মুক্তিযুদ্ধ শেষে বাংলাদেশে ফিরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাঁর প্রথম টেলিভিশন ভাষণে বলেছিলেন, "দশ লক্ষাধিক মানুষের আত্মাহুতির মাঝ দিয়ে আমরা পশুশক্তির হাত থেকে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা বিধৌত বাংলাদেশকে স্বাধীন করে ঢাকার বুকে সোনালী রক্তিমবলয় খচিত পতাকা উত্তোলন করেছি"। (দৈনিক বাংলা, ৪ জানুয়ারী ১৯৭২)
তাজউদ্দিন আহমেদ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছেন, যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে তিনি যথেষ্ট পরিমান ধারণা রাখতেন, কাজেই তার বলা এই সংখ্যাটিও যথেষ্ট গুরুত্বের দাবী রাখে।
তাহলে ৩০ লক্ষ সংখ্যাটার উদ্ভব কোথায়?
২০১১ সালের ২৩ মে, বিবিসির বাংলা বিভাগের উপ-প্রধান সিরাজুর রহমান ব্রিটিশ পত্রিকা দ্যা গার্ডিয়ানে একটি চিঠি পাঠান। তিনি ইয়ান জ্যাকের লেখা একটি প্রবন্ধ যেখানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মৃতের সংখ্যা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছিলো, তার উপর নিজের মতামত প্রকাশ করেছিলেন। জনাব রহমান একটি ইতিহাস তুলে ধরেন সেখানে। তিনি লেখেন, “১৯৭২ সালের জানুয়ারীর ৮ তারিখে, আমিই ছিলাম প্রথম বাংলাদেশী যিনি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে দেখা করি। তাঁকে হিথ্রো থেকে লন্ডনের ক্ল্যারিজেসে আনা হয় এবং আমি প্রায় সাথে সাথে সেখানে পৌঁছাই তিনি যখন আমার কাছ থেকে জানতে পারেন যে তার অবর্তমানেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে এবং তাঁকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করা হয়েছে, তখন তিনি বিষ্মিত হন। দৃশ্যত তিনি লন্ডনে এসেছিলেন এই ধারণা নিয়ে যে তিনি পূর্ব-পাকিস্তানিদের যেই স্বায়ত্বশাসনের জন্যে লড়াই করছিলেন পাকিস্তানিরা তা মেনে নিয়েছে।
সেইদিন আমি এবং অন্যরা তাঁকে যুদ্ধের একটি বিবরণ দেই। আমি তাঁকে জানিয়েছিলাম যে এখন পর্যন্ত যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির কোন সঠিক হিসাব জানা যায়নি, তবে বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে আমাদের অনুমান, কমপক্ষে তিন লাখ মানুষ মারা গিয়েছেন। আমি খুবই অবাক হয়েছিলাম যখন তিনি ডেভিড ফ্রস্টকে বললেন ত্রিশ লক্ষ মানুষকে পাকিস্তানিরা হত্যা করেছে। আমি জানি না কি কারণে তিনি এই সংখ্যাটি বলেছিলেন, হয়তো তিনি মিলিয়ন শব্দটির ভুল অনুবাদ করেছিলেন কিংবা তাঁর অস্থিরচিত্ত এর জন্যে দায়ী হয়ে থাকতে পারে। তবে আজও অনেক বাংলাদেশী বিশ্বাস করেন সংখ্যাটি আসলেই অতিরঞ্জিত।” (http://goo.gl/AP3k5z)
১৯৯১ সালে ড. এম এ হাসানের নেতৃত্বে গঠিত ‘ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি’ নামে একটি সংগঠন সুনির্দিষ্ট গবেষণা পদ্ধতি অনুসরণ করে প্রায় ১৭ বছর যাবৎ মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে দেশে শহীদের সংখ্যা নিরূপনের চেষ্টা করে। তাদের সংগঠনটি পুরো বাংলাদেশ চষে বেড়িয়েছে, গ্রামে গ্রামে গিয়েছে।
ড. হাসান অনুমান করেন, যদি প্রতিটি কবরে ১০০টি করে লাশ থাকে তবে মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়াবে ৫,০০,০০০। অবশ্য, ডঃ হাসানের মতে এই অনুমান মোট মৃতের সংখ্যার ৩০ শতাংশের মত, কারণ তিনি গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দাদের সাক্ষাৎকার থেকে অনুমান করেছেন যে মোট নিহতের প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষকে গণকবরে সমাহিত করা হয়েছিলো আর বাকীদের দেহ নদী-নালায় বা উন্মুক্ত স্থানে ফেলে দেয়ায় তা পচে গলে নষ্ট হয়ে গেছে।
এভাবে ডঃ হাসান, যিনি সম্ভবত এই বিষয়ে দীর্ঘসময় গবেষণাকারী একমাত্র বাংলাদেশী, অনুমান করেন মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা ১২ লক্ষের মত হবে। এই সংখ্যাটি ১৯৭২ সালে প্রকাশিত কল্যান চৌধুরীর লেখা 'জেনোসাইড ইন বাংলাদেশ' বইতে উল্লেখিত ১২,৪৭,০০০ এর প্রায় কাছাকাছি।
যাদের রক্তে মুক্ত স্বদেশ, তাদের পরিচয় জানার অধিকার এই দেশের ভবিষ্যত নাগরিকদের রয়েছে। সেই ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলোকে ক্ষতিপুরণ আদায় করে দেবার প্রয়োজন রয়েছে, প্রয়োজন রয়েছে তাদের বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধায় অগ্রাধিকার দেবার। সেই কারণেই তাদের তালিকাটি আমাদের জানা থাকা দরকার।
সংকলিত
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ দুপুর ২:৩৩