আমার শৈশব পেড়িয়ে কৈশোর নিয়ে যে সময়টা গ্রামের ফ্রেমে বন্দী হয়ে আছে সেতো সস্তা ক্যামেরার যুগের না, তাইতো সে এখনও জীবন্ত কল্পনায়...।
আমাদের বাড়ীর উঠান পেড়িয়ে দক্ষিণে ছিল একটি শিউলি ফুলের গাছ। সকালে ঘুম ভেঙেই দেখতাম, শিউলি নামের সাদা ফুলের সুবাস আর তার শরীরে জমানো শিশিরের কণায় সিক্ত হচ্ছে কিশোর কিশোরীর নিটোল দুটি হাত। উঠানে শীতল পাটিতে পড়তে বসার ফাঁকে গল্প গাঁথায় রোদ এসে পায়ের কাছে চুপটি মেরে বসে থাকতো।
স্কুলের পথের পাশেই দাড়িয়ে থাকতো একটি বকুলের গাছ। গাছের নীচে জমানো সবুজ ঘাসের আঙিনায় ঝরা বকুলের পাপড়িরা প্রাচীন এক ঘ্রাণ বুকে নিয়ে আমাদের দৃষ্টি সীমানায় একটি মখমল চাদরের গালিচা হয়ে যেতো। ছেলেরা বুক পকেটে বকুল ফুলের ঘ্রাণ আর মেয়েরা বকুলের মালা হাতে সাজিয়ে রাখতো দিনমান।
পলাশ আর শিমুলের রক্ত লাল গাছের নীচে ছেলেমেয়েদের হাট বসে যেতো। স্কুলের আঙিনায় স্বচ্ছ পুকুরের জলে ঝুলে পড়তো একঝাঁক জবা ফুলের গাছ। গাছের ডালে ডালে ঝুলে থাকা লাল আর সাদা জবা ফুলের রেনুতে একঝাক মৌমাছি উড়ে উড়ে বেড়াতো।
স্কুলের মাঠ পেড়িয়ে পূর্ব দিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতো একদল তাল, নারিকেল আর সুপারির গাছ। জ্যৈষ্ঠ মাসের হাওয়ায় সেই গাছের মাথায় রূপকথার দৌত্যেরা এসে ভীর জমাতো। শরতের সাদা মেঘের আকাশে ঘুড়ি উড়াতে আমরা যেতাম গ্রামের উত্তরের শেষ সীমানায়। সেখানে পূর্ব পশ্চিমে প্রবাহিত বংশাই নদীর দু’ধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা হয়ে যেতো। কাশবনের গহীন ভেতরে আমরা চোর পুলিশ খেলার আয়োজন করতাম।
গ্রাম্য মেঠোপথের ধারে আকাশের সীমানায় মাথা উচু করে দাড়িয়ে থাকতো কৃষ্ণচূড়ার লাল, রাধাচূড়ার হলুদ আর জারুলের বেগুনি। রুপকথার নায়কের মতো লাল, হলুদ আর বেগুনির গালিচায় আমরা খুঁজে পেতাম তেপান্তরের মাঠ।
একঝাঁক হিংস্র শেয়ালের চিৎকারে গ্রামে নেমে আসতো সন্ধ্যা। জানালার পাশে হাসনাহেনার ফুল ফুটত। হাসনাহেনার গন্ধে মাতাল রাতে দাদির চারপাশে আমরা ভীর করে বসতাম আর দাদি বলতো, “সে বহুকাল আগের কথা। এই পৃথিবী থেকে বহু দূরে ছিল একটা দেশ। যেখানে পরীরা এসে মানুষের সাথে গল্প করত। পাখিরা, মাছেরা সব কথা বলত। যেখানে ছিল বৃষ্টি গাছ। যে গাছের নীচে দাঁড়ালেই বৃষ্টি ঝরত আর সাথে মিষ্টি সুবাস।সেখানে ছিল একটা সুখ নদী।”
...আজ এতোদিন পরে, আমার গ্রামের শানবাঁধানো শ্যাওলা সবুজ পুকুরঘাটে বসে বসে ভাবি; আমাদের যেদিন ছিল সেটাই এখন হয়ে গেছে রূপকথা। জাগতিক ঐশ্বর্যের মতো প্রিয় শত্রু; একে একে কেড়ে নিয়েছে সবই!?