somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দুর্নীতি, অনিয়ম ও বিপর্যয়ঃ মেরিটাইম বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ (পর্ব-২)

০৪ ঠা জুন, ২০১৪ রাত ১১:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রথম পর্বের পর......

আসুন দেখি কিভাবে মেরিন পেশাটিকে মিথ্যার মোড়কে ঢেকে সাধারনের কাছে লোভনীয় করে তোলা হচ্ছে শুধুমাত্র ব্যবসার স্বার্থে।
১। মেরিনদের মাধ্যমে প্রতি বছর আসছে হাজার কোটি টাকা
উপরের লেখাটিতে বিভিন্ন পরিসংখ্যান এমন ভাবে তুলে ধরা হয়েছে যে যেকোন সাধারন মানুষ তা বিশ্বাস করতে বাধ্য হবে। লেখাটি পড়ার পর মেরিন পেশায় আসার জন্য তার চোখ চক চক করে উঠবে। কারণ লেখার এক পর্যায়ে খুব সুন্দর করে লিখে দেয়া হয়েছে “মেরিন অ্যাকাডেমির সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে একজন সদ্য পাস করা মেরিন ইঞ্জিনিয়ারের গড় মাসিক বেতন ৫০০ থেকে ৭০০ ডলার।”
আমি বাংলাদেশ মেরিন একাডেমীরই একজন ক্যাডেট। একাডেমী থেকে পাস আউটের পর আমার চাকুরি করা দুইটি কোম্পানিতে কন্ট্রাক্ট করি।
একটিতে ৩০০ ডলার এবং অন্যটিতে ১৫০ ডলার। এটাই বাস্তবতা।
আমার ব্যাচের ৮০% এর ই ক্যাডেট লাইফে স্যালারি ১৫০ থেকে ৪০০ এর মধ্যে।
হ্যাঁ। একজন ক্যাডেটের বেতন ৫০০ থেকে ৭০০ ডলার ও হয়। কিন্তু যখন সেরকম একটি ভালো কোম্পানির রিকোয়ারমেন্ট ভারতের গণ্ডি পেরিয়ে বাংলাদেশের সীমানা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে এবং ম্যানিং এজেন্ট রা স্যালারি নেগোশিয়েটের সময় আর কোন কাটছাঁট না করে।
লেখকের লেখা গুলো আরও পর্যবেক্ষণ করা যাক। “এ ছাড়া চট্টগ্রামে রয়েছে আরো তিনটি বেসরকারি মেরিটাইম প্রতিষ্ঠান, যেগুলো থেকে গড়ে তোলা হয় অভিজ্ঞ নাবিক ও মেরিন প্রকৌশলী। এ তিনটি প্রতিষ্ঠান হলো নগরের হালিশহর এইচ ব্লকে অ্যাকাডেমি অব মেরিন এডুকেশন অ্যান্ড টেকনোলজি (এএমইটি), মাস মেরিটাইম লিমিটেড ও ফৌজদারহাট তুলাতলি সড়কের ওশান মেরিটাইম লিমিটেড। এসব বেসরকারি মেরিটাইম প্রতিষ্ঠানেও ভর্তির সুযোগ রয়েছে। বেসরকারি মেরিটাইম প্রতিষ্ঠান অ্যাকাডেমি অব মেরিন এডুকেশন অ্যান্ড টেকনোলজির কোর্স কো-অর্ডিনেটর মির্জা এম রহিম বলেন, বেসরকারিভাবে দুই বছরমেয়াদি এই কোর্স শেষ করতে খরচ পড়বে প্রায় ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকা। তবে বেসরকারিভাবে কোর্স করলে তারা চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে পারেন, এটি অনেক বড় সুবিধা।”

এভাবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে হাইলাইট করার কারণ কি বুঝতে পারছেন?? মেধার দৌড়ে সবাই সমান ভাবে এগিয়ে যেতে পারে না। কেউ কেউ পিছিয়ে পড়ে। কিংবা পড়তে হয়। কিন্তু এই পিছিয়ে পড়াদের পুঁজি করেই প্রাইভেট একাডেমী গুলোর প্রতি জনের জন্য ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকার ব্যবসা। বাস্তবে এখন এটি ২৪ লাখ টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
আরও কিছু লিঙ্কঃ
স্বপ্নীল ক্যারিয়ার মেরিন ইঞ্জিনিয়ার

