somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এ্যারাবী -জেমস জয়েস

১১ ই জুন, ২০১২ বিকাল ৫:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কানা গলি উত্তর রিচমন্ড স্ট্রীট খ্রীষ্টান ব্রাদার্স স্কুলের শিক্ষার্থীদের ছুটির সময় ছাড়া বেশ শান্তই থাকে। গলির শেষ মাথায় বর্গাকার জমিতে প্রতিবেশীদের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা একটি জনশূন্য দো’তলা বাড়ি একাকী দাঁড়িয়ে। নিজেদের রুচিসম্মত জীবনযাত্রার ব্যাপারে সচেতন রাস্তার অন্যান্য বাদামি রঙের বাড়িগুলো একে অপরের দিকে একঘেয়ে নির্বিকারচিত্তে তাকিয়ে থাকে।

বাড়ির প্রাক্তন বাসিন্দা ছিলেন একজন ধর্মযাজক, যিনি পিছনের বসার ঘরে মারা গিয়েছেন। বহুদিন বদ্ধ থাকা বাসি হাওয়া ঘরগুলোতে ভেসে থাকে; রান্নাঘরের পিছনে পরিত্যক্ত ঘরটি পুরনো অব্যবহৃত কাগজে পূর্ণ। আমি তার মধ্যে কাগজের মলাটযুক্ত কিছু দুমড়ানো ও স্যাঁতস্যাঁতে বই খুঁজে পেয়েছিলামঃ ওয়াল্টার স্কটের দি অ্যাবোট , দ্য ডেভ্যু কম্যুনিকেন্ট, এবং ভিদক এর স্মৃতিকথা । আমার শেষেরটা বেশী পছন্দ ছিল, কারণ এর পাতাগুলো হলদেটে হয়ে গিয়েছিলো। বাড়ির পিছে অযত্নে বেড়ে ওঠা বাগানের মধ্যমণি একটি আপেলগাছ এবং কিছু অগোছালো ঝোপ যার নিচে আমি মৃত বাসিন্দার মরচে পড়া বাই-সাইকেল পাম্প খুঁজে পেয়েছিলাম। তিনি খুবই পরোপকারী ধর্মযাজক ছিলেন; তিনি তার সমস্ত অর্থ কিছু প্রতিষ্ঠানকে এবং বাড়ির সব আসবাব তার বোনকে দান করে গেছেন।

শীতের ছোট দিনে রাতের খাবার সারার আগেই সন্ধ্যা নামতো। যখন আমরা রাস্তায় মিলিত হতাম বাড়িগুলো তখন মলিন দেখাতো। উপরের আকাশ সদা-পরিবর্তনশীল ধ্রূম বর্ণ ধারণ করতো, আর তার দিকে রাস্তার বাতিগুলো তাদের ক্ষীণ আলো তুলে ধরতো। শীতল হাওয়া আমাদের শরীর বিদ্ধ করতো, আমাদের শরীর গরম হওয়া পর্যন্ত আমরা খেলতাম। আমাদের চিৎকার নীরব সড়কে প্রতিধ্বনিত হত। খেলার উদ্দেশ্যে আমরা বাড়ির পিছনে অন্ধকার কর্দমাক্ত গলির কুটিরগুলোতে থাকা বর্বর উপজাতিদের বিদ্রপ করে অন্ধকার ও ভেজা বাগানের ছাইয়ের গাঁদার দূর্গন্ধযুক্ত পিছনের দরজা পর্যন্ত, অথবা অন্ধকার দূর্গন্ধময় আস্তাবল পর্যন্ত পালিয়ে যেতাম যেখানে সহিস ঘোড়ার শরীর আঁচড়িয়ে মসৃণ করত এবং ঘোড়ার সাজের বগলস-এর ঝাঁকুনিতে সুর তৈরি হত। আমরা যখন রাস্তায় ফিরতাম তখন রান্নাঘরের জানালার আলোতে ফুটপাত আলোকিত হয়েছে। আমার চাচাকে আসতে দেখা গেলে আমরা অন্ধকারে লুকিয়ে থাকতাম যতক্ষণ না তিনি বাড়ি পৌছান। অথবা যদি ম্যানগানের বোন তার ভাইকে চা-এর জন্য ডাকতে তাদের সিড়ির ধাপে আসত আমরা তাকে আঁধার থেকে উঁকি দিয়ে দেখতাম। সে থাকবে না চলে যাবে এটা দেখার জন্য অপেক্ষা করতাম, যদি সে থাকত তাহলে আমরা অনীহার সাথে ম্যানগানের বাড়ির সিড়ি পর্যন্ত যেতাম। সে আমাদের জন্য অপেক্ষা করত, আধ খোলা দরজার আলো তার দেহাকৃতি ফুটিয়ে তুলতো। তার ভাই তার কথা শোনার আগে তাকে ব্যঙ্গ করতো, আমি তখন রেলিং-এর কাছে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। সে যখন হাঁটত তার জামা আলোড়িত হত এবং তার নরম চুলের বেণী এক পাশ থেকে আরেক পাশে দোল খেতো।

