা এ্যাক্টিভ লিসেনিং- এমনি এমনি গজিয়ে উঠার সম্ভাবনা কম, এ’বিদ্যায় পারদর্শী হতে হলে আমোদের কি কি টোটকা-তদবীর মানতে হবে এটা জানা দরকার । এখানে আমি আপনাদের সাথে সহজ কয়েকটি টিপস নিয়ে আলোচনা করব যাতে করে এগুলো আপনি সচেতনভাবে আয়ত্ব করে নিয়ে একজন ‘সক্রিয় শ্রোতা’ হয়ে উঠতে পারেন-
তদবীর-১: যার সাথে কথা বলছেন অর্থাত বক্তার দিকে মুখ ফেরান এবং আই-কন্ট্যাক্ট করুন ।
আই-কন্ট্যাক্ট সরাসরি কথোপকথনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অপলক তাকিয়ে থাকা অস্বস্তিকর হতে পারে, তাই স্বাভাবিক পর্যায়ে দৃষ্টিপাত করতে থাকুন । প্রতি পাঁচ সেকেন্ডে পরপর চোখের পলক ফেলুন এবং আপনি যে মনোযোগ দিয়ে শুনছেন তা দেখাতে, পাঁচ সেকেন্ডের জন্য একটি চোখের দিকে তাকান, তারপরে অন্য চোখে পাঁচ সেকেন্ডের জন্য, তারপর তাদের মুখের উপ্রে নজর নিয়ে আসুন । দূরে, নীচের দিকে তাকানোর চেয়ে পাশে বা উপরে তাকাবেন, দুরে বা নীচে তাকালে মনে হতে পারে আপনি কথাবার্তা চালাতে আগ্রহী নন ।
আপনার বডি-পশ্চ্যুর লক্ষ্য রাখুন এবং হাত অথবা পা ক্রস করবেন না- দুই দিকে স্বাভাবিক দুরত্বে খোলা রাখুন; হাত অথবা পা ক্রস করে রাখা মানে আপনি হয় কিছু লুকোচ্ছেন অথবা আপনি ওপেন নন- আপনি অনাগ্রহী । সঠিক পজিশন হচ্ছে, সামান্য সামনে বা পাশে ঝুঁকে থাকা; এর মানে আপনি শুনছেন - আপনার মাথার সামান্য কাত করে রাখবেন বা পরিবেশ অনুযায়ী আপনার মাথা আপনার হাতের উপর রেখে দিতে পারেন।
তদবীর-২: অব্যক্ত ইঙ্গিতগুলিও "শুনুন"
অন্য ব্যক্তি তাদের শারীরিক ভাষা দিয়ে কি বলছে মনোযোগ দিন । তার মুখের অভিব্যক্তি, কণ্ঠস্বর এবং অঙ্গভঙ্গি দেখুন এগুলি আপনাকে ঠিক কি বার্তা দিচ্ছে । তাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ কি বলে সেদিকে মনোযোগ দিন - যেমন, তারা কি হাসছে, বা তাদের হাতগুলো কি ক্রস করা আছে, বা তারা তাদের চোখ ডলছে যেন তারা ক্লান্ত বা বিরক্ত। মোবাইল বা ফোনে কথা বলার সময় বোঝার চেষ্টা করুন, অপর পাশের কন্ঠস্বর কি ওয়েলকামিং, নিস্পৃহ, দমিত না উচ্ছ্বসিত- মনোযোগ দিয়ে শুনলেই বুঝতে পারবেন । তাহলে পরবর্তী আলোচনার গতিপথ কোনদিকে যাবে সেটা বুদ্ধিমত্তার সাথে ঠিক করতে পার্বেন ।
তদবীর-৩: কথার মাঝখানে বামহাত দেবেন না বা কথা ঢোকাবেন না ।
কথার মাঝখানে কথা ঢোকানো সাধারন শিষ্টাচারের পক্ষেও হতাশাজনক - এটি এমন ধারণা দেয় যে আপনি আরও গুরুত্বপূর্ণ, অন্যদের যা বলার আছে সেটা শোনার জন্য আপনার কাছে সময় নেই। আপনি যদি ন্যাচারালি একজন দ্রুত চিন্তাশীল ব্যক্তি বা বক্তা হন, তাহলে নিজেকে স্লো করতে বাধ্য করুন যাতে অন্য ব্যক্তি নিজের কথা বলতে পারে। মনে রাখবেন, অপর পক্ষের একটি বিরতি বা কয়েক সেকেন্ডের নীরবতার অর্থ এই নয় যে আপনাকে এরি মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে৷ অন্য ব্যক্তিকে কথা বলতে দেওয়া আপনার পক্ষেও তাদের বার্তা বোঝা সহজ করে তুলবে৷