প্রথম লিঙ্কের লেখক তার লেখার শেষ করেছেন একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা দিয়ে। যেটা সব কথার শেষ কথা। “স্কলারশিপ :উভয় পরীক্ষায় সব বিষয়ে জিপিও ৫ প্রাপ্তদের জন্য সর্বমোট খরচ ৮,৫০,০০০ টাকা। ভর্তি ফি ৩০,০০০ টাকা থেকে ৪২,৫০০ টাকা। আর অন্যদের সর্বমোট খরচ ১০,৫০,০০০ টাকা। যোগাযোগ :ওয়েস্টার্ন মেরিন একাডেমি রূপসী, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ।”
সাগর জলের হাতছানি
দ্বিতীয় জন ও ডলারের হাতছানি দেখিয়ে তার লেখার ইতি টানলেন প্রাইভেট একাডেমীর ঠিকানা দিয়ে। যেন একাডেমীতে মেধার জোরে ভর্তি না হতে পারলেও টাকার জোরে কোন মধ্যবিত্ত পরিবারের এক তরুনের সমুদ্রে যাওয়ার স্বপ্নটি হাতছাড়া না হয়। লেখক লেখার শুরুতে লিখেছেন বিশ্ব বাজারে মেরিন অফিসারের ঘাটতির কথা। কিভাবে দেখুনঃ “বিশ্বব্যাপী বছরে ছয় বিলিয়ন টন মালামাল পরিবহন করে ৫০ হাজার সমুদ্রগামী জাহাজ। কিন্তু এ কাজের জন্য প্রয়োজনীয় সি-ফেয়ারিং অফিসারের চাহিদা পূরণ করতে পারছেন না বাংলাদেশসহ ১৫০টি দেশের প্রায় ১২ লাখ সি-ফেয়ারিং অফিসার। ২০০৫ সালে ঘাটতি ছিল ১০ হাজার অফিসার। ২০১৩ সালে এ ঘাটতি ১৬ হাজার এবং ২০১৫ সালে ২৭ হাজার! ২০২৫ সাল পর্যন্ত বাড়তেই থাকবে এই ঘাটতি।”

আমি একাডেমী থেকে পাস করে বের হয়েছি ২০১১ সালে। ঘাটতির এই দুনিয়ায় ইন্টার্নশিপ শেষ করার জন্য জাহাজ পেতে পেতেই আমার প্রায় এক বছর চলে যায়। উঠি পরের বছর জানুয়ারি মাসে। এক বছর শেষ করে জাহাজ থেকে নেমে সার্টিফিকেট অব কম্পিটেন্সি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে আমার সময় লাগে ১০ মাস। আমি এখন জাহাজের একজন সার্টিফাইড অফিসার যার উপর ভরসা করে জাহাজের ক্যাপ্টেন প্রতিদিনের ৮ টি ঘণ্টা জাহাজ পরিচালনার দায়িত্ব আমার উপর অর্পণ করতে পারবেন। যেখানে জাহাজের প্রতিটি সদস্যার জীবন মৃত্যু নির্ভর করতে পারে আমার ই এই ৮ ঘণ্টার কোন সঠিক বা ভুল সিদ্ধান্ত কিংবা দায়িত্তে অবহেলার জন্য। হাঁ আমি সেই দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার যার নাকি অনেক ঘাটতি। কিন্তু সার্টিফিকেট পাওয়ার পর ও যেখানে প্রায় ৪ মাস হতে চলল। এত ঘাটতির মধ্যেও তাহলে চাকুরির বাজারে এত সঙ্কট কেন???

পাবনা মেরিন একাডেমীর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন
এই লিঙ্কে দেখুন। একই ঘাটতির কথা উচ্চারিত হচ্ছে দেশের জাহাজ শিল্পের বা পরিকল্পনা মন্ত্রনালয়ের সব বড় বড় মাথায়। “পরিকল্পনামন্ত্রী এয়ার ভাইস মার্শাল (অবঃ) এ কে খন্দকার (বীর উত্তম) বলেছেন, বিশ্বব্যাপী সমুদ্রগামী জাহাজ পরিচালনায় প্রায় সাড়ে ৬ লাখ মেরিন অফিসার ও ইঞ্জিনিয়ার প্রয়োজন। অথচ বর্তমানে রয়েছে প্রায় সাড়ে ৫ লাখের মতো। অর্থাৎ প্রায় ১ লাখ মেরিন ইঞ্জিনিয়ারের ঘাটতি রয়েছে।
আমাদের মাননীয় নৌ মন্ত্রীর ধারনা দেখুন আমাদের বেতন সম্পর্কে “বিশেষ অতিথি নৌপরিবহণ মন্ত্রী মো. শাহজাহান খান এমপি বলেন, দেশে বর্তমানে একটি মেরিন একাডেমী ও ১৩টি বেসরকারি মেরিন ইন্সটিটিউট রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের ডিগ্রীধারী ক্যাডাররা বর্হিবিশ্বে মাসিক ৫ লাখ থেকে ২৫ লাখ টাকা বেতনে চাকুরীর সুযোগ পাচ্ছে।”

