somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কাপুরুষের জবানবন্দি(পর্ব-১)

১৫ ই মার্চ, ২০১৩ রাত ৮:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

"চল পালিয়ে যাই।"

"না পালাতে পারব না।"

"কেন?"

আমি নিরুত্তর। ফারজানা বিচলিত। "তাহলে ভালবাসি বলেছিলে কেন?"

"ফারজানা ভালবাসার অর্থ এই নয় যে চোরের মত পালাতে হবে।"

"তাহলে বীরের মত একটা কিছু কর।"

আমি নিরুত্তর।

ফারজানা উত্তেজিত কণ্ঠে বলল,"তেলাপোকা দেখে ভয় পাও চুরির কথা বললে আবার নিতীকথা বল। চুরি ছাড়া তো তোমার উপায়ও নেই, না,না..উপায় তো তোমার আছেই উপায় নেই কেবল আমার। তোমার তো কিচ্ছু হবেনা। যহবার আমার হবে। আমি মরে যাব......."

"কি হয়েছে তোমার অপেক্ষা করনা আর কিছুটা সময়।"

"তুমি জাননা আমি একটা মেয়ে মানুষ। আর মেয়ে মানুষ ইচ্ছে করলেই সব কিছু পারেনা। এত ভিতু কেন তুমি? তোমার শরীরে কি রক্ত মাংস নেই?তোমার শরীরে কি গণ্ডারের চামড়া?এত অপমান সহ্য করে কেন তুমি এখানে মুখ থুবড়ে পড়ে থাক?দুরে গিয়ে মরতে পারনা?"

"ফারজানা তুমি তো জান,আমার মা‌‌‌‌ টা এ জগতে বড় দূঃখি। আমি এ জগতে তার আর কেউ নেই। মাকে হারাতে পারব না। তারচে বরং তুমি আমাকে ভুলে যাও।"

"কাপুরুষ! বাড়ি গিয়ে শাড়ি ব্লাউজ পড়ে বসে থকগে। যাও আমার সামনে থেকে।"

ঝরঝর করে কেদে ফেলল ফারজানা। তারপর হনহন করে হেটে চলে গেল। আমার দিকে আর তাকালোও না।

গন্ধে মাতাল করা অসংখ্য ফুল ফোটানো কদম গাছটির নিচে দাড়িয়ে রইলাম একাকী। এই কদম গাছ আমাদের ভালবাসার সাক্ষী।

এই কদম গাছের নিচে দাড়িয়ে আমাদের প্রথম ভালবাসা বিনিময় হয়েছিল। আমি উপর দিকে তাকালাম। পাতার ফাকে ফাকে কদম ফুল। মনে হল ফুলেরা যেন হাসছে আমার দিকে চেয়ে চেয়ে। সাধারণ হাসি নয়। উপহাসের হাসি। দূঃখে আমার অন্তরটা ফেটে যেতে চাইলো। পাসের বাশবাগান থেকে একটা বাদুর ডানা ঝাপটিয়ে এসে ঝুলল কদম ডালে। একটা কদম গোটা পড়ল আমার মুখের উপর। মনে হল কদম গাছটি বিদ্রুপ স্বরুপ একটি ঢিল মেরে বলল, কাপুষ।

ফারজানাদের বাড়ি আমার জন্য নিষিদ্ধ। শুধু আমি না আমার ছায়াও নিষিদ্ধ। সেদিন সকালে বসে বসে আমি,ফারজানার ভাই দিপু ও ফারজানা লুডু খেলছিলাম। এমন সময় উপস্থিত হলেন ফারজানার বাবা। ভদ্রলোক আইন ব্যবসায়ী। নামকরা উকিল। কথা বার্তা এবং চলাফেরায় বিরাট বিনয়ী ভাব। কিন্তু মন কুটিল বুদ্ধিতে ভরা। কেউ তার সঙ্গে লাগতে এলে আইনের প্যাচে ফেলে অবস্থা কাহিল করে দেন। তিনি অত্যন্ত কোমল কণ্ঠে আমাকে বললেন,"এই ছেলে, তুমি উঠে এস।"

আমি বাধ্য ছেলের মত উঠে এলাম। "আসসালামু আলাইকুম।"