এমনকি তারা যা বলেছে তাতে সহমত পোষন করার জন্য দেয়া বাধাগুলিও বিভ্রান্তিকর হতে পারে এবং এর ফলে পুরো আলোচনা ভিন্নপথে চলে যেতে পারে । যদি তাই হয়, তবে আলোচনার ট্রেনটিকে লাইনে ফেরানোর দায়িত্ব আপনার, যেটা আপনি করতে পারেন এভাবে "সুতরাং, আপনি আমাকে এ’সম্পর্কে যেটা বলছিলেন..." বলে সুত্র ধরিয়ে দিন ।
তদবীর-৪: রায় জারী করবেন না বা সিদ্ধান্ত নেবেন না; আগে শুনুন
আপনি যদি কথা শোনার সাথে সাথে সাড়া দিতে পারেন, তাহলে পরবর্তীতে যে সমস্ত আলোচনা হবে সেটা ফলপ্রসূ হতে পারে । শোনার উপর ফোকাস করার চেষ্টা করুন । একই সাথে, অনুমান করতে যাবেন না যে আপনি জানেন যে পরবর্তীতে কী বলা হবে।
তদবীর-৫: কথার উত্তর কি বলবেন তার প্ল্যান করতে শুরু করবেন না
আপনি একই সময়ে শুনতে এবং জবাব তৈরী করতে পারবেন না। শোনার সময় শুধুই শুনবেন, মনে মনে প্রশ্নোত্তর বা পাল্টা প্রশ্ন তৈরী করতে থাকবেন না । নিশ্চিত হোন যে, অন্য পক্ষের বক্তব্য শেষ হয়েছে ।
তদবীর-৬: প্রমান করুন আপনি শুনছেন
বক্তব্যের সাথে মিল রেখে আপনার মাথা নাড়ান, হাসুন এবং "হ্যাঁ" এবং "হুহ" এর মতো ছোট শব্দ করুন, যাতে করে দেখা যায় যে আপনি শুনছেন এবং বক্তাকে বলতে উত্সাহিত করুন। ঘড়ির দিকে তাকাবেন না, অযথা নড়াচড়া করবেন না বা আপনার চুল নিয়ে খেলবেন না, দাঁতে নখ কাটবেন না । আপনি এভাবে নিজেকে একজন জাগ্রত শ্রোতা হিসাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করুন ।
তদবীর-৭: আপনার মতামত বা সমাধান চাপিয়ে দেবেন না
কোন মতামত না দিয়ে শোনাটা সত্যিই সবসময় সহজ নয় । আমরা যে কোন রোগের বা সমস্যার সমাধান ততক্ষনাত দিতে পারলে আত্মতৃপ্তি বোধ করি । কিন্তু, আসলে সহানুভূতি সহকারে শ্রবণ তাদের কী করা উচিত তা বলার চেয়ে অনেক বেশি ফলপ্রসূ হতে পারে। যখন একজন লোক তার সমস্যার কথা অন্য কাউকে বলে তার মানে হলো তারা সম্ভবত আপনাকে বলতে চায় তারা কেমন অনুভব করছে; এমন সময়ে তাদের কী করা উচিত সে সম্পর্কে অনেক পরামর্শের পরিবর্তে মন দিয়ে কথা শুনলে তাদের বুকের ভার নেমে যাবে- ঐটাই হলো সত্যিকারে প্রয়োজনের সময় বন্ধুর কাজ ।
জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও, বেশিরভাগ লোকেরা তাদের নিজস্ব সমাধানে আসতে পছন্দ করে। আপনি যদি সত্যিই কোন ভাল সমাধান শেয়ার করতে চান, প্রথমে জিজ্ঞাসা করুন তারা এটি শুনতে চায় কিনা –"আপনি কি আমার পরামর্শ শুনতে চান?"
