somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বই রিভিউ : জিন - ফিকশন এবং নন-ফিকশনে মোড়ানো থ্রিল, হরর এবং অতিপ্রাকৃতের কমপ্লিট প্যাকেজ

২১ শে জুন, ২০২২ সকাল ১১:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



লেখক এম জে বাবু'র অপর নাম হাইপওয়ালা বাবু৷ তার প্রতিটা বইই তুমুল হাইপ তোলে পাঠক মহলে৷ তার প্রথম বই দিমেন্তিয়া এই হাইপ দেখেই কিনেছিলাম৷ আর পড়ার পর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম নিজের টাকা দিয়ে উনার বই আর কিনব না৷ ভয়াবহ কাঁচা লিখনশৈলী আর দূর্বল চরিত্র চিত্রণ৷ পুরো বইয়ে একমাত্র আকর্ষণীয় দিক ছিল এর গল্পটা৷ যদিও শেষ টা আরোপিত লেগেছে৷ তাই যতই হাইপ উঠুক তাই আমি তার বই এড়িয়েই যাই৷ কিন্তু ভ্রম আর পিনবলের মারাত্বক সব রিভিউ (এবার খুব রিলায়েবল আর অনেস্ট রিভিউয়ার দের থেকে (যাদের আমি ফলো করি আরকি)) দেখে আমি আমার সিদ্ধান্ত গিলে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলাম৷ যেহেতু সতীর্থের কোন বই আমি কিনবোনা তাই আশায় থাকলাম কবে যাকারিয়া ভাই আমাকে পিনবল বইটা গিফট করে (কারন, কেউ কেউ কথা রাখে)৷ আর এর মধ্যেই ঝড় তুলে হাজির হোল জিন৷ ঝড় না বলে তুফানই বলা যায়৷ সিদ্ধান্তটা চটজলদি পানি ছাড়া গিলে ফেলে নিজের টাকায় অর্ডার দিয়ে দিলাম আর আলাদিনের জিনের মত মুহুহাহাহা করতে করতে এম জে বাবু'র জিন হাজির হয়ে গেল দুদিন পরেই৷ পড়া শুরু করলাম নগদে..

বইটা পড়তে পড়তে দুই বার ঘুমায় পড়েছিলাম৷ এর মধ্যে একবার মাঝ রাত্তিরে লাফিয়ে উঠেছি দু:স্বপ্ন দেখে৷ গল্পের তারিন একটা সিকোয়েন্সে বাথরুমে আটকা পড়ে৷ তারপর হঠাৎ দেখে বাথরুমের দরজাটা উধাও৷ তারপর চারপাশের দেয়াল রক্তে লাল হয়ে গেল, চুইয়ে পড়তে লাগল তাজা রক্ত৷ আমার দু:স্বপ্নে তারিনের জায়গায় আমি ছিলাম৷

এই ব্যাক্তিগত দু:স্বপ্নের প্যাচাল পাড়ার উদ্দেশ্য আছে একটা৷ যে লোক শিজ্জিন আর ডাব্বে সিরিজ দেখেছে তার কাছে হলিউডি হরর মুভিগুলো কমেডি শো লাগার কথা৷ আর সেই হিসাবে এই জিন বইটাও তাকে ভয় খাওয়াতে পারার কথা না৷ তবে যেটা সত্যি তা হোল হরর সিকোয়েন্স গুলো পড়তে ভালই অস্বস্তি লেগেছে৷ আর ইম্প্যাক্ট ফেলেছে মনের ভেতর৷ জিনে ধরার গল্প শহরে গ্রামে সবাই কম বেশি শুনেছে৷ এই গল্পের শুরুর সাথে তাই খুব সহজেই রিলেট করতে পারা গেছে৷

বইটা দারুন পেইজ টার্নার৷ স্লো বিল্ড আপ, ভালই এক্সিকিউশন, দুটো প্লট ধরে আগানো গল্প, প্লট দুটোকে সুচারুভাবে মেলানো এবং শকিং টুইস্ট৷ এরকম শক খেয়েছিলাম লাস্ট "সাইরাত" মুভি দেখে৷

পুরো বইতে দারুন সব রেফারেন্স, কোটেশন ব্যাবহার করা হয়েছে৷ কিছু কিছু সরাসরি পবিত্র কুরআন এবং হাদীস শরীফ থেকে৷ আর বাকি গুলো অথেন্টিক সোর্স থেকে৷ যেগুলো সম্পাদনা এবং কারেকশন করেছেন উম্মে কুলসুম সাদিয়া৷