তিনি সালামের জবাব না দিয়েই বললেন,"তোমাকে এই বাড়িতে রাখা হয়েছিল আমার ছেলেকে পড়ানোর জন্য,লুডু খেলার জন্য নয়। তাও যদি তুমি শুধু লুডু খেলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে তাহলেও তোমাকে ক্ষমা করা যেত। কিন্তু ইদানিং তুমি আমার মানসম্মান নিয়েও খেলা শুরু করেছ। কাজেই তোমার অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। এই মুহুর্তে তুমি আমার বাড়ি থেকে বের হয়ে যাও। তোমার জন্য আমার বাড়ি নিষিদ্ধ। তোমার ছায়াও নিষিদ্ধ। আর তোমার বাবাকে বলবে আমার সঙ্গে দেখা করতে।"

মাথা নিচু করে কথাগুলো গিলছিলাম। মাথা নিচু করেই বললাম,"জি।"

"আউট। ক্লিয়ার আউট।"

দিপুকে বললেন,"তুমি আমার জন্য এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে এসো।"

দিপু চলে গেলে ফারজানাকে ঘরের মধ্যে বাইরে থেকে তালা দিলেন্।
আমি ক্লিয়ার আউট হয়ে গেলাম।

সেদিন বাবাকে ডেকে হয়তো তিনি ভয় দেখালেন অথবা ধমক -ধামক অথবা অপমান করলেন।
ফারজানার বাবা প্রতাপশালী। সে তুলনায় আমার বাবা অতি নগন্য। কাজেই সব অপমান মুখ বুজে সহ্য করে তিনি বাড়িতে ফিরে এলেন। অপমানের জ্বালা আর যত রাগ ঝাড়লেন আমার উপর।
ঘটনার সবিস্তার বর্ণনা করার সুযোগ পেলাম না। প্রচণ্ড মার খেলাম বাবার হাতে।
মা আপত্তি করলে তিনিও মার খেলেন। এটা কোন ব্যাপার নয়। বাবার হাতের মার খাওয়া আমার এবং মার কাছে পান্তা ভাত।
সেই ছোটবেলা থেকেই খেয়ে আসছি। কিন্তু আমার বাবা এখানেই থামলেন না। ঘর থেকে আমার সব বই খাতা এনে ফেললেন উঠানের ওপর। তারপর কেরোসিন আর দেয়াশলাই এনে আগুন ধরিয়ে দিলেন। দাউ দাউ করে জ্বললো আগুন। বইগুলো যেন নয়,আমার কলিজাটা পুড়ে ছারখার হয়ে গেল। আমি শুধু বোকার মত জ্বলন্ত আগুনের দিকে চেয়ে রইলাম।

ছোবেলা থেকেই আমি কোনও স্বপ্ন দেখিনা। আমার কোনও স্বপ্ন নেই। তবুও মনে হলো,আমার বুঝি সব শেষ হয়ে গেল। আর দুই মাস পরে আমার অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা। আশা ছেড়ে দিলাম। কি হবে আর পড়ে?

এত্তসব স্বত্তেও আমি ফারজানার বাবার কথা রাখতে পারিনি। তবে ওদের বাড়ি পর্যন্ত যাওয়ার সাহস আমার হয়নি। আমার ঠিকানা ওই কদম গাছ। ওদের ঘরের পেছনে একটা লাউমাচা,সরিষা,মুলা,ডাটা প্রভৃতি সবজির একটা ছোট বাগান। তার দশ কি পনের হাত দুরে কদম গাছটা। আমি ওখানে এলে ফারজানাও কিভাবে যেন টের পেয়ে যায়। আমি কতদিন ওকে না বলে এসে দেখেছি,কিছুক্ষণ পরে ও ঠিকই টিপটিপ পায়ে এসে হাজির হয়।"আমি এখানে এলে তুমি বোঝ কিভাবে?"

"তোমার গায়ের গন্ধ পাই।"

"ধুর,ধুর, আমার গায়ের আবার গন্ধ কি?"