প্রতি সকালে বৈঠকখানার সামনে মেঝেতে শুয়ে তার দরজার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। জানালার শার্শি একইঞ্চি খোলা রেখে নামিয়ে রাখতাম যাতে আমাকে দেখা না যায়। সে যখন দরজার সিড়িতে আসতো আমার হৃদয়ে কম্পন শুরু হতো। আমি দৌঁড় দিয়ে বারান্দায় গিয়ে বই নিয়ে তার পিছ ধরতাম। আমার চোখ সবসময় তার বাদামী শরীরের উপর স্থির থাকত, এবং যখন আমাদের রাস্তা ভাগ হবার সময় হত আমি তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে তাকে অতিক্রম করতাম। দিনের পর দিন এটা ঘটত। কিছু খাপছাড়া বাক্য বিনিময় ছাড়া কোনদিন তার সাথে আমার কথা হয়নি, যদিও তার নাম আমার অবুঝ রক্তকে চঞ্চল করে তুলতো।

তার প্রতিমা আমাকে সবচেয়ে প্রেমবৈরী পরিবেশে সঙ্গ দিত। শনিবার সন্ধ্যাগুলোতে যখন আমার চাচি কেনাকাটা করতে বাজারে যেতেন আমাকে প্যাকেট বহন করার জন্য সাথে যেতে হত। আলোকিত রাস্তায় মদ্যপ ও দর কষাকষি করা মহিলাদের ধাক্কার ভিতর দিয়ে, শ্রমিকদের খিস্তি, শুকর-গন্ডের পিপের পাশে দাড়িয়ে থাকা পাহারারত বালক কর্মচারীদের তীক্ষ্ণ প্রার্থনা, রাস্তার গায়কদের ভজন, যারা ও’ ডোনাভান রোসা সম্পর্কে তোমরা সবাই এসো অথবা মাতৃভূমির কষ্টের উপাখ্যান গাইত, তাদের মধ্য দিয়ে আমরা হেঁটে যেতাম। এই হট্টগোলগুলো আমার জন্য একক অনুভূতি তৈরী করতোঃ কল্পনায় আমি পবিত্র পান পাত্র অজস্র শত্রুর ভীড়ে নিরাপদে বহন করতাম। আমার মুখ দিয়ে সেই মূহুর্তে অজ্ঞাত প্রার্থনা ও আরাধনায় তার নাম নিঃসৃত হত যা আমার নিজেরই বোধগম্য ছিলোনা। প্রায়ই আমার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে যেত (আমি জানি না কেন) এবং মাঝে মাঝে আমার হৃদয় থেকে আগত প্লাবনে আমার বুক ভেসে যেত। ভবিষ্যত নিয়ে আমি খুব কমই ভাবতাম, আমি আদৌ কখনো তার সাথে কথা বলবো কিনা, আর যদি কখনো বলি কিভাবে তাকে আমি বিহবল আরাধনার কথা জানাব তা আমি জানতাম না। কিন্তু আমার শরীর ছিল বীণা এবং তার কথা ও অঙ্গভঙ্গি তারের উপর ছোটাছোটি করা আঙ্গুল।

