somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ড্রাকুলা কলিং...

১৮ ই জানুয়ারি, ২০১৩ বিকাল ৫:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আপনাকে কি কোন ড্রাকুলা কখনো ফোন দিয়েছে? গমগমে কন্ঠের পুরুষ ড্রাকুলা; কিম্বা জলতরঙ্গের সুরে নারী ড্রাকুলা? অতি পরিচিত ভংগীতে কুশলাদি জিজ্ঞেস করেছে এবং তারপরেই বিনয়ের সাথে আপনার রক্তের জন্য বায়না ধরেছে? আপনি সাইড কাটার চেষ্টা করতেই কৃত্তিম আবেগ এনে মুখস্থ কিছু বাণী শুনিয়েছে? ঠিক যেমন গত সপ্তায় আমি শুনলাম

: হ্যালো, আপনি কি সামিউল আলম খান বলছেন?
: জ্বী বলছি।
: আমাদের আজকের ব্লাড ক্যাম্পে কি আপনি আসতে পারবেন?
: দুঃখিত। আজকে একটু অফিসের ঝামেলায় আটকে গেছি। এবার আসতে পারছিনা, ইনশাআল্লাহ, পরেরবার।
: ধন্যবাদ। আপনার আরোগ্য কামনা করি। আশা করি আপনি আবার সুস্থ হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন!!
: @&^$%(%&*&@#!~@!%%!!~~&%#$@@!!!

রক্তের স্বাদ
অনেক আগে ছোটবেলায় নানীর বাড়িতে চাপকল চাপতে গিয়ে হঠাত হ্যান্ডেল ছুটে ঠাস করে আমার ঠোঁটে! সাথে সাথে একটা দাঁত উড়ে গেল, আরেকটা আহত হয়ে চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেল! কোরিয়ান সিনেমার নায়কদের যেমন ভচাত করে খোঁচা লাগলেই ভুস ভুস করে গ্যালন গ্যালন রক্ত বেরুতে থাকে ঠিক তেমনি আমার মুখ দিয়ে রক্ত বেরুতে লাগল। ভয়ে আমি ফ্যাকাশে হয়ে গেলাম সব রক্ত বেরিয়ে যাচ্ছে ভেবে !! মরিয়া হয়ে মুখের ভেতর রক্ত জমিয়ে কোঁত করে গিলে ফেললাম !! সেই পেলাম রক্তের স্বাদ; প্রথমবারের মত !! কি অদ্ভুত মাদকতাময় নোনতা স্বাদ !!!

বাবার অপারেশনের সময় সামান্য এ পজেটিভ রক্ত খুঁজে পাচ্ছিলাম না হন্যে হয়েও। সবার গায়ে এত রক্ত, অথচ আমার প্রিয়জন কে দেয়ার মত একব্যাগ রক্ত কারো নেই!! শরীরের সমস্ত রক্ত দিয়ে দিতে চাইলেও নাকি ডাক্তার সাহেবরা নেবেন না গ্রুপ না মেলায়! আশঙ্কাজনক অবস্থায় যখন শেষ মুহূর্তে খুঁজে পেয়েছিলাম একব্যাগ রক্ত, তখন বুঝেছিলাম রক্তের আরেক স্বাদ !! কি অদ্ভুত প্রশান্তিময় মিষ্টি স্বাদ !!!



ফেরেশতার অটোগ্রাফ
আমার বন্ধুর কোন এক বন্ধুর মা’য়ের রক্ত লাগবে। ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে সিরিয়াল নিয়ে অপেক্ষা করছি। পাশেই মধ্যবয়স্ক সাধারন প্যান্ট শার্ট পড়া এক লোক আয়েশ করে বসে আছেন। আলাপ জমাতে জিজ্ঞেস করলাম, “কি চাচামিয়া রক্ত দিতে আইসেন নাকি?”
উনি মাথা নাড়েন।
আমি ব্যাপক পার্ট নিয়ে বললাম, “বাহ বাহ ভালো !! রক্ত দেয়া খুব ভালো কাজ। আমি এ পর্যন্ত ২২ বার দিসি। তা চাচামিয়া, আপনে কয়বার দিসেন?”
তিনি নিষ্পৃহভাবে উত্তর দিলেন, “৫২ বার।”

গত ২৫ বছর ধরে এই মানুষটি নিয়ম করে চলে আসেন এই হাসপাতালে আর অপেক্ষা করেন রক্তের আশায় থাকা গরীব অসহায় মানুষদের। তাদের নিজের শরীর থেকে এক ব্যাগ রক্ত দেন, তারপর চলে যান নিজের পথে, আবার ফিরে আসেন ৪ মাস পর। আমি শুনছিলাম আর ভাবছিলাম, আমি কি কাদামাটির কোন মানুষের পাশে বসে আছি; নাকি নূরের তৈরী একজন ফেরেশতার?
একটা অটোগ্রাফ রেখে দেয়া উচিত ছিল!!