"সেটা আমি জানি তুমি বুঝবে না।"

"মিথ্যা কথা।"

"তাহলে বল তো আমি কিভাবে টের পাই।"

"তুমি সব সময় নজর রাখ এই জায়গাটার দিকে।"

ফারজানাদের বাড়ির সামনে দিয়ে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে যে বড় রাস্তাটা তার এক কিলোমিটার পূর্বে আমাদের বাড়ি। ফারজানার বাবা আমার জন্য তার বাড়ি নিষিদ্ধ করার পর সন্ধার পর লুকিয়ে এভাবে ওই কদম গাছের নিচে ফারজানার সঙ্গে দেখা করি। পরে বাড়িতে ফিরে যাই।

আজ আর বাড়িতে যেতে ভাল ইচ্ছ করছে না। আমি বরং উল্টাদিকে হাটা ধরলাম। পশ্চিম দিকে খানিক এগুলেই নদী। জোৎস্না রাতে নদীর পাড়ে বসে নদীর পানি দেখতে কেমন লাগে!

কেমন এক ঘোরলাগা অবস্থায় নদীর দিকে হেটে যেতে লাগলাম। রাস্তা ছেড়ে বিস্তির্ণ মাঠের মধ্যে নেমে পড়লাম। শস্যের মাঠ পেরিয়ে ধীরে ধীরে নদীর পাড়ে এসে পড়লাম। ঘন দূর্বা ঘাসে কি সুন্দর বিছানা হয়ে আছে! মন্ত্রমুগ্ধের মতো বসে পড়লাম।

চাদ উঠেছে। পূর্ণ চাদ। জোৎস্না এসে পড়েছে নদীর বুকে। মৃদু বাতাসে পানিতে কাপুনি হচ্ছে। চকমক করছে পানি। আমার মনে এসে দোলা লাগছে। ইশ! মনটা কেমন করে ওঠে। মনের অজান্তেই বলে ফেললাম কি সুন্দর! কি সুন্দর!

নদী পাড়ের মদীর হাওয়ায় মন উতলা হলো আমার। মনে হলো স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ মর্ত্যলোক থেকে ফিরে এসে গাইছেন,আজ জোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে...

আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। কোথায় বসে গাইছেন?কোথায় বসে?

রবীন্দ্রনাথ লিখতেন। তিনি কি গাইতেনও। এটা আমার জানা নাই। তবুও মনে হলো তিনিই গাইছেন।

স্রোতের তোড়ে ভেসে যাচ্ছে কচুরিপানা। স্রোত যেদিকে যায় কচুরিপানাও সেদিকে যায়। এর কোন নিজস্ব গতি নেই। এই যে আমি এখন এই মধ্যরাত্রিতে নদী পাড়ে বসে আছি এটা কি আমার ইচ্ছায়? যদি উত্তর না হয় তাহলে আমিও কি স্রোতের তোড়েই ভেসে চলছিনা?আমার কি নিজস্ব কোন গতি আছে?


আকাশের দিকে তাকালাম। চাদ একা। আলো ছড়াচ্ছে পৃথিবীতে আর মিটি মিটি হাসছে। আমি ও যদি কখনো এমন একা হয়ে যাই তাহলে কি আমি ও হাসতে পারবো?আমার মা‌‌‌‌‌‌ ও তো ওই চাদের মত একা। তাহলে তিনি কখনো হাসেন না কেন?

সারা রাত ওভাবে বসে থেকে মনের মধ্যে নানা কল্পনা করে মনটাকে নোংরা স্টেশনে পরিণত করে ভোরবেলা নদীর জলে গোসল করে বাড়ির দিকে রওনা হলাম। বাড়িতে গিয়ে টের পেলাম গত রাতে আমি আমার এই পৃথিবীর সেরা রত্নটিকে হারিয়েছি।

মা প্রতি ভোরে উঠে ফজরের নামাজ পড়ে কোরান শরিফ নিয়ে বসেন। আজ ঘরে গিয়ে দে;খলাম মা শুয়ে আছেন। কি ব্যাপার?মা কি তাহলে অসুস্থ?কপালে হাত রাখলাম। একি শরীর এত ঠাণ্ডা কেন?

"মা,ও মা।"

কোন সাড়া নেই।

"মা,ওমা। শরীর খারাপ নাকি তোমার?ফজরের নামাজ পড়বা না? ওয়াক্ত চলে গেল যে।"

কাপড় বদলে এসে মায়ের পাশে বসলাম। একি হাত ও তো ঠাণ্ডা!