এক সন্ধ্যায় পিছনের বসার ঘরে যেখানে ধর্মযাজক মারা গিয়েছিলেন সেখানে গেলাম। এটা ছিল অন্ধকার ও শান্ত বর্ষণমূখর একটি সন্ধ্যা। ভাঙ্গা জানালার মধ্য দিয়ে আমি মাটির উপর বৃষ্টির আছড়ে পড়ার, সোঁদা ঘাসের উপর সূক্ষ্ণ সুঁইয়ের মত অবিরাম বর্ষণরত জলের খেলা করার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। দূর থেকে আগত বাতি বা জানালার আলো আমার নিচে অস্পষ্টভাবে জ্বলজ্বল করছিল। ভাগ্য ভাল যে আমি খুব কমই দেখতে পাচ্ছিলাম। আমার ইন্দ্রিয়গুলো নিজেদের গোপন করতে চেষ্টা করছিল, আমি টের পাচ্ছিলাম আমি তাদের থেকে আলাদা হয়ে পড়ছি, আমি আমার হাতগুলো সজোরে একে অপরের সাথে চেপে রাখলাম যতক্ষণ না তারা আবেগে কেঁপে ওঠে, আর অব্যক্ত স্বরে বহুবার বললাম, “প্রেম আমার!প্রেম আমার!”

অবশেষে সে আমার সাথে কথা বলল। যখন সে প্রথম আমাকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলল আমি বুঝতে পারছিলাম না তার প্রেক্ষিতে আমার কি বলা উচিত। সে আমাকে জিজ্ঞেস করল যে আমি এ্যারাবী যাব কিনা। আমার মনে পড়ছে না আমি হ্যাঁ বলেছিলাম নাকি না। সে বললো এটা একটা মনোরম বাজার এবং সে পারলে সেখানে যেত।

“কেন যেতে পারবে না?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

আমার সাথে কথা বলার সময় সে তার হাতের রূপোর বালা নিয়ে খেলা করছিল। সে বললো যে সে যেতে পারবে না কারণ সেই সপ্তাহে তার আশ্রমে প্রার্থণা হবে। আমি একা রেলিং-এর কাছে দাঁড়িয়ে ছিলাম, তার ভাই ও আরো দু’জন ছেলে তাদের টুপি নিয়ে মারামারি করছিল। সে আমার দিকে নিচু হয়ে খুঁটা ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। আমাদের উল্টোদিক থেকে আসা বাতির আলো তার শুভ্র বাঁকা ঘাড়ের উপর স্থির হয়ে সেখানে ঝুলে থাকা চুলগুলোকে সমুজ্জ্বলিত করছিলো, আর সাথে নিচে রেলিং-এর উপর রাখা তার একটি হাত। সেই আলো তার জামার একপ্রান্তে এসে পড়ছিলো, সে স্বচ্ছন্দে দাঁড়িয়ে থাকায় তার পেটিকোটের সাদা পাড় দেখা যাচ্ছিলো।

“তোমার ভালো লাগবে,” সে বললো।

“আমি যদি যাই তাহলে তোমার জন্য কিছু নিয়ে আসবো”।

সেই সন্ধ্যার পর কত নির্বোধ চিন্তা যে আমার সচেতন ও অচেতন মূহুর্ত নষ্ট করেছে তার ইয়ত্তা নেই। মাঝের ক্লান্তিকর দিনগুলোকে মুছে ফেলার কঠোর চেষ্টা করতাম। স্কুলের কাজগুলোতে যারপরনাই বিরক্ত হতাম। রাতে আমার ঘরে আর দিনে শ্রেণীকক্ষে তার প্রতিমা আমার ও বইয়ের পাতাগুলোর মাঝে এসে হানা দিত । এ্যারাবী শব্দটির হরফগুলো নিঃশব্দে আমাকে হাতছানি দিয়ে ডেকে আমার উপর প্রাচ্যীয় ইন্দ্রজাল আরোপ করত, আর আমার আত্মা সেখানে বিলাসিতায় মোহিত থাকত। আমি শনিবার রাতে বাজার যাওয়ার জন্য অনুমতি চাইলাম। আমার চাচি অবাক হলেন, তিনি আশা করলেন এটা কোনো চরমপন্থী সংস্থার কার্যকলাপের সাথে সম্পর্কিত নয়। শ্রেণীকক্ষে আমাকে কিছু প্রশ্নের জবাব দিতে হলো। আমার শিক্ষক অমায়িক থেকে কঠোর হয়ে গেলেন, তিনি সতর্ক করে দিলেন আমি যেন অলস না হয়ে পড়ি। আমি আমার এলোমেলো ভাবনাগুলোকে এক করতে পারছিলাম না। আমার এবং আমার আকাঙ্ক্ষার মাঝে কাঁটার মত বিঁধে থাকা জীবনের গুরুতর ব্যাপারগুলো সম্পর্কে অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছিলাম, এগুলো আমার কাছে ছেলেখেলা মনে হচ্ছিল; জঘন্য, একঘেয়ে ছেলেখেলা।