রক্তের ঋণ
আমার বাবা’কে দেয়া রক্তের দাম শোধ করতে পারবোনা কোনদিন। তবু কিছুটা হলেও মানবতার প্রতি ঋণ শোধ করতে রক্তদান করে যাচ্ছি ২০০০ সাল থেকে। কোয়ান্টাম মেথডের সাথে জড়িত না হলেও কোয়ান্টাম ব্লাড ফাউন্ডেশনের সিল্ভার ডোনার হিসেবে এবং শরীরে রক্ত থাকলে আত্মীয় অনাত্মীয় যেকারো ডাকে চেষ্টা করি নিয়মিত রক্ত দিতে।

আমার ভয়াবহ শুকনা এক বন্ধু (কোয়ান্টাম মেথডে মেথডিত হয়ে সে সফট ড্রিঙ্কস ছেড়ে দিয়েছে, কিন্তু হার্ড ড্রিঙ্কস ধরে রেখেছে) নিজের ওজন বাড়াতে দু তিনটা হাফ প্যান্ট আর কয়েক প্রস্থ জামা কাপড় পড়ে নিত; শুধু রক্ত দিতে যাবার সময়। তাকে দেখেই আমি সাহসী হয়েছিলাম নিয়মিত রক্তদাতা হতে।

এক থা টাইগার
এক কাজিনের ডেঙ্গু। রক্ত লাগবে। খোঁজ খোঁজ খোঁজ! বীরদর্পে এগিয়ে আসলেন বড় ভাইয়ের বন্ধু গাট্টাগোট্টা মিনহাজ ভাই।
“কয় ব্যাগ রক্ত লাগবো ক তুই। আমি দিমু। বাকি যা লাগে সব যুগাড় কইরা দিমু। আমি আছিনা! তুই চিন্তা করস ক্যা?”
রক্ত নেয়ার দিন তিনি চিন্তিত মুখে ডাক্তারের রুমে ঢোকেন। বিছানায় শুয়ে তিনি বড় বড় নিঃশ্বাস নেয়া শুরু করলেন। নার্স ইঞ্জেকশান রেডি করেন, তিনি তাকিয়ে থাকেন আতঙ্কিত দৃষ্টিতে। তার কপালে চিকন ঘাম দেখা দেয়। সুঁই পুশ করা হোল, তিনি ছুরিকাঘাত হবার যন্ত্রনায় চিৎকার দিলেন! রক্ত পাস হওয়া শুরু করতেই তিনি বিকট সুরে বিলাপ শুরু করলেন।
“আমারে ছাইড়া দেএএএএন...রক্ত নিলে আমি মইরা যামুগাআআআআ...”
যতটুকু নেয়া হয়েছে ব্যাগ টিপেটুপে ততটুকু রক্ত আবার রিভার্স করে তার শরীরে ফেরত দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাকে শান্ত করা হোল।
মোরেলঃ রক্ত দিতে হলে শুধু গায়ে গতরে বড় হলেই হয়না। সদিচ্ছা থাকতে হয়, একটা পিপড়ার কামড় সহ্য করার মত সাহসীও হতে হয়।

রক্তের ফোয়ারা আর হার্ট এটাক
তাড়াহুড়োয় রক্ত দিয়ে একটু বিশ্রাম না নিয়েই হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে রিকশা ঠিক করতে গেল মাসুম। যথারীতি ভাড়া বেশি চাইল রিকশাওয়ালা।

মাসুমের ঝাড়ি; “ভাড়া বেশি চাইলা ক্যা?” তারপর পিচিক !! লাল রংয়ের ফোয়ারা। রিকশাওয়ালা রঙ্গীন হয়ে গেল।

“গেলে যাইবেন, না গেলে নাই!! রঙ দিলেন ক্যা, অই মিয়া?”