"কাল রাতে আমি আসিনি বলে কি তুমি আমার উপরে রাগ করেছ?আমি জানি তুমি আমার জন্য চিন্তা করেছ মা।"

যতই ডাকা ডাকি করি কোন সাড়া -শব্দ নেই। আসলেই তো নেই। নিঃশ্বাস ও তো পড়ছে না।

আমাদের উপর অভিমান করে আমার মা এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। কিছুই করতে পারলাম না তার জন্য বড় অপদার্থ আমি।

এই পৃথিবীতে আমাকে বোঝার জন্য ছিল দুজন মাত্র মানুষ। এজন মা। তিনি চলে গেলেন। আর একজন ফারজানা। তাকেও পাবার আশা নেই।

আর বাবা থেকেও নেই। অবশ্য তাকে আমি বাবা বলে স্বীকার ও করি না। তিনি আমার জন্মদাতা বাবা নন। জন্ম দিলেই জন্মদাতা হওয়া যায় কিন্তু বাবা হওয়া যায় না। তাকে আমি বাবা বলে ডেকেছি বলেও আমার মনে হয়না। বাবার আলাদা সংসার আছে। তিনি সেখানে অ্যাকটিভ। চাকরানির মত দিন-রাত খেটেও আমার মা শেষ পর্যন্ত এ সংসারে টিকে থাকতে পারলেন না। বাবার কাছে আমি এবং মা চতুর্থ বিষয়ের মত।


আমার প্রতি মায়ের ভালবাসা ছিল নিখাদ। ভালবাসায় চাওয়া-পাওয়ার বিষয়টা থাকেই। তবে তা মুখ্য বিষয় নয়। যে তোমার ভালবাসা পেলেই আমি তোমাকে ভালবাসবো,না হলে বাসবো না,সেটা তাহলে ভালবাসা নয়। সেটা অন্য কিছু। যে কিছু পায় বা না পায়, তবু ভালবেসেই যায় সেটাই হল নিখাদ ভালবাসা। আমার প্রতি মায়ের ভালবাসা ছিল এমনি নিখাদ।

ফারজানাও কি আমাকে এমন করে ভালবাসে,নাকি ও আমাকে শুধু পাওয়ার আশায় ভালবাসে?না পেলে আমাকে ভালবাসবে না। কে জানে?তবে আমার মন বলে ফারজানাও আমাকে ছাড়া ভাল থাকতে পারবে না। তাই ওর জন্যে হলেও ওকে আমার পেতেই হবে। কিন্তু তা কিভাবে সম্ভব?

আমি আমার বাবাকেও চিনি,ফারজানার বাবাকেও চিনি। তারা কোনদিন আমাদের এক হতে দেবেন না। তারা মানুষ নন।

ফারজানা বোধ হয় এ জন্যই আমাকে পালিয়ে যাবার কথা বলেছিল।


'চলো।'
ফারজানা অপলক আমার মুখপানে চেয়ে রইলো। কোন কথা বললো না।

হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে আবারো বললাম,'ধরো। মেয়ে মানুষের হাত নয়,পুরুষ মানুষের হাত।'

ফারজানা আমার হাত ধরলো। যেন সব পাওয়া হয়ে গেছে। আমাদের আর কিছু লাগবে না। আজ সব ভয়,লজ্জা জলাঞ্জলি দিয়েই এই হাত ধরেছি। কিন্তু স্বয়ং ভাগ্য দেবতা যেখানে অপ্রসন্ন সেখানে আমার এক এক হাত দিয়ে কেন পৃথিবীর সব মানুষের হাত দিয়ে ধরলেও কাজ হবে না।

বড় রাস্তার মোড় পর্যন্ত যেতেই পুলিশের জিপ এসে থামলো আমাদের সামনে আচানক ভাবে। কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই লাফিয়ে পড়লো পুলিশের দল। ঘিরে ফেললো আমাদের।

সে দলে ফারজানার বাবাও আছেন। তিনি ফারজানার একটি হাত ধরে টান দিলেন। অন্য হাত আমার হাতের সংগে বাধা। আমি ছাড়ছি না। রিতিমত টানাটানি অবস্থা। 'হেইও''হেইও'।

দুজন পুলিশ এসে পাজা করে ধরলো আমাকে। ফারজানার হাত ছাড়ছি না দেখে সবচেয়ে মোটা আর ঘন গোফওয়ালা যে পুলিশটা সম্ভবত দলপতি,সে এগিয়ে এলো। বন্দুকের গোড়া দিয়ে এক ঘা বসালো আমার হাতে। ফারজানা পুরোপুরি চলেগেল তার বাবার দখলে।

আমি চেঁচিয়ে বললাম,'ছাড়ুন,আমাকে ছাড়ুন। কেন ধরেছেন আমাকে?আমার কি অপরাধ?


