রিজার্ভ থেকে অর্থ চুরির ঘটনায় গভর্নর ও দুই ডেপুটি গভর্নরকে সরিয়ে দেয়া হলেও ঘটনার মূল হোতারা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন। প্রভাবশালী এ গ্রুপটি দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকে আধিপত্য বিস্তার করে বিভিন্ন অপকর্ম করছে। তবে ভয়ে কেউ তাদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর শীর্ষপদগুলোয়ও তাদের লোকজনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ বিশেষ মহলটি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে শক্ত অবস্থানে দাঁড়াতে দিচ্ছে না। তারা পদে পদে বাধা সৃষ্টি করছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রের ধারণা, এ মহলটিই বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশাল এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত। জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, পৃথিবীর কোনো দেশেই রিজার্ভ থেকে অর্থ চুরির রেকর্ড নেই। বাংলাদেশ এ রেকর্ড সৃষ্টি করল। আশা করছি, তদন্ত রিপোর্ট এলে জড়িত সবার নাম পাওয়া যাবে। জানা গেছে, সদ্য নিয়োগ পাওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের আইটি কনসালটেন্ট রাকেশ আস্তানার মৌখিক পরামর্শে সব বিভাগ, সেল, ইউনিট, উইং এবং শাখা অফিসের কম্পিউটার, ল্যাপটপ ও সার্ভারের সরবরাহকৃত সিকিউরিটি প্যাচ নামের সার্ভার ইনস্টল করা হয়েছে। এতে অনেকেই বিস্মিত হয়েছেন। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের সব তথ্য ফাঁস হওয়ার আশংকা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ কারণে অনেক কর্মকর্তা রাকেশ আস্তানার সরবরাহকৃত সিকিউরিটি প্যাচ ইনস্টল করতে চাচ্ছে না। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত ডেপুটি গভর্নর এসকে সুর চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চাননি। রিজার্ভ থেকে যে কোনো লেনদেনের তথ্যের মেসেজ জেনারেট করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ফ্রন্ট অফিসের একজন কর্মকর্তা। ভেরিফাই করেন একই অফিসের আরেক কর্মকর্তা। আবার মেসেজ ট্রান্সশিপমেন্ট করেন একই বিভাগের আরেক কর্মকর্তা। আর মিডল অফিসের দুই কর্মকর্তা ফ্রন্ট অফিসের মেসেজ যথাযথ হয়েছে কিনা, তা তদারকি করে থাকেন। রিজার্ভ ম্যানেজমেন্টের জন্য এ দুই অফিস নিয়ন্ত্রণ করে ফরেক্স রিজার্ভ ও ট্রেজারি ম্যানেজমেন্টের বিভাগ। অপরদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগ নিয়ন্ত্রণ করে ব্যাক অফিস। এ ব্যাক অফিস ফ্রন্ট ও মিডল অফিসের কাজগুলো ঠিকমতো হচ্ছে কিনা বা পাঠানো বার্তা অনুযায়ী ঠিকমতো রিজার্ভ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা কেটে রাখা হয়েছে কিনা, দেশের রিজার্ভ কী পরিমাণে রয়েছে এগুলো দেখাশোনা করে। কিন্তু রিজার্ভ থেকে ৮০০ কোটি টাকা চুরির ঘটনায় তদন্ত করা হচ্ছে শুধু ব্যাক অফিসকে নিয়ে। এর ফলে প্রকৃত ঘটনা আড়াল হয়ে যেতে পারে বলে মনে করছেন অনেকেই। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী যেসব বিভাগ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত, ডিলিং রুমের সিসি ক্যামেরা অকেজো কেনো ছিল এবং সাভার ও কম্পিউটার থেকে তথ্য কেন মুছে ফেলা হয়েছে- এসব বিষয়ে তেমন কোনো তদন্ত হচ্ছে না। তদন্ত হচ্ছে, যে বিভাগ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হিসাব-নিকাশ রাখে, সেই বিভাগে। এ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। তদের অভিযোগ, দায় থেকে কাউকে বাঁচাতে অথবা তদন্তের ফলকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে পরিকল্পিতভাবে এটি করা হচ্ছে। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও তদন্তকে একমুখী করছেন। তাদের পক্ষ থেকে অর্থমন্ত্রণালয়ও ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তার মতে, দুই অফিসেই (ফরেক্স রিজার্ভ ও ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ এবং অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগ) তদন্ত হওয়া উচিত। তাহলেই প্রকৃত ঘটনা বের করা সম্ভব হবে। তা না হলে তদন্ত যেমন একমুখী হবে, তেমনি প্রকৃত ঘটনাটি বের হবে না। সূত্র জানায়, এ মহলটিই চুরির ঘটনার সময়কালে কম্পিউটার ও সার্ভার থেকে প্রয়োজনীয় সব তথ্য মুছে ফেলেছে। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনার আগে থেকেই ব্যাংকের ফরেক্স রিজার্ভ ও ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট ডিভিশনের ডিলিং রুমের দুটি ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা বিকল ছিল। ফলে ওই ঘটনার সময় ডিলিং রুমে কারা ছিল, সুইফট কোড ব্যবহার করে কারা কাজ করছিল- এসব তথ্য বের করা সম্ভব হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ডলার চুরির সময়ে সম্পাদিত বার্তাগুলো মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকে গেছে ৪ ফেব্রুয়ারি বিকাল ৫টা থেকে রাত ৮টার মধ্যে। বাংলাদেশ সময় রাত ৮টায় যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক খোলা হয়। ফলে বার্তাগুলো যাওয়ার পর ৫টি বার্তা কার্যকর হয়ে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হয়ে যায়। ওইদিন বিকাল ৫টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডিলিং রুমে সুইফটের মাধ্যমে অ্যাকাউন্ট পরিচালন ব্যবস্থায় প্রবেশ করে কাজ করেছেন কয়েকজন কর্মকর্তা। এক্ষেত্রে প্রতিটি পর্যায়ে সিস্টেমে ঢুকতে পৃথক ইউজার নেম ও পাসওয়ার্ড রয়েছে। এ পদ্ধতিতে সিস্টেমে কারা প্রবেশ করল এবং কারা বের হল সেসব তথ্য সংশ্লিষ্ট সার্ভারে ও কম্পিউটারে থাকার কথা। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা তদন্ত করতে গিয়ে এসব তথ্য খুঁজে পাচ্ছেন না। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, ওই সিস্টেমে ঢুকতে একটি বিশেষ পাসওয়ার্ড বা অ্যাকসেস লগ রয়েছে। ওখানে সব কর্মকাণ্ডে রেকর্ড থাকে। এগুলো কম্পিউটারের পাশাপাশি সার্ভারেও থাকে। কিন্তু ওই সময়ে কারা কাজ করেছে সেসব তথ্য তারা এখন কম্পিউটার ও সার্ভারে খুঁজে পাচ্ছেন না। ডিলিং রুমটি ফরেক্স রিজার্ভ ও ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট ডিভিশনের পূর্বদিকে কাচঘেরা একটি কক্ষ। এ কক্ষে বিশেষ কার্ডের সাহায্যে প্রবেশ করতে হয়। এখানে দুটি সিসি ক্যামেরা রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ডলার চুরির ঘটনার কিছু দিন আগে থেকেই ডিলিং রুমের দুটি ক্যামেরা অকেজো ছিল। ফলে কারা কক্ষে কাজ করেছে সেই ভিডিও ফুটেজও নেই। তবে পরে ক্যামেরা দুটি সচল করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডিলিং রুমের ব্যাক অফিস হিসাবে কাজ করে অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগ। এ বিভাগের জিএম পদে চুক্তির ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া হয়েছে বদরুল হক খানকে। তিনি আগে ছিলেন এবি ব্যাংকে। ওই ব্যাংক থেকে নানা কারণে তাকে চাকরি ছাড়তে হয়েছে। আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এসব পদে বাইরে থেকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হতো না। সাম্প্রতিক সময়ে এসব পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। এ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তাদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষও রয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে বৈদেশিক মুদ্রাবাজার প্রায় সব সময়ই খোলা থাকে। বিভিন্ন দেশের সরকারি ছুটির সঙ্গে সমন্বয় করলে এটি শনিবার বেশিরভাগ দেশে বন্ধ থাকে। অনেক দেশেই সাপ্তাহিক ছুটি শনি ও রোববার, বাংলাদেশে শুক্র ও শনিবার। এসব কারণে বৈদেশিক লেনদেনের জন্য ডিলিং প্রায় সব সময়ই খোলা রাখার নিয়ম রয়েছে। বহুজাতিক ব্যাংকসহ বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোও ছুটির দিনে ডিলিং রুম খোলা রাখে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকেরও ছুটির দিন ডিলিং রুম খোলা রেখে কাজ করার নজির রয়েছে। কিন্তু রিজার্ভ থেকে ডলার চুরির সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডিলিং রুম বন্ধ ছিল। ফলে মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে যে বার্তা এসেছিল তা পরীক্ষা করে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়নি। - See more at: Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মার্চ, ২০১৬ রাত ১১:১২