রঙ ছিলোনা, ছিল রক্ত। বিশ্রাম না নেয়াতে আর তুলা দিয়ে ভালমত না চেপে ধরাতে রক্তের ফ্লো তখনো বন্ধ হয়নি মাসুমের।

রক্ত দেয়ার অন্তত ঘন্টাখানেক আগে পড়ে কিছু খাওয়া উচিত না, সিগারেট তো নয়ই। অনেক বছর আগে একবার বীরপুঙ্গব এই আমি রক্ত খয়রাত করে এসে মানবজাতির জন্য বিশাল কিছু একটা করে ফেলেছি; এই ভাবালুতায় আক্রান্ত হলাম। এবং তৃপ্তির সাথে একটা সিগারেট ধরালাম। প্রথম সুখটান দেয়ার সাথে সাথে দুনিয়াটা চক্কর দিল, আমি আক্ষরিক অর্থেই একটা পাক খেয়ে দোকানদারের উপর পড়লাম। সম্বিত ফিরে পেয়ে দেখি সারা শরীর ঘেমে একেবারে ফরয গোসল করে ফেলেছি!! ভাল মানুষ দোকানদার আমাকে আধাঘন্টা তার ছাতার তলে বসিয়ে; সেই ৫ টাকার বেনসনের বিনিময়ে ৩০ টাকার জুস খাইয়ে বিদায় দিল।

আমার রক্ত আমি দেব, যাকে খুশী তাকে দেব
আপনার মা আপনাকে খাইয়ে খাইয়ে শরীর ভর্তি রক্ত জমিয়েছেন তিলে তিলে। এই কষ্টের রক্ত আপনি আরেকজনকে মুফতে কেন দিবেন? কেন শুধু শুধু সুঁইয়ের খোঁচা খাবেন, যেখানে রক্ত আর সুঁই দেখলেই আপনার আত্মা উড়ে যায়? তাহলে ভাবুন, আপনার কিম্বা আপনার প্রিয়জনের যদি কোনদিন রক্ত লাগে তাহলে অন্যেরা কেন আপনাকে দেবে?

বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতি বছর রক্তের প্রয়োজন “মাত্র” ৪ লাখ ব্যাগ। এ রক্তের বড় অংশ আসে পেশাদার রক্ত বিক্রেতাদের কাছ থেকে, যারা রক্ত বেচে নেশা করে কিম্বা বেশি অভাবীরা সংসার চালায়। এগুলো বেশিরভাগ দূষিত রক্ত। আর এই রক্ত গ্রহন করেই হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’, এইডস, সিফিলিস এবং ম্যালেরিয়াসহ বিভিন্ন রকম ভয়াবহ সব রোগে আক্রান্ত হবার আশঙ্কায় থাকছে আপনার আমার প্রিয়জন। আর এর জন্য দায়ী কে জানেন?

রক্ত না দান করা এই আপনি।



আসুন ড্রাকুলা হই
আমরা যারা ড্রাকুলা কিম্বা রক্তাদাতা যাই বলুননা না কেন, আপনার কাছে চোখা দাঁত নয়, সুঁই এগিয়ে দিচ্ছি, আপনার রক্ত ভিক্ষা পাবার আশায়, আমাদের নিজেদের জন্য নয়, আমাদের প্রিয়জন দের জন্য।
নিজে রক্ত দিন, অন্যকে রক্তদানে উত্সাহিত করুন।


রক্তদান সম্পর্কে বেসিক কিছু জানতে দেখুন
রক্ত দিন জীবন বাঁচান
রক্তদানের উপকারিতা
Blood Donation Frequently Asked Questions (FAQ)
স্বেচ্ছা - Digital Blood Donor Archive
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জানুয়ারি, ২০১৩ দুপুর ২:৫৭
৮৯টি মন্তব্য ৮৯টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহমিকা পাগলা

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


এক আবেগ অনুভূতি আর
উপলব্ধির গন্ধ নিলো না
কি পাষাণ ধর্মলয় মানুষ;
আশপাশ কবর দেখে না
কি মাটির প্রণয় ভাবে না-
এই হলো বাস্তবতা আর
আবেগ, তাই না শুধু বাতাস
গায়ে লাগে না, মন জুড়ায় না;
বলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩




তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×