ইতিমধ্যে হাতকড়া পড়ানো হয়েছে আমার হাতে। পেটের মধ্যে বন্দুকের গোড়ার আরেক ঘা খেলাম। চোখে শত শত জোনাকি পোকা দেখতে লাগলাম। সর্দার পুলিশ দাত কটমট করে বলতে লাগলেন,'চোপ শালা,ভদ্রলোকের মেয়েকে নিয়ে পালাচ্ছিস আবার বলছিস অপরাধ। '
'আমাকে একশবার ধরলেও আমি ওকে নিয়ে যাবই।'
'চোপ শালা,চোপ। খান সাহেব আপনি মেয়ে নিয়ে বাড়ি যান। এ শালার ব্যবস্থা আমি করছি।'

ফারজানার বাবা ওকে নিয়ে চললেন। ফারজানা চাপা কণ্ঠে বললো,'মাহবুব তুমি এসো কিন্তু। আমি অপেক্ষা করবো। সব বাধা পেরিয়ে তুমি এস।'

এদিকে পুলিশ অফিসার তার কথা রাখলেন। আমার ব্যাবস্থা করলেন।
'শালা,শুয়োরেরবাচ্চা,ভদ্রলোকের মেয়েকে নিয়ে পালাস আবার বলছিস অপরাধ। আজ তোর বাবার নাম ভুলিয়ে ফেলবো। ভালবাসা আজ তোর পাছা দিয়ে ঢুকায়ে দেবো।'
তার এতটুকু দয়া-মায়া নেই। বন্দুকের গোড়া দিয়ে ইচ্ছামত পেটালো আমার পাছা এবং পিঠের মধ্যে। পুলিশের নিষ্ঠুরতার কথা লোকমুখে শুনেছিলাম। এতোদিন পরে পরিচিত হলাম। শক্ত বুটের প্রচণ্ড একটা লাথিও খেলাম। চোখে-মুখে অন্ধকার দেখতে লাগলাম। রাগে-দুঃখে আমার চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এল। কিন্তু মুখে কিছু বললাম না।

'এই শালারে গাড়িতে তোল'। অফিসারটি বললেন।
উঠে দাড়ানোর শক্তি ছিল না আমার।
ওরাই ধরাধরি করে গাড়িতে তুললো আমাকে।
গাড়ি সিটে বসে মাথা সোজা রাখতে পারছিলাম না। ওরা আমাকে ধাক্কা দিয়ে পায়ের কাছে ফেলে দিলো। সেখানে জ্ঞান হারালাম। তারপর আর কিছু মনে নেই।


ছয় মাসের জেল হলো আমার। এই সময়ের মধ্যে কেউ এলনা আমার সংগে দেখা করতে না ফারজানা, না বাবা। ফারজানা মেয়ে মানুষ তার হাত-পা বাধা। কিন্তু বাবা? আমার মনে একটি প্রশ্ন জাগে, ছোটবেলায় আমার বাবা কি আমাকে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন?আমার প্রতি তার এত ঔদাসীন্যতা কেন?মা এবং আমার সংগে বাবার এহেন সম্পর্ক আজও আমার কাছে রহস্য।

যাহোক,বাবা বিষয়ক প্রশ্নটা আমি মন থেকে মুছে ফেললাম। বাবা নামটা আমার খাতা থেকে কেটে দিলাম।

যখন ছাড়া পেলাম তখন সোজা চলে গেলাম সেই কদম গাছের নিচে। আমার ধারণা ছিল,ওখানে গেলেই ফারজানা আসবে। কিন্তু আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। ফারজানা এলো না।
কেন এলো না?কেন এলো না?

