ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ার একজন সাধারণ শিশু যেভাবে বেড়ে ওঠছে- আমাদের শিশুরা তার চেয়ে যোজন যোজন দূরে। ইলিমেন্টারী বা প্রাইমারিতে পড়া একটা শুিশু হাইস্কুলে যাওয়ার আগেই তাদের বেশ কয়েকটি বড় বড় শহর এমনকি দেশও ঘুরা হয়ে যায়। স্কুল থেকে বাচ্চাদের নিয়ে যাওয়া হয়- পার্লামেন্ট ভবনে, নাসাতে, ডিজনী ল্যাণ্ডে, বড় মিউজিয়ামে। ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো ওরা ঘুরে ঘুরে দেখে জ্ঞান লাভ করে। পার্লামেন্ট ভবনে গিয়ে ওরা সরাসরি যেকোনো রকমের প্রশ্ন এম,পি-মন্ত্রিদের কাজে জিজ্ঞাসা করে। একটু বড় হলেই-কিংবা হাইস্কুলে-কলেজে ওঠলেই নতুন ভাষা শিক্ষার জন্য দেখেছি-সরাসরি চায়না, জাপান, স্পেন , ইটালি, জার্মান চলে যেতে। ঐসব দেশে গিয়ে ওসব পরিবারের সাথে মিশে -সরাসরি ওদের কালচার, ভাষা রপ্ত করে। এসবের পাশাপাশি বলতে গেলে অধিকাংশ কিশোর-কিশোরিরা অভিজ্ঞতা সন্চয় এবং বাড়তি আয়ের জন্য স্কুল ছুটিতে নানা রকমের কাজ করে।
আমেরিকা এসে তখন আমি একটা ফাস্টফুড রেস্টুরেন্ট কাজ করি। পনের বা ষোল বয়সী একটা ছেলে আমাকে কাজে সাহায্য করতো। মার্টিন নামক ছেলেটি -আমাকে দিল্লীর কুতুবমিনার, আগ্রার তাজমহল থেকে শুরু করে মায়া-ইনকা সভ্যতার পতন কিভাবে হলো- এসবের গল্প বলে যেতো। আমি অবাক হয়ে শুনতাম। বললাম- তুমি কি এসব পড়ে জেনেছো।
কিছু পড়েছি। তবে বেশিরভাগ আমরা ঘুরে ঘুরে দেখেছি। আমাদের স্কুল থেকে আমাদের নিয়ে গিয়েছিলো।
কী সুন্দর -সরাসরি শিক্ষা।
ইউরোপ আমেরিকার শিশুদের আমি খুব কমই কাঁদতে দেখেছি। কাঁদবেই বা কেন?
সুন্দর পরিবেশে বড় হচ্ছে, সুস্বাস্থ্য খাবার খেয়ে বেড়ে ওঠছে। শারীরিক যন্ত্রণা, পেটের যন্ত্রণা হলেইতো শিশু কাঁদে। এগুলো না হলে সে কাঁদবে কেন?
এখানে একটা শিশু ইচ্ছে করলেই ডাক্তার, প্রকৌশলী, বিগ্গানী, চিত্রকর হওয়ার ৯৯% সুযোগ আছে। কিন্তু আমাদের শিশুদের সেই সুযোগ নেই। একটা নাম্বার কম পেলেই -যে ছেলে ডাক্তার হতে চায় সে আর ডাক্তার হতে পারবেনা। যে প্রকৌশলী হতে চায় সে আর প্রকৌশলী হতে পারবেনা। ইচ্ছের বিরুদ্ধ বিষয় নিয়ে তাকে পড়তে হয় এবং একমাত্র বিসিএসে ঠিকে থাকাই তার অধ্যয়ন জীবনের শেষ ভরসা হয়ে দাঁড়ায়।
আমার এক বোনের ছেলে যখন- সিডনি অপেরা হাউস , পার্লামেণ্ট ভবন ঘুরে ঘুরে দেখে জীবনের সরাসরি অভিজ্ঞতা সন্চয় করছে। আরেকবোনের সন্তান তখন-প্রচণ্ড গরমের মাঝে ট্রাফিক জ্যামে আটকে বসে আছে। গাড়ীর হর্ণে কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। আফ্রিকার জঙ্গলে পশু তাড়াবার জন্য যে হর্ণ ব্যবহার করা হয়-সেই একই হর্ণ আমাদের দেশের গাড়ীতে ব্যবহার করা হয়। কী আজব ব্যাপার। প্রতিদিন কমপক্ষে চারটি ঘন্টা ট্রাফিক জ্যামে পড়ে একটা শিশুর জীবন থেকে এভাবেই চলে যায়। এভাবে মাসে কত ঘন্টা, বছরে কত ঘন্টা যায়?? কত কোটি কোটি শিশুর জীবনের মূল্যবান সময় এভাবে নষ্ট হচ্ছে। আর এভাবেই প্রতিদিনই উন্নত বিশ্বের শিশুদের থেকে যোজন যোজন পেছনে পড়ে যাচ্ছে-এ দেশের শিশুরা। কে এর দায়ভার নেবে???