শনিবার সকালে আমি আমার চাচাকে মনে করিয়ে দিলাম যে আমি সন্ধ্যায় বাজার যেতে চাই। তিনি দরজার কাছের তাকে টুপি পরিষ্কার করার ব্রাশ খোঁজার জন্য সবকিছু এলোমেলো করছিলেন, আমাকে ছোট করে উত্তর দিলেনঃ

“আমি জানি”।

তিনি তখনো দরজার কাছে থাকার কারণে আমি বৈঠকখানার সামনে জানালার কাছে শুয়ে থাকতে পারছিলাম না। বাসা থেকে খুব খারাপ মেজাজ নিয়ে বের হয়ে ধীরে ধীরে স্কুলের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। আবহাওয়া ছিল রুক্ষ ও অনমনীয়; ইতিমধ্যেই আমার মন আমার সফলতা নিয়ে সন্দেহের দানা বুনেছে।

যখন আমি রাতের খাবারের জন্য বাড়ি ফিরে আসলাম আমার চাচা তখনো ঘরে ফেরেননি। হাতে তখনো অনেক সময় ছিলো। আমি কিছুক্ষণ বসে স্থিরদৃষ্টিতে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে থাকলাম, ঘড়ির টিকটিক শব্দে বিরক্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। আমি সিড়ি দিয়ে বাড়ির উপরতলায় গেলাম। উঁচু, ঠাণ্ডা, শূন্য ও বিষণ্ণ ঘরগুলো আমাকে পুর্ণজীবিত করলো, আমি গান গেতে গেতে এক ঘর থেকে আরেক ঘর ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। সামনের জানালা থেকে নিচের রাস্তায় আমি আমার সঙ্গীদের খেলতে দেখতে পেলাম। তাদের চিৎকার ক্ষীণ ও অস্পষ্ট হয়ে আমার কাছে পৌছায়, জানালার ঠাণ্ডা কাঁচে কপাল ঠেকিয়ে তার অন্ধকার বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকলাম। তার বাদামী অবয়ব, তার শুভ্র বাঁকা ঘাড়ে, রেলিং-এর উপর রাখা তার হাতে ও তার জামার নিচের কোণায় আলোর নিপুণ ছোঁয়া কল্পনা করে সেখানে দাড়িয়ে ছিলাম দাঁড়িয়ে ছিলাম প্রায় ঘন্টাখানেক।

যখন আমি নিচে আসলাম মিসেস মার্সার-কে আগুনের কাছে বসে থাকতে দেখলাম। তিনি একজন বাচাল মহিলা, একজন মৃত বন্ধক-গ্রহীতার স্ত্রী,
যিনি পবিত্র উদ্দেশ্যে ডাকটিকিট সংগ্রহ করতেন। চায়ের টেবিলে আমাকে তাদের পরচর্চা সহ্য করতে হল। আহারের সময় এক ঘন্টারও বেশী বিলম্বিত হলো, কিন্তু আমার চাচা তখনো আসেননি। মিসেস মার্সার যাওয়ার জন্য উঠে দাড়ালেনঃ আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে পারলেন না বলে ক্ষমা প্রার্থণা করলেন, কিন্তু তখন আটটা বেজে গিয়েছিল, বেশী রাত পর্যন্ত বাইরে থাকা তিনি পছন্দ করতেন না, কারণ রাতের হাওয়া তার জন্য স্বাস্থ্যকর নয়। যখন তিনি চলে গেলেন হাতের মুঠো শক্ত করে আমি ঘরের মধ্যে পায়চারি শুরু করলাম। আমার চাচি বললেনঃ