দুই হাতে কদম গাছটাকে জড়িয়ে ধরলাম। কাদো কাদো গলায় বললাম,'হে কদম বৃক্ষ,তুমি বলো আমার অপরাধ কি?ও আসছে না কেন?আসছে না কেন?'

গাছটি একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। বাতাস বইছিল না। তবুও সমস্ত গাছটি যেন হটাত কেপে উঠলো। আমি হিতাহিত জ্ঞান হারালাম।

সোজা ছুটলাম ফারজানাদের বাড়িতে। চিতকার ডাকলাম,'ফারজানা,ফারজানা কোথায় তুমি?আমি এসেছি। সত্যি এসেছি।'
ফারজানা এলো না। দরজা খুলে ওর বাবা বেরিয়ে এলেন।
'কি চাও?'
'ফারজানাকে চাই।'
'ও নেই।'
'কেন?কি হয়েছে ওর?'
'ওর বিয়ে হয়ে গেছে। ও এখন তোমাকে ভুলে গেছে।'
'না। বিশ্বাস করিনা আমি। ও আমাকে বলেছিল অপেক্ষা করবে।'
'তোমার বিশ্বাস-অবিশ্বাসে কিছু যায় এসে না। আউট। ক্লিয়ার আউট।'

সেদিন মা'র কবরের পাসে গিয়ে কেদেকেদে চোখের সমস্ত জল শেষ করে ফেলতে চাইলাম। কিন্তু শেষ হল না। অঝর ধারায় ঝরতে লাগলো।
বললাম,'মা,মা,মাগো তুমি কেন আমাকে একা রেখে চলে গেলে?আমি যে এখন বড় অসহায়। বড় একা। কেউ আমারে ভালবাসেনা মা। এই পৃথিবীর মানুষগুলো বড় নিষ্ঠুর। এখানে আমার কোন স্থান নেই। আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যাও,মা। মা,মা,মাগো....'

কোথাও ফারজানার সন্ধান পেলাম না। তারপর যে আমি কোথা থেকে কোথায় গেলাম তার কোন হিসাব নেই। দাড়-গোফে আমার সমস্ত মুখ ঢেকে গেল। পরিধিত বস্ত্র মলিন হতে হতে এক সময় ছিড়ে গেল।কিন্তু সে দিকে আমার খেয়াল ছিল না। ক্ষিধে লাগলে ভিক্ষুকদের দলে মিশে যেতাম। কখনো বা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতাম। গাছ তলায় বসে থাকতাম। কখনো বা আমার লজ্জাস্থান বেরিয়ে পড়ে। তাই দেখে দুষ্টু ছেলের দল ইটপাটকেল ছোড়ে। কপাল ফাটায়। রক্ত বের হয়। পাগল পাগল বলে ধাওয়া করে। আমি দৌড়াই। দৌড়াতে মজা পাই। শরতবাবুর 'দেবদাস' পড়ার সময় কত টিটকারিই না ক্রেছিলাম দেবদাসকে। আজ নিজেই যে সাক্ষাৎ দেবদাসে পরিণত হলাম!

এভাবে একদিন দৌড়াতে গিয়ে চলন্ত মোটরবাইকের সংগে ধাক্কা খাই। ছিটকে পড়ি রাস্তার পাশের খাদে। শরীরের বিভিন্ন স্থান কেটে-কুটে গুরুতর ভাবে আহত হই। অচেতন হয়ে ওখানেই পড়ে রই।