এরপর স্কুল থেকে ঘরে ফিরে- হয়তো ট্যাপে পানি নাই, অথবা পড়তে বসলে বিদ্যুৎ নাই। প্রচণ্ড গরমে -এই শিশুগুলো পড়ালিখা করবে কীভাবে। তারপর যা খাচ্ছে- তাতে শুধুই বিষ। এরপর রয়েছে অসহ্য মশার যন্ত্রণা। আপনারা AIDS এর নাম শুনেছেন। ভয়ানক রোগ। কিন্তু AIDS এর চেয়ে আরো ভয়ঙকর রোগ হলো NAIDS( Nutritionally acquired immune deficiency syndromes)। বাংলাদেশের কোটি কোটি শিশুরা এই নাইডস বা পুষ্টিহীন রোগের শিকার।
অসুস্থ শিশু মানে অসুস্থ জাতি। অপুষ্ট খাবার খেয়ে -রোদেপুড়ে , ট্রাফিক জ্যামে আটকা পড়ে, বিদ্যুৎ , পানি হীন পরিবেশে বড় হয়ে, মশার কামড় খেয়ে বিশ্বায়নের এই যুগে একটা শিশু প্রতিযোগিতা করবে কীভাবে? দশটি দেশের সাথে ক্রিকেট খেলাই শুধু বিশ্বপ্রতিযোগিতা নয়। মাইক্রোসফট, হার্ভাড, এমআইটি, ক্যাম্ব্রিজ, অক্সফোর্ড, গুগলের অলিগলিতে যখন বিশ্ব শিশুরা ঘুরছে-তখন আমার দেশের শিশুরা জীবনের এক অন্ধকার গলিতে আটকে পড়ে আছে। মেধায় যার কর্তৃত্ব বেশী সে জাতি বিশ্ব নেতৃত্ব দিবে- এর চেয়ে চিরসত্য কথা আর নেই। এই প্রতিযোগিতায় ঠিকে থাকাই হলো আসল প্রতিযোগিতা।
এমন পরিবেশে থেকেও দুএকজন যে নিজেদের উচ্চ জায়গায় নিয়ে যায়না- তা নয়। তবে সেটা ব্যতিক্রম। গড়পরতা মানুষের জীবনের মান যদি উন্নত না হয়- তবে সেটাকে কোনোভাবেই উন্নয়ন বলা যাবেনা।
আর এখনতো আরো ভয়াবহ সময় যাচ্ছে। শিশুরা বড় বড় শহর, বড় বড় নগর, বড় বড় দেশ, বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় দেখবে দূরের কথা। নিজের ঘর থেকেই বের হলেই ধর্ষণ। প্রতি সপ্তাহেই বলতে গেলে একটা শিশুর ধর্ষণের খবর আসছে। জীবনে চলার কোনো নিশ্চয়তা নেই। বাংলাদেশের কোটি কোটি শিশুদের জীবনকে আমরা এভাবে হারিয়েছি। ওদের প্রাপ্য অধিকারটুকু দেয়া দূরের কথা। জীবনের নিশ্চয়তাটুকুও দিতে পারছিনা। আমরা সবাই ব্যর্থ। আমরা অভিশপ্ত।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুলাই, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:২১