“আমি দুঃখিত যে আমাদের গৃহকর্তার জন্য তোমাকে আজকে বাজার যাওয়া বাদ দিতে হবে”।

ন’টার দিকে বাহিরের দরজায় চাচার চাবির শব্দ শুনতে পাই। আমি তাকে বিড়বিড় করতে শুনলাম এবং তার ওভারকোটের ওজনে কোট রাখার তাক দুলতে শোনা গেল। লক্ষণগুলো আমার পরিচিত। তার আহারের মাঝপথে তার কাছে বাজার যাওয়ার জন্য টাকা চাইলাম। তিনি ভুলে গিয়েছিলেন।

“মানুষ এখন তাদের প্রথম রাতের ঘুম ঘুমাচ্ছে”, তিনি ঠাট্টা করলেন।

আমি হাসলাম না। আমার চাচি উৎসাহের সাথে তাকে বললেনঃ

“তাকে কি তুমি কিছু টাকা দিয়ে যেতে দিতে পারোনা? তুমি তাকে যথেষ্ট অপেক্ষা করিয়েছ”।

আমার চাচা ভুলে যাওয়ার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন। তিনি বললেন যে তিনি একটা পুরনো প্রবাদ বিশ্বাস করেনঃ “খেলা ছাড়া শুধু কাজ জ্যাককে নির্বোধ করে তোলে”। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি কোথায় যাব, যখন আমি তাকে দ্বিতীয়বারের মত বললাম তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি এক আরব ও তার ঘোড়ার বিচ্ছেদ কবিতাটি জানি কিনা। আমি যখন রান্নাঘর থেকে বের হয়ে আসছিলাম তখন তিনি কবিতাটির প্রথম লাইনগুলো আমার চাচিকে আবৃত্তি করে শোনাচ্ছিলেন।

আমি বাকিংহাম স্ট্রীটের ষ্টেশনে যাওয়ার সময় দু’আনার এর একটি মুদ্রা হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে ছিলাম। ক্রেতাদের ভীড় ও গ্যাসের আলোয় উজ্জ্বল রাস্তা আমাকে আমার লক্ষ্য সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। আমি একটা পরিত্যক্ত ট্রেনের তৃতীয় শ্রেণীর কামরায় যেয়ে বসি। অসহনীয় বিলম্বের পর ট্রেনটি ধীরে ধীরে ষ্টেশন ছেড়ে যায়। জীর্ণ বাড়িঘরের মধ্য দিয়ে ও তারার আলোয় ঝিকমিক করা নদীর উপর দিয়ে ট্রেনটি ধীরে ধীরে এগুতে থাকে। ওয়েস্টল্যান্ড রো স্টেশনে কিছু মানুষ জোর করে ট্রেনে ঢোকার চেষ্টা করে; কিন্তু দারোয়ান তাদের সরিয়ে দিয়ে বলে এটি বাজারের জন্য বিশেষ ট্রেন। খালি কামরায় আমি একা। কিছুক্ষণ পর ট্রেনটি কাঁপতে কাঁপতে কাঠের তৈরী একটি প্ল্যাটফর্মে দাড়াল। আমি রাস্তায় উঠে আসলাম, ঘড়িতে তখন দশটা বাজতে দশ মিনিট। আমার সামনের বড় দালানে লেখা সেই মায়াবী নাম।