যখন জ্ঞান ফিরলো তখন দেখি যে হাসপাতালের বেডে আছি। আমার বাম পাশে কর্তব্যরত ডাক্তার এবং নার্স। ডান পাশে কাচা-পাকা চুলের চল্লিশ-উর্ধব এক ভদ্রলোক। তিনি আমার দিকে উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়ে আছেন। চোখ মেলে তাকাতেই তিনি বললেন,'এখন কেমন বোধ করছেন?'
যদিও সুস্থ বোধ করছিলাম তবুও কথা বলতে ইচ্ছা হল না। চোখ বুজে কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করতে লাগলাম।
ডাক্তার তাকে বাইরে ডেকে নিয়ে গেলেন। আবার ফিরে এসে বসলেন আমার শিয়রে। চোখ মেলে তাকালাম।তিনি বললেন,'আপনি আমার হোন্ডার সাথে এ্যাকসিডেন্ট করেছিলেন। বিশ্বাস করুন ঘটনাটা আচমকা ঘটে গেছে। আজ তিন দিন হয়ে গেল আপনার কোন হুশ নেই। কি যে দুশ্চিন্তার মধ্যে ছিলাম,জানে পানি ছিল না রে ভাই!'
অপলক চেয়ে রইলাম কত তফাৎ মানুষে মানুষে কেউ মেরে রক্তাক্ত করে জেলে ভরে,কেউ রাস্তা থেকে তুলে এনে হসপিটালে ভর্তি করায় আবার তিন দিন ধরে দুশ্চিন্তায় থাকে। বড় অদ্ভুত যায়গা এই পৃথিবী। কিন্তু এই লোক কে?কেন আমার জন্য এতটা করছেন?এ্যাকসিডেন্ট করে তিনি তো দিব্যি পালিয়ে যেতে পারতেন।
বললাম,'আমাকে তুলে আনলেন কেন?'
'সে কি,আপনি তো আহত হয়েছিলেন?আপনি মারা যেতে পারতেন।'
'ওটাই তো ভাল ছিল। এই পৃথিবীর আলো-বাতাস বড় বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। আর ভালো লাগে না।'

'আপনার ঠিকানা বলুন। পৌছে দেই।'
'আমার তো কোনো ঠিকানা নেই।'
ভদ্রলোক হতবাক হয়ে চেয়ে রইলেন। বললেন,'সে কি কথা!'
'যা সত্য তাই। যেখান থেকে তুলে এনেছিলেন সেখানেই রেখে আসুন না হয়। ওটাই আমার ঠিকানা।
'আমার সংগে যাবেন?'
কোনো কথা বললাম না। তার দিকে চেয়ে রইলাম। চোখটা ভারী হয়ে উঠলো। সম্ভবত জলে ভরে উঠেছে।

ভদ্রলোকের নাম রাজা চৌধুরী। বাড়ি শেরপুর জেলা শহরে। সেখানেই 'আশা কিন্ডারগার্টেন' নামে একটি স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক তিনি। তার বাবা,মা এবং অন্য ভাই বোনেরা বিদেশে থাকেন। বিয়ে করেননি। আমার মুখে ঘটনা সবিস্তার শুনে তিনি আমাকে তার কাছে রেখে দিলেন। স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনলেন আমাকে। তার উতসাহে নতুন করে বাঁচতে ইচ্ছা হলো আমার।
তিনি বললেন,'কি হয়েছে তোমার?এর চেয়ে বড় বড় ঘটনা ঘটে মানুষের জীবনে। আসলে আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাদের মাঝে মধ্যে বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে ফেলে পরীক্ষা করেন। যারা কৃতকার্য হয় তারাই হয় আল্লাহর প্রিয় বান্দা। আর যারা অকৃতকার্য হয়,আল্লাহ তার খাতা থেকে তাদের নাম কেটে দেন।'
'কিন্তু ভাই আমার অপরাধটা কোথায়?'
'অপরাধ!অপরাধের কথা কেন বলছ ভাই?মন থেকে নেগেটিভ ভাবনা মুছে ফেল। বরং এমন করে ভাবতে চেষ্টা করো,মনে ম্নে আল্লাহকে বলো, হে আল্লাহ,তুমি যে আমাকে এখনো প্রাণে বাঁচিয়ে রেখেছ তার জন্যে তোমার দরবারে হাজার শোকর। কয়টা দিন বাচি আমরা পৃথিবীতে?খুব অল্প দিন। তার জন্য এত হা-হুতাশের প্রয়োজন নেই। স্বভাবিক হওয়ার চেষ্টা করো মাই ব্রাদার।'
তার কথায় আমার কি হলো আমি জানিনা। তবে এটুকু মনে হলো,আল্লাহ আমাকে একজন সঠিক মানুষ পাইয়ে দিয়েছে। তিনি আমাকে তার স্কুলে শিক্ষকতার দ্বায়িত্ব দিলেন। থাকার জায়গা দিলেন। আমার যা কিছু প্রয়োজন,সব কিছুর ব্যবস্থা করলেন।
রাতের বেলা যা হোক না কেন,দিনের বেলা ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের নিয়ে ব্যস্ত থাকলাম। এভাবেই জীবন থেকে আরও সাতটি বছর পার হয়ে গেল।

