কবিতা বা ছড়া লেখা কঠিন কোন কাজ নয়। বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশে কাক এর সংখ্যার চেয়ে কবির সংখ্যা নাকি বেশি। হতে পারে, একজন কবি হিসেবে এরকম কথা শুনে গর্ব বোধ করি! কারণ কবিদের অবজ্ঞা করে এমন কথা বলা হলেও আমি মনে করি সত্যি যদি দেশে কবির সংখ্যা কাকের সংখ্যার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি হয়ে যেত তাহলে মন্দ হতো না। কিন্তু মাঝে মাঝে খারাপ লাগে যখন দেখি অনেক কবি বা ছড়াকার ছন্দ সম্পর্কে তেমন কোন ধারনা ছাড়াই কাব্য চর্চা করে যান। শুরুটা ছন্দজ্ঞান ছাড়াই হবে, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু যখন লিখতে লিখতে সাহিত্য জগতে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার মতো সময় চলে আসবে তখনও কি ছন্দ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা আমাদের উচিত নয়? অনেক কাব্য প্রতিভা আছেন যারা ছন্দজ্ঞান ছাড়াই নির্ভুল কবিতা বা ছড়া রচনা করতে পারেন। এটা অনেক সময় হয়ে গেলেও তাদের চলার পথে যে কোন মুহূর্তে ছন্দ পতন ঘটতে পারে। তাই ছন্দ সম্পর্কে অন্তত প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করাটা কবিতা বা ছড়া সংশ্লিষ্ট সকলের জন্য অত্যন্ত জরুরি।
ছন্দ কাকে বলে?
বিভিন্ন ছন্দ বিশেষজ্ঞ ছন্দকে বিভিন্ন আঙ্গিকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। আসুন প্রথমে তাদের বক্তব্যগুলো এক নজরে দেখে নেই।
প্রখ্যাত ছান্দসিক প্রবোধচন্দ্র সেনের মতে ‘শিল্পিত বাক্রীতির নামই ছন্দ।’
অমূল্যধন মুখোপধ্যায় বলেছেন, ‘ যেভাবে পদবিন্যাস করিলে বাক্য শ্রুতিমধুর হয় এবং মনে রসের সঞ্চার হয়, তাহাকে ছন্দ বলে।’
তারাপদ ভট্টাচার্য ছন্দ বলতে ‘গতি সৌন্দর্য’ বুঝিয়েছেন এবং তিনি সাহিত্যিক ও ব্যবহারিক অর্থে ছন্দকে ‘ভাষার অন্তর্গত প্রবহমান ধ্বনিসৌন্দর্য’ বলে উল্লেখ করেছেন।
কেউ কেউ ‘নির্দিষ্ট সংখ্যক অক্ষর ও যতিবিশিষ্ট সুখপাঠ্য পদ-বিন্যাসই ছন্দ’- এ ধরনের সংজ্ঞাও প্রদান করেছেন।
ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, ‘বাক্যস্থিত পদগুলিকে যেভাবে সাজাইলে বাক্যটি শ্রুতিমধুর হয় ও তাহার মধ্যে ভাবগত ও ধ্বনিগত সুষমা উপলদ্ব হয়, পদ সাজাইবার সেই পদ্ধতিকে ছন্দ বলে।’
অধ্যাপক মাহবুবুল আলম তাঁর ‘বাংলা ছন্দের রূপরেখা’ গ্রন্থে ছন্দের সূত্র নির্দেশ করতে গিয়ে বলেন, ‘বাক্য-পরম্পরায় ভাষাগত ধ্বনি প্রবাহের সুসমঞ্জস, সঙ্গীতমধুর ও তরঙ্গ-ঝঙ্কৃত বঙ্গি রচনা করা হয় পরিমিত পদবিন্যাসরীতিতে- তাকে ছন্দ বলেন।’
অতএব, বিশেষজ্ঞদের উপরোক্ত মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে, ‘ছন্দ হচ্ছে কোন ভাষার এমন এক ধরনের পদবিন্যাসরীতি যা বাক্যকে তরঙ্গিত, শ্রুতিমধুর এবং সুখপাঠ্য করে তোলে।
ছন্দ কেন প্রয়োজন?
কবিতা বা ছড়ার প্রাণ হচ্ছে ছন্দ। গদ্যে যে কথাটি সাধাসিধে বলে মনে হয় সে কথাটাকেই ছন্দোবদ্ধভাবে বললে অনেক বেশি শ্রুতিমধুর শোনায়। মানুষের মনে রাখাটাও সহজ হয়ে যায়। উদাহরণ স্বরূপ লক্ষ্য করুন- ‘এইখানে তোর দাদীর কবর ডালিম গাছের তলে/ তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।’ এই দুটি লাইনকে গদ্যের ভাষায় লিখলে কেমন লাগে? ‘এইখানে ডালিম গাছের তলায় তোর দাদীর কবর, তিরিশ বছর থেকে দুই নয়নের জলে ভিজায়ে রেখেছি।’
এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, ‘শুধু কথা যখন খাড়া দাঁড়িয়ে থাকে তখন কেবলমাত্র অর্থকে প্রকাশ করে। কিন্তু সেই কথাকে যখন তির্যক ভঙ্গি ও বিশেষ গতি দেওয়া যায় তখন সে আপন অর্থের চেয়ে আরও কিছু বেশি প্রকাশ করে।’
(আগামী পর্বের আলোচ্য বিষয়- বাংলা ছন্দের উপাদান)।
তথ্যসূত্র: বাংলা ছন্দের রূপরেখা- মাহবুবুল আলম