তদবীর-৮: মনোযোগী থাকুন
কেউ কি বলছে তার উপর ফোকাস করা যদি আপনার কঠিন মনে হয়, তাহলে তাদের কথাগুলো আপনার মাথায় পুনরাবৃত্তি করার চেষ্টা করুন – এটা বারবার করুন তাহলে মনোযোগ বাড়বে। রুমে অন্যান্য আলোচনা না শোনার চেষ্টা করেন এবং অবশ্যই আপনার ফোনের দিকে তাকাবেন না।
তদবীর-৯: প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করুন
প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা দেখাতে পারে যে আপনি শুনছেন এবং যা বলা হয়েছে তা স্পষ্ট হতে সহায়তা করবে ।
আপনি সঠিকভাবে বুঝতে পেরেছেন কিনা তা নিশ্চিত না হলে, বক্তা বিরতি না দেওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন এবং তারপরে কিছু বলুন "আপনি কি বলতে চান যে x..." বা "আমি নিশ্চিত নই যে আপনি যা বলছেন তা আমি বুঝতে পেরেছি কিনা..."
আপনি যেখানে প্রযোজ্য সেখানে খোলা প্রশ্নগুলিও ব্যবহার করবেন, যেমন "ঐসময়ে আপনার কেমন বোধ হল?" "আপনি এরপর কি করলেন?"
তদবীর-১০: সারসংক্ষেপ আলোচনা করুন
যা শুনেছেন তার মূল পয়েন্ট রিপিট করুন, তাহলে মনে হবে আপনি এ্যাক্টিভ শ্রোতা ছিলেন এবং আপনি যদি কোথাও বুঝতে না পারেন তবে স্পিকার আপনাকে সানন্দে সংশোধন করে দেবেন ।
আপনি যদি বুঝে উঠতে না পারেন যে এটি কীভাবে করবেন, তাহলে এই বাক্য শুরু করার চেষ্টা করুন: "মনে হচ্ছে আপনি বলছেন..."
এবং মনে রাখবেন…. অনুশীলন সাফল্যের চাবিকাঠি
পুরানো বদঅভ্যাস ভাঙ্গা বেশ কঠিন, তবুও আপনাকে সক্রিয় শ্রোতা হওয়ার জন্য সচেতন প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। একটি সপ্তাহ এমনি করে চেষ্টা করুন যেখানে আপনি প্রতিটি কথোপকথন বা মিটিং শেষে মূল পয়েন্ট বা ফলাফলের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিবেন । এটি আপনাকে ’সক্রিয় শ্রবন’ এর অভ্যাস গড়তে সাহায্য করবে ।
মোদ্দা কথা হল, প্র্যাক্টিস...প্র্যাক্টিস একমাত্র সাফল্যের চাবিকাঠি, যার মাধ্যমে এইসব সুক্ষ, আধুনিক ব্যক্তিগত দক্ষতাকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে পরিবর্তনশীল বিশ্বে মানিয়ে চলার যুদ্ধে জয়ী হতে পারবেন- আপনার পূর্ন সাফল্য কামনা করি, ইতি ভবদীয় লেখক ।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৩ বিকাল ৪:৫০