অদৃশ্য এই জিন জাতি সম্পর্কে জানার আগ্রহ কম বেশি সবারই আছে৷ আর মুসলিম হিসেবে আমাদের পরিচিত ডাইমেনশনের বাইরে বসবাসকারী এই জাতির অস্তিত্বকে বিশ্বাস করা ফরজ৷ তাই গল্পের ছলে ফিকশনের মোড়কে যদি এই জিন, জাদু টোনা, পরাবাস্তবতা, কালো জাদু, শিরক আর এর ভয়াবহ পরিণতির ফ্যাক্টগুলো জানা হয়ে যায় তাহলে ব্যাপারটা কতটুকু ইন্টারেস্টিং হতে পারে? পৃথিবীতে মানুষ আগমনের দুই হাজার বছর আগে ঘটে যাওয়া এঞ্জেলিক ওয়ার, আজাজিলের ইতিহাস, ফেরেশতা হারুত আর মারুতের গল্প, সুলাইমান আ: আর তার জিন বাহিনীর কাহিনী ইত্যাদি দারুন ইন্টারেস্টিং টপিক গুলো যদি এক মলাটে পাওয়া যায়? তাই জিন বইটা এগুলোর একটা কমপ্লিট প্যাকেজ৷

প্রচুর ইনফো ডাম্প করা হয়েছে বাট বিরক্তি আসে নাই কোথাও৷ এমনকি সবজান্তা সমশের কিম্বা দুনিয়ার জ্ঞান হজম করা পাকনা টাইপ চরিত্রও এখানে ছিল না৷ যার মুখ দিয়ে তথ্যগুলো লেখক দিয়েছেন তাকে সেই পরিমান ক্রেডিবিলিটিও দিয়েছেন সমানভাবে৷ তাই আরোপিত লাগেনি কোথাও৷ দিমেন্তিয়ার সবচে বড় দূর্বলতা চরিত্র চিত্রন লেখক এই বইতে কাটিয়ে উঠেছেন দারুন ভাবে৷ প্রতিটা চরিত্রকে অনুধাবন করা গেছে স্মুথলি৷ বিশেষ করে তারিনের মানসিক যন্ত্রণা আর কষ্টের নারকীয় বর্ণনা এত বাস্তবধর্মী যে ভিজ্যুয়ালাইজ করা যাচ্ছিল তার যন্ত্রণার তীব্রতাটা৷

এবার আসি নেগেটিভ পয়েন্টে -

প্রাক কথন সহ পুরো বইয়ের লেখনশৈলী বেশ অপরিপক্ক লেগেছে৷ সম্পাদনার জোরে এই দূর্বলতাটা কিছুটা ঢাকা পড়লেও অনেক জায়গায় বেশ প্রকট৷ বইয়ের শুরুতেই প্রাক কথনে যে ভয়াবহ ঘটনাটা আছে তা দিয়েই পাঠকের ঘাম ছুটিয়ে দেয়া যেত৷ অথচ আমার বুঝতেই সমস্যা হচ্ছিল কখন মেয়েটা ভয় পাচ্ছে আর কখন মেয়েটার ঘুম পাচ্ছে৷

উপমা আর চরিত্রগুলোর ন্যাচারাল প্রতিক্রিয়া কিছু কিছু জায়গায় বেমানান৷ যেমন - জগ দিয়ে গ্লাসে পানি ঢালছে আর আওয়াজ হচ্ছে টপ টপ করে৷ যেখানে ইন্টারেস্টিং একটা আলোচনা হচ্ছে সেখানে হঠাত অযাচিত ভাবে একজন সেই বক্তাকে প্রশ্ন করল খোঁচা দিয়ে! যেখানে জানার আগ্রহেই প্রশ্ন করা যায়!

অতিরিক্ত বর্ননা বইয়ের মেদ দাড়িয়েছে অনেকাংশে৷ যেটা পাঠক হিসেবে পড়তে গেলে বিরক্তিকর৷ যেমন - সে ডান হাত বাড়িয়ে সুইচবোর্ডের ডান দিকের সুইচটি টিপে বাথরুমের লাইট জ্বালালো (সরাসরি কোট করছি না)! এরকম বাহুল্য রয়েছে বেশ অনেক জায়গায়৷ ২০/২৫ পেইজ কমানো যেত অনায়াসে অথচ ভাব গাম্ভীর্য বা থ্রিল নষ্ট হোত না এক বিন্দুও৷

তারপর আসি কিছু অসামঞ্জস্যে৷ লেখকের কাছে এগুলোর যথাযথ ব্যাখ্যা থাকতে পারে যদিও৷ যেমন - কোন মাদ্রাসায় বাচ্চারা দুপুর ১২ টা পর্যন্ত ঘুমায়? একজন এমপি'র বাসায় কোন কাজের লোক নেই, সেই এমপি নিজের বাসার লাইটের সুইচ কোথায় তা জানে না, তার বাসায় বেশিরভাগ সময় বিদ্যুত থাকে না (পৃ১০৪), থাকলেও রাতেরবেলায় তার বেডরুম, হলঘর,সিড়িঘর কোথাও লাইট জলে না, শুধুই "ঘিরে থাকে ঘুটঘুইট্টা অন্ধকার"! হরর বই দেখেই এগুলো মানতে হবে?