খারাপ লাগে যখন দেখি যে এই ঘাটতির বাজারেও ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাস আউটের পর থেকে এখন ২০১৪ সালের মাঝামাঝিতে জাহাজ থেকে পাওয়া আমার মোট আয় মাত্র প্রায় ২ লাখ ৮০ হাজার টাকার কিছু বেশি এবং এই অবস্থা শুধুমাত্র বাংলাদেশ মেরিন একাডেমী থেকে পাস করা আমার নয়। এই অবস্থা আমার প্রায় সব ব্যাচমেটের এবং জুনিয়রদেরও।

শুধুমাত্র দ্রুত প্রতিষ্ঠা লাভের আশায় কিংবা মধ্যবিত্ত পরিবারটিকে আরেকটু সচ্ছল করতে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ ঢাকা ইউনিভার্সিটি, বুয়েট বা অন্য সব প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিক্যালে চান্স পাওয়ার পর ও এমন অনেক বন্ধু বা জুনিয়র আছে যারা বাংলাদেশ মেরিন একাডেমীতে ভর্তি হয়েছিল। আজ তাদের স্বপ্ন ভাঙতে চলেছে। চলুন আরেকটু দেখি।

মেরিন প্রফেশন নিয়ে কিছু কথা
এই লিঙ্কের লেখক প্রাইভেট একটি একাডেমীর প্রথম ব্যাচের এক ক্যাডেট। তার কথাতেই উঠে আসছে বাংলাদেশ মেরিন একাডেমীর অফিসার ক্যাডেটদের কেন পিছিয়ে পড়তে হচ্ছে।
বাংলাদেশ সরকারী মেরিন একাডেমিতে ২৭৫ আসনের ২০টি সিট নারীদের জন্য বরাদ্দ। অল্পসংখ্যক আসনের ভর্তি যুদ্ধটাও বেশ কষ্টকর হয়। সবচেয়ে বড় কথা এত যুদ্ধের পরও সেখান থেকে চধংংরহম ড়ঁঃ হতে প্রায় ৬ লাখ টাকা খরচ হয়ে যায়। নিজ দায়িত্বে ইন্টার্নশিপ করতে হয়। এতে দেখা যায় ক্যাডেটদের প্রায় বছরখানেক লাগে। এসব বিষয়ে কম ধারণার কারণে দেখা যায় অনেকের আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও মতভেদের জন্য ভর্তি হওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।”

তাহলে দেখা যাচ্ছে আমি মিথ্যা বলি নি। হাঁ। নিজ দায়িত্তে ইন্টার্নশিপ। কিন্তু তাদের কি জাদুর পাথর আছে যে তাদের ইন্টার্নশিপের দায়িত্ব কেউ নিয়ে নিচ্ছে??
বিষয়টা হচ্ছে এই যে সব প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানেরই নিজস্ব ম্যানিং এজেন্সি আছে। যারা এখনো ভারত থেকে আসা কিছু রিকয়ারমেন্ট প্রসেস করে তাদের নিজেদের ক্যাডেটদের দিচ্ছে এবং সেই সাথে নিজেদের ব্যবসাও টিকিয়ে রাখছে। অথচ এই রিকয়ারমেন্ট গুলো তাদের অনুপস্থিতিতে আগে পেত বাংলাদেশ মেরিন একাডেমীর অফিসার ক্যাডেটরা। পেশাগত দক্ষতার কারনে কোম্পানির নজর পড়ত তাদের উপর এবং পরবর্তীতে এই রিকয়ারমেন্ট গুলো ফিরে আসতো এবং এখন এভাবেই বিশ্বে বাংলাদেশের মেরিন অফিসারদের তৈরি করা আস্থা এবং সুনামের স্থানটি ধীরে ধীরে হারাচ্ছে শুধুমাত্র দক্ষতা ভিত্তিক নয় সংখ্যা ভিত্তিক মেরিনার তৈরির কারখানা গুলো একে একে চালু করে।

(চলবে)
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায় কারো হাত না ধরে (ছবি ব্লগ)

লিখেছেন জুন, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৯

ঐ নীল নীলান্তে দূর দুরান্তে কিছু জানতে না জানতে শান্ত শান্ত মন অশান্ত হয়ে যায়। ১৯২৯ সালে রবার্ট মোস নামে এক ব্যাক্তি লং আইল্যান্ড এর বিস্তীর্ণ সমুদ্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদীর পরিবার সংক্রান্ত আপডেট

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯


মার্চ মাস থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম। ক'দিন আগেও খুলনায় যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানিয়েও আমার বিগত লিখায় কিছু তথ্য চেয়েছিলাম। অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেহেদীর পরিবারকে দেখতে আমার খুলনা যাওয়া হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×