এই সাত বছর পরে একদিন সকালে স্কুলের ক্লাস শুরু হওয়ার আগে স্কুলের অফিস রুমে বসে সেদিনের দৈনিক পত্রিকাটা চোখের সামনে তুলে ধরে বসে ছিলাম। এমন সময় এক ভদ্রমহিলা পাঁচ-ছয় বছরের একটি নাদুস-নুদুস বাচ্চা নিয়ে রুমে ঢুকলেন।
আমি বাচ্চাটির দিকে তাকালাম। ভারী মিস্টি চেহারা।
কিছুক্ষণ পরে বাচ্চাটির মা বললেন,'আমার মেয়েকে আপনাদের এখানে ভর্তি করাতে চাই।'
কণ্ঠস্বরটি আমার বুকের গভীর থেকে আরো গভীরে গিয়ে ধাক্কা দিলো। থতমত খেয়ে তাকালাম মহিলার দিকে। তাকিয়েই আমি ভূত দেখার মত চমকে উঠলাম। চোখে চোখ পড়াতে সেও চমকে উঠলো।
আমার সামনে ফারজানা দাড়িয়ে!
ধীরে ধীরে উঠে দাড়ালাম। চোখে চোখ রাখলাম। কোনো কথাই বলতে পারছিলাম না।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মে, ২০১৫ রাত ১০:৪১
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=নিছক স্বপ্ন=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৯ শে মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৮



©কাজী ফাতেমা ছবি
তারপর তুমি আমি ঘুম থেকে জেগে উঠব
চোখ খুলে স্মিত হাসি তোমার ঠোঁটে
তুমি ভুলেই যাবে পিছনে ফেলে আসা সব গল্প,
সাদা পথে হেঁটে যাব আমরা কত সভ্যতা পিছনে ফেলে
কত সহজ... ...বাকিটুকু পড়ুন

একদম চুপ. দেশে আওয়ামী উন্নয়ন হচ্ছে তো?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৯ শে মে, ২০২৪ রাত ১০:৫৯



টাকার দাম কমবে যতো ততোই এটিএম বুথে গ্রাহকরা বেশি টাকা তোলার লিমিট পাবে।
এরপর দেখা যাবে দু তিন জন গ্রাহক‍কেই চাহিদা মতো টাকা দিতে গেলে এটিএম খালি। সকলেই লাখ টাকা তুলবে।
তখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে গরু দুধ দেয় সেই গরু লাথি মারলেও ভাল।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২০ শে মে, ২০২৪ রাত ১২:১৮


০,০,০,২,৩,৫,১৬, ৭,৮,৮,০,৩,৭,৮ কি ভাবছেন? এগুলো কিসের সংখ্যা জানেন কি? দু:খজনক হলেও সত্য যে, এগুলো আজকে ব্লগে আসা প্রথম পাতার ১৪ টি পোস্টের মন্তব্য। ৮,২৭,৯,১২,২২,৪০,৭১,৭১,১২১,৬৭,৯৪,১৯,৬৮, ৯৫,৯৯ এগুলো বিগত ২৪ ঘণ্টায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

কোরআন কী পোড়ানো যায়!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৮

আমি বেশ কয়েকজন আরবীভাষী সহপাঠি পেয়েছি । তাদের মধ্যে দু'এক জন আবার নাস্তিক। একজনের সাথে কোরআন নিয়ে কথা হয়েছিল। সে আমাকে জানালো, কোরআনে অনেক ভুল আছে। তাকে বললাম, দেখাও কোথায় কোথায় ভুল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরানের প্রেসিডেন্ট কি ইসরায়েলি হামলার শিকার? নাকি এর পিছে অতৃপ্ত আত্মা?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯


ইরানের প্রেসিডেন্ট হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে নিহত!?

বাঙালি মুমিনরা যেমন সারাদিন ইহুদিদের গালি দেয়, তাও আবার ইহুদির ফেসবুকে এসেই! ইসরায়েল আর।আমেরিকাকে হুমকি দেয়া ইরানের প্রেসিডেন্টও তেমন ৪৫+ বছরের পুরাতন আমেরিকান হেলিকপ্টারে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×