পুরো বইতে মুরুব্বী স্থানীয় চরিত্রদের নাম ধরে ডাকা হলো৷ কি পরিমান অড লেগেছে যে পড়তে তা আর বলার মত না৷ কেয়ারটেকার রফিক, তরুন এমপি সাজেদ আর প্রৌঢ় মন্ত্রী শহিদ - যেন তিন বন্ধু !! নুন্যতম সাহেব শব্দটা লাগালেও তো সেই বয়স্ক চরিত্রদের গাম্ভীর্য টা আসে !! যাইহোক এই মন্ত্রী "শহিদ" এর প্রোটকলের কোন খবর নেই৷ তিনি স্ট্রোক করার পর রেন্ট এ কার থেকে এম্বুলেন্স কল করতে হলো!

রুকাইয়া বা জাদু কাটানোর আমল সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তার সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র ধারনা নেই৷ তাই শুদ্ধ অশুদ্ধ বলতে পারছিনা৷ তবে একাধিক পর পুরুষ দ্বারা বেষ্টিত হয়ে একজন ধার্মিক মানুষ একজন নারীর রুকইয়া করতে পারেন কি না সে ব্যাপারে খটকা লেগেছে আমার৷

২২৬ পৃষ্ঠায় বর্ণিত "লাইলাহা...শাইয়্যিন ক্বাদীর"- এই দোয়াটা পাঁচ মিনিটেই একশবার পড়ে ফেলাটা কোনভাবেই সম্ভব না৷ লেখক কে অনুরোধ করবো নিজে পড়ে দেখবার৷

সবচে বড় ভুল, শুধু ভুল না বরং অন্যায় হয়েছে আমার মতে - বইয়ের শেষে রেফারেন্স হিসেবে সরাসরি কুরআন শরীফের অনেক গুলো আয়াত তুলে দেয়াটা৷ দিনশেষে এটা একটা থ্রিলার ফিকশন, কে কোথায় রাখবে বইটা, কিভাবে পড়বে তার কোন ঠিক আছে? কুরআনের আয়াতের যে অমর্যাদা হবে না তার কি কোন গ্যারান্টী আছে? পরবর্তী সংস্করনে আয়াত গুলো তুলে দিয়ে শুধু আয়াত নাম্বার দিয়ে রেফারেন্স দেয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি৷

শেষে জটিল একটা ক্লিফহ্যাঙ্গার রেখেছেন লেখক৷ অনেক প্রশ্নের জবাব দেয়া হয়নি৷ বরং তুলে দিয়েছেন আরো জট পাকানো প্রশ্নের৷ এটা না করলেই বরং ভালো হোত৷ পাঠক হিসেবে আমি না পেরেছি শেষের শক টা অনুধাবন করতে আর না পেরেছি প্রশ্নের উত্তর বের করতে৷ মনে হচ্ছিল আমি বুঝিনি কোথাও৷ কিন্তু কোথায় বুঝিনি সেটাও বুঝতে পারছিলাম না৷ এই ডামাডোলে শক টার আবেদনই কমে গেল কিছুটা৷

পাপ, পূণ্য, প্রায়শ্চিত্ত - খুব সহজ সমীকরণ হয়ে আসেনা সবার জীবনে৷ বরং পূণ্যের প্রতিটি বিনিময় দিয়েও কিছু কিছু পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয় না

কিছু ত্রুটি থাকার পরেও এই বইটা পড়া পাঠকের জন্য একটা দুর্দান্ত আধিভৌতিক অভিজ্ঞতা হবে সেটা নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি৷ মাস্ট রিড; থ্রিলার, হরর এবং অতিপ্রাকৃত প্রেমীদের জন্যে৷

জিন
এম জে বাবু
গ্রন্থরাজ্য
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুন, ২০২২ সকাল ১১:৫৮
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিসিএস-পরীক্ষার হলে দেরিঃ পক্ষ বনাম বিপক্ষ

লিখেছেন BM Khalid Hasan, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



বর্তমানের হট টপিক হলো, “১ মিনিট দেরি করে বিসিএস পরীক্ষার হলে ঢুকতে না পেরে পরীক্ষার্থীর স্বপ্ন ভঙ্গ।” প্রচন্ড কান্নারত অবস্থায় তাদের ছবি ও ভিডিও দেখা যাচ্ছে। কারণ সারাজীবন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৮




আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না। আমাদের দেশে মানুষ জন্ম নেয়ার সাথেই একটি গাছ লাগানো উচিৎ । আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানবতার কাজে বিশ্বাসে বড় ধাক্কা মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৭


মানুষ মানুষের জন্যে, যুগে যুগে মানুষ মাজুর হয়েছে, মানুষই পাশে দাঁড়িয়েছে। অনেকে কাজের ব্যস্ততায় এবং নিজের সময়ের সীমাবদ্ধতায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে না। তখন তারা সাহায্যের হাত বাড়ান আর্থিক ভাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

জব্বারের বলীখেলা ও বৈশাখী মেলা-২০২৪

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩৭



ছবি সৌজন্য-https://www.tbsnews.net/bangla




ছবি- মঞ্চে তখন গান চলছে, মধু হই হই আরে বিষ খাওয়াইলা.......... চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী গান।

প্রতি বছরের মত এবার অনুষ্ঠিত হল জব্বারের বলীখেলা ও বৈশাখী মেলা-২০২৪। গত ২৪/০৪/২৪... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

×