আমি কোনো ছয় পয়সার প্রবেশদ্বার খুঁজে পেলাম না, বাজার বন্ধ হয়ে যেতে পারে এই ভয়ে আমি তাড়াতাড়ি ঘূর্ণায়মান দরজা দিয়ে ঢুকে অবসন্ন চেহারার লোকটার হাতে এক আনা ধরিয়ে দিলাম। আমি গ্যালারী পরিবেষ্টিত একটা বড় হলঘরে এসে পড়ি। প্রায় সব দোকানই বন্ধ হয়ে গেছে এবং হলের একটা বড় অংশ পুরোপুরিই অন্ধকার। বাজারটি জুড়ে গীর্জার প্রার্থণা অনুষ্ঠানের পর ছেয়ে থাকা নিস্তব্ধতা। আমি ভয়ে ভয়ে বাজারের কেন্দ্রে হেঁটে যাই। একটি খোলা দোকানে কিছু মানুষ জমা হয়েছে। রঙিন আলো দিয়ে দিয়ে সঙ্গীত চা-ঘর লেখা একটি পর্দার একটি থালার উপর দু’জন মানুষ টাকা গুনছে। আমি পয়সার পড়ার শব্দ শুনতে পেলাম।

হঠাৎ করেই মনে পড়লো আমি কেন এখানে এসেছি। আমি একটা দোকানে যেয়ে পোর্সেলিন ফুলদানি আর ফুলের ছাপ দেয়া চায়ের সেট দেখতে লাগলাম। দোকানের দরজার কাছে এক তরুণী দু’জন যুবকের সাথে হেসে হেসে কথা বলছিল। আমি তাদের ভাসা ভাসা কথা শুনে তাদের ইংরেজী বচনভঙ্গি খেয়াল করলাম।

“আমি কখনই এরকম কিছু বলিনি!”

“না, তুমি বলেছ”।

“না, বলিনি”।

“ও এটা বলেনি?”

“হ্যাঁ, আমি ওকে বলতে শুনেছি”।
“এটা কিন্তু একেবারেই মিথ্যা…!”

তরুণী আমাকে লক্ষ্য করে এগিয়ে আসে, আমাকে জিজ্ঞেস করে আমি কিছু কিনবো কিনা। তার স্বরে কোনো প্রাণ ছিল না, শুধুই দায়িত্বপালনের জন্য বলা। দোকানের দু’পাশে রাখা প্রাচ্যীয় প্রহরীর মত বড় জারগুলোর দিকে তাকিয়ে মৃদু কন্ঠে বললামঃ

“না, ধন্যবাদ”।

তরুণীটি একটি জার একটু ঘুরিয়ে রেখে যুবকগুলোর কাছে ফিরে গেলো। তারা আবার আগের আলোচনায় মশগুল হলো। তরুণীটি দুই একবার ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালো।

আমি তার দোকানের সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম তার পণ্যসামগ্রীর প্রতি আমার আগ্রহকে বাস্তবমুখী করে তুলতে, যদিও তা ছিলো নিতান্তই অপ্রয়োজনীয়। আমার পকেটের পয়সাগুলো নাড়াচাড়া করে ইতস্তত করতে লাগলাম। গ্যালারীর এক প্রান্ত থেকে একজন বাতি নিভিয়ে দিতে বললো। হলের উপরের অংশ পুরোপুরিই অন্ধকার হয়ে গেলো।

অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে নিজেকে অহং তাড়িত ও বিদ্রুপাহত প্রাণি মনে হলো; আমার চোখগুলো বেদনা ও ক্রোধে দগ্ধ হতে লাগলো।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুন, ২০১২ বিকাল ৫:৪০
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায় কারো হাত না ধরে (ছবি ব্লগ)

লিখেছেন জুন, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৯

ঐ নীল নীলান্তে দূর দুরান্তে কিছু জানতে না জানতে শান্ত শান্ত মন অশান্ত হয়ে যায়। ১৯২৯ সালে রবার্ট মোস নামে এক ব্যাক্তি লং আইল্যান্ড এর বিস্তীর্ণ সমুদ্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ অপেক্ষা

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২৩



গরমের সময় ক্লাশ গুলো বেশ লম্বা মনে হয়, তার উপর সানোয়ার স্যারের ক্লাশ এমনিতেই লম্বা হয় । তার একটা মুদ্রা দোষ আছে প্যারা প্রতি একটা শব্দ তিনি করেন, ব্যাস... ...বাকিটুকু